গদাধর মুহুরীকে বলিলেন–ভড়মশায়, চালানটা মিলিয়ে দেখলেন একবার?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, সাড়ে-সাত আনা খরিদ দরের ওপর টাকায় দু’পয়সা আড়তদারি আর গাড়িভাড়া দু’আনা এই ধরুন আট আনা–দশ আনা…
–ওরা বিক্রি করেচে কততে?
–সাড়ে-চোদ্দ–ওদের আড়তদারি বাদ দিন টাকায় এক আনা…
–ওইটে বেশি হচ্চে ভড়মশায়। সিঙ্গিমশায়দের একটা চিঠি লিখে দিন আড়তদারিটার সম্বন্ধে
–বাবু ও-নিয়ে আরবারে কত লেখালেখি হলো জানেন তো? ওরা ওর কমে রাজী হবে না–আমরাও অন্য কোনো আড়তে দিয়ে বিশ্বাস করতে পারবো না। সব দিক বিবেচনা করে দেখলে বাবু ও-আড়তদারি আমাদের না দিয়ে উপায় নেই। ওদের চটালে কাজ চলবে না, পুজোর সময় দেখলেন তো?
–বাদ দিন ও-কথা মণের চালান?
–সাড়ে-পাঁচশো আর খুচরো সাতাসি…
বাহির হইতে আড়তের কয়াল নিধু সা আসিয়া বলিল– মুহুরীমশায়, কাঁটা ধরাবো? মাল নামচে গাড়ি থেকে।
ভড় মহাশয় বলিলেন–ক’গাড়ি?
–দু’গাড়ি, এলো-পাট-কালকের খরিদ।
–ভিজে আছে?
–তা তো দ্যাখলাম না–আসুন না একবার বাইরে।
গদাধর ধমক দিয়া কহিলেন–মুহুরীমশায় না গেলে ভিজে কি শুকনো পাট দেখে নেওয়া যায় না? দেখে নাওগে না–কচি খোকা সাজচো যে দিন-দিন!
নিধু সা কাঁচা কয়াল নয়, কয়ালী কাজে আজ ত্রিশ বছর নিযুক্ত থাকিয়া মাথার চুল পাকাইয়া ফেলিল। কাঁটায় মাল উঠাইবার আগে মালের অবস্থা যাচাই করাইয়া লওয়ার কাজটা আড়তের কোনো বড় কর্মচারীর দ্বারা না করাইলে ভবিষ্যতে ইহা লইয়া অনেক কথা উঠিতে পারে–এমন কি, একবার দেখাইয়া লইলে পরে বিক্রেতার সহিত যোগসাজশে মণ-মণ ভিজা পাট কাঁটায় তুলিলেও আর কোনো দায়িত্ব থাকে না–তাহাও সে জানে। বাবুরা ইহার পর আর তাহাকে দোষ দিতে পারিবে না। তবুও সে গদাধরের কথার প্রতি সমীহ করিয়া বিনীতভাবে বলিল– তা যা বলেন বাবু, তবে মুহুরীবাবু পাট চেনেন ভালো, তাই বলচিলাম।
গদাধর বলিলেন–মুহুরীমশায় পাট চেনে, আর তুমি চেন না? আর এত পাট চেনাচেনির কি কথাই বা হলো? হাত দিয়ে দেখলে বোঝা যায় না, পাট ভিজে কি শুকনো?
নিধু কয়াল দ্বিরুক্তি না করিয়া চলিয়া গেল।
মুহুরীর দিকে চাহিয়া গদাধর বলিলেন–ভড়মশায়, নিধেটা দিন-দিন বড় বেয়াদব হয়ে উঠচে মুখোমুখি তর্ক করে!
ভড় মহাশয় তাহার উত্তরে মৃদু হাস্য করিলেন মাত্র, কোন কথা বলিলেন না। ইহার কারণ, গদাধরের চণ্ডালের মত রাগে ইন্ধন যোগাইলে এখুনি চটিয়া লাল হইয়া নিধু কয়ালকে বরখাস্তও করিতে পারেন তিনি। কিন্তু ভড় মহাশয় জানেন, নিধু সা চোর বটে, তবে সত্যই কয়ালী কাজে ঝুনা লোক–গেলে অমনটি হঠাৎ জুটানো কঠিন।
সন্ধ্যা হইয়া গেল।
এই সময় কে একজন বাহিরে কাহাকে বলিতেছে শোনা গেল–না, এখন দেখা হবে না, যাও এখন।
গদাধর হাঁকিয়া বলিলেন–কে রে?
নিধু কয়ালের গলার উত্তর শোনা গেল–কে একজন সন্নিসি ফকির, বাবু।
কথার শেষ ভালো করিয়া হইতে-না-হইতে একজন পাঞ্জাবী সাধু ঘরে ঢুকিল–হলদে পাগড়ী পরা, হাতে বই–সে-ধরণের সাধুর মূর্তির সঙ্গে পরিচয় সকলেরই আছে আমাদের। ইহারা সাধারণতঃ রামেশ্বর তীর্থে যাইবার জন্য পাথেয় সংগ্রহ করিতে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হইয়া বাংলাদেশে আসিয়া গৃহস্থের ঘরে ঘরে হাত দেখিয়া বেড়ায় ও প্রবাল, পাক হরিতকী, দুর্লভ ধরণের শালগ্রাম ইত্যাদি প্রত্যেক ভক্তকে বিনামূল্যে বিতরণ করিয়া পাথেয় ও খোরাকী বাবদ পাঁচ টাকার কম লয় না।
গদাধর বলিলেন–কি বাবাজী? কাঁহাসে আসতা হ্যায়?
সাধু হাসিয়া বলিল–কলকত্তা–কালিমায়ীকি থান সে। হাত দেখলাও।
–বোসো বাবাজি।
গদাধর হাত প্রসারিত করিয়া দিলেন, সাধু বলিল–অঙ্গুঠি উতার লেও–
মুহুরী বলিলেন–আংটি খুলে নিতে বলছে হাত থেকে।
গদাধর তখুনি সোনার আংটিটি খুলিয়া হাতের আঙুল প্রসারিত করিয়া সাধুর দিকে হাত বাড়াইয়া দিলেন।
সাধু বলিল–চাঁদি ইয়ানে সোনা হাতমে রাখবো–হাতমে চাঁদি রাকখো! নেই তো হাত কেইসে দেখেগা?
এ-কথা শুনিয়া বাক্স হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া হাতে রাখিয়া গদাধর সাধুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
সাধু হাতখানা ভালো করিয়া উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল–তেরা বহুৎ বুরা দিন আতা–ইনসাল ইয়ানে দুসর সাল-সে বহুৎ কুছ গড়বড় হো যায়গা।
গদাধর ভালো হিন্দী না বুঝিলেও মোটামুটি জিনিসটা বুঝিলেন। কিন্তু তিনি আবার একটু নাস্তিক-ধরণের লোক ছিলেন, কৃত্রিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–দেখা যাক।
সাধু বলিল–কেয়া?
–কিছু না..বলতা হায়, বেশ।
সাধু বলিল–কুছ যাগ করনে হোগা। পরমাত্মাকা কৃপা-সে আচ্ছা হো যায়গা–করোগে?
–ওসব এখন হোগাটোগা নেই বাবাজি, আবি যাও।
–তেরা খুশি।
বলিয়া খপ করিয়া হাতের টাকাটি তুলিয়া লইয়া বেমালুম ঝুলির মধ্যে পুরিয়া সাধু বলিল–আচ্ছা, রাম-রাম বাবু।
গদাধর একটু অবাক হইয়া বলিলেন–টাকাটা নিলে যে?
–দচ্ছিনা তো চাহিয়ে বেটা। নেহি দচ্ছিনা দেনে-সে কোই কাম আচ্ছা নেহি বনতা!
সাধু আর ক্ষণমাত্রও বিলম্ব না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। গদাধর বেকুবের মত বসিয়া রহিলেন।
ভড় মহাশয় বলিলেন–টাকাটা দিব্যি কেমন নিয়ে গেল!
গদাধর রাগত সুরে বলিলেন–সব জোচ্চোর! সাধু না হাতী! একটা টাকার ঘাড়ে জল দিয়ে গেল বিকেলবেলা! আরও বলে কিনা তোমার খারাপ হবে!