অনঙ্গ তাহার এই দাদাকে খুব ভালোবাসিত। নানারকমে তাহাকে সৎপথে ফিরাইবার চেষ্টা করিয়াও শেষ পর্যন্ত কিছুই হইল না–তাই সে এখন মনের দুঃখে বাপেরবাড়ি যাওয়া বন্ধ করিয়াছে। তাহার দাদাও ভগ্নীপতির গৃহে কালে-ভদ্রে পদার্পণ করে।
গদাধর বোঝেন ব্যবসা, পয়সা উড়াইবার মানুষ তিনি নহেন। কোনোপ্রকার শৌখিনতাও নাই তাঁহার। এমন কি, হাতে পয়সা থাকা সত্ত্বেও বাড়ি-ঘর কেন সারাইতেছেন না–ইহা লইয়া ঘরে পরে বিস্তর অনুযোগ সহ্য করিয়াও তিনি অটল। তাঁর নিজের মত এই যে, চলিয়া যখন যাইতেছে, তখন এই অজ পাড়াগাঁয়ে ঘর বাড়ির পিছনে কতগুলা টাকা ব্যয় করিয়া লাভ নাই!
একদিন তাঁহার এক আত্মীয় কী কার্যোপলক্ষে তাঁহার বাড়ি আসিয়াছিল। বাড়ি-ঘর দেখিয়া বলিল–গদাধর, বাড়ি-ঘর এমন অবস্থায় রেখেছো কেন?
–কেন বলো তো?
-জানালা নেই-চট টাঙিয়ে রেখেচো, দেওয়াল পড়ে গিয়েচে, দরমার বেড়া–তোমার মত অবস্থার লোক কি এরকম করে?
–তুমি কি বলো?
-ভালো করে বাড়ি করো, পুজোর দালান দাও, বৈঠকখানা ভালো করে করো–তবে তো জমিদারের বাড়ি মানাবে।
-হ্যাঁঃ, পাগল তুমি! কতকগুলো টাকা এখানে পুঁতে রাখি।
–তা বাস করতে গেলে করতে হয় বইকি। এতে লোকে বলে কি!
–যা বলে বলুকগে। তুমিই ভেবে দ্যাখো না ভাই, এই বাজারে কতকগুলো টাকা খরচ করে এখানে ওসব ধুমধামের কি দরকার আছে?
–এই বাড়িতে চিরকাল বাস করবে। পৈতৃক-বাড়ি ভালো করে তৈরি করো–দশজনের মধ্যে একজন হয়ে বাস করো।
–এখানে আর বড় বাড়ি করে কি হবে? চলে তো যাচ্চে–সে টাকা ব্যবসায়ে ফেললে কাজ দেবে। ইট গেড়ে টাকা খরচ করা আমার ইচ্ছে নয়।
তবে গদাধরের একটা শৌখিনতা আছে এক বিষয়ে। পায়রা পুষিতে তিনি খুব ভালোবাসেন। ছাদে বাঁশ চিরিয়া পায়রার জায়গা করিয়া রাখিয়াছেন–নোটন পায়রা, ঝোটন পায়রা, তিলে খেড়ি, গিরেরাজ–সাদা, রাঙা, সবুজ সব রংয়ের পায়রার দিনরাত ডানার ঝাপট, উড়ন্ত পালকের রাশি ও অবিশ্রান্ত বকবকম শব্দে গদাধরের ভাঙা অট্টালিকার কার্নিশ, থামের মাথা ও ছাদ জমাইয়া রাখিয়াছে।
তাঁহার বিশ্বাস পায়রা যেখানে, লক্ষ্মী সেখানে বাঁধা।
পায়রার শখে বছরে কিছু টাকা খরচ হইয়াও যায়। পায়রার প্রধান দালাল নির্মল–সে কলিকাতা হইতে ভালো পায়রার সন্ধান মাঝে মাঝে আনিয়া টাকা লইয়া গিয়া কিনিয়া আনে। অনঙ্গ এজন্য নির্মলের উপর সন্তুষ্ট নয়। সে পায়রার কিছু বোঝে না, ভাবে নির্মল ফাঁকি দিয়া স্বামীর নিকট হইতে টাকা আদায় করে।
দুপুরের দিকে অনঙ্গ স্বামীর কাছে বসিয়া বলিল–তুমি আজকাল আমার সঙ্গে কথাও বলো না…
–কে বলেচে বলিনে?
–দেখতেই পাচ্চি। কাছে বসলে বিরক্ত হও।
–ওটা বাজে কথা। আসল কথাটা বলো কি–মতলবটা কি?
–আমাকে পঞ্চাশটি টাকা দাও।
–অনেকক্ষণ বুঝেছি, এইরকম একটা কিছু হবে।
–দেবে?
–কি হবে শুনি?
–তা বলবো না।
গদাধর হাসিয়া স্ত্রীর মুখের কাছে হাত নাড়িয়া বলিলেন–তবে যদি আমিও বলি, দেবো না?
অনঙ্গ ডান হাতে ঘুষি পাকাইয়া তক্তপোশের উপর কিল মারিয়া বলিল–আলবৎ দিতে হবে!
–কখন দরকার?
–আজই। এক জায়গায় পাঠাবো।
গদাধর বিস্ময়ের সুরে বলিলেন–পাঠাবে? কোথায় পাঠাবে?
অনঙ্গ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অপেক্ষাকৃত গম্ভীর ও বিমর্ষ ভাবে বলিল–দাদার কাছে।
গদাধর আর কোনো কথা কহিলেন না। শুধু বলিলেন-আচ্ছা, গদিতে গিয়ে পাঠিয়ে দেবো-এখন।
তাঁহার এই বড় শালাটি মানুষ নয়, টাকা ওড়াইতে ওস্তাদ। বাপের অতবড় বিষয়টা নষ্ট করিয়া ফেলিল এই করিয়া। ছোট বোনের কাছে মাঝে মাঝে হয়তো অভাব জানায়–স্নেহময়ী অনঙ্গ মাঝে মাঝে কিছু দেয় দাদাকে–ইহা লইয়া গদাধর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিতে চান না।
কিন্তু একদিন এমন একটি ব্যাপার ঘটিল, যাহা গদাধর কখনো কল্পনা করেন নাই! বৈকালের দিকে ঘুম হইতে উঠিয়া তিনি গদির দিকে যাইতেছেন, এমন সময়ে একখানি গরুরগাড়ি তাঁহার বাড়ির দিকে যাইতে দেখিয়া পিছনে ফিরিয়া সেখানার দিকে চাহিয়া রহিলেন। গাড়ি তাঁর বাড়ির সামনে থামিল। দূর হইতে তিনি বেশ দেখিতে পাইলেন–একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক গাড়ি হইতে নামিল–পুরুষটিকে তাঁহার বড় শালা বলিয়া বোধ হইল, কিন্তু স্ত্রীলোকটি কে? বড় শালা তো বিপত্নীক আজ বছর দুই…ও-বয়সের অন্য কোনো মেয়েও তো শ্বশুরবাড়িতে নাই!
গদাধর একবার ভাবিলেন, বাড়িতে গিয়া দেখিবেন নাকি? পরক্ষণেই মুখ ফিরাইয়া গদির দিকে চলিলেন। দরকার নাই ওসব হাঙ্গামার মধ্যে এখন যাওয়ার। গদিতে গিয়াই লোক দিয়া পঞ্চাশটি টাকা স্ত্রীর নিকট পাঠাইয়া দিলেন।
গদির কাজ শেষ হইতে রাত হইয়া গেল। গদাধর বাড়ি ফিরিবার পথে ভাবিলেন, যদি শালাটি বাড়িতে থাকে, তবে তো মুশকিল! বড় শালাটি তাঁহার মধ্যে মধ্যে আসে বটে, কিন্তু গদাধরের সঙ্গে তার তত সদ্ভাব নাই। থাকিলেও আতিথ্যের খাতিরে কথাবার্তা বলিতে হইবে–কিন্তু তিনি সেটা অপ্রীতিকর কর্তব্য বলিয়া মনে করেন। তার চেয়ে নির্মলের বাড়ি বেড়াইয়া একটু রাত করিয়া ফেরা ভালো।
নির্মল বলিল–কি ভাই, বড় ভাগ্যি যে আমার বাড়ি তুমি এসেছো!
–একটু দাবা খেলবে?
–খেলো। চা খাবে?
–নিশ্চয়ই। চা খাবো না কি-রকম?
নির্মলের অবস্থা ভালো নয়। পাঁচিল ঘেরা উঠানের তিনদিকে তিনখানি খড়ের ঘর, একখানি ছোট রান্নাঘর–পিছনদিকে পাতকুয়া ও গোয়াল। ঘরের আসবাবপত্রের অবস্থা হীন, তক্তপোশের উপর ময়লা কাঁথাপাতা বিছানা। এতখানি রাত হইয়া গিয়াছে, এখনও বিছানা কেহ পাট করিয়া পাতে নাই–সকালবেলার দিকে যে লেপখানা উল্টাইয়া ফেলিয়া বিছানা ছাড়িয়া লোক উঠিয়া গিয়াছে– সেখানা এত রাত পর্যন্ত সেই একই অবস্থায় পড়িয়া। ইহাতে আরও মনে হয়, বাড়ির মেয়েরা, বিশেষ গৃহকর্ত্রী অগোছালো।