আশ্চর্য হইয়া ভড়মশায় জিজ্ঞাসা করিলেন–এ কি খোকা? ও কি হচ্চে? মা কোথায়?
খোকা ভড়মশায়কে দেখিয়া অপ্রতিভ হইয়া ভাতের দলা তুলিতে গিয়া হাত গুটাইয়াছিল। মুখের দু’পাশের ভাত ক্ষিপ্রহস্তে মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়া বলিল–মা’র জ্বর। আমরা কাল রাত্রে কিছু খাই নি, তাই পলুকে ভাত বেড়ে দিচ্চি। মা কাল বলেছিল, হাঁড়ি থেকে নিয়ে খেতে।
সে এমন ভাব দেখাইল যে, শুধু ছোট ভায়ের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য তাহার এই নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা। তাহার খাওয়ার উপর বিশেষ কোনো স্পৃহা নাই।
-বলো কি খোকা! জ্বর তোমার মা’র? কোথায় তিনি?
খোকা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল–বিছানায় শুয়ে। কথা বলচে না কিচ্ছু–এত করে বললাম, আমি নুন পাড়তে পারি নে, পলুকে কি দেবো, তা মা…
ভড়মশায় ভীত হইয়া ঘরের মধ্যে গিয়া উঁকি মারিলেন। অনঙ্গ জ্বরের ঘোরে অভিভূত অবস্থায় পড়িয়া আছে, তাহার কোনো সাড়া-সংজ্ঞা নাই–লেপখানা গা হইতে খুলিয়া একদিকে বিছানার বাহিরে অর্ধেক ঝুলিতেছে!
ভড়মশায় ডাকিলেন–ও বৌ-ঠাকরুণ! বৌ-ঠাকরুণ!
অনঙ্গ কোনো সাড়া দিল না।
–কি সর্বনাশ! এমন কাণ্ড হয়েচে তা কি জানি? ও বৌ ঠাকরুণ!
দু’তিনবার ডাকাডাকি করার পরে অনঙ্গ জ্বরের ঘোরে ‘অ্যাঁ’ করিয়া সাড়া দিল। সে সাড়ার কোনো অর্থ নাই। তাহা অচেতন মনের বহুদিনব্যাপী অভ্যাসের প্রতিক্রিয়া মাত্র। তাহার পিছনে বুদ্ধি নাই…চৈতন্য নাই।
ভড়মশায় ছুটিয়া গিয়া গিরীশ ডাক্তারকে ডাকিয়া আনিলেন। ডাক্তার দেখিয়া বলিল–কোনো চিন্তা নাই, সাধারণ ম্যালেরিয়া জ্বর, তবে একটু সাবধানে রাখা দরকার। ভড়মশায়ের নিজের স্ত্রী বহুদিন পরলোকগত–এক বিধবা ভাইঝি থাকে বাড়ীতে, তাহাকে আনাইয়া সেবা-শুশ্রূষার ব্যবস্থা করিলেন–প্রতিবেশীরা বিশেষ কেহ উঁকি মারিল না।
চৌদ্দ-পনেরো দিন পরে অনঙ্গ সারিয়া উঠিয়া রোগজীর্ণ-মুখে পথ্য করিল। কিন্তু তখন সে অত্যন্ত দুর্বল–উঠিয়া দাঁড়াইবার ক্ষমতা নাই।
ভড়মশায় এতদিন জিজ্ঞাসা করিবার অবকাশ পান নাই, আজ জিজ্ঞাসা করিলেন–বৌ-ঠাকরুণ, টাকা কোথায়?
–টাকা সিন্দুকে আছে।
–চাবিটা দাও, দেখি।
এদিক-ওদিক খুঁজিয়া চাবি পাওয়া গেল না। বালিশের তলায় তো থাকিত, কোথায় আর যাইবে, এখানে কোথায় আছে! সব জায়গা তন্ন তন্ন করিয়া খোঁজা হইল, ছেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হইল, অবশেষে কামার ডাকাইয়া তালা ভাঙিয়া দেখা গেল, সিন্দুকে কিছুই নাই। টাকা তো নাই-ই, উপরন্তু অনঙ্গর হাতের দু’গাছা সোনা-বাঁধানো হাতীর দাঁতের চুড়ি ছিল, তাহাও উবিয়া গিয়াছে। আর গিয়াছে গদাধরের পিতামহের আমলের সোনার তৈরি ক্ষুদ্র একটি শীতলা-মুর্তি। ক্ষুদ্র হইলেও প্রায় ছ’সাত ভরি। ওজনের সোনা ছিল মূর্তিটাতে।
বহুকষ্টে অর্জিত অর্থের সঙ্গে শীতলা-মূর্তির অন্তর্ধানে, নানা অমঙ্গল আশঙ্কায় অনঙ্গ মাথা ঠুকিতে লাগিল।
ভড়মশায় মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। আজ এক বৎসরের বহু কষ্টে সঞ্চয় করা যৎসামান্য পুঁজি যাহা ছিল কোনোরকমে তাহাতে হাত-ফেরত খুচরা ব্যবসা চালাইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ হইতেছিল।
অবলম্বনহীন, সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় এখন ইহাদের কি উপায় দাঁড়াইবে?
ভড়মশায় জিজ্ঞাসা করিলেন–বাড়ীতে কে কে আসতো?
অনঙ্গ বিশেষ কিছু জানে না! তাহার মনে নাই। জ্বরের ঘোরে সে রোগের প্রথমদিকে অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া থাকিত–কে আসিয়াছে গিয়াছে তাহার খেয়াল ছিল না। প্রতিবেশিনীরা মাঝে মাঝে তাহাকে দেখিতে আসিত–শচীনের মা একদিন না দুদিন আসিয়াছিলেন, স্বর্ণ গোয়ালিনী একদিন আসিয়াছিল মনে আছে– আর আসিয়াছিলেন মুখুয্যেগিন্নী। তবে ইহাদের বেশির ভাগই অশুচি হইবার ভয়ে রোগীর ঘরের মধ্যে ঢোকেন নাই, দোরে দাঁড়াইয়া উঁকি মারিয়া দেখিয়া, ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া উঠান পার হইয়া গিয়াছিলেন। ইহার একটি ন্যায্য কারণ যে না ছিল তাহা নয়। বাড়ীর ছেলে দুটি মায়ের শাসনদৃষ্টি শিথিল হওয়ায় মনের আনন্দে যেখানে-সেখানে ভাত ছড়াইয়াছে, এঁটো থালাবাসন রাখিয়াছে, যাহা খুশি তাহাই করিয়াছে–সেখানে কোনো জাতিজন্মবিশিষ্ট হিন্দুঘরের মেয়ে কি করিয়া নির্বিকার মনে বিচরণ করিতে পারে, ইহাও ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। শুধু লোকের নিন্দা করিয়া লাভ নাই।
চুরির কোনো হদিস মিলিল না। উপরন্তু অনঙ্গ বলিল– ভড়মশায়, আমার যা গিয়েচে গিয়েচে–আপনি আর কাউকে বলবেন না চুরির কথা। শত্রু হাসবে, সে বড় খারাপ হবে। উনি শত্রু হাসাবার ভয়ে আজ পর্যন্ত গাঁয়ে ফিরলেন না–আর আমি সামান্য টাকার জন্যে শত্ৰু হাসাবো? তিনি এত ক্ষতি সহ্য করতে পারলেন–আর আমি এইটুকু পারবো না ভড়মশায়?
সুতরাং ব্যাপার মিটিয়া গেল।
ভড়মশায় কলিকাতায় মেসের ঠিকানায় দু’তিনখানা চিঠি দিয়া কোনো উত্তর পাইলেন না। অবশেষে সব কথা খুলিয়া লিখিয়া একখানি রেজেষ্ট্রি চিঠি দিলেন–চিঠি ফেরত আসিল, তাহার উপর কৈফিয়ৎ লেখা–মালিক এ ঠিকানায় নাই।
অনঙ্গর হাতে দু’গাছা সোনা-বাঁধানো শাঁখা ছিল। খুলিয়া তাহাই সে বিক্রয় করিতে দিল। সেই যৎসামান্য পুঁজিতে হলুদের গুঁড়ার ব্যবসা করিয়া কোনো হাটে বারো আনা, কোনো হাটে বা কিছু বেশি আসিতে লাগিল। অকূল সমুদ্রে সামান্য একটা ভেলা হয়তো–কিন্তু জাহাজ যেখানে মিলিতেছে না, সেখানে ভেলার মূল্যই কি কিছু কম!