পরদিন অনঙ্গ দুপুরে কলতলায় মাছ ধুইতেছে, হঠাৎ স্বামীকে বাড়ী ঢুকিতে দেখিয়া সে বিস্মিত হইল। গদাধর কাছে আসিয়া বলিলেন–কেমন আছো?
অনঙ্গ একদৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়াছিল। অনেকদিন দেখে নাই–প্রায় পনেরো-ষোলো দিন। স্বামীর স্বাস্থ্য ভালো হইয়াছে, চেহারায় গেঁয়ো-ভাবটা অনেকদিন হইতেই দূর হইয়াছিল–বেশ চমৎকার চেহারা ফুটিয়াছে।
তবুও অভিমানের নীরসতা কণ্ঠে আনিয়া সে বলিল–ভালো থাকি আর না থাকি, তোমার তাতে কি? দেখতে এসেছিলে একদিন, মরে গিয়েচে বাড়ীসুদ্ধ না বেঁচে আছে?
-তুমি আজকাল বড় রাগ করো। আমি কাজ নিয়ে বড় ব্যস্ত আছি, স্টুডিওতে খাই, স্টুডিওতে শুই, তাই সময় পাই নে–কিন্তু ভড়মশায়ের কাছে রোজই খবর পাচ্চি ফোনে–রোজ ফোন করি গদিতে।
–বেশ করো। না করলেই বা কি ক্ষতি?
–কার কথা বলছো–তোমার না আমার?
–দুজনেরই। যাক্, এখন কি মনে করে অসময়ে? খাওয়া হয় নি, তা মুখ দেখেই বুঝতে পারচি। ঘরে গিয়ে বসো, আমি মাছ কটা ধুয়ে আসছি।
একটু পরে অনঙ্গ ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, স্বামী ছেলেদের লইয়া গল্প করিতেছেন। অনঙ্গ বলিল–চা খাবে নাকি? এখনও রান্নার দেরি আছে কিন্তু!
গদাধর ব্যস্ত হইয়া বলিলেন–আমার দেরি করলে চলবে না। চা বরং একটু-করে দাও–আর আমি এসেছিলাম যে জন্যে…
অনঙ্গ বলিল–সে আমি শুনেচি, সে হবে না।
–টাকা তুমি দেবে বা অনঙ্গ? লক্ষ্মীটি, বড় বিপদে পড়েছি। একটা মেশিনের কিস্তির টাকা কাল দিতে হবে, নইলে তারা মেশিন উঠিয়ে নিয়ে যাবে–স্টুডিওর কাজ বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে লক্ষ্মীটি, অমত কোরো না। বড় আশা করে এসেছি।
গদাধরের চোখে মিনতির দৃষ্টি! অনঙ্গর মন এতটুকু দমিত না বা টলিত না, যদি স্বামী তম্বিতম্বি করিত বা রাগঝাল দেখাইত। কিন্তু স্বামীর অসহায় মিনতির দৃষ্টি তাহার মতিভ্রম ঘটাইল। সে নিজেকে দৃঢ় রাখিতে পারিল না।
গদাধর টাকা আদায় করিয়া চলিয়া গেলেন।
এই টাকা দেওয়ার মুহূর্তের দুর্বলতার জন্য অনঙ্গকে পরে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল।
মাসখানেক পরে আদালতের বেলিফ আসিয়া বাড়ী শিল করিয়া গেল। বন্ধকী বাড়ী, পাছে বেনামী হস্তান্তর হয়, তাই মহাজন ডিক্রির আগেই কোর্ট হইতে আটক রাখিবার ব্যবস্থা করিয়াছে।
গদাধরের অবস্থা যে কত খারাপ হইয়া পড়িয়াছে, ভড়মশায় তাহা ইদানীং বেশ ভালো করিয়াই জানিতে পারিয়াছিলেন। আড়তের ঠিকানায় বহু পাওনাদার আসিয়া জুটিতে লাগিল। ভড়মশায় পাকা লোক–তাহাদের ভাগাইয়া দিলেন। এ ফার্মের সঙ্গে ও-সব দেনার সম্বন্ধ কি? অনেকে শাসাইয়া চলিয়া গেল।
কিন্তু যেদিন খবর পাওয়া গেল যে, আদালতের বেলিফ বাড়ী সিল করিবে, সেদিন ভড়মশায় অনঙ্গকে গিয়া সব খুলিয়া বলিলেন।
অনঙ্গ বলিল–আমাদের কি উপায় হবে?
–একটা ভাড়াটে-বাড়ী আজ রাত্রের মধ্যেই দেখি, কাল সেখানে উঠে যাওয়া যাক।
–তার চেয়ে বলুন, দেশে ফিরে যাই ভড়মশায়। সেখানে গেলে আমার মন ভালো থাকবে।
–এই অবস্থায় সেখানে যাবেন বৌ-ঠাকরুণ? লোকে হাসবে না?
-হাসুক ভড়মশায়। আমার স্বামীর, আমার শ্বশুরের ভিটেতে আমি না খেয়ে একবেলা পড়ে থাকলেও আমার কোনো অপমান নেই। সেখানে সজনে-শাক সেদ্ধ করে খেয়েও একটা দিন চলে। যাবে, এখানে তা হবে না। আপনি চলুন দেশে।
–আমারও তাই মত বৌ-ঠাকরুণ। আপনার যদি তাতে মন না দমে, আজই চলুন না কেন?
.
০৮.
অনেকদিন পরে অনঙ্গ আবার দেশের বাড়ীতে ফিরিল।
গত চার বছরের বর্ষার জল পাইয়া দু’খানা ছাদ বসিয়া গিয়াছে, উঠানে ভাঁটশেওড়ার বন, পাঁচিলে ও কার্নিসে বনমূলা ও চিচ্চিড়ের ঝাড়, রোয়াকে ও দেওয়ালের গায়ে প্রতিবেশীরা ঘুঁটে দিয়াছে। দু’একজোড়া জানালার কবাট কে খুলিয়া লইয়া গিয়াছে বেওয়ারিশ মাল বিবেচনায়। বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া অনঙ্গ চোখের জল রাখিতে পারিল না।
একটা কুলুঙ্গিতে অনঙ্গর শাশুড়ী লক্ষ্মীর বাটা রাখিতেন, শাশুড়ীর নিজের হাতের সিঁদুরের কৌটার পুতুল এখনও কুলুঙ্গির ভিতরে আঁকা। যে খাটে অনঙ্গ নববধূরূপে ফুলশয্যার রাত্রি যাপন করিয়াছিল, পশ্চিমের ঘরে সে প্রকাণ্ড সেকেলে কাঁঠাল কাঠের তক্তপোশখানা উইয়ে-খাওয়া অবস্থায় এখনও বর্তমান।
বাড়ী আসিয়া নামিবার কিছু পরে, পাশের বাড়ীর বড়-তরফের কর্ত্রী-ঠাকরুণ এ-বাড়ী দেখিতে আসিলেন। অনঙ্গ তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–ভালো আছো দিদি? বট্ঠাকুর ভালো, ছেলেপিলে সব…
–হ্যাঁ তা সব এক রকম–কিন্তু বড় রোগা হয়ে গেছিস ছোটবৌ। আহা, শচীনের (ইনি শচীনের মা) কাছে সব শুনলাম। তা ঠাকুরপো যে কলকাতায় গিয়ে এ-রকম করে উচ্ছনে যাবে, তা কে জানতো! শুনলাম নাকি এক মাগী নাচওয়ালী না কি ওই বলে আজকাল–তাকে নিয়ে কি ঢলাঢলি, কি কাণ্ড! একেবারে পথে বসিয়ে দিলে তোদের ছোটবৌ, কিছু নেই, বাড়ীখানা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল গো! আহা-হা…
অনঙ্গর চিত্ত জ্বলিয়া গেল বড়বৌয়ের কথার ধরণে। সহানুভূতি দেখাইবার ছুতায় আসিয়া এ একপ্রকার গায়ের ঝাল ঝাড়া আর কি! বড়-তরফ যখন যে গরীব সেই গরীবই থাকিল, ছোট তরফের তখন অত বাড় বাড়িয়া কলকাতায় বাড়ী কেনা, আড়ত ও ছবি তুলিবার কোম্পানি খোলা–এসব কেন? কথায় বলে, ‘অত বড় বেড়োনাকো ঝড়ে ভেঙে যাবে’–এখন কেমন?