পরিখার জলে পদ্মফুল দেখে সুশীল ও সনৎ ভাবলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতীক যেন ওই ফুল। আটশো বছর আগে যে হিন্দু ঔপনিবেশিকগণ প্রথম পদ্মলতা এনে দুর্গপরিখার জলে পুঁতে দেয়, তারা আজ কোথায়? কিন্তু জলে একবার শেকড় গেড়ে যে পদ্মলতা বেঁচে উঠেছিল, সে বংশানুক্রমে আজও অক্ষয় হয়ে বিরাজ করছে এই গভীর অরণ্যের মধ্যে। ইয়ার হোসেনের আদেশে তার দু-জন অনুচর জল মেপে দেখলে, এখানে পার হওয়া অসম্ভব। পরিখার জল বেশ গভীর। পরিখার এক বাহু ধরে এক দল ও অন্য দিকে অন্য বাহুর সন্ধানে অন্য দল বার হল।
শেষের দলে গেল সুশীল।
উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বা প্রাচীর-পরিখার উত্তর দিকে আধ মাইল-টাক গিয়ে ওদের দল সবিস্ময়ে দেখলে প্রাচীরের এক স্থান ভগ্ন। মাঝখান বেয়ে বেশ একটা রাস্তা যেন ছিল সুপ্রাচীনকালে। এখন অবশ্য ঘন বন। দেখে মনে হয় শত্রু দ্বারা দুর্গ বা নগর-প্রাচীর হয়তো এখানে ভগ্ন হয়ে থাকবে, নতুবা এর অন্য কোনো কারণ নির্দেশ করা যায় না।
দেখা গেল পরিখার সেইখানে প্রাচীনকালে বোধহয় কাঠের সেতু ছিল, এখন সেটা ভেঙে পড়েছে জলে। জলের গভীরতা সেখানে কম। কাঠের সেতু প্রথমে দেখা যায়নি। ইয়ার হোসেনের জনৈক অনুচর প্রথমে জলের ধারে একটা শেকল দেখতে পায়। শেকলটা টেনে জলের মধ্য থেকে একখন্ড লোহার পাত বেরোলো। আন্দাজ করা কঠিন নয় যে এই লোহার পাত কাঠের চওড়া তক্তার গায়ে লাগানো ছিল। অনুমানটুকু ছাড়া কাঠের সেতুর অস্তিত্বের জন্য কোনো নিদর্শন এতকাল পরে কীভাবে পাওয়া সম্ভব হতে পারে!
ইয়ার হোসেন বললে–এখান দিয়ে পার হওয়া যাক–জল গম্ভীর হবে না।
সুশীল সামান্য একটু আপত্তি করলে–অথবা কেন যে করলে তা সে নিজেই জানে না।
প্রথমে নামল ইয়ার হোসেন নিজে–তার পেছনে নামল সুশীল। হাত তিন-চার মাত্র জলে যখন ওরা গিয়েছে তখন ওরা দেখলে সামনে জলের যা গভীরতা, তাতে আর অগ্রসর হওয়া চলবে না। ঠিক সেই সময় ওদের নিকট থেকে হাত পাঁচ-ছয় দূরে ইয়ার হোসেনের একজন অনুচর–যে শিকল টেনে তুলেছিল জল থেকে–সে নামল, উদ্দেশ্য, ওদের পাশাপাশি সেও পরিখা পার হবে। কিন্তু পরক্ষণেই এক ভয়াবহ কান্ড ঘটল।
সুশীল চোখের কোণ দিয়ে অল্পক্ষণের জন্যে দেখতে পেলে, লোকটার ছ-সাত হাত দূরে ছোট্ট কাঠের মতো কালো কী একটা জিনিস যেন ভাসছে। দু-সেকেণ্ড মাত্র, পরেই হঠাৎ যেন ভূমিকম্পে বিরাট জলোচ্ছাস উঠল, একটা আর্ত চিৎকার-ধ্বনি অল্পক্ষণের মধ্যে শোনা গেল… কীসের একটা প্রবল ঝাঁপটা এসে ওদের জলের ওপর কাত করে ফেললে…ওদের দু জনকে।
পরক্ষণেই ইয়ার হোসেনের সেই অনুচর অদৃশ্য।
কী হল ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারলে না–অবিশ্যি এক মিনিটও হয়নি এর মধ্যে সব ঘটে গেল।
সঙ্গেসঙ্গে ডাঙায় যারা ছিল তারা চেঁচিয়ে উঠল–শয়তান! শয়তান!
ইয়ার হোসেন আকুলভাবে চিৎকার করে বললে–ডাঙায় ওঠো–ডাঙায় ওঠো!
হতভম্ব সুশীল কাদা হাঁচড়ে মরি-বাঁচি ডাঙায় উঠল–পাশাপাশি ইয়ার হোসেন উঠল, জলে চেয়ে দেখলে জল কাদা-ঘোলা হয়েছে, ইয়ার হোসেনের অনুচর নিশ্চিহ্ন।
সুশীল ও ইয়ার হোসেন তখনও হাঁপাচ্ছে; সুশীলের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে!
সে ভীত কণ্ঠে বললে–কী হল?
ইয়ার হোসেন বললে–আমাদের সাবধানে জলে নামা উচিত ছিল। এইসব প্রাচীনকালের জলাশয়ে কুমির থাকা সম্ভব, একথা ভুলে গিয়েছিলাম। খোঁজো সবাই–
কুমির! সুশীল অবাক হয়ে গেল। কে জানত নগরীর পরিখায় কুমির থাকতে পারে। দুর্গপরিখার প্রহরী এরা–হয়তো প্রাচীন দিনেই শত্ৰুরোধকল্পে জলের মধ্যে কুমির ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সুবিশ্বস্ত প্রহরীর ন্যায় এখনও তারা বাইরের লোকের অনধিকার প্রবেশে বাধাদান করছে।
খুঁজে কিছু হল না–জল কিছুক্ষণ পরে হতভাগ্য অনুচরের রক্তে রাঙা হয়ে উঠল। ইয়ার হোসেন বললে–আজ থামলে আমাদের চলবে না–এগোও। নগরের ফটক খোঁজো–
সুশীল বললে–জলের মধ্যে অজানা বিপদ। জল পার হওয়ার দরকার নেই– হেঁটে বা সাঁতরে। কোথাও সেতু আছে কি না দেখা যাক।
আবার উত্তর মুখে সকলে চলল। মাইল দুই সোজা চলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল–কারণ ভীষণ জঙ্গল কেটে কেটে অগ্রসর হতে হচ্ছে। আগুন জ্বেলে তাঁবু ফেলে সেদিন সকলে সেখানে রাত্রি কাটাবার আয়োজন করলে। এমন সময় বহু দূরে একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল–তার উত্তরে ওরাও একটা আওয়াজ করলে। দু-টি দলের মধ্যে যোগসূত্র রাখবার একমাত্র উপায় এই বন্দুকের আওয়াজ–অনেক দূর থেকে দক্ষিণগামী দলের এ হল সংকেত-ধ্বনি। পরদিন সকালে আরও এক মাইল গিয়ে প্রাচীরের উত্তর দিক থেকে পূর্ব দিকে মুখ ফেরালে। অর্থাৎ এ দিকে আর শহর নেই। প্রাচীর ধরে সবাই বাঁকতে গিয়ে দেখলে পরিখার এপারে অনেকগুলো স্তূপ, স্তূপের ওপর বিরাট জঙ্গল। বড়ো বড়ো পাথর গড়িয়ে এসে পড়েছে স্তূপ থেকে নীচে–সেগুলি বেশ চৌকশ করে কাটা। সম্ভবত স্কুপের ওপর কোনো দুর্গ ছিল যা ঠিক নগর-প্রাচীরের উত্তর-পশ্চিম কোণ পাহারা দিত।
পশ্চিম মুখে কতটা যেতে হবে কেউ জানে না, কারণ তারা দৈর্ঘ্য ধরে যাচ্ছে, না প্রস্থ ধরে যাচ্ছে তা জানবার সময় এখনও আসেনি। সেদিনও কেটে গেল বনের মধ্যে; সন্ধ্যা নামল। সন্ধ্যায় যে বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল, তার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ও অস্পষ্ট।