শোভা? একটা যা হয় বলো আমায়!
–কি বলবো, বলুন? ছবি মার খেয়ে যাবে আমি আগেই জানতাম।
–সে তো বুঝলাম! যা হবার হয়েচে–এখন আমায় বাঁচাও।
–আমি কি করতে পারি যে আমার কাছে এসেচেন?
–আরও কিছু টাকা দাও, আর এ ছবিতে নামো!
–কোনোটাই হবে না আমার দ্বারা। আমায় এত বোকা পেয়েছেন?
–কেন হবে না শোভা? আমায় উদ্ধার করো। প্রথম ছবি! তেমন হয়নি হয়তো, সেছবি থেকে অনেক কিছু বুঝে নিয়েছি– আর একটি বার…
শোভা এবার রাগ করিল। গলার সুর তাহার কখনো বিশেষ চড়ে না, একটু চড়িলেই বুঝিতে হইবে সে রাগ করিয়াছে। সে চড়া গলায় বলিল–আমার টাকা ফেলে দিন, মিটে গেল–আমি উদ্ধার করবার কে? আমার কথা শুনেচিলেন আপনি? আমি বলি নি যে ফিল্ম কোম্পানি চালানো আপনার কর্ম নয়? আপনি যার কিছু বোঝেন না, তার মধ্যে…
গদাধর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁরও গলায় রাগের সুর আসিয়া গেল। হয়তো রাগের সঙ্গে দুঃখ মেশানো ছিল।
বলিলেন–বেশ, তুমি দিও না টাকা। না দিলেই বা কি করতে পারি আমি? তবে আমি ছবি একখানা করবোই। দেখি অন্য জায়গায় চেষ্টা–আচ্ছা, আসি তাহলে।
গদাধর বাহির হইয়া সিঁড়ি দিয়া নামিতে যাইবেন–শোভা ডাকিয়া বলিল–বা রে, চলে গেলেই হলো? শুনে যান–আমার টাকার একটা ব্যবস্থা করুন!
–হবে, হবে, শীগগির হবে।
–শুনুন, শুনুন!
-কি?
–কোম্পানি করবেনই তবে? আপনার সর্বনাশ হোলেও শুনবেন না?
গদাধর বোধহয় খুব চটিয়া গিয়াছিলেন। সিঁড়ি বাহিয়া তরতর করিয়া নামিতে নামিতে বলিলেন–না, সে তো বলেচি অনেকবার। কতবার আর বলবো? ও আমি না বুঝে করতে যাচ্চি নে। আমায় কারো শেখাতে হবে না।
গদাধর অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
শোভা অন্যমনস্ক হইয়া কতক্ষণ সিঁড়ির মুখে দাঁড়াইয়া রহিল। সে এমন একধরণের মানুষ দেখিল, যাহা সে সচরাচর দেখে না! অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া কি ভাবিয়া সে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিল।
একটু পরে শচীন একখানা বড় মোটর-ভর্তি বন্ধুবান্ধব লইয়া হাজির হইল। সকলে কোলাহল করিতে করিতে উপরে উঠিয়া আসিল। ইহাদের মধ্যে একজনকে শোভা চেনে–উড়িষ্যার কোনো এক দেশীয়-রাজ্যের রাজকুমার, পূর্বে একদিন শোভাদের স্টুডিও দেখিতে গিয়াছিলেন। পৈতৃক অর্থ উড়াইবার তীর্থস্থান কলিকাতা ধামে গত পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যে কুমারবাহাদুর প্রায় বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা অন্তরীক্ষে অদৃশ্য করিয়া দিয়া স্বীয় দরাজ-হাতের ও রাজোচিত মনের পরিচয় দিয়াছেন!
কুমার-বাহাদুর আগাইয়া আসিয়া পরিষ্কার বাংলায় বলিলেন– নমস্কার, মিস্ মিত্র, কেমন আছেন? এলাম একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে!
শোভা নিস্পৃহভাবে হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া বলিল–ভালো আছি।
শচীন পিছন হইতে বলিল–কুমার-বাহাদুর এসেছিলেন তোমায় নিয়ে যেতে–উনি মস্ত বড় পার্টি দিচ্ছেন ক্যাসানোভায় আজ সাতটা থেকে। এখন একবার সবাই মিলে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের…
শোভা বলিল–আমার শরীর ভালো নয়।
কুমার-বাহাদুর বেশ সুপুরুষ, তরুণবয়স্ক, সাহেবি পোষাকপরা, কেতাকায়দা-দুরস্ত। সাহেবিয়ানাকে যতদূর নকল করা সম্ভব একজন অর্ধশিক্ষিত দেশী লোকের পক্ষে–তাহার ত্রুটি তিনি রাখেন নাই। অসুখের কথা শোভার মুখ হইতে বাহির হইবামাত্র তিনি তটস্থ হইয়া বলিলেন–আপনার অসুখ হয়েচে, মিস মিত্র? গাড়িতে করে যেতে পারবেন না?
শোভা বিরুক্তির সুরে বলিল–আজ্ঞে না, মাপ করবেন।
শচীন দলবল লইয়া অগত্যা বিদায় লইল।
দিন-দুই পরে শোভা নিজের স্টুডিওতে হঠাৎ গদাধর ও রেখাকে দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। প্রথমে তাহার মনে হইল, তাহারই জন্য উহারা আসিয়াছে। শেষে দেখিল, তাহা নয়, অন্য কি-একটা কাজে আসিয়া থাকিবে–অন্য কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর কাছে। শোভা সেটে দাঁড়াইবার পূর্বে সাজগোজ করিয়াছে, মাথায় মুকুট, হাতে সেকেলে তাড়, বালা, চূড়–বাহুতে নিমফল-ঝোলানো রাংতার গিল্টি-করা বাজু–পৌরাণিক চিত্রের ব্যাপার। তবুও সে একজন ছোকরা চাকরকে বলিল–এই, ওই বাবু আর মাইজিকে ডেকে নিয়ে আয় তো!
তাহার বুকের মধ্যে একটি অনুভূতি, যাহা শোভা কখনো অনুভব করে নাই পূর্বে! রেখাকে গদাধরের সঙ্গে বেড়াইতে দেখিয়াই কি এরূপ হইল? সম্ভব নয়। উহারা যাহা খুশি করিতে পারে, তাহার তাহাতে কিছুই আসে যায় না। তবে লোকটির মধ্যে তেজ আছে, সাহস আছে–বেশির ভাগ পুরুষই তাহার কাছে আসিয়া কেমন যেন হইয়া যায়; মেরুদণ্ডবিহীন মোমের পুতুলদের দুদণ্ড চালানো যাইতে পারে, কিন্তু তাহাতে আনন্দ নাই, জয়ের গর্ব সেখানে বড়ই ক্ষণস্থায়ী। শাণিত ছোরার আগার সাহায্যে কচুগাছের ডগা কাটা! ছোরার অপমান হয় না তাতে?
গদাধরবাবুর কাছে গিয়া চাকরটি কি বলিল, গদাধরকে আঙুল দিয়া তাহার দিকে দেখাইল চাকরটা–এ পর্যন্ত শোভা দেখিল। তাহার বুকের মধ্যে ভীষণ ঢিপঢিপ শুরু হইল অকস্মাৎ-বুকের রক্ত যেন চাইয়া উপরের দিকে উঠিতেছে। ঠিক সেই সময় ডাক পড়িল–গদাধরের সঙ্গে শোভার আর দেখা হইল না সেদিন।
মাস পাঁচ-ছয় কাটিল। পুনরায় পূজা আসিল, চলিয়াও গেল। কার্তিক মাসের শেষের দিকে একদিন শচীন কথায়-কথায় বলিল–শুনেচো, গদাধর আমাদের বড় বিপদে পড়েছে!
শোভা জিজ্ঞাসা করিল–কি হয়েচে?
–ওর সেই ছবি অর্ধেক হয়ে আর হলো না–কতকগুলো টাকা নষ্ট হলো। এবার একেবারে মারা পড়বে!