হাসিমুখে জেনারেল চু-টে মার্জিত ইংরেজিতে বললেন, গুড মর্নিং, আপনাদের কোনো কষ্ট হয়নি পথে?
এরাও হাসিমুখে কিছু সৌজন্যসূচক কথা বললে।
জেনারেল চুটে বললেন–আমি ভারতবর্ষের লোকদের বড়ো ভালোবাসি। আপনারা আমাদের পর নন।
বিমল বললে–আমরাও তাই ভাবি।
–মহাত্মা গান্ধী কেমন আছেন? ওই একজন মস্ত লোক আপনাদের দেশের!
জেনারেল চু-টে-র মুখে মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনে বিমল ও সুরেশ্বর দু-জনেই আশ্চর্য হয়ে গেল। তবে মহাত্মা গান্ধী তো আর ওদের বাড়ির পাশের প্রতিবেশী ছিলেন না, সুতরাং তাঁর দৈনন্দিন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ওদের কোনো জ্ঞান নেই–তার ওপর ওরা আজ দু-মাস দেশ ছাড়া।
–ভালোই আছেন। ধন্যবাদ
–মি. জহরলাল নেহেরু ভালো আছেন? আমি তাঁকে শিগগির একটা চিঠি লিখছি। আমাদের দেশের জন্য ভারতের সাহায্য, কংগ্রেসের সাহায্য চেয়ে।
বিমল ও সুরেশ্বরের বুক গর্বে ফুলে উঠল। একজন স্বাধীন দেশের বীর সেনানায়কের মুখে তাদের দরিদ্র ভারতের নেতাদের কথা শুনে চীনদেশ ভারতের কাছে সাহায্যপ্রার্থী একথা শুনে ওরা যেন নতুন মানুষ হয়ে গেছে।
জেনারেল চুটে বললেন–আমার এক সময় অত্যন্ত ইচ্ছে ছিল ভারতে বেড়াতে যাব। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। ভারতে ভালো বৈমানিক তৈরি হচ্ছে? এরোপ্লেন চালাবার ভালো স্কুল কোথায় স্থাপিত হয়েছে?
বিমলেরা এ খবর রাখে না। দমদমায় একটা যেন ওই ধরনের কিছু আছে–তবে তার বিশেষ কোনো বিবরণ ওরা জানে না।
চুটে বললেন–আপনাদের ধন্যবাদ, এদেশকে আপনারা সাহায্য করতে এসেছেন। আপনাদের ঋণ কখনো চীন শোধ দিতে পারবে না। আপনারা পথ দেখিয়েছেন। আপনাদের প্রদর্শিত পথে দুই দেশের মিলন আরও সহজ হোক এই কামনা করি।
বিমল বললে–এখন কি আমাদের সাংহাইতে থাকতে হবে?
কিছুদিন। বৈদেশিক মেডিকেল ইউনিটে আমেরিকান ডাক্তার ব্লুমফিল্ডের অধীনে। এখন আপনাদের থাকতে হবে মার্কিন কনসেশনে–সাধারণ শহরে নয় আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে চীন গভর্নমেন্ট আপনাদের জীবনের জন্য দায়ী। সাধারণ শহরে বোমা পড়বে, হাতাহাতি যুদ্ধ হবে–এখানে কারো জীবন নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক কনসেশনে আমরা হাসপাতাল খুলেছি। সেখানে আপনারা কাজ করবেন।
ইওর এক্সেলেন্সি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, যদি বেয়াদবি না হয়!
বলুন?
সাংহাই কি জাপানিরা আক্রমণ করবে বলে আপনি ভাবেন?
জেনারেল চুটে বললেন–এ তো আন্দাজের কথা নয়–সাংহাই-এর দিকেই তো ওরা পিকিং থেকে আসছে। সেনসি হচ্ছে লুংহাউ রেলের শেষপ্রান্ত। সেখানে আমরা সৈন্য জড়ো করছি ওদের বাধা দিতে। যাতে উত্তর-পশ্চিম চীনে আর না এগোতে পারে। তবে সাংহাইতে একটা বড়ো যুদ্ধ হবে অল্পদিনের মধ্যেই। মেডিকেল ইউনিটের আরও সেইজন্যে সাংহাইতেই এখন দরকার।
সুরেশ্বর ও বিমল অভিবাদন করে বিদায় নিলে।
সৈন্যবিভাগের দপ্তরখানা থেকে বার হয়ে ওরা মোটরে চড়ে আন্তর্জাতিক কনসেশনে পৌঁছোলো। বিমল ও সুরেশ্বর লক্ষ করলে ব্রিটিশ প্রজা হলেও ওদের ব্রিটিশ কনসেশনে না নিয়ে গিয়ে ফরাসি কনসেশনে নিয়ে যাওয়া হল! ওদের সঙ্গে দু-জন চীনা সামরিক কর্মচারী ছিল, আবশ্যকীয় কাগজপত্র তারাই দেখালে বা সই করলে।
প্রকান্ড ব্যারাক। কড়া সামরিক আইনকানুন। হুকুম না নিয়ে কনসেশনের সীমার বাইরে যাবার নিয়ম নেই, ঢোকবারও নিয়ম নেই। ফরাসি সান্ত্রী রাইফেল হাতে সর্বদা পাহারা দিচ্ছে। ফরাসি জাতীয় পতাকা উড়ছে ব্যারাকের পতাকা মন্দিরে। ওদের যাবার দু-দিন পরে একদল আমেরিকান যুবক কনসেশনে এসে পৌঁছোলো–এরা বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এসেছে চীন গভর্নমেন্টকে সাহায্য করতে, নিজেদের সুখসুবিধা বিসর্জন দিয়ে, প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন করে। এদের মধ্যে তিনটি তরুণী ছাত্রীও ছিল, এরা এল সেদিন সন্ধ্যাবেলা। এদের কনসেশনে ঢোকানো নিয়ে চীনা গভর্নমেন্টকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।
একটি মেয়ের নাম অ্যালিস ই. হুইটবার্ন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিমলের সঙ্গে সে যেচে আলাপ করলে। যেমনি সুশ্রী তেমনি অদ্ভুত ধরনের প্রাণবন্ত, সজীব মেয়ে। কুড়ি-একুশ বয়েস–চোখেমুখে বুদ্ধির কী দীপ্তি!
বিমল তাকে বললে–মিস হুইটবার্ন, তুমি ডাক্তারির ছাত্রী ছিলে?
মেয়েটি বললে–না! আমি নার্স হব আন্তর্জাতিক রেডক্রসে কিংবা চীনা সামরিক বিভাগের হাসপাতালে।
তোমার বাপ-মা আছেন?
আছেন। আমার বাবা ঘোড়ার শিক্ষক। খুব নামকরা লোক আমাদের কাউন্টিতে।
তাঁরা তোমাকে ছেড়ে দিলেন?
তাঁদের বুঝিয়ে বললাম। জগতের এক হতভাগা জাতি যখন এত দুর্দশা ভোগ করছে, তখন পড়াশুনো বা বিলাসিতা কি ভালো লাগে? আমি আমার সেন্ট আর পাউডারের টাকা জমিয়ে, টকির পয়সা জমিয়ে, পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এদের সাহায্যের জন্যে মার্কিন রেডক্রস ফাণ্ডে। তারপর নিজেই না এসে পারলুম না–তুমিই বলো না মি. বোস পারা যায় থাকতে?
বিমল মুগ্ধ হয়ে গেল এই বিদেশিনি বালিকার হৃদয়ের উদারতার পরিচয় পেয়ে। স্বাধীন দেশের মেয়ে বটে! সংস্কারের পুঁটুলি নয়।
মেয়েটা বললে–আমাকে এ্যালিস বলে ডেকো। একসঙ্গে কাজ করব, অত আড়ষ্ট ভদ্রতার দরকার নেই। আমার একখানা ফোটো দেব তোমায়, চলো তুলিয়ে আনি দোকান থেকে।
কনসেশনের মধ্যে প্রায়ই সব আমেরিকান দোকান। মেয়েটি বললে, চলো সাংহাই শহরের মধ্যে একটু বেড়িয়ে আসি–কোনো চীনা দোকানে ফোটো তুলব। ওরা দু-পয়সা পাবে।