ওরা কনসেশনে ফিরে এল। সুরেশ্বরের কাছে বিমল খুব বকুনি খেল, তাকে ফেলে যাওয়ার জন্যে।
এ্যালিস বললে–ওকে বকছ কেন–আমি ভেবেছি আজ বিকেলে আবার চীনাপাড়ায় যাবার চেষ্টা করব। তুমি চল না, সুরেশ্বর।
এবার ওদের সঙ্গে আর একটি মেয়ে যাবে বললে। এ্যালিসের সঙ্গে পড়ত, নাম তার মিনি –মিনি বেরিংটন।
বিকেলে ওরা ট্যাক্সি আনালে। ওদের ট্যাক্সি কনসেশনের গেট পর্যন্ত এসেছে–এমন সময় একজন তরুণ চীনা সামরিক কর্মচারী ওদের ট্যাক্সিখানা থামালো।
বললে–আপনারা কোথায় যাবেন?
বিমল বললে–শহর বেড়াতে।
যাবেন না। আমরা গুপ্ত খবর পেয়েছি, জাপানি যুদ্ধজাহাজ বন্দরের বাইরের সমুদ্র থেকে লম্বা পাল্লার কামানে গোলাবর্ষণ শুরু করবে আজ সন্ধ্যার সময়ে–সেই সঙ্গে জাপানি উড়ো জাহাজও যোগ দেবে বোমা ফেলতে।
ধন্যবাদ। আমরা একটু ঘুরে এখুনি চলে আসব।
একথা বললে এ্যালিস–কাজেই বিমল বা সুরেশ্বর কিছু বলতে পারলে না। শহরের মধ্যে এসে দেখলে, পুলিশ সকলের হাতে চীনা ভাষায় মুদ্রিত এক এক টুকরো কাগজ বিলি করছে। চীনা ছাত্রদের একটা লম্বা দল পতাকা উড়িয়ে মুখে কী বলতে বলতে শোভাযাত্রা করে চলেছে।
সাংহাই অতিপ্রকান্ড শহর। এত বড়ো শহর বিমল দেখেনি–সুরেশ্বরও না। কলকাতা এর কাছে লাগেই না।
চীনাপল্লির নাম চা-পেই। সে-জায়গাটায় রাস্তাঘাট কিন্তু অপরিসর নয়–তবে বড়ো ঘিঞ্জি বসতি। প্রত্যেক মোড়ে খাবারের দোকান, ছোটো-বড়ো হঁদুর ভাজা ঝুলছে। বাঁকে করে ফিরিওয়ালা ভাত-তরকারি বিক্রি করছে।
বিমলের ভারি ভালো লাগল এই চীনাপাড়ার জীবনস্রোত। এক জায়গায় একটা বুড়ি বসে ভিক্ষে করছে–টাকাপয়সার বদলে সে পেয়েছে ভাত-তরকারি, ওর মুখে এমন একটি উদার ভালোবাসার ভাব, চোখে সন্তোষ ও তৃপ্তির দৃষ্টি। বোধ হয় আশাতীত ভাত-তরকারি পেয়েছে। বলে এত খুশি হয়ে উঠেছে মনে মনে। প্রাচ্য-ভূখন্ডের দারিদ্র্য ও সহজ-সরল সন্তোষের ছবি যেন এই বৃদ্ধা ভিখারিনির মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে।
হঠাৎ আকাশে কী একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ শুনে ওরা মুখ তুলে চাইলে। একটা চাপা সোঁ-ও-ও শব্দ। মিনি সর্বপ্রথমে বলে উঠল–এ শেলের শব্দ! সর্বনাশ, এ্যালিস, চলো আমরা ফিরি–জাপানি যুদ্ধজাহাজের কামান থেকে শেল ছুড়ছে! দুম! দুম!–দূরে অস্পষ্ট কামানের আওয়াজ শোনা গেল।
কাছেই কোথায় একটা ভীষণ বিস্ফোরণের আওয়াজ হল সঙ্গেসঙ্গে। লোকজন চারিধারে ছুটতে লাগল–ওরাও ছুটল তাদের পিছু পিছু। বসতি যেখানে খুব ঘিঞ্জি, সেখানে একটা বাড়িতে গোলা পড়েছে। বাড়িটার সামনের অংশ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে–ইট, চুন, টালিতে সামনের রাস্তাটা প্রায় বন্ধ–কে মরেছে না মরেছে বোঝা যাচ্ছে না, সেখানে লোকজনের বেজায় ভিড়।
আবার সেই রকম সোঁ—সোঁ–ও–ও শব্দ!
কাছেই আর একটা জায়গায় গোলা পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে আকাশে সারবন্দি একদল এরোপ্লেন দেখা গেল। তারা অনেক উঁচু দিয়ে যাচ্ছে, পাছে চীনা বিমানধ্বংসী কামানের গোলা খেতে হয় এই ভয়ে।
এ্যালিস বললে–ওরা পাল্লা ঠিক করে দিচ্ছে যুদ্ধজাহাজের গোলন্দাজদের। চলো এখানে আর থাকা নয়–এই চীনা পাড়াটা ওদের লক্ষ।
কিন্তু ওদের যাওয়া হল না। এ্যালিসের কথা শেষ হতে-না-হতেই, যেন একটা ভীষণ ভূমিকম্পে, পায়ের তলায় মাটি দুলে উঠল এবং একসঙ্গে দু-তিনটি শেলের বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ ও সেই সঙ্গে প্রচুর ধোঁয়া ও বিশ্রী শ্বাসরোধকারী কর্ডাইট-এর উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল। তুমুল হইচই, আর্তনাদ, কলরব ও পুলিশের হুইসলের মাঝে এ্যালিসের হাত ধরলে বিমল, মিনির হাত ধরলে সুরেশ্বর, কিন্তু পালাবার পথ নেই তখন কোনো দিকেই। ওদের ট্যাক্সিখানা দাঁড়িয়ে আছে বটে, ট্যাক্সিওয়ালার সন্ধান নেই– সে বোধ হয় পালিয়েছে।
চা-পেই পল্লির ওপর কেন বিশেষ লক্ষ জাপানি তোপের, একথা বোঝা গেল না, কারণ এখানে চীনা গৃহস্থদের বাড়িঘর মাত্র, কোনো সামরিক ঘাঁটি তো নেই এখানে। দেখতে দেখতে বাড়িঘর ভেঙে গুড়ো হয়ে পড়ে সামনের-পেছনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন আগে যা কিছু মারা পড়েছিল–এখন সবাই পালিয়েছে, কেবল যারা ভাঙাবাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছে তাদেরই আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।
একটা ভগ্নস্তূপের মধ্যে যেন ছোটো ছেলের কান্নার শব্দ। এ্যালিস বললে–দাঁড়াও বিমল –এখানে সবাই দাঁড়াও।
গোলাবর্ষণ তখনও চলছে, কিন্তু চীনাপল্লির অন্য অঞ্চলে। এদিকে এখন শুধু গোঙানি, চিৎকার, হইচই কলরব ও কাতরোক্তি।
এ্যালিস আগে চড়ল গিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপরে। পেছনে মিনি ও সুরেশ্বর। বিমল নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটা কড়িকাঠ সরিয়ে ওরা তিনজনে একটা দরজা পেলে। তারপর একটা ছোটো ঘর। এ্যালিস অতি কষ্টে ঘরে ঢুকল–সুরেশ্বর ওকে সাহায্য করলে। একটা ন-দশ মাসের শিশু সেই ঘরের মেঝেতে অক্ষত অবস্থায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে।
এ্যালিস তাকে সন্তর্পণে মেঝে থেকে তুলে সুরেশ্বরের হাতে দিলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, ঘরটার মধ্যে অন্ধকার। তিনজনে ঘরের মধ্যে থেকে ইটকাঠের স্তূপটার ওপরে উঠে শুনলে, বিমল উত্তেজিত ভাবে ডাকছে–আঃ কোথায় গেলে তোমরা? চট করে নেমে এসো–বড়ো বিপদ!
চারিদিকের গোলা ফাটবার আওয়াজ ও ছুটন্ত শেলের চাপা
সোঁও-ও রব খুব বেড়েছে। একটা একটা শেল মাঝে মাঝে আকাশেই সশব্দে ফেটে তারাবাজির মতো অনেকখানি আকাশ আলো করে ছড়িয়ে পড়ছে।