অনঙ্গ চিন্তিতমুখে বলিল–আপনার হাতে এখন কত টাকা আছে?
অনঙ্গর মুখের দিকে চাহিয়া ভড়মশায় হাসিয়া বলিলেন– আন্দাজ শ’দুই-আড়াই। কি করতে চান বৌ-ঠাকরুণ, ওতে বাবুর দেনা শোধ করা যাবে না।
–আপনি একবার কলকাতায় যান ভড়মশায়, নির্মল ঠাকুরপো বলচিল তাঁর নাকি দেনার দায়ে জেল হবে, একবার আপনি নিজের চোখে দেখে আসুন ভড়মশায়–আমি স্থির থাকতে পারছি নে যে একেবারে, এ-কথা শুনে কি আমার মুখে ভাতের দলা ওঠে? আপনি আজ কি কাল সকালেই যান একবার।
–আজ হবে না বৌ-ঠাকরুণ, আজ হাটবার। টাকা-পঞ্চাশেক হাতে আছে ও টাকাটায় ওবেলা পাট কিনতে হবে। যা হয় দুপয়সা তো ওই থেকেই আসচে।
পরদিন সকালে অনঙ্গ একপ্রকার জোর করিয়া ভড়মশায়কে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিল। সঙ্গে দিল একখানা লম্বা চিঠি আর একশোটা টাকা। ভড়মশায় টাকা দিতে বারণ করিয়াছিলেন, ইহা শুধু সংসারখরচের টাকা নয়, এই যে সামান্য ব্যবসায়ের উপর কষ্টেসৃষ্টেও যা হোক একরকম চলিতেছে, এ টাকা সেই ব্যবসার মূলধনের একটা অংশও বটে। অনঙ্গ শুনিল না। তিনি বিপদের মধ্যে আছেন, যদি তাঁর কোনো দরকার লাগে!
৯-১০. শোভারাণীর বাড়ী
ভড়মশায় সটান গিয়া শোভারাণীর বাড়ী উঠিলেন। চাকরের নিকট সন্ধান লইয়া জানিলেন, গদাধরবাবু বহুদিন যাবৎ এখানে আসেন না।..মাইজী? না, মাইজী এখন স্টুডিওতে। এসময় তিনি বাড়ী থাকেন না কোনোদিন।
শচীনের কাছে সন্ধান মিলিল। দক্ষিণ-কলিকাতার একটা মেসের বাড়ীর ক্ষুদ্র ঘরে কেওড়াকাঠের তক্তপোশে বসিয়া মনিব বিড়ি খাইতেছেন, এ অবস্থায় ভড়মশায় গিয়া পৌঁছিলেন।
গদাধর আশ্চর্য হইয়া বলিলেন–কি খবর, ভড়মশায় যে! আমার ঠিকানা পেলেন কোথায়?
–প্রণাম হই বাবু।
বলিয়াই ভড়মশায় কাঁদিয়া ফেলিলেন।
–আরে আরে, বসুন বসুন, কি হয়েচে–ছিঃ! আপনি নিতান্ত…
চোখের জল মুছিতে মুছিতে ভড়মশায় বলিলেন–বাবু, আপনি বাড়ী চলুন।
–বাড়ী যাবার জো নেই এখন ভড়মশায়। সে-সব অনেক কথা। সকল কথা শুনেও দরকার নেই,–আমার এখন বাড়ী যাওয়া হয় না।
–বৌ-ঠাকরুণ কেঁদে-কেটে.
–কি করবো বলুন, এখন আমার যাবার উপায় নেই–বসুন। ঠাণ্ডা হোন। খাওয়াদাওয়া করুন এখানে এবেলা।
ভড়মশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–বাবু, একটা কথা বলবো?
–কি বলুন!
–আপনাকে সংসারের ভার নিতে হবে না। আমি ফেটি পাটের কেনাবেচা করে একরকম যা হয় চালাচ্চি–আপনি গিয়ে শুধু বাড়ীতে বসে থাকবেন।
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–ভড়মশায়, আমি এখন গাঁয়ে গেলে যদি চলতো, আমি যেতুম। আমার সঙ্গে সঙ্গে সমনজারি করতে পেয়াদা ছুটবে দেশের বাড়ীতে, আর বড়-তরফের ওরা হাসাহসি করবে! সে-সব হবে না–তাছাড়া আমি আবার একটা কিছু করবার চেষ্টায় আছি।
ভড়মশায় বলিলেন–আপনার জন্যে বৌ-ঠাকরুণ কিছু পাঠিয়ে দিয়েচেন, আমার কাছে আছে।
ভড়মশায় দেখিয়া একটু আশ্চর্য হইলেন যে, মনিব টাকার কথা শুনিয়া বিশেষ কিছু আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না! নিস্পৃহভাবে বলিলেন–কত?
–আজ্ঞে, পঞ্চাশ টাকা।
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–ওতে কি হবে ভড়মশায়? আমায় হাজার-তিনেক টাকা কোনরকমে তুলে দিতে পারেন এখন? তাহলে কাজের খানিকটা অন্ততঃ মীমাংসা হয়।
–না বাবু, সে সম্ভব হবে না। ফেটি পাট কিনি ফি হাটে ষাট, সত্তর…বড় জোর একশো টাকার। তাই গণেশ কুণ্ডুর আড়তে বিক্রি করে কোনো হাটে পাঁচ, কোনো হাটে চার–এই লাভ। এতেই বৌ-ঠাকরুণকে সংসার চালাতে হচ্চে। তাঁরই পুঁজি– তিনি যে এই পঞ্চাশ টাকা দিয়েচেন তাঁর সেই পুঁজি ভেঙে। আমায় বললেন, বাবুর কষ্ট হচ্চে ভড়মশায়, আপনি গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসুন। অমন লক্ষ্মী মেয়ে…।
গদাধর অসহিষ্ণু ভাবে বলিল–আচ্ছা, থাক্। আপনি ও টাকাটা দিয়েই যান আমায়। অন্ততঃ যে ক’দিন জেলের বাইরে থাকি, মেসখরচটা চলে যাবে।
জেলের কথা শুনিয়া ভড়মশায় রীতিমত ভয় পাইয়া গেলেন। মনিব জেলে যাইবার পথে উঠিয়াছেন–সে কেমন কথা? এ-কথা শুনিলে বৌ-ঠাকরুণ কি স্থির থাকিতে পারিবেন? এই মেসেই ছুটিয়া আসিবেন দেখা করিতে হয়তো। সুতরাং এ-কথা সেখানে গিয়া উত্থাপন না করাই ভালো। তিন হাজার টাকার যোগাড় করিতে না পারিলে যদি জেলে যাওয়ার মীমাংসা না হয়, তবে চুপ করিয়া থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ, কারণ সে টাকা কোনোরকমেই এখন সংগ্রহ করা যাইতে পারে না।
পঞ্চাশটি টাকা গুনিয়া মনিবের হাতে দিয়া ভড়মশায় বিদায় লইলেন। দেশে পৌঁছিতে পরদিন সকাল হইয়া গেল। অনঙ্গ ছুটিয়া আসিয়া বলিল–কি, কি রকম দেখলেন ভড়মশায়? দেখা হলো? ওঁর শরীর ভালো আছে? কবে বাড়ী ফিরবেন বললেন?
-বলচি বৌ-ঠাকরুণ–আগে আমায় একটু চা ক’রে যদি…
–হ্যাঁ, তা এক্ষুণি দিচ্চি বলুন আগে–উনি কেমন আছেন? দেখা হয়েচে? –আছেন কোথায়? টাকা দিয়েচেন?
–আছেন একটা কোন মেসের বাড়ীতে দিব্যি আলাদা একটা ঘর! আমায় যেতেই খুব খাতির…বেশ চেহারা হয়েচে।
এই পর্যন্ত শুনিয়াই অনঙ্গ খুশিতে গলিয়া গিয়া বলিল–আচ্ছা বসুন, আমি এসে সব শুনচি, আগে চা করে আনি আপনার জন্যে।
ভড়মশায় ডাকিয়া বলিলেন–হ্যাঁ বৌমা…এই কিছু বিস্কুট আর লেবেঞ্চুস খোকাদের জন্যে..এটা রাখো।
কিছুক্ষণ পরে অনঙ্গ চা আনিয়া রাখিল, তার সঙ্গে একবাটি মুড়ি। সে হঠাৎ বন্য হরিণীর ন্যায় চঞ্চল ও উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে–হাতে-পায়ে বল ও মনে নতুন উৎসাহ পাইয়াছে। ভড়মশায় সব বুঝিলেন, বুঝিয়া একমনে চা ও মুড়ি চালাইতে লাগিলেন।