–কেন, কি হলো?
–রেখা ঝগড়া করে ছেড়ে দিয়েচে। তার সঙ্গে নাকি কোনো লেখাপড়া ছিল না এবার। সে সুবিধে পেয়ে গেছে–এখন নাকি শুনচি, রেখা বিয়ে করবে কাকে, সব ঠিক হয়ে গিয়েচে। যাকে বিয়ে করবে, রেখাকে সে ছবিতে নামতে দেবে না–নানা গোলমাল। রেখা চলে গেলে তার সঙ্গে সুষমাও চলে আসবে। ডিস্ট্রিবিউটার অনেক টাকা ঢেলেচে-তারা নালিশ করবে গদাধরের নামে, বেচারী এবার একেবারে মারা যাবে তাহ’লে–বাজারসুদ্ধ দেনা।
শোভা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল–গদাধরবাবু এখন কোথায়?
–সেই বাড়ীতেই আছে। তবে শুনচি, বাড়ী বন্ধক। বাড়ী থাকবে না, যতদূর মনে হচ্চে!
–বড্ড চাল বাড়িয়েছিল, এবার একেবারে ধনে-প্রাণে গেল। মানে, তুই ছিলি বাবু পাটের আড়তদার, করতে গেলি ফিল্মের ব্যবসা, যাকে যা না সাজে–বোকা পেয়ে পাঁচজনে মাথায় হাত বুলিয়ে–বুঝলে?
শোভা একটু অন্যমনস্ক হইয়া অন্যদিকে চাহিয়া ছিল, শচীনের শেষদিকের কথার মধ্যে কতকটা মজা দেখিবার উল্লাসের সুর ধ্বনিত হওয়ায় সে হঠাৎ ঝাঁঝিয়া উঠিয়া তীব্র বিরক্তির সুরে বলিল–আ-আঃ, কেন মিছিমিছি বাজে বকচেন একজনের নামে? আপনার গাঁয়ের লোক, আত্মীয় না? এত আমোদ কিসের তবে?
শচীনের কণ্ঠ হইতে আমোদের সুর এক মুহূর্তে উবিয়া গেল, সে শোভার দিকে চাহিয়া বলিল–না, তাই বলচি, তাই বলচি– লোকটার মধ্যে যে কেবল নিছক বেকুবি…
–আবার ওই সব কথা! লোকটার মধ্যে যাই থাকুক, সে-সব আলোচনা এখানে করবার কোনো দরকার নেই।
শোভার গলার সুরে রাগ বেশ সুস্পষ্ট ফুটিয়া উঠিল।
ইহার পর শচীন এ-সম্বন্ধে কোনো কথা তুলিতে আর সাহস করিল না–কিন্তু সে আশ্চর্য হইল মনে মনে। সে জানিত, শোভা একগাদা টাকা ধার দিয়েচে গদাধরকে, সে-ধারের একটা পয়সা এখনও সে পায় নাই…!
তাহাদের স্টুডিওর সঙ্গে টেক্কা দিয়া গদাধর ছবি তুলিতে গিয়া বিপন্ন হইয়াছে–বিশেষতঃ রেখার পূর্ব ইতিহাস যাহাই হউক, এখন যে অভিনয়ক্ষেত্রে সে শোভার প্রতিদ্বন্দিনী হইয়া উঠিতেছে দিন-দিন–এ-সব বিবেচনা করিয়া দেখিলে গদাধরের দুর্দশা তো পরম উপভোগ্য বস্তু–নিতান্ত মুখরোচক গল্পের উপকরণ!
কি জানি, মেয়েমানুষের মেজাজ যে কখন কি, শচীন অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহা বুঝিতে পারিল না।
কিন্তু ইহা অপেক্ষাও আরো ভীষণ অবাক হইয়া গেল সে, দিনকতক পরে একটি কথা শুনিয়া।
একদিন তাহাদের স্টুডিওর একটি মেয়ে, শোভার বিশেষ বন্ধু, শচীনকে ডাকিয়া বলিল–শুনুন, আপনাকে একটি কথা বলি।
–এই যে অলকা দেবী–ভালো তো? কি কথা?
–কথাটা খুব গোপনে রাখবেন কিন্তু। আপনি শোভাকে জানেন অনেকদিন থেকে, তাই আপনার কাছে বলচি, যদি আপনার দ্বারা কিছু কাজ হয়।
শচীন বিস্ময়ের সুরে বলিল–শোভার সম্বন্ধে কথা! আমায় দিয়ে কি উপকার–বুঝতে পারচি নে!
–শোভা এ স্টুডিও ছেড়ে ভারতী ফিল্ম কোম্পানিতে ঢোকবার চেষ্টা করছে–জানেন না? সেখানে চিঠি লিখেচে।
শচীন মূঢ়ের মত দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে চাহিয়া অবিশ্বাসের সুরে বলিল—‘ভারতী ফিল্ম কোম্পানি’? সে তো আমাদের গদাধরের!
–সে-সব জানি নে মশাই, ওই যে যাদের ‘ওলট-পালট’ বলে ছবিটি একেবারে মার খেয়ে গেল।
–বুঝেচি, জানি–তারপর? সেখানে যেতে চাইচে শোভা?
-যেতে চাইচে মানে, চিঠি লিখেচে..দরখাস্ত করেচে…যাকে বলে মশাই-যাওয়ার জন্যে ক্ষেপে উঠেছে!
তার মানে?
–আমি কিছু বুঝতে পারচি নে। সেইজন্যেই আপনার কাছে বলা।
–এখানে ডিরেকটরের সঙ্গে ঝগড়া হলো নাকি?
–সে-সব না। ওর সঙ্গে আবার ঝগড়া হবে কার? আমি কিছু বুঝচি নে। ভারতী ফিল্ম কোম্পানি একটা ফিল্ম বার করে যা নাম কিনেচে–তাতে ওদের ছবি বাজারে চলবে না। যতদূর আমি জানি, ওদের পয়সা-কড়িরও তেমন জোর নেই–ওখানে শোভা কেন যেতে চাইছে, এ আমার মাথায় আসে না কিছুতেই।
–আপনি বুঝিয়ে বলে দেখুন না, অলকা দেবী?
–আমি কি না বুঝিয়েছি? অনেক বারণ করেচি–ওর ব্যাপার জানেন তো, যখন যা গোঁ ধরবে, তা না করে ছাড়বে না। খেয়ালী মেজাজের মেয়ে–এখানে ওর কন্ট্রাক্ট রয়েচে এক বছরের। এরা নালিশ করে দেবে, তখন কি হবে?
–সে তো জানি।
–আবার বুঝেসুঝে চলতেও ওর জোড়া নেই! যেখানে যখন বুঝতে চাইবে সেখানে অঙ্ক কষবে–অথচ কেন অবুঝ হলো। এমন যে…
–হুঁ!
–আপনি একবার বুঝিয়ে বলুন না শচীনবাবু। আমার মনে হয়…
–আচ্ছা দেখি, কতদূর কি হয়।
শচীন মুখে বলিল বটে, কিন্তু সে সাহস করিয়া শোভার কাছে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে পারিল না–আজ কাল করিয়া প্রায় দিনপনেরো কাটিল। শোভা কিন্তু স্টুডিও ছাড়িয়া কোথাও গেল না। দিনের পর দিন রীতিমত চাকুরী করিয়া যাইতে লাগিল। তবে শচীন লক্ষ্য করিল, শোভার মুখ ভার-ভার, সে কোনোখানেই তেমন মেলামেশা করে না লোকের সঙ্গে, তবু আগে যাহাও একটু-আধটু করিত, এখন একেবারেই তা করে না। নিজের গাড়ীতে স্টুডিওতে ঢোকে, কাজ শেষ করিয়া গাড়ীতেই বাহির হইয়া যায়।
সেদিন তাহার সঙ্গে অল্প কয়েক মিনিটের জন্য কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল অলকার।
গাড়ীতে উঠিতে যাইবে শোভা, সামনে অলকাকে দেখিয়া সে একটু অপেক্ষা করিল।
অলকা বলিল–কি, আজকাল যে বড় ব্যস্ত, কেমন আছো শোভা?
–ভালোই আছি। তুই যাস নে কেন আমার ওখানে?
–একটু ব্যস্ত ছিলাম ভাই–যাবো শীগগির একদিন। যাক, আর কদিন আছো আমাদের এখানে?