ইতিমধ্যে আরও মুশকিল হইল।
পুনরায় একখানা ছবি তোলা হইবে বলিয়া আর্টিস্টদের সঙ্গে, যে বাগানবাড়ী ভাড়া লইয়া স্টুডিও খোলা হইয়াছিল–তাহাদের সঙ্গে এবং মেসিন-বিক্রেতাদের সঙ্গে এক বৎসরের কন্ট্রাক্ট করা হইয়াছিল–ছবি তুলিবার দেরি হইতেছে দেখিয়া তাহারা চুক্তিমত টাকার তাগাদ শুরু করিল। কেহ কেহ অন্যথায় নালিশ করিবার ভয়ও দেখাইল।
গদাধর যে সাত হাজার টাকা পাইয়াছিলেন–তাহার অনেক টাকাই গেল এই দলের মধ্যে কিছু কিছু করিয়া দিয়া তাহাদিগকে আপাততঃ শান্ত করিতে। শোভার টাকা শোধ দেওয়ার কোনো পন্থাই হইল না। বাজারেও এখন প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা দেনা।
অঘোরবাবু উপদেশ দিলেন, ইহার একমাত্র প্রতিকার নতুন একখানা ছবি তৈরি করা। আরও টাকা চাই-গদাধর ডিস্ট্রিবিউটারদের সঙ্গে কথা চালাইলেন। তাহারা এ ছবিতে বিশেষ লোকসান খায় নাই, নিজেদের টাকা প্রায় সব উঠাইয়া লইয়াছিল–তাহারা বাকি ত্রিশ হাজার টাকা দিতে রাজী হইল– কিন্তু গদাধরকে ত্রিশ হাজার বাহির করিতেই হইবে। ষাট হাজার টাকার কমে ছবি হইবে না। অঘোরবাবু উৎসাহ দিলেন, ছবি করিতেই হইবে। দু’একখানা ছবি অমন হইয়া থাকে।
৭-৮. সামনের হপ্তাতেই কাজ
সামনের হপ্তাতেই কাজ আরম্ভ করা দরকার–কিছু টাকা চাই।
গদাধর ভড়মশায়কে বলিলেন–ক্যাশে কত টাকা আছে?
–হাজার-পনেরো।
–আর মোকামে?
–প্রায় সাত হাজার।
–ক্যাশের টাকাটা আমাকে দিতে হবে। আপনি বন্দোবস্ত করুন–দু’চার দিনের মধ্যে দরকার।
ভড়মশায় মৃদু প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন–ক্যাশের টাকা দিলে মিলের অর্ডারী মাল কিনবো কি দিয়ে বাবু? ক্যাশের টাকা হাতছাড়া কড়া উচিত হবে না। মিলওয়ালাদের দু’হাজার গাঁটের অর্ডার নেওয়া হয়েচে–মোকামে অত মাল নেই। নগদে কিনতে হবে। এদিকে মহাজনের ঘরে আর বছরের দেনা শোধ হয়নি– তাদেরও কিছু দিতে হবে।
–হাজার-পাঁচেক রেখে, হাজার দশেক দিন আমায়।
ভড়মশায় আর কিছু বলিতে সাহস করিলেন না, কিন্তু মনে মনে প্রমাদ গণিলেন। ক্যাশের টাকা ভাঙিয়া বাবু কি সেই ছবি তোলার ব্যবসায়ে ফেলিবেন? এবার যে ছবি তোলা হইল, তাহাতে যদি লাভ হইত, তবে পুনরায় টাকার দরকার হইবে কেন বাবুর? এ কি রকম ব্যবসা? ভড়মশায় গিয়া অনঙ্গকে সব খুলিয়া বলিলেন।
অনঙ্গ কাঁদিয়া বলিল–কি হবে ভড়মশায়? তাও যায় যাক– আমরা দেশে ফিরে নুনভাত খেয়ে থাকবো, আপনি ওঁকে ফেরান।
সেদিন অনঙ্গ স্বামীকে বলিল–দ্যাখো, একটা কথা বলি। আমি কোনো কথা এতদিন বলি নি বা তুমিও আমার কাছে কিছু বলো নি। কিন্তু শুনলুম, তুমি টাকা নিয়ে ছবি তৈরির ব্যবসা করচো– তাতে লোকসান খেয়েও আবার তাই করতে চাইচো। এ-সব কি ভালো?
গদাধর বলিলেন–তুমি বুঝতে পারচো না অনঙ্গ। এ-সব কথা তোমায় বলেচে ওই বুড়োটা–না? ও এ-সবের কি বোঝে যে, এর মধ্যে কথা বলতে যায়! ছবিতে লোকসান হয়েচে সত্যি কথা– কিন্তু আর-একখানা দিয়ে আগের লোকসান উঠিয়ে আনবো। ব্যবসার এই মজা। ব্যবসাদার যে হবে, তার দিল চাই খুব বড়–সাহস চাই খুব। পুঁটি মাছের প্রাণ নিয়ে ব্যবসায় বড় হওয়া যায় না অনঙ্গ…হারি বা জিতি! আমার কি বুদ্ধি নেই ভাবচো? সব বুঝি আমি। এ সবের মধ্যে তুমি মেয়েমানুষ, থাকতে যেও না।
–বোঝো যদি, তবে লোকসান খেলে কেন?
–হার-জিৎ সব কাজেরই আছে, তাতে কি? বলেচি তো তুমি এ-সব বুঝবে না!
অনঙ্গ চোখের জল ফেলিয়া বলিল–আমাদের মেলা টাকার দরকার নেই–চলো আমরা দেশে ফিরে যাই। বেশ ছিলাম সেখানে–এখানে এসে অনেক টাকা হয়ে আমাদের কি হবে? সারাদিনের মধ্যে তোমার একবার দেখা পাই নে, সর্বদা কাজে ব্যস্ত থাকো–দুটো খেতে আসবার সময় পর্যন্ত পাও না! সেখানে থাকলে তবুও দু’বেলা দেখতে পেতাম তোমাকে। আমার মন যে কি হু-হু করে, সে কথা…
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–অত ঘরবোলা হয়ে ছিলুম বলেই সেখানে ব্যবসাতে উন্নতি করতে পারিনি অনঙ্গ। ও ছিল গেরস্ত আড়তদারের ব্যবসা। দিন কেনা, দিন বেচা-লোকসানও নেই, লাভও বেশি নেই। ওতে বড়মানুষ হওয়া যায় না।
–বড়মানুষ হয়ে আমাদের দরকার নেই। লক্ষ্মীটি চলো, গাঁয়ে ফিরে যাই। আমরা কি কিছু কম সুখে ছিলাম সেখানে, না খেতে পাচ্ছিলাম না?
গদাধর এইবার স্পষ্টই বিরক্ত হইলেন–কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করা তাঁর স্বভাব নয়–চুপ করিয়া রহিলেন।
অনঙ্গ বলিল–ওগো, আমায় একবার দেশে নিয়ে চলো না– একদিনের জন্যে!
–কেন? গিয়ে কি হবে এখন?
–দশঘরায় বন-বিবির থানে পুজো মানত ছিল–দিয়ে আসবো।
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–অর্থাৎ তোমার পুজো মানত আরম্ভ হয়ে গিয়েচে এরি মধ্যে!
–সে জন্যে না, তুমি অমত কোরো না..লক্ষ্মীটি…সামনের মঙ্গলবার চলো দেশে যাই–দু’দিন থাকবো মোটে।
–পাগল! এখন আমার সময় নেই, ওসব এখন থাক গে।
সেদিন সন্ধ্যার সময় গদাধর শোভারাণীর বাড়ী গেলেন–ফোন করিয়া পূর্বেই যাইবার কথা বলিয়াছিলেন।
শোভা বলিল–কি খবর?
–অনেক কথা আছে। খুব বিপদে পড়ে এসেচি তোমার কাছে। তুমি যদি অভয় দাও…
–অত ভঙ্গিতে শোনবার সময় নেই আমার। কি হয়েচে বলুন না!
গদাধর নিজের অবস্থা সব খুলিয়া বলিলেন। কিছু টাকার দরকার এখনই। কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না?
বলিলেন–একটা-কিছু করতেই হবে শোভা। বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি। আর একটা অনুরোধ আমার, এ-ছবিতে তোমাকে নামতে হবে, না নামলে ছবি চলবে না। তোমার টাকা আমি দেবো, আমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করো–যা তোমার দাম দর হবে, তা থেকে কিছু কমাবো না।