–হ্যাঁ, তারপর বলুন ভড়মশায়।
–হ্যাঁ, তারপর তো সেই মেসের বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম।
-মেসের বাড়ীতে উঠলেন কেন? চেহারার কথা বলচিলেন– মানে, শরীরটা…
-সুন্দর চেহারা হয়েচে। কলকাতায় থাকা…তার ওপর আজকাল একটু অবস্থা ফিরতির দিকে যাচ্চে…আমায় বললেন মানে একটু স্ফুর্তি দেখা দিয়েচে কিনা!
–টাকা দিয়ে এলেন তো?
ভড়মশায় লংক্লথের আধময়লা কোটের সুবৃহৎ ঝোলা-সদৃশ পকেট হাতড়াইতে হাতড়াইতে বলিলেন–হ্যাঁ ভালো কথা—টাকা সব নিলেন না। পঞ্চাশটি নিয়ে বললেন, এখন আর দরকার নেই, বাড়ীতে তো টানাটানি যাচ্চে…তা–এই সেই বাকি টাকাটা একটা খামের মধ্যে–সামনের হাটে এতে…
কথাটা শুনিয়া অনঙ্গ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল। স্বামী যখন টাকা ফিরাইয়া দিয়াছেন–তখন নিশ্চয়ই তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে যাইতেছে। বাঁচা গেল, লোকে কত কি বলে, তাহা শুনিয়া তাহার যেন পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকিয়া যায়। মা সিদ্ধেশ্বরী মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন এতদিন পরে।
সে একটু সলজ্জ কণ্ঠে বলিল–আচ্ছা আমাদের–আমার কথা টথা কিছু–মানে, কেমন আছিটাছি…
ভড়মশায় তাহার মুখের কথা যেন লুফিয়া লইয়া বলিলেন–ঐ দ্যাখো, বুড়োমানুষ বলতে ভুলে গিয়েচি। সে কত কথা…অনেকক্ষণ ধরে বললেন তোমাদের কথা বৌ-ঠাকরুণ। তোমার সম্বন্ধেও…
–ও! কি বললেন? এই কেমন আছি, মানে…
নিজের অজ্ঞাতসারে তাহার কণ্ঠে ঔৎসুক্য ও কৌতূহলের সুর আসিয়া গেল।
ভড়মশায় মৃদু মৃদু হাসিমুখে বলিলেন–এই সব বললেন– একা ওখানে থেকে মনে শান্তি নেই তাঁর। অথচ এ-সময়টা দেশে আসতে গেলে কাজের ক্ষতি হয়ে যায় কিনা! তোমার কথা কতক্ষণ ধরে বললেন। আসবার সময় ঐ বিস্কুট লেবেঞ্চুস তো তিনিই কিনে দিলেন!
–আপনাকে শেয়ালদা ইস্টিশানে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন বুঝি?
–হ্যাঁ, তাই তো। উঠিয়েই তো দিয়ে গেলেন–সেখানেও তোমার কথা…
অনঙ্গ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া চোখের জল গোপন করিল।
ভড়মশায় চলিয়া আসিলেন। এভাবে বেশীক্ষণ চালানো সম্ভব নয়, হয়তো বা কোথায় ধরা পড়িয়া যাইবেন। বৌ-ঠাকরুণের বুদ্ধির উপর তাঁর শ্রদ্ধা আছে। তবে স্বামীর ব্যাপার লইয়া কথাবার্তা উঠিলে বৌ-ঠাকরুণ সহজেই ভুলিয়া যান–এই রক্ষা।
ভড়মশায় কি সাধে মনিবকে বাকি পঞ্চাশটি টাকা দেন নাই?
বৌ-ঠাকরুণ বা ছেলেদের কথা তো একবারও লোকে জিজ্ঞাসা করে–এতদিন পরে যখন? অমন সতীলক্ষ্মী স্ত্রী, ছেলেরা বাড়ীতে– তাহাদের সম্বন্ধে একটা কথা নয়? সেখানে ভড়মশায় দিতে যাইবেন টাকা? তা তিনি কখনো দিবেন না।
শরৎকাল চলিয়া গেল। আবার হেমন্ত আসিল।
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অনঙ্গ প্রতিদিনই আশা করিয়াছে– স্বামী হঠাৎ আজ হয়তো আসিয়া পড়িবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয় নাই।
ভড়মশায় আসিয়া বলেন–বৌ-ঠাকরুণ, টাকা দিতে হবে।
–কত?
–ছত্রিশ টাকা দাও আজ, পাট আর আসচে না হাটে। ওতেই কাজ চলে যাবে।
সন্ধ্যাবেলা লাভের দু’তিন টাকাসুদ্ধ টাকাটা আবার ফিরাইয়া দিয়া যান। একদিন শশী বাগদিনী অনঙ্গকে পরামর্শ দিল– হলুদের গুঁড়ার ব্যবসা করিতে। উহাতে খুব লাভ, আস্ত হলুদ বাজার হইতে কিনিয়া বাগদি-পাড়ায় দিলে, তাহাদের ঢেঁকিতে তাহারাই কুটিয়া দিবে–মজুরী বাদেও যাহা থাকে, তাহা অনঙ্গ হিসাব করিয়া দেখিল নিতান্ত মন্দ নয়। আজকাল সে ব্যবসা বুঝিতে পারে ব্যবসা-বুদ্ধি খুলিয়া গিয়াছে।
ভড়মশায়কে কথাটা বলিতে তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন।
–হুঃ ফুঁঃ! গুঁড়ো হলদির আবার ব্যবসা?
অনঙ্গ বলিল–না ভড়মশায়, আমি হিসেব করে দেখেচি আপনি আমায় হলুদ দিন দিকি, আমি বাগদি-পাড়া থেকে কুটিয়ে আনি…
দু’তিনবার হলুদের গুঁড়ো কেনাবেচা করিয়া দেখা গেল, পাটের খুচরো কেনাবেচার চেয়েও ইহাতে লাভের অঙ্ক বেশি।
আর একটা সুবিধা, এ ব্যবসা বারোমাস চলিবে। বৌ-ঠাকরুণের বুদ্ধির উপর ভড়মশায়ের শ্রদ্ধা জন্মাইল। টাকা বসিয়া থাকে না, অনঙ্গ নানা বুদ্ধি করিয়া এটা-ওটার ব্যবসায়ে খাটাইয়া যতই সামান্য হউক, তবুও কিছু কিছু আয় করে।
কিন্তু বর্ষার শেষে ম্যালেরিয়া নিজমূর্তি ধরিয়াছে।
অনঙ্গ একদিন জ্বরে পড়িল। জ্বর লইয়াই গৃহকর্ম করিয়া রাত্রের দিকে জ্বর বেশ বাড়িল। আগাগোড়া লেপমুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল বিছানায়–উঠিবার শক্তি নাই। অতবড় বাড়ী, কেহ কোথাও নাই–কেবল এই ঘরখানিতে সে আর তাহার দুটি ছেলে।
বড় খোকা আট বছরে পড়িয়াছে। সে বলিল–মা, আমাদের এবেলা ভাত দেবে কে?
অনঙ্গ জ্বরের ঘোরে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল–সে প্রথমটা কোনো উত্তর দিল না। পরে বিরক্ত হইয়া ছেলেকে বকিয়া উঠিল। খোকা কাঁদিতে লাগিল। অনঙ্গ আরও বকিয়া বলিল–কানের কাছে ঘ্যান্-ঘ্যান্ করিস্ নে বলচি খোকা–খাবি কি তা আমি কি বলবো? আপদগুলো মরেও না যে আমার হাড় জুড়োয়! তোদের মানুষ করচে কে, জিগ্যেস্ করি? কে ঝক্কি পোয়ায়? যা, বাসিভাত হাঁড়িতে আছে, বেড়ে নে।
পরদিন ভড়মশায় আসিয়া দেখিলেন, ছেলে দুটি রান্নাঘরের সামনে ভাতের হাঁড়ি বাহির করিয়া একটা থালায় তাহা হইতে একরাশ পান্তাভাত ঢালিয়া এঁটো হাতে সমস্ত মাখামাখি করিয়া ভাত খাইতেছে। অনঙ্গ আবার একটু শুচিবাইগ্রস্ত হইয়া উঠিয়াছে আজকাল–তাহার বাড়ীতে এ কি কাণ্ড! ছেলে দুটো এঁটো-হাতে রান্নার হাঁড়ি লইয়া ভাত তুলিয়া খাইতেছে কি রকম?