গদাধর হাসিয়া বলিলেন–ঠকবার মজা কি জানো? যে ঠকে সে তো ঠকেই–আবার উপরন্তু পাঁচজনের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে প্রাণ যায়!
অনঙ্গ অভিমানের সুরে বলিল–বেশ, তাহ’লে দিও না কৈফিয়ৎ। কে চায় শুনতে?
-না না, শোনো।
–শুনি তো আমার বড় দিব্যি!
–না যদি শোনাই, তবে আমারও অতি-বড় দিব্যি।
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল–বলো, কি হলো শুনি?
গদাধর সাধুর ব্যাপার বলিলেন। অনঙ্গ শুনিয়া কেমন একটু অন্যমনস্ক হইয়া গেল, পরে কি ভাবিয়া বলিল–তুমি যদি সাধুকে বাড়ীতে আনতে তো বেশ হতো।
কেন?
–আমার হাতটা দেখতাম।
–তোমার হাত কি দেখবে আবার! দিব্যি তো আছো!
–দেখালে দোষ কি?
–ওরা কি জানে? আমার বিশ্বাস হয় না।
–তুমি নাস্তিক বলে সবাই তো নাস্তিক নয়।
–কি দেখাবে? আয়ু?
–তাও দেখাতাম বৈকি। দেখাতাম তোমার আগে মরি কি না–
–এ শখ কেন?
–এ শখ কেন, যদি মেয়েমানুষ হতে, তবে বুঝতে।
–যখন তা হই নি, তখন আপসোস করে লাভ নেই। এখন চা-টা খাবে? জুড়িয়ে যে জল হয়ে গেল!
বলিয়া গদাধর চায়ের পেয়ালা মুখ হইতে নামাইয়া রাখিলেন।
স্বামীর কথায় চা-টুকু শেষ করিয়া অনঙ্গ ঘরের বাহিরে যাইবার উপক্রম করিতেই গদাধর বলিলেন–একটু দাঁড়াও না ছাই!
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল–বসলে চলে? রান্নাবান্না সবই বাকী।
–তা হোক বোসো একটু।
অনঙ্গ স্বামীর সংস্পর্শ হইতে বেশ কিছু দূরে বসিয়া বলিল– এই বসলাম।
অর্থাৎ সে এখন শুচি-বস্ত্র পরিয়া রান্না করিতেছে–নাস্তিক গদাধরের আড়ত-বেড়ানো কাপড় পরনে, সে এখন স্বামীর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি করিতে রাজি নয়।
গদাধর মুচকি হাসিয়া বলিলেন–ছুঁয়ে দিই?
–তাহ’লে থাকলো হাঁড়ি উনুনে চড়ানো–সে হাঁড়ি আর নামবে না।
–ভালোই তো। কারো খাওয়া হবে না।
–কারো খাওয়ার জন্যে আমার দায় পড়েচে ভাববার। ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাবে না খেয়ে সেটাই ভাবনার কথা।
–ও, বেশ।
আমার কাছে পষ্ট কথা–পষ্ট কথার কষ্ট নেই!
–সে তো বটেই।
অনঙ্গ হাসিতে লাগিল। তাহার বয়স এই সাতাশ-আটাশ– প্রথম যৌবনের রূপ-লাবণ্য কবে ঝরিয়া গেলেও অনঙ্গ এখনও রূপসী। এখনও তাহার দিকে চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। রং যে খুব ফর্সা তা নয়, উজ্জ্বল শ্যাম বলিলেই ভালো হয়, কিন্তু অনঙ্গর মুখের গড়নের মধ্যে এমন একটা আলগা চটক আছে, চোখ এমন টানা-টানা, ভুরু দুটি এমন সরু ও কালো, ঠোঁট এমন পাতলা, বাহু দুটির গড়ন এমন নিটোল, মাথার চুলের রাশ এমন ঘন ও ঠাসবুনানো, হাসি এমন মিষ্ট যে মনে হয়, সাজিয়া-গুঁজিয়া মুখে স্নো-পাউডার মাখিয়া বেড়াইলে এখনও অনঙ্গ অনেকের মুণ্ড ঘুরাইয়া দিতে পারে।
নারীর আদিম শক্তি ইহার মধ্যে যেন এখনও নির্বাপিত আগ্নেয়গিরির গর্ভে সুপ্ত-অগ্নির মতই বিরাজমান।
গদাধর বলিলেন–সাধু আজ আমার হাত দেখে কি বলেচে জানো?
–কি গা?
–আমার নাকি শীগগির খুব খারাপ সময় হবে!
অনঙ্গ শিহরিয়া উঠিয়া বলিল–ওমা, সে কি গো!
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–তাই তো বললে।
আচ্ছা, তোমার সব-তাতে হাসি আমার ভালো লাগে না। তুমি যেমন কিছু জানো না, বোঝ না–সবাই তো তোমার মত নয়! কি কি বললে সাধুবাবা শুনি?
–ওই তো বললাম।
-সত্যি এই কথা বলেচে?
–হ্যাঁ, ভড়মশায় জানে, জিজ্ঞেস্ কোরো।
–ওমা, শুনে যে হাত-পা আসচে না!
–হ্যাঁঃ–তুমি রেখে দাও। ভণ্ড সাধু সব কোথাকার, ওদের আবার কথার ঠিক!
অনঙ্গ ঝাঁঝের সহিত বলিল–ওই তো তোমার দোষ। কাকে কি চটিয়েছো, কি বলে গিয়েচে–ওরা সব করতে পারে, তা জানো? ওদের নামে অমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে আছে? ওই দোষেই তোমায় ভুগতে হবে, দেখচি! সাধুকে কিছু দাওনি?
গদাধর হাসিয়া উঠিয়া হাতে চাঁদি-বসানো এবং সাধুর টাকা তুলিয়া লওয়ার বর্ণনা করিলেন।
অনঙ্গ বলিল–হেসো না। যাক্, তবুও কিছু দক্ষিণা-প্রণামী পেয়ে গিয়েচেন তো তিনি! আমার এখানে আগে এসেছিলেন– তখন যদি জানতাম, আমি ভাল করে সেবাভোগ দিতাম–মনটা খুশী করে দিতাম বাবার…ওঁরা সব পারেন।
বলিয়া অনঙ্গ হাত জোড় করিয়া কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিয়া উদ্দেশে প্রণাম করিল!
গদাধরের দোষ এই, স্ত্রীর কাছে গম্ভীর হইয়া থাকিতে পারেন না। অনঙ্গর কাণ্ড দেখিয়া হাসি চাপিয়া রাখা গদাধরের পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়াইল। প্রথমটা হাসি চাপিতে গিয়া শেষকালে ফল ভালো হইল না–ঘরের মধ্যে মনে হইল যেন একটা হাসির বোমা বুঝি-বা ফাটিয়া পড়িল!
অনঙ্গ রাগে ফরফর করিতে করিতে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
গদাধরের তখন আর-এক পেয়ালা হইলে মন্দ হইত না– কিন্তু স্ত্রীকে চটাইয়াছেন, সে আশা বর্তমানে নির্মুল।
তিনি ডাকিলেন–গৈবি…
গৈবি বাহির-বাড়ী হইতে উত্তর দিল–যাই বাবু!
–ওরে, শোন এদিকে। একটু তামাক দে–আর একবার দেখে আয়, কলকাতা থেকে নির্মলবাবু, এসেচে কিনা মুখুয্যেবাড়ীর।
–এখনি যাবো, বাবু?
–তামাক দিয়ে তারপর গিয়ে দেখে আয়। যদি আসে তো ডেকে নিয়ে আসবি!
এই সময় অনঙ্গ আবার ঘরে ঢুকিয়া বলিল–কেন, নির্মলবাবুকে ডাকচো কেন শুনি?
–সে খোঁজে তোমার দরকার কি?
দরকার আছে। নির্মলবাবুর সঙ্গে তোমাকে মিশতে দেবো না আমি।
–আমি কি ছেলেমানুষ?
ছেলে-বুড়োর কথা নয়। সে এসে কেবল টাকা ধার করে আর দেয় না। গাঁয়ের সকলের কাছেই নিয়েছে, এমন কি মিনির বাপের কাছ থেকেও সাতটা টাকা নিয়ে গিয়েচে। তোমার কাছ থেকে তো অনেক টাকাই নিয়েছে, কিছু দিয়েচে?