অনঙ্গ ঝগড়াটে স্বভাবের মেয়ে কোনোদিনই নয়। ভগবান যখন পাঁচজনকে দেখিতে দিয়াছেন–দেখুক।
কলিকাতার বাড়ীর জন্য ডবল পালঙ্ক, কয়েকখানা সোফা ও একটা বড় কাঁচ-বসানো আলমারি অনঙ্গ শখ করিয়া কিনিয়াছিল– এত কষ্টের মধ্যেও সেগুলি সে বেচিয়া বা ফেলিয়া আসিতে পারে নাই–সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। গত সুখের দিনের স্মৃতিচিহ্ন এগুলি–অনঙ্গ এখানকার ঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছে, বড়বৌ সেগুলি দেখিয়া বলিলেন–এসব আর এখন কি হবে ছোটবৌ, বিক্রি করে দিয়ে এলে তবুও দু-দিন চলতো সেই টাকায়! অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা! বলিস তো খাট-আলমারির খদ্দের দেখি,–ওই মুখুজ্যেদের গিন্নি বলচিল একখানা খাট ওর দরকার!
অনঙ্গ বলিল–আচ্ছা দিদি, আমি তোমায় জানাবো দরকার বুঝে। এনেচি যখন, এখন থাকুক–জায়গার তো অভাব নেই রাখবার, কারো ঘাড়েও চেপে নেই।
দিন যাহা হউক একপ্রকার কাটিতে লাগিল। অনঙ্গর মনে কিন্তু বড় দুঃখ, স্বামী তাহার পর হইয়া গেল। এত কষ্টের ও পরের টিটকারীর মধ্যেও যদি স্বামীকে সে কাছে পাইত, এসব দুঃখ-কষ্টকে সে আমল দিত না। পুরানো বাড়ীর কার্নিসের ফাঁকে গোলা-পায়রার ঝাঁক আর গিয়াছে–তাহার পরিবর্তে বাড়ীর কানাচে রাত্রিবেলা পেঁচার কর্কশ সুর শোনা যায় রাত দুপুরে, আমড়া গাছের মাথায় চাঁদ ওঠে, একা-একা ছেলে দুটি লইয়া এই শতস্মৃতিভরা বাড়ীতে থাকিতে তাহার বুকভাঙা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে, প্রতিদিন কলিকাতা হইতে আনা সেই পালঙ্কে শুইবার সময়।
রাত্রি নির্জন–বাড়ীটা ফাঁকা–কেহ কোথাও নাই আজ। দিনের বেলায় তবু কাজ লইয়া ভুলিয়া থাকা যায়, রাতের নির্জনতা যখন বুকে চাপিয়া বসে–তাহার বুক হু হু করে, শত্রু হাসাইবার ভয়ে যে কান্নার বেগ দিনমানে চাপিয়া রাখিতে হয়–রাতে তাহা আর বাধা মানে না।
হাতে বিশেষ পয়সা আর নাই–ভড়মশায়ের সাহায্যে সে ছোটখাটো খুচরা ব্যবসা চালাইতে লাগিল। মূলধন নাই, হাটবারে রাস্তার ধারে পাটের ফেটি কিনিয়া কোনদিন একমণ, কোনদিন বা কিছু বেশি মাল কৃষ্ণ দাঁয়ের আড়তে বিক্রি করিয়া নগদ আট আনা কি বারো আনা লাভ হয়, হাত-খরচটা একরূপে চলিয়া যায় তাহা হইতে।
মূলধনের অভাবে বেশি পরিমাণে খরিদ-বিক্রি করা চলিল না, দুর্দিনের বন্ধু ভড়মশায় অনেক চেষ্টা করিয়াও কোথাও বেশি পুঁজি জুটাইতে পারিলেন না।
একদিন নির্মল দেখা করিতে আসিল।
অনঙ্গ সন্তুষ্ট ছিল না নির্মলের উপর–তবুও জিজ্ঞাসা করিল–ওঁর খবর জানো ঠাকুরপো?
–কলকাতাতেই আছে, শচীনের কাছে শুনেচি।
-তুমি জানো ঠিকানা ঠাকুরপো? বাড়ীতে একবার আসতে বলো না ওঁকে। যা হবার হয়েচে, তা ভেবে আর কি হবে! বাড়ীতে এসে বসুন, আমি চালাবো, ওঁকে কিছু করতে হবে না।
-পাগল হয়েচো বৌদি। গদাধরদাকে চেনো না? বলে, মারি তো হাতী, লুটি তো ভাণ্ডার! সে এসে বসে তোমার ওই পাটের ফেটির ব্যবসা করবে? তা ছাড়া তার এখনো রাজ্যের দেনা, কলকাতা ছেড়ে আসবার জো নেই।
–কত টাকা দেনা ঠাকুরপো?
–তা অনেক। নালিশ হয়েচে তিন-চারটে–জেলে যেতে না হয়!
অনঙ্গ শিহরিয়া উঠিয়া বলিল–বলো কি ঠাকুরপো? এত দেনা হল কি করে? ছবি চললো না?
–সে নানা গোলমাল। যে মেয়েটির ওপর ভরসা করে ছবি তৈরি করা হচ্ছিলো, তার হয়ে গেল বিয়ে। সে আর ছবিতে নামলো না, অন্য একটি মেয়েকে দিয়ে সে পার্ট করানো হতে লাগলো– ছবি একরকম করে হয়ে গেল। কিন্তু সকলেই জেনে গিয়েছিল যে রেখা দেবী–মানে সে মেয়েটি এ-ছবিতে শেষ পর্যন্ত নেই–ছবি তেমন জোরে চললো না। গদাধর বড্ড ভুল করলে–একটি খুব নামজাদা অভিনেত্রী ইচ্ছে করে ছবিতে নামতে চেয়েছিল, গদাধর তাকে নেয় নি–শচীনের মুখে শুনলাম!
–কেন?
–তা কি করে বলবো? বোধ হয় মন-কষাকষি ছিল!
–আগে থেকে জানি নাকি তার সঙ্গে?
নির্মল হাসিয়া বলিল–খু-ব! কেন, তুমি কিছু জানো না বৌ ঠাকরুণ? তার কাছে তো গদাধর অনেক টাকা ধার করেচিল, সেও তো একজন বড় পাওনাদার। তার নাম শোভারাণী। আমি শচীনের কাছে শুনেচি, ভড়মশায় একবার সে দেনার সম্পর্কে মেয়েটির বাড়ী গিয়েছিল।
-তারপর কি হলো?
–টাকা কি কেউ ছাড়ে? সেও নালিশ করচে শুনচি। তারও তো রাগ আছে।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অনঙ্গ বলিল–এত কথা আমি জানিনে তো ঠাকুরপো। আমাকে কেউ বলেওনি। আমি না হয় গহনা বেচে তার দেনা শোধ করতাম।
নির্মল হাসিয়া বলিল–সে অনেক টাকা দেনা বৌ-ঠাকরুণ! তোমার গহনা ইদানীং যা ছিল, তা বেচে অত টাকা হবে কোথা থেকে? সে শুনেচি, হাজার চার-পাঁচ টাকা!
অনঙ্গ আকুল কণ্ঠে বলিল–হোকগে যত টাকা, তুমি একটা কাজ করো ঠাকুরপো–তুমি তাকে যে ক’রে পারো একবার এখানে এনে দাও। দেখিনি কতদিন–আমার মন যে কি হয়েচে, সে শুধু তুমি বলেই বলচি। এই উপকারটা করো তুমি। দেনা আমি যে ক’রে হোক, জমিজায়গা বেচে হোক, শোধ করে দেবো–আমি নিজে এখন ব্যবসা বুঝি–করচিও তো।
নির্মল হাসিয়া বলিল–তুমি জানো না বৌদি, তোমার ধারণা নেই। তুমি যা ভাবচো, তা নয়। দেনা বিশ হাজারের কম নয়–সে তুমি তোমার ওই সামান্য ব্যবসা করেও শোধ করতে পারবে না, জায়গা-জমি বেচেও পারবে না!
–তাহলে কি হবে ঠাকুরপো?
–কি হবে, কিছুই বুঝতে পারচি নে। আর কিছুদিন না গেলে…
নির্মল চলিয়া গেল। অনঙ্গ বসিয়া বসিয়া কত কি ভাবিল। সেদিন আর তাহার মুখে ভাত উঠিল না। ভড়মশায়কে ডাকাইয়া পরামর্শ করিতে বসিল। ভড়মশায় পাকা বিষয়ী লোক, সব শুনিয়া বলিলেন–এর তো কোনো কূলকিনেরা পাচ্চি নে বৌ-ঠাকরুণ!