শোভা হাসিয়া বলিল–বরাবর আছি। ঘাড় থেকে ভূত নেমে গেছে।
অলকা খুশী হইয়া বলিল–নেমেছে? সত্যি নেমেচে ভাই?
–নেমেচে। আচ্ছা, চলি তবে।
শচীন অলকার মুখে সংবাদটা শুনিয়া নিতান্তই খুশী হইয়া উঠিল। সেইদিনই সে শোভার ওখানে গেল। মনের উল্লাস চাপিতে না পারিয়া কথায়-কথায় বলিল–তারপর, একটা কথা আজ অলকা গুপ্তার মুখে শুনে বড় আনন্দ হলো শোভা!
–কি কথা? কার সম্বন্ধে?
–তোমার সম্বন্ধেই।
শোভা বিস্ময়ের সুরে বলিল–আমার সম্বন্ধে? কি কথা, শুনি?
–যদিও আমি জানি নে তুমি কেন ঝোঁক ধরেছিলে ভারতী ফিল্মে যাবার জন্যে–তবুও শুনে সুখী হলাম যে, সে ভূত তোমার ঘাড় থেকে নেমে গিয়েচে!
শোভা গম্ভীর মুখে বলিল–ভূত নামে নি নামিয়ে দিয়েচে– জানেন?
শচীন বুঝিতে না পারার ভঙ্গিতে চাহিয়া বলিল–মানে?
–মানে, এই দেখুন চিঠি!
শোভা শচীনের হাতে যে চিঠিখানা দিল, সেখানা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত–টাইপ করা ইংরেজি চিঠি। তাতে ভারতী ফিল্ম স্টুডিও’র কর্তৃপক্ষ দুঃখের সঙ্গে জানাইতেছেন যে শোভারাণী মিত্রকে বর্তমানে তাঁহাদের স্টুডিওতে লওয়া সম্ভব হইবে না!
শচীন নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারিল না। ফিল্ম গগনের অত্যুজ্জ্বল ঝকঝকে তারকা মিস্ শোভারাণী মিত্র দীনভাবে চিঠি লিখিয়া চাকুরী প্রার্থনা করিতে গিয়াছিল ভারতী ফিল্ম কোম্পানির মত তৃতীয় শ্রেণীর চিত্র প্রতিষ্ঠানে, আর তাহারা কিনা…
ব্যাপারটা শচীন ধারণা করিতেই পারিল না। শোভারাণীর মুখের দিকে চাহিয়া সে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস করিল না। তাহার মনে হইল, শোভা এ-সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করিতে অনিচ্ছুক। তবুও এ এমনই একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, যাহা মন হইতে যাইতে চায় না।
শচীন বাসায় ফিরিবার পথে কতবার জিনিসটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিল। শোভার মত তেজী মেয়ে, সচ্ছল অবস্থার অভিনেত্রী রূপসী তরুণী–কি বুঝিয়া কিসের জন্য এ হাস্যকর ঘটনার অবতারণা করিতে গেল? কোনো মানে হয় ইহার? যার পায়ের ধূলা পাইলে ভারতী স্টুডিওর মত কতশত ছবি-তোলা কোম্পানি কৃতকৃতার্থ হইয়া যাইত–তাহাকে কিনা চিঠি লিখিয়া জানাইয়া দিল, এখানে তোমাকে চাকুরী দেওয়া সম্ভব হইবে না!
সাহস করিয়া স্টুডিওর বন্ধুবান্ধবের কাছেও এমন মজার কথাটা শচীন বলিতে সাহস করিল না। শোভার কানে উঠিলে সে চটিবে।
ভড়মশায় পাটের কাজ ভালো ভাবেই চালাইতেছিলেন। আড়তের ক্যাশ হইতে মাসে মাসে টাকা যদি তুলিয়া না লওয়া হইত, তবে ভড়মশায়ের সুনিপুণ পরিচালনায় আড়তের কোনোই ক্ষতি হইত না। কিন্তু গদাধর বারবার টাকা তুলিয়া আড়তের খাতা শুধু হাওলাতী হিসাবে ভর্তি করিয়া ফেলিলেন। কাজে মন্দা দেখা দিল।
কার্তিক মাসের প্রথম। নতুন পাট কিনিবার মরসুমে পাঁচ ছ’হাজার টাকা বিভিন্ন মোকামে ছড়ানো ছিল–এইবার সেখান হইতে মাল আনিবার ব্যবস্থা করিতে হয়। এইসময় ভড়মশায় একটা মোটা অর্ডার পাইলেন মিল হইতে–মাল যোগান দিতে পারিলে দু’পয়সা লাভ হইবে–কিন্তু টাকা নাই। ভড়মশায় নানাদিকে বহু চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য হইয়া শেষে অনঙ্গর সহিত পরামর্শ করিতে গেলেন। গত চার-পাঁচ মাস তিনি অনঙ্গকে জিজ্ঞাসা না করিয়া, তাঁহার সহিত পরামর্শ না করিয়া কোনো কাজ করেন না। অনঙ্গ যে এত ভালো ব্যবসা বোঝে, ভড়মশায় দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছেন। বৌ-ঠাকরুণের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা বাড়িয়া উঠিয়াছে। অনঙ্গ শুনিয়া বলিল–ব্যাঙ্ক থেকে কিছু নেওয়া চলবে না?
–তা হবে না বৌ-ঠাকরুণ, অনেক নেওয়া আছে, আর দেবে না!
–মোকাম থেকে পাট আনিয়ে নিন, আর আমার গহনা যা আছে বিক্রি করুন।
–তোমার যা গহনা এখনও আছে, বৌ-ঠাকুরণ, তাতে আর আমি হাত দিতে চাই নে। পাটের ব্যবসা–জুয়ো খেলা, হেরে। গেলে তোমার গহনাগুলো যাবে।
কিন্তু অনঙ্গ শুনিল না। সেও নিতান্ত ভীতু-ধরণের মেয়ে নয়, এখন তাহার পিতৃবংশের যদিও কেহই নাই–কেবল এক বখাটে ভাই ছাড়া–একসময়ে তাহার বাবাও বড় ব্যবসায়ী ছিলেন– ব্যবসাদারের দিল আছে তাহার মধ্যে। সে জোর করিয়া গহনা বিক্রয় করাইয়া সেই টাকায় মালের যোগান দিল। কিছু টাকাও লাভ হইল।
যেদিন মিলের চেক ব্যাঙ্কে ভাঙানো হইবে, সেদিন গদাধর আসিয়া এক হাজার টাকা চাহিয়া বসিলেন। তিনি আজকাল বাড়ীতে বড়-একটা আসেন না। কোথায় রাত কাটান, কিভাবে থাকেন, ভড়মশায় বা অনঙ্গ জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করে নাই। এবার কিন্তু ভড়মশায় শক্ত হইয়া বলিলেন–বাবু, এ টাকা বৌ ঠাকরুণের গহনা-বেচা টাকা! এ থেকে আপনাকে দিতে গেলে, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে–তাঁর হুকুম ভিন্ন দিতে পারি নে!
গদাধর ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন–আড়ত আমার নামে, আপনার বৌ-ঠাকরুণের নামে নয়। আমার আড়তে অপরের টাকা খাটে কোন হিসেবে?
–সে কথাটা বাবু আপনি গিয়ে তাঁকে বলুন–আমি এর জবাব দিতে পারবো না।
–আপনি টাকা দিয়ে দিন, আমার বড্ড দরকার, পাওনাদারে ছিঁড়ে খাচ্চে। আমি এখন যাই, কাল সকালে আবার আসবো।
ভড়মশায় অনঙ্গকে গিয়া কথাটা জানাইলেন। অনঙ্গ টাকা দিতে রাজী হইল না। তাহার ও তাহার ছেলেদের দশা কি হইবে, সে-কথা স্বামী কি একবার ভাবিয়া দেখিয়াছেন? ওই দেড় হাজার টাকা ভরসা! বাড়ীভাড়া দিতে হয় না–তাই এক-রকমে সংসার চলিবে কিছুদিন ওই টাকায়।