সারারাত্রি এভাবে কাটলে বোধহয় সনৎ সে যাত্রা ফিরত না–কিন্তু অনেক রাত্রে হঠাৎ সনৎ-এর তন্দ্রা গেল ছুটে। অনেক লোক আলো নিয়ে এসে ডাকাডাকি করছে। ইয়ার হোসেনের গলা শোনা গেল–হ্যাঁলু-উ-উ–মি. রায়–
সনৎ-এর সর্বশরীর ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গিয়েছিল–সে গলা দিয়ে স্বর উচ্চারণ করতে পারলে না। কিন্তু ইয়ার হোসেনের টর্চের আলো এসে পড়ল ওর ওপরে। সবাই এসে ওকে ঘিরে দাঁড়াল। পাশের মৃত অজগর দেখে ওরা আগে ভেবেছিল সর্পের বেষ্টনে সনৎও প্রাণ হারিয়েছে–তারপর ওকে হাত নাড়তে দেখে বুঝলে ও মরেনি।
তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রূষা করতে সনৎ চাঙা হয়ে উঠল।
ইয়ার হোসেন সেদিন ওদের ডেকে পরামর্শ করতে বসল।
জামাতুল্লাকে বললে–কই, তোমার সে মন্দিরের বা শহরের ধ্বংসাবশেষ তো দেখি নে কোনোদিকে।
জামাতুল্লা বললে–আমি তো আর মেপে রাখিনি মশাই ক-পা গেলে শহর পাওয়া যাবে –সবাই মিলে খুঁজে দেখতে হবে।
সুশীল একটা নকশা দেখিয়ে বললে–এ ক-দিনে যতটা এসেছি, জঙ্গলের একটা খসড়া ম্যাপ তৈরি করে রেখেছি। এই দেখে আমরা যে-যে পথে এসেছি দেখতে হবে, সে-পথে আর যাব না।
আবার ওদের দল বেরিয়ে পড়ল, দু-দিন পরে সমুদ্র-কল্লোল শুনে বনঝোঁপের আড়াল থেকে বার হয়ে ওরা দেখলে–সামনেই বিরাট সমুদ্র।
সনৎ চিৎকার করে বলে উঠল–আলাট্টা! আলাট্টা!
সুশীল বললে–তোমার এ চিৎকার সাজে না সনৎ। তুমি জেনোফনের বর্ণিত গ্রিক সৈন্য নও, সমুদ্রের ধারে তোমার বাড়ি নয়–
ইয়ার হোসেন বললে–ব্যাপার কী? আমি তোমাদের কথা বুঝতে পারছি নে–
সনৎ বললে–জেনোফন বলে একজন প্রাচীন যুগের গ্রিক লেখক–নিজেও তিনি একজন সৈনিক–পারস্য দেশের অভিযান শেষ করে ফিরবার সমস্ত দুঃখ-কষ্টটা দশ সহস্রের প্রত্যাবর্তন বলে একখানা বইয়ে লিখে রেখে গিয়েছেন–তাই ও বলছে–
ইয়ার হোসেন তাচ্ছিল্যের সুরে বললে–ও!
জামাতুল্লা বললে–আমার একটা পরামর্শ শোনো। কম্পাসে দিক ঠিক করে চলো এবার উত্তর মুখে যাই–ওদিকটা দেখে আসা যাক।
সকলেই একথায় সায় দিলে। সূর্যের মুখ না দেখে সকলেরই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। ওরা প্রথম দিনেই সমুদ্রের বালির ওপরে অনেকগুলো বড়ো বড়ো কচ্ছপ দেখতে পেলে। ইয়ার হোসেনের একজন অনুচর ছুটে গিয়ে একটাকে উলটে চিত করে দিলে, বাকিগুলি তাড়াতাড়ি গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মালয় দেশীয় দায়ের (মালয়েরা বলে বোলো) সাহায্যে কচ্ছপটাকে কাটা হল, মাংসটা ভাগ করে রান্না করে সকলে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করলে। ভাগ করার অর্থ এই যে ইয়ার হোসেনের দল ও জামাতুল্লার রান্না হত আলাদা, সুশীল ও সনৎ-এর আলাদা রান্না সনৎ নিজেই করত।
একদিন সমুদ্রের ধারে বালির ওপরে কী একটা জানোয়ার দেখে সনৎ ছুটে এসে সবাইকে খবর দিলে।
সকলে গিয়ে দেখলে প্রকান্ড বড়ো শুয়োরের মতো বড়ো একটা জানোয়ার বালির ওপর চুপ করে শুয়ে। তার থ্যাবড়া নাকের নীচে বড়ো বড়ো গোঁফ–মুখের দু-দিকে দুটো বড়ো
বড়ো দাঁত।
ইয়ার হোসেন বললে–এ এক ধরনের সীল–সিঙ্গাপুরের সমুদ্রে মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায় বটে।
সীলের মূল্যবান চামড়ার লোভে সনৎ ওকে গুলি করতে উদ্যত হল।
ইয়ার হোসেন নিষেধ করে বললে–ওটা মেরো না–ও সীলকে বলে সী লায়ন, ও মারলে অলক্ষণ হয়।
পরদিন তাঁবু তুলে সকলে উত্তর দিকের জঙ্গল ভেদ করে রওনা হল। উত্তর দিকের জঙ্গলে সমুদ্রের ধার দিয়ে অনেকটা গেল ওরা। এক গাছ থেকে আর এক গাছে বড়ো বড়ো পুষ্পিত লতা সারাবন সুগন্ধে আমোদ করে ঝুলে পড়েছে–সুবৃহৎ লতা যেন অজগর সাপের নাগপাশে মহীরুহকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করছে–রাশি রাশি বিচিত্র অর্কিড। বিচিত্র উজ্জ্বল বর্ণের পাখির দল ডালে ডালে–অদ্ভুত সৌন্দর্য বনের। সুশীল বললে–মি. হোসেন, ও কী লতা জানেন? যেমন সুন্দর ফুল–আর লতা দেখা যাচ্ছে না ফুলের ভারে– গন্ধও অদ্ভুত। ইয়ার হোসেন লতার নাম জানে না–তবে বললে, সিঙ্গাপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ওরকম লতা সে দেখেছে।
সারাদ্বীপে গভীর বন। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া কঠিন ও অনবরত গাছপালা কেটে যেতে হয় পথ করবার জন্যে–কাজেই ওরা সমুদ্রের ধার বেয়ে চলছিল। এক জায়গায় একটা নদী এসে সমুদ্রে পড়েছে বনের মধ্যে দিয়ে, নদী পার হয়ে যাওয়া কষ্টকর বলে ওরা বাধ্য হয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। নদী সরু হবার নাম নেই–অনেক দূরে বনের মধ্যে ঢুকে এখনও নদী বেশ গভীর।
সুশীল বললে–ওহে, নদীটা আমাদের দেশের বড়ো একটা খালের মতো দেখছি। এ দ্বীপে এত বড়ো নদী আসছে কোথা থেকে? তেমন বড়ো পাহাড় কোথায়?
নিশ্চয়ই বড়ো পাহাড় আছে বনের মধ্যে, সেইদিকেই তো যাচ্ছি–দেখা যাক–
আরও আধঘণ্টা সকলে মিলে গভীর জনহীন বনের মধ্যে দিয়ে চলল। বনের রাজ্য বটে এটা–সত্যিকার বন কাকে বলে এতদিন পরে প্রত্যক্ষ করল সুশীল-সনৎ।
হঠাৎ এক জায়গায় একটা নাগকেশর গাছ দেখে সুশীল বলে উঠল–এই দেখো একটা আশ্চর্য জিনিস! এই গাছ কোথাও এদিকে দেখা যায় না। নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ থেকে আমদানি এ গাছটা।
খুঁজতে খুঁজতে আশেপাশে আরও কয়েকটা নাগকেশর গাছ পাওয়া গেল। এই গভীর বনের মধ্যে নাগকেশর গাছ থাকার মানেই হচ্ছে এখানে কোনো ভারতীয় উপনিবেশের অস্তিত্ব ছিল পুরাকালে।
সনৎ বললে–কিন্তু এ গাছ তো খুব পুরোনো না, দেখেই মনে হচ্ছে। আট ন-শো বছরের নাগকেশর গাছ কি বাঁচে?