মিস নর্টন সীতাকে খুব ভালবাসে। মাঝে মাঝে সীতাকে সঙ্গে নিয়ে যায় ওদের মিশন বাড়িতে, ওকে ছবির বই, পুতুল, কেক, বিস্কুট কত কি দেয়—-ছবি আঁকতে শেখায়, বুনতে শেখায়–এরই মধ্যে সীতা বেশ পশমের ফুল তুলতে পারে, মানুষের মুখ, কুকুর আঁকতে পারে। ওরা আমাকেও অনেক বই দিয়েচে–মথি-লিখিত সুসমাচার, লুক-লিখিত সুসমাচার, যোহন-লিখিত সুসমাচার, সদাপ্রভুর কাহিনী–আরো অনেক সব। যীশু একটুকরো মাছ ও আধখানা রুটিতে হাজার লোককে ভোজন করালেন–গল্পটা পড়ে একবার আমার হঠাৎ মাছ ও রুটি খাবার সাধ হ’ল। কিন্তু মাছ এখানে মেলে না–মা ভরসা দিলেন খাওয়াবেন, কিন্তু দু মাসের মধ্যেও সেবার মাছ পাওয়া গেল না, আমার শখও ক্রমে ক্রমে উবে গেল।
বাবার বন্ধু দু-একজন বাঙালী মাঝে মাঝে আমাদের এখানে এসে দু-একদিন থাকেন। মেমেরা মাকে পড়াতে আসে, এ ব্যাপারটা তাঁদের মনঃপূত নয়। বাবাকে তাঁরা কেউ কেউ বলেছেনও এ নিয়ে। কিন্তু বাবা বলেন–ওরা আসে, এজন্যে এক পয়সা নেয় না– অথচ সীতাকে ছবি আঁকা, সেলাইয়ের কাজ শেখাচ্ছে–কি ক’রে ওদের বলি তোমরা আর এসো না? তা ছাড়া ওরা এলে মেয়েদের সময়ও ভালোই কাটে, ওদের কেউ সঙ্গী নেই, এই নির্জন চা-বাগানের এক পাশে পড়ে থাকে–একটা লোকের মুখ দেখতে পায় না, কথা বলবার মানুষ পায় না–ওরা যদি আসেই তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি কি?
মায়ের মনের একটা গোপন ইচ্ছা ছিল, সেটা কিন্তু পূর্ণ হয়নি। বাবা অত্যন্ত মদ খান–এবং যেদিন খুব বেশী করে খেয়ে আসেন, সেদিন আমাদের বাংলো ছেড়ে পালাতে হয়। নইলে সবাইকে অত্যন্ত মারধোর করেন। সে সময়ে তাঁকে আমরা যমের মত ভয় করি–এক সীতা ছাড়া। সীতা আমাদের মত পালায় না–চা-ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে চায় না। সে বাংলোতে থাকে, বলে–মারবে বাবা?..না হয় মরে যাবো–তা কি হবে? রোজ এ রকম ছুটোছুটি করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। বাবার এই ব্যাপারের জন্যে আমাদের সংসারে শান্তি নেই–অথচ বাবা যখন প্রকৃতিস্থ থাকেন, তখন তাঁর মত মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার–এত শান্ত মেজাজ। যখন যা চাই এনে দেন, কাছে ডেকে আদর করেন, নিয়ে খেলা করেন, বেড়াতে যান–কিন্তু মদ খেলেই একেবারে বদলে গিয়ে অন্য মূর্তি ধরেন, তখন বাংলো থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর আমাদের অন্য উপায় থাকে না।
মা’র ইচ্ছে ছিল মেমেদের ধর্মের এই বই পড়ে যদি বাবার মতিগতি ফেরে। মেমেরা মদ্যপানের কুফলের বর্ণনাসূচক ছোট ছোট বই দিয়ে যেতো–মা সেগুলো বাবার বিছানায় রেখে দিতেন–কে জানে বাবা পড়তেন কিনা–কিন্তু এই দেড় বৎসরের মধ্যে আমাদের মাসের মধ্যে তিন-চারবার চা-ঝোপের আড়ালে লুকনো বন্ধ হয়নি।
প্রায়ই আমি আর সীতা কোর্ট রোড ধরে বেড়াতে বেরুই। আমাদের বাগান থেকে মাইল দুই দূরে একটা ছোট ঘর আছে, আগে এখানে পোস্ট আপিস ছিল, এখন উঠে যাওয়াতে শুধু ঘরটা পড়ে আছে-উমপ্লাঙের ডাক-রানার ঝড়-বৃষ্টি বা বরফপাতের সময়ে এখানে মাঝে মাঝে আশ্রয় নেয়। এই ঘরটা আমাদের ভ্রমণপথের শেষসীমা, এর ওদিকে আমরা যাই না যে তা নয়, কিন্তু সে কালেভদ্রে, কারণ ওখান থেকে উমপ্লাং পর্যন্ত খাড়া উৎরাই নাকি এক মাইলের মধ্যে প্রায় এগারো শ ফুট নেমে গিয়েছে, মিস নর্টনের মুখে শুনেচি–যদিও বুঝি নে তার মানে কি। আমাদের অত দূরে যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না, যা আমরা চাই তা পোস্ট আপিসের ভাঙা ঘর পর্যন্ত গেলেই যথেষ্ট পেতাম–দু-ধারে ঘন নির্জন বন। আমাদের বাগানের নীচে গেলে আর সরল গাছ নেই–বনের তলা আর পরিষ্কার নেই, পাইন বন নেই, সে বন অনেক গভীর, অনেক নিবিড়, যেমন দুষ্প্রবেশ্য তেমনি অন্ধকার, কিন্তু আমাদের এত ভাল লাগে! বনে ফুলের অন্ত নেই–শীতে ফোটে বুনো গোলাপ, গ্রীষ্মকালে রডোডেনড্রন বনের মাথায় পাহাড়ের দেওয়ালে লাল আগুনের বন্যা আনে, গায়ক পাখীরা মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে চারিধারের নির্জন বনানী গানে মুখরিত করে তোলে। ঝর্ণা শুকিয়ে গেলে আমরা শুকনো ঝর্ণার পাশের পথে পাথর ধরে ধরে নীচের নদীতে নামতাম–অতি সন্তর্পণে পাহাড়ের দেওয়াল ধ’রে ধ’রে, সীতা পেছনে, আমি আগে। দাদাও এক-একদিন আসতো, তবে সাধারণত সে আমাদের এই সব ব্যাপারে যোগ দিতে ভালবাসে না।
এক-একদিন আমি একাই আসি। নদীর খাতটা অনেক নীচে–তার পথ পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে গিয়েচে–যেমন পিছল তেমনি দুর্গম–নদীর খাতে একবার পা দিলে মনে হয় যেন একটা অন্ধকার পিপের মধ্যে ঢুকে গিয়েচি। দু-ধারে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল উঠেচে–জল তাদের গা বেয়ে ঝরে পড়চে জায়গায় জায়গায়–কোথাও অনাবৃত, কোথাও গাছপালা, বনফুল, লতা–মাথার ওপরে আকাশটা যেন নীল কার্ট রোড–ঠিক অতটুকু চওড়া, ঐ রকম লম্বা, এদিকে-ওদিকে চলে গিয়েছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ কার্ট রোড বেয়ে চলেচে, কখনও বা পাহাড়ের এ-দেওয়াল ও-দেওয়াল পার হয়ে চলে যাচ্ছে–মেঘের ঐ খেলা দেখতে আমার বড় ভাল লাগত। নদী-খাতের ধারে একখানা শেওলা ঢাকা ঠাণ্ডা পাথরের ওপর বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখ উঁচু করে চেয়ে চেয়ে দেখতাম–বাড়ি ফিরবার কথা মনেই থাকত না।
মাঝে মাঝে আমার কি একটা ব্যাপার হ’ত। ওই রকম নির্জন জায়গায় কতবার একটা জিনিস দেখেচি।..