অনঙ্গ এখনও পায়ে বল পায় নাই। কোনক্রমে রান্নাঘরে বসিয়া দুটি রান্না করে, ছেলে দুটিকে খাওয়াইয়া, নিজে খাইয়া রোয়াকের একপ্রান্তে মাদুর পাতিয়া রৌদ্রে শুইয়া থাকে, কোনদিন বা একটু ঘুমায়। দুবেলা রান্না হয় না, হাঁড়িতে ওবেলার জন্য ভাত-তরকারি থাকে, সন্ধ্যার পরে ছেলে-মেয়েরা খায়।
একটু চুপ করিয়া শুইয়া দেখে, ধীরে ধীরে উঠানের আতাগাছটা লম্বা ছায়া ফেলিতেছে দোরের কাছে, পাঁচিলের গাছে আমরুল শাকের জঙ্গলে একটি প্রজাপতি ঘুরিতেছে, খোকার বাজনার টিনটা কূয়াতলায় গড়াগড়ি যাইতেছে, পাশের জমিতে শচীনের সেওড়াতলী আমগাছটার মগডালের দিকে রোদ উঠিতেছে ক্রমশঃ, নাইবার চাতালে গর্ত বর্ষায় বন-বিছুটির গাছ গজাইয়াছে– অনেকদিন আগে গদাধর কূয়াতলায় বসিয়া স্নানের জন্য শখ করিয়া একটি জলচৌকি গড়াইয়াছিলেন–সেখানা একখানা পায়া ভাঙা অবস্থায় কাঠ রাখিবার চালাঘরের সামনে চিত হইয়া পড়িয়া আছে। তাহার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল।
বড় খোকাকে ডাকিয়া বলিল–হাঁরে, ও চৌকিখানা ওখানে অমন ক’রে ফেলেছে কে রে?
খোকা এদিক-ওদিকে চাহিতে চাহিতে জলচৌকিখানা দেখিতে পাইল। বলিল–আমি জানিনে তো মা? আমি ফেলিনি।
–যেই ফেলুক, তুই নিয়ে এসে দালানের কোণে রেখে দে। কেউ না ওতে হাত দেয়।
তারপর সে আবার দুর্বলভাবে বালিশে ঢলিয়া পড়ে। মনেও বল নাই, হাত-পায়েও জোর নাই যেন। তাহার ভালো লাগে না, একা একা এ বাড়ীতে যে থাকিতে পারে না। জীবন যেন তার বোঝা হইয়া পড়িয়াছে, বিশেষ করিয়া এই শীতের সন্ধ্যাবেলা মনের মধ্যে কেমন হু হু করে। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। কেহ নাই যে একটি কথা বলিয়া আদর করে, মুখের দিকে চায়। কত কথা মনে পড়ে–এমনি কত শীতের ঠাণ্ডা রোদ সেওড়াতলী আমগাছটার মগডালে উঠিয়া গিয়াছে আজ চৌদ্দ বছর ধরিয়া, চৌদ্দ বছর আগে এমনি এক শীতের মধ্যাহ্নে সে নববধূরূপে এ-গৃহে প্রথম প্রবেশ করে। ওই অতি পরিচিত ঠাণ্ডা রোদ-মাখানো আমগাছটার দিকে চাহিলে কত ভালো দিনের কথা মনে পড়ে, কত আনন্দ ভরা শীতের সন্ধ্যার স্মৃতিতে হৃদয় ব্যথায় টনটন করিয়া ওঠে।
চিরকাল কি এমনি কাটিবে?
মা মঙ্গলচণ্ডী কি মুখ তুলিয়া চাহিবেন না?
ভড়মশায় হাটের টাকা লইয়া দরজার কাছে আসিয়া সাড়া দেন–বৌ-ঠাকরুণ আছো? বৌ-ঠাকরুণ?
–হ্যাঁ, আসুন। নেই তো আর যাচ্চি কোথায়?
–এগুলো গুনে নিও।
অনঙ্গ গুনিয়া বলিল–সাড়ে তের আনা? আজ যে বেশি?
–হলদির দর চড়ে গিয়েচে বাজারে। সামনের হাটে আরও হবে–আর কিছু বেশি টাকা হাতে আসতো, এ-সময় তো একটা থোক লাভ করা যেতো হলুদ থেকে।
–আচ্ছা ভড়মশায়?
অনঙ্গর গলায় সুরের পরিবর্তনে ভড়মশায় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন–কি? কি হলো?
–আচ্ছা, একবার আপনি কলকাতায় যাবেন?
–কলকাতায়? তা…
–তা নয় ভড়মশায়। অনেকদিন কোনো খবর পাইনি, আমার মনটা…আপনি একবার বরং…
স্বামীর কথা বলিতে গেলেই কোথা হইতে কান্না আসিয়া কেন যে গলার স্বর আটকাইয়া লোকের সামনে লজ্জায় ফেলে এমনধারা!
ভড়মশায় চিন্তিত মুখে বলেন–তা–তা–গেলেও হয়।
–তাই কেন যান না আজই। একবার দেখে আসুন। আজ কত দিন হলো, কোনো খবর পাইনি–শরীর-গতিক কেমন আছে, কি-রকম কি করছেন, আপনি নিজের চোখে দেখে এলে…
ভড়মশায় কথাটা ভাবিয়া দেখিলেন। যাইতে অবশ্য এমন কি আপত্তি, তা নয়, তবে পয়সা খরচের ব্যাপার। এই নিতান্ত টানাটানির সংসারে এমনি পাঁচটা টাকা ব্যয় হইয়া যাইবে যাতায়াতে! বৌ-ঠাকরুণ সে টাকা পাইবেনই বা কোথায়?
মুখে বলিলেন–আচ্ছা দেখি।
–তাহলে কোন গাড়িতে যাবেন আপনি?
–আজ বা কাল তো হয় না। হাটবার আসছে সামনে।
–হাটবার লেগেই থাকবে। আমি এক-রকম করে চালিয়ে নেবো এখন, আপনি যান–আমার কাছে তিনটে টাকা আছে, তুলে রেখে দিইচি, তাই নিয়ে যান।
সপ্তাহের শেষে অনঙ্গ আবার জ্বরে পড়িল। তবে এবার জ্বরটা খুব বেশি নয়, সাধারণ ম্যালেরিয়া জ্বর, এসময় পাড়াগাঁয়ের ঘরে-ঘরেই এমন জ্বর লাগিয়া আছে, তাহাতে ডাক্তারও আসে না, বিশেষ কোন ঔষধও পড়ে না। তবুও ভড়মশায় ডাক্তার ডাকানোর প্রস্তাব করিয়াছিলেন, অনঙ্গ কথাটা উড়াইয়া দিয়া বলিল–হ্যাঁ, আবার ডাক্তার কি হবে? বরং ডাকঘরের কুইনিন এক প্যাকেট কিনে দিন, তাই খেয়েই যাব এখন–ভারি তো জ্বর!
সে জ্বরে তিন-চারদিন ভুগিয়া তখনকার মত গেল বটে, কিন্তু দুদিন অন্নপথ্য করিতে না করিতে আবার জ্বর দেখা দিল। একেই সে ভালো ভাবে সারিয়া উঠিতে পারে নাই প্রথম অসুখের পর, এভাবে বার বার ম্যালেরিয়ায় পড়াতে আরও দুর্বল হইয়া পড়িল, রক্তহীনতার দরুন মুখ হলদে ফ্যাকাসে রং-এর হইয়া আসিল, শরীর রোগা, মাথার সামনের চুল উঠিয়া সিঁথির কাছটা কুশ্রী ধরণের চওড়া হইয়া গেল, ভাতে রুচি নাই, একবার পাতের সামনে বসে মাত্র, মুখে কিছু ভালো লাগে না।
সংসারে বেজায় টানাটানি চলিতেছিল, শীত পড়ার মুখে হলুদের দর একটু চড়াতে হাটে হাটে আগের চেয়ে আয় কিছু বাড়িল। অনঙ্গ আজকাল ব্যবসা বেশ বোঝে, সে নিজে অসুখ শরীরে শুইয়া শুইয়া একদিন মুখুজ্যে-বাড়ী হইতে শুকনো পিপুল কিনিয়া আনাইল এবং সেগুলি হাটে পাঠাইয়া পাঁচ-ছ’টাকা লাভ করিল।
একদিন সে আবার ভড়মশায়কে ধরিল কলিকাতা যাইবার জন্য।