চিঠিতে ঠিকানা লেখা ছিল, ভড়মশায় একদিন ভয়ে-ভয়ে গিয়া দরজার কড়া নাড়িলেন। চাকর আসিয়া দরজা খুলিয়াই বলিল–ও তুমি আড়তের লোক?
ভড়মশায় বলিলেন–হ্যাঁ।
–মাইজি ওপরে আছেন, এসো।
ভড়মশায় কিছু বুঝিতে পারিলেন না–এ চাকরটি কি করিয়া জানিল, তিনি আড়তের লোক?
উপরে যে ঘরে চাকরটি তাহাকে লইয়া গেল, সে ঘরে একটি সুন্দরী মেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া অন্য একটি মেয়ের সহিত গল্প করিতেছিল–দেখিয়া ভড়মশায় একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন। তিনি দরজা হইতে সরিয়া যাইতেছিলেন, মেয়েটি বলিল–কে?
ভড়মশায় বিনয়ে ও সঙ্কোচে গলিয়া বলিলেন–এই–আমি—
চাকর পিছন হইতে বলিল–আড়তের লোক।
মেয়েটি বলিল–ও, আড়তের লোক! তা তোমাকে ডেকেছিলাম কেন জানো–এবার ওরকম চাল দিয়েছো কেন? ও চাল তুমি ফেরত নিয়ে যাও এবার–আর এক মণ কাটারি ভোগ পাঠিয়ে দিও–এখনি–বুঝলে?
ভড়মশাই ভয়ে ভয়ে বলিলেন, তিনি চালের আড়ত হইতে আসেন নাই, গদাধর বসুর গদি হইতে আসিয়াছেন।
— মেয়েটি কিছুক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল– তাই নাকি! ও, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েচে। কিছু মনে করবেন না, বসুন আপনি। গদাধরবাবু এখন কোথায়?
–আজ্ঞে, তিনি ভোটান ঘাট…
–ও, শুটিং হচ্চে শুনেচিলাম বটে! এখনও ফেরেন নি?
–আজ্ঞে না।
–আচ্ছা, ঠিকানাটা দিয়ে যান আপনি। একটু চা খাবেন?
–আজ্ঞে না, মাপ করবেন মা-লক্ষ্মী, আমি চা খাই নে।
–শুনুন, আপনি আমার চিঠিখানা পড়েচেন তাহ’লে? নইলে আমার ঠিকানা কোথায় পেলেন? আমার পাওনা টাকাটার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকদিন হলো–এক মাসের জন্যে নিয়ে আজ তিন মাস…
–আজ্ঞে, বাবু এলেই তিনি দিয়ে দেবেন। আপনি আর কিছুদিন সময় দিন দয়া করে।
–আচ্ছা, আপনি ভাববেন না। এলে যেন একবার উনি আসেন এখানে, বলবেন তাঁকে।
ভড়মশায় অনেক কিছু ভাবিতে ভাবিতে গদিতে ফিরিলেন। কে এ মেয়েটি? হয়তো ভালো শ্ৰেণীর মেয়ে নয়, কিন্তু বেশ ভদ্র। যাহাই হউক, ইহার নিকট কর্তা টাকা ধার করিতে গেলেন। কেন, বৃদ্ধ তাহাও কিছু ভাবিয়া পাইলেন না। একবার ভাবিলেন, বৌ-ঠাকরুণকে সব খুলিয়া বলিবেন–শেষে ঠিক করিলেন, বৌ ঠাকরুণকে এখন কোনো কথা না বলাই ভালো হইবে। কি জানি, মনিব যদি শুনিয়া চটিয়া যান?
ইহার মাসখানেক পরে শোভারাণী একদিন হঠাৎ গদাধরকে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে দেখিয়া বিস্মিত হইল।
সকালবেলা। শোভারাণীর প্রাতঃস্নান এখনও সম্পন্ন হয় নাই। আলুথালু চুল, ফিকে নীল রংয়ের সিল্কের শাড়ী পরনে, হাতে ভোরের খবরের কাগজ। শোভা কিছু বলিবার পূর্বেই গদাধর বলিলেন–এই যে, ভালো আছো শোভা? এই ট্রেন থেকে নেমেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলুম, এখনও বাড়ী যাই নি।
–আমার চিঠি পেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। উত্তর দিতুম, কিন্তু চলে আসবো কলকাতায়, ভাবলুম আর চিঠি দিয়ে কি হবে, দেখাই তো করবো।
–আমার টাকার কি ব্যবস্থা করলেন?
–টাকার ব্যবস্থা হয়েই রয়েচে। ছবি তোলা হয়ে গেল—এখন চালু হলেই টাকা হাতে আসবে।
তার আগে নয়?
–তার আগে কোথা থেকে হবে বলো? সবই তো বোঝো। কলকাতার বাড়ীও মর্টগেজ দিতে হয়েচে বাকী বারো হাজার টাকা তুলতে। এখন সব সার্থক হয়, যদি ছবি ভালো বিক্রি হয়!
–ওসব আমি কি জানি? বেশ লোক দেখছি আপনি! কবে আমার টাকা দেবেন, ঠিক বলে যান!
–আর দুটো মাস অপেক্ষা করো। তোমার এখন তাড়াতাড়ি টাকার দরকার কি? সুদ আসচে আসুক না। এও তো ব্যবসা।
শোভা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল–বেশ মজার কথা বললেন যে! আমার সুদের ব্যবসাতে দরকার নেই। টাকা কবে দেবেন বলুন? তখনতো বলেন নি এত কথা–টাকা নেবার সময় বলেছিলেন এক মাসের জন্যে!
গদাধর মিনতির সুরে বলিলেন–কিছু মনে কোরো না শোভা। এসময় যে কি সময় আমার, বুঝে দ্যাখো। ক্যাশে টাকা নেই গদিতে। মিলের নতুন অর্ডার আর নিই নি–এখন পুঁজি যা কিছু সব এতে ফেলেছি।
–কত দিনের মধ্যে দেবেন? দু’মাস দেরি করতে পারবো না।
–আচ্ছা, একটা মাস! এই কথা রইলো। এখন তবে আসি। এই কথাটা বলতেই আসা।
–বেশ, আসুন।
দুই মাস ছাড়িয়া তিন মাস হইয়া গেল।
গদাধর বড় বিপদে পড়িয়া গেলেন। ডিস্ট্রিবিউটার ছবি তৈরি করিতে অগ্রিম অনেকগুলি টাকা দিয়াছে ছবি বিক্রির প্রথম দিকের টাকাটা তাহারাই লইতে লাগিল। ছবি ভাড়া দেওয়া বা বিক্রয় করার ভার তাদের হাতে, টাকা আসিলে আগে তাহারা নিজেদের প্রাপ্য কাটিয়া লয়-গদাধরের হাতে এক পয়সাও আসিল না এই তিন মাসের মধ্যে। অথচ পাওনাদাররা দুবেলা তাগাদা শুরু করিল। যে পরিমাণে তাহাদের উৎসাহ ও অধ্যবসায় তাহারা প্রদর্শন করিতে লাগিল টাকার তাগিদ দিতে, তাহার অর্ধেক পরিমাণ উৎসাহ ও অধ্যবসায় দেখাইয়া মারকোনি বেতার-বার্তা পাঠাইবার কৌশল আবিষ্কার করিয়াছিলেন, বা প্রখ্যাতনামা বাণার্ড পেলিসি এনামেল করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করিয়াছিলেন।
কিন্তু এরূপ অমানুষিক অধ্যবসায় দেখাইয়াও কোনো ফল হইল না–গদাধর কাহাকেও টাকা দিতে পারিলেন না!
ছবি বাজারে চলিল না, কাগজে নানা বিরুদ্ধ সমালোচনা হইতে লাগিল–তবুও গোলাদর্শকরা মাস-দুই ধরিয়া বিভিন্ন মফঃস্বলের শহরে ছবিখানা দেখিল। কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটারের অগ্রিম দেওয়া টাকা শোধ করিতেই সে টাকা ব্যয় হইল–গদাধরের হাতে যা পড়িল–তাহার অনেক বেশি তিনি ঘর হইতে বাহির করিয়াছেন। প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করিয়া গদাধর পাইলেন সাত হাজার টাকা! তেইশ হাজার টাকা লোকসান।