গদাধরকে সেই তক্তপোশেরই একপাশে বসিতে হইল।
নির্মল বলিল–ওহে, একটা কথা শুনেচো? মঙ্গলগঞ্জের কুঠী বাড়ি বিক্রি হচ্চে।
–কোথায় শুনলে?
–রাধানগর থেকে লোক গিয়েছিল আজ কোর্টের কাজে সেখানে কার মুখে শুনেচে।
–বেচবে কে?
–মালিকের ছেলে স্বয়ং। কিনে রাখো না বাড়িখানা!
–হ্যাঁ, আমি অত বড় বাড়ী কিনে কি করবো? তার ওপর পুরানো বাড়ি। একবার ভাঙতে শুরু হলে, সারাতে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে যাবে! লোক নেই, জন নেই নির্জন জায়গায় বাড়ি, ভূতের ভয়ে দিনমানেই গা ছমছম করবে।
-আরে, না না–নদীর ওপর অমন খোলা আলোবাতাসওয়ালা চমৎকার জায়গা। কিনে রাখো–সস্তায় হবে, আমার লোক আছে।
–কি রকম?
মালিকের ছেলের সঙ্গে আমার মামাতো-ভাই শচীনের খুব আলাপ। তাকে দিয়ে ধরতে পারি।
–কত টাকায় হতে পারে মনে হয়?
–তা এখন কি করে বলবো? তুমি যদি বলো, তবে জিগ্যেস করি।
এই সময় নির্মলের স্ত্রী সুধা চা ও বাটিতে তেল-মাখা মুড়ি লইয়া আসিল। গদাধর বললেন–এই যে সুধা বৌঠাকরুণ, আজকাল। আমাদের বাড়ির দিকে যাও-টাও না তো?
সুধা একসময়ে হয়তো দেখিতে মন্দ ছিল না–বর্তমানে সংসারের অনটনে ও খাটাখাটুনিতে, তার উপর বৎসরে সন্তান প্রসবের ফলে যৌবনের লাবণ্য ঝরিয়া গিয়া দেহের গড়ন পাকসিটে ও মুখশ্রী প্রৌঢ়ার মত দেখিতে হইয়াছে–যদিও সুধার বয়স এই ত্রিশ। সুধা হাসিয়া বলিল–কখন যাই বলুন? সংসারের কাজ নিয়ে সকাল থেকে সন্দে পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনে। শাশুড়ী মরে গিয়ে অবধি দেখবার লোক নেই আর কেউ। আপনার বন্ধুটি তো উঁকি মেরে দেখেন না, সংসারের কেউ বাঁচলো না মরলো! এত রাত হয়ে গেল–এখনও রান্না চড়াতে পারি নি, বিছানা গোছ করতে পারিনি! আপনি এই বিছানাতেই বসেচেন–আমার কেমন লজ্জা করচে।
-না না, তাতে কি, বেশ আছি।
-মুড়ি এনেচি, কিন্তু আপনার জন্যে নয়–ওঁর জন্যে। আপনি কি তেলমাখা মুড়ি খাবেন?
–কেন খাবো না? আমি কি নবাব খানজা খাঁ এলাম নাকি? বৌ-ঠাকরুণ দেখছি হাসালে!
–তা নয়, একদিন মুড়ি খাইয়ে শরীর খারাপ করিয়ে দিলে, অনঙ্গ-দি আমায় বকে রসাতল করবে।
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–দোহাই বৌ-ঠাকরুণ, তাকে আর যাই বলো বলবে–কিন্তু এই চা খাওয়ানোর কথাটা যেন কখনো তার কানে না যায়, দেখো! তাহলে তোমারও একদিন–আমারও একদিন!
আরো ঘণ্টাখানেক দাবা খেলিবার পরে গদাধর বাড়ি ফিরিলেন। বাড়ির চারিধারে বাঁশবনের অন্ধকারে ভালো পথ দেখা যায় না। বাড়ি ঢুকিবার পথে সেই গরুরগাড়িখানা দেখিতে পাইলেন না।
ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া দেখিলেন, অনঙ্গ বসিয়া বসিয়া সেলাই করিতেছে–ঘরে কেহ নাই। গদাধর বলিলেন–রান্না হয়ে গিয়েচে?
অনঙ্গ মুখ তুলিয়া বলিল–এসো। এত রাত?
–নির্মলের বাড়ি দাবা খেলতে গিয়েছিলুম।
–হাত-মুখ ধোবার জল আছে বাইরে, দোরটা বন্ধ করে দাও–বড্ড শীত।
গদাধর আড়চোখে চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন–তাঁহার অনাহূত অতিথির চিহ্নও নাই কোনো দিকে। তবে কি চলিয়া গেল? কিংবা বোধহয় পাশের ঘরে শুইয়া পড়িয়াছে! কিন্তু বস্ত্র পরিবর্তনের অছিলায় পাশের ঘরে গিয়া, সেখানেও কাহাকে দেখিলেন না।
অনঙ্গ ডাকিল–খাবে এসো।
গদাধর এ-সন্দ ও-সন্দ করিতে করিতে খাইয়া গেলেন। নিজ হইতে তিনি কোনো কথা তুলিলেন না বা অনঙ্গও কিছু বলিল না। আহারাদি শেষ করিয়া গদাধর শুইয়া ভাবিতে লাগিলেন, ব্যাপারখানা কি? বড় শালা কাহাকে লইয়া বাড়িতে আসিল…সে গেলই বা কোথায়…তাহার আসিবার উদ্দেশ্যই বা কি…অনঙ্গ কিছু বলে না কেন?
সে রাত্রি এমনি কাটিয়া গেল।
পরদিন গদাধর চা খাইতে বসিয়াছেন সকালে, অনঙ্গ সামনে বসিয়া নিম্নকণ্ঠে বলিল–ওগো, একটা কাজ করে ফেলেচি– বকবে না বলো!
-কি?
–আগে বলো, বকবে না?
–তা কখনো হয়? যদি মানুষ খুন করে থাকো, তবে বকবো না কি-রকম?
–সে-সব নয়। কাল দাদা এসেছিল, তার একশো টাকার নাকি বড় দরকার। তোমাকে লুকিয়ে দিতে হবে। আমি তোমাকে লুকিয়ে কখনো কোনো কাজ করেচি কি? এ-টাকাটা আমি দিয়েছি কিন্তু।
–খুব অন্যায় কাজ করেচো। এ-টাকা সেই পঞ্চাশ টাকা বাদে?
–হ্যাঁ-না–হ্যাঁ, তা বাদেই।
গদাধর আশ্চর্য হইয়া গেলেন। পঞ্চাশ টাকা তিনি স্বেচ্ছায় দিয়ে গেলেন, ইহাই যথেষ্ট। আবার তাহা বাদে আরও একশো টাকা লোকটা ঠকাইয়া আদায় করিয়া লইয়া গেল? তিনি গরুরগাড়ি হইতে শালাকে নামিতে দেখিয়া তখনই ফিরিয়া আসিলে পারিতেন–তাহা হইলে এই একশো টাকা আক্কেল-সেলামি দিতে হইত না! বলিলেন–সে গুণ্ডাটা একা ছিল?
–ও আবার কি ধরণের কথা দাদার ওপর? অমন বলতে নেই, ছিঃ! হোক, আমার দাদা, তোমার গুরুজন। আমাদের আছে, আত্মীয়-স্বজনের বিপদে-আপদে হাত পেতে যদি কেউ চায়, দিতে দোষ নেই। দাদার সম্বন্ধে অমন বলতে আছে? তার বুঝ সে বুঝবে–আমরা ছোট হতে যাই কেন?
গদাধর আরও রাগিয়া বলিলেন–টাকা আমার গুণ্ডাবদমাইশদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্যে হয় নি তো? কেন বলবো না, একশোবার বলবো। এ কেমন অত্যাচার শুনি? আছে বলেই ভগ্নিপতির কাছ থেকে তার সিন্দুক ভেঙে টাকা নিয়ে যাবে?
–সিন্দুক ভেঙে তো নেয় নি–কেন মিছে চেঁচামেচি করচো!
–আমি এসব পছন্দ করি নে। সকাজে টাকা ব্যয় করতে পারা যায়–তা ব’লে এই সব জুয়োচোর আর গুণ্ডাকে…।