ভড়মশায় বলিলেন–বেশ।
–বড় দেরি হয়ে যাচ্চে যাই-যাই করে, কাজ তো আছেই, আপনি কালই যান! টাকা সকালে নেবেন, না এখন নেবেন?
–এখন পাঁচ জায়গায় ঘুরবো নিজের কাজে, কোথায় হারিয়ে যাবে। কাল সকালে বরং…
উৎসাহে অনঙ্গ মাদুর ছাড়িয়া ঠেলিয়া উঠিল বিকালে। পরদিন সকালে ভড়মশায় টাকা নিতে আসিলে অনঙ্গ তাঁহার হাতে একটি বেশ ভারি-গোছের পোঁটলা দিয়া বলিল–এটা ওঁকে দেবেন।
কাল সারাদিন ধরিয়া গুছাইয়াছে সে, ভড়মশায় দেখিলেন, তাহার মধ্যে হেন জিনিস নাই যা নাই। গোটাকতক কাঁচা পেঁপে, এমন কি একটা মানকচু পর্যন্ত। তাছাড়া গাছের বরবটি, আমসত্ত্ব, পুরানো তেঁতুল, পোস্তদানার বড়ি…
ভড়মশায় মনে মনে হাসিলেন, মুখে কিছু বলিলেন না।
অনঙ্গ আঁচল হইতে খুলিয়া আরও তিনটে টাকা বাহির করিয়া বলিল–ভাড়া বাদে একটা টাকা নিয়ে যান, যাবার সময় হরি ময়দার দোকান থেকে নতুনগুড়ের সন্দেশ সের-দুই নিয়ে যাবেন।
ভড়মশায় দ্বিরুক্তি না করিয়া টাকা কয়টি পকেটে পুরিয়া বলিলেন–চিঠি টিটি কিছু দেবে না?
–না, চিঠি আর দিতে হবে না, মুখেই বলবেন। একবার অবিশ্যি করে যেন আসেন এরই মধ্যে, বলবেন।
ভড়মশায় দরজার বাইরে পা ভালো করিয়া বাড়ান নাই, এমন সময় অনঙ্গ পিছন হইতে ডাক দিয়া বলিল–শুনুন, বাড়ী আসবার কথা বলবেন, বুঝলেন তো?
–আচ্ছা বৌ-ঠাকরুণ, নিশ্চয় বলবো।
–এরই মধ্যে যেন আসেন–বুঝলেন?
ভড়মশায় ঘাড় হেলাইয়া প্রকাশ করিতে চাহিলেন যে, তিনি বেশ ভালোই বুঝিয়াছেন। কোনো ভুল হইবে না তাঁহার।
–আর যদি সঙ্গে করে আনতে পারেন…
–বেশ বৌ-ঠাকরুণ, সে চেষ্টাও করবো।
.
১০.
ভড়মশায় দ্রুতপদে বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন।
কলিকাতায় পৌঁছিয়াই ভড়মশায় মনিবের পুরানো মেসে গেলেন। সংবাদ লইয়া জানিলেন, বহুদিন হইতেই গদাধরবাবু সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন। মেসের ম্যানেজার কোনো ঠিকানা বা সন্ধান দিতে পারিল না। তাহা হইলে কি জেলই হইল? তাহাই সম্ভব।
কিন্তু সে-কথা তো আর যাকে-তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না!
ভাবিয়া-চিন্তিয়া তিনি শচীনের বাসায় গেলেন। শচীনেরও দেখা পাইলেন না। এখন একমাত্র স্থান আছে, যেখানে মনিবের সন্ধান হয়তো মিলিতেও পারে–সেটি হইল শোভারাণীর বাড়ী। কিন্তু সেখানে যাইতে ভড়মশায়ের কেমন বাধোবাধো ঠেকিতে লাগিল। অনেকদিন সেখানে যান নাই, হয়তো তাহারা তাঁহাকে চিনিতেই পারিবে না, হয়তো বাড়ীতে ঢুকিতেই দিবে না। তাছাড়া সেখানে যাইতে প্রবৃত্তিও হয় না তাঁহার। তবুও যাইতে হইল। গরজ বড় বালাই!
দরজায় কড়া নাড়িতেই যে চাকরটি দরজা খুলিয়া মুখ বাড়াইল, ভড়মশায় তাহাকে চিনিলেন না। চাকর বলিল–কাকে দরকার?
–মাইজী আছেন?
–হ্যাঁ আছেন।
–একবার দেখা করবো, বলো গিয়ে।
চাকর কিছুমাত্র না ভাবিয়া বলিল–এখন দেখা হবে না।
ভড়মশায় অনুনয়ের সুরে বলিলেন–বড্ড দরকার। একবার বলো গিয়ে।
–কি দরকার? এখন কোনো দরকার হবে না, ওবেলা এসো।
–আচ্ছা, গদাধরবাবুর কোনো সন্ধান দিতে পারো? আমি তাঁর দেশের লোক, যশোর জেলার কাঁইপুর গ্রামে বাড়ী, থানা রামনগর…
চাকর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল–দাঁড়াও, আমি আসছি।
দুরুদুরু বক্ষে ভড়মশায় কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। কি না-জানি বলে! চাকরটা নিশ্চয় মনিবকে চেনে, অন্ততঃ নামও শুনিয়াছে।
এবার আবার দরজা খুলিল। চাকর মুখ বাড়াইয়া বলিল– আপনার নাম কি? মাইজী বললেন, জেনে এসো।
–আমার নাম মাখনলাল ভড়। আমি বাবুর সেরেস্তার মুহুরী। বলো গিয়ে, যাও।
কিছুক্ষণ পরে চাকর পুনরায় আসিয়া ভড়মশায়কে উপরে লইয়া গেল।
ভড়মশায় উপরে গিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন, এ সে মেয়েটি নয়–সেবার যাহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন। ইহার বয়স বেশি, গায়ের রং তত ফরসা নয়।
মেয়েটি বলিল–আপনি কাকে চান?
ভড়মশায় অপরিচিত স্ত্রীলোকের সম্মুখে কথা বলিতে অভ্যস্ত নন, কেমন একটা আড়ষ্টতা ও অস্বস্তি বোধ করেন এসব ক্ষেত্রে। বিনীতভাবে সসঙ্কোচে বলিলেন–আজ্ঞে, গদাধর বসু, নিবাস যশোর জেলায়…
মেয়েটি হাসিয়া বলিল–বুঝেছি, তা এখানে খোঁজ করছেন। কেন?
–এখানে আগে যিনি থাকতেন, তিনি এখন নেই?
–কে? শোভা মিত্তির?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই নাম।
–সে এখান থেকে উঠে গিয়েচে। তাকে কি দরকার?
–তাঁর সঙ্গে আমাদের বাবুর জানাশোনা ছিল, একবার তাই এসেছিলাম।
–গদাধর বসু, ন্যাশনাল সিনেমা কোম্পানীর জি বসু তো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, উনিই আমার বাবু। কিন্তু..
মেয়েটি বলিল–তা আপনি বলছেন গদাধরবাবুর মুহুরী দেশের–কিন্তু আপনি তাঁর কলকাতার ঠিকানা জানেন না কেন?
ভড়মশায় পাকা লোক। ইহার কাছে ঘরের কথা বলিয়া মিছামিছি মনিবকে ছোট করিতে যাইবেন কেন? সুতরাং বলিলেন–আজ্ঞে তাঁর সেরেস্তায় চাকরি নেই আজ বছরাবধি। তাঁকে একটু বলতে এসেছিলাম, যদি চাকরিটি আবার হয়, গরীব মানুষ, কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে বড় বিপদে পড়েচি, তাই..
-আপনি টালিগঞ্জে গিয়ে স্টুডিওতে দেখা করুন, ঠিকানা। কাগজে লিখে দিচ্চি–বাড়ীতে এখন তাঁর দেখা পাবেন না।
ভড়মশায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন, আনন্দে হাত-পায়ে যেন বল পাইলেন। বাঁচা গেল, মনিবের তাহা হইলে জেল হয় নাই। সেই ছবি-তোলার কাজেই লাগিয়া আছেন, বোধহয় চাকরি লইয়া থাকিবেন।