Site icon BnBoi.Com

কাদম্বরী – বানভট্ট

কাদম্বরী - বানভট্ট

১. উপক্রমণিকা

প্রথম বারের বিজ্ঞাপন

সংস্কৃত ভাষায় মহাকবি বাণভট্টবিরচিত কাদম্বরী নামে যে মনোহর গদ্য গ্রন্থ প্রসিদ্ধ আছে, তাহা অবলম্বন করিয়া এই পুস্তক লিখিত হইল। ইহা ঐ গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। গল্পটি মাত্র অবিকল পরিগৃহীত হইয়াছে, বর্ণনার অনেক অংশ পরিত্যাগ করা গিয়াছে। সংস্কৃত কাদম্বরী পাঠে অনির্ব্বচনীয় প্রীতি লাভ হইয়া থাকে এবং তাহার বর্ণনা শুনিলে অথবা পাঠ করিলে সাতিশয় চমৎকৃত হইতে হয়। এই বাঙ্গলা অনুবাদ যে সেই রূপ প্রীতিদায়ক ও চমৎকারজনক হইবেক ইহা কোন রূপেই সম্ভাবিত নহে। যাহা হউক, যে সকল মহাশয়েরা বাঙ্গলা ভাষায় অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া থাকেন তাঁহারা পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক এক এক বার পাঠ করিলেই সমুদায় শ্রম সফল জ্ঞান করিব।

শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
কলিকাতা, সংস্কৃত কালেজ
৩রা আশ্বিন সংবৎ ১৯১১

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন

কাদম্বরী দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল। এই বারে কোন কোন স্থান পরিত্যক্ত ও কোন কোন স্থান পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। যে সকল স্থান অসংলগ্ন অথবা দুরূহ বোধ হইয়াছিল, ঐ সকল স্থান সংলগ্ন ও সহজ করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছি; কিন্তু কত দূর পর্য্যন্ত কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না।

শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
১৫ বৈশাখ
সংবৎ ১৯১৩

————–

উপক্রমণিকা

শূদ্রকনামে অসাধারণধীশক্তিসম্পন্ন অতিবদান্য মহাবল পরাক্রান্ত প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। বিদিশানাম্নী নগরী তাঁহার রাজধানী ছিল। যে স্থানে বেত্রবতী নদী বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। রাজা নিজ বাহুবলে ও পরাক্রমে ক্রমে ক্রমে অশেষ দেশ জয় করিয়া সসাগরা ধরায় আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক সুখে ও নিরুদ্বেগচিত্তে সাম্রাজ্য ভোগ করেন। একদা প্রাতঃকালে আপন অমাত্য কুমারপালিত ও অন্যান্য রাজকুমারের সহিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে প্রতীহারী আসিয়া প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল মহারাজ! দক্ষিণাপথ হইতে এক চণ্ডালকন্যা আসিয়াছে। তাহার সমভিব্যাহারে এক শুকপক্ষী আছে। কহিল, “মহারাজ সকল রত্নের আকর, এই নিমিত্ত এই পক্ষীরত্ন তদীয় পাদপদ্মে সমর্পণ করিতে আসিয়াছি।” দ্বারে দণ্ডায়মান আছে অনুমতি হইলে আসিয়া পাদপদ্ম দর্শন করে।

রাজা প্রতিহারীর বাক্য শুনিয়া সাতিশয় কৌতুকাবিষ্ট হইলেন এবং সমীপবর্ত্তী সভাসদগণের মুখাবলোকন পূর্ব্বক কহিলেন কি হানি আছে লইয়া আইস। প্রতিহারী যে আজ্ঞা বলিয়া চণ্ডালকন্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল। চণ্ডালকন্যা সভামণ্ডপে প্রবেশিয়া দেখিল উপরে মনোহর চন্দ্রাতপ, চন্দ্রাতপের চতুর্দ্দিকে মুক্তাকলাপ, মালার ন্যায় শোভা পাইতেছে; নিম্নে রাজা স্বর্ণময় অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া মণিময় সিংহাসনে বসিয়া আছেন; সমাগত রাজগণ চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। অন্যান্য পর্ব্বতের মধ্যগত হইলে সুমেরুর যেরূপ শোভা হয়, রাজা সেইরূপ অপূর্ব্ব শ্রী ধারণ করিয়া সভামণ্ডপ উজ্জ্বল করিতেছেন। চণ্ডালকন্যা সভার শোভা দেখিয়া অতিশয় চমৎকৃত হইল এবং নৃপতিকে অনন্যমনা করিবার আশয়ে করস্থিত বেণুযষ্টি দ্বারা সভাকুট্টিমে এক বার আঘাত করিল। তালফল পতিত হইলে অরণ্যচারী হস্তিযূথ যেরূপ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করে, বেণুযষ্টির শব্দ শুনিবামাত্র সেইরূপ সকলের চক্ষু রাজার মুখমণ্ডল হইতে অপসৃত হইয়া সেই দিকে ধাবমান হইল।

রাজাও সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন অগ্রে এক জন বৃদ্ধ, পশ্চাতে পিঞ্জরহস্ত একটী বালক এবং মধ্যে এক পরমসুন্দরী কুমারী আসিতেছে। কন্যার এরূপ রূপ লাবণ্য, যে কোন ক্রমেই তাহাকে চণ্ডালকন্যা বলিয়া বোধ হয় না। রাজা তাহার নিরুপম সৌন্দর্য্য ও অসামান্য সৌকুমার্য্য অনিমিষলোচনে অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। ভাবিলেন, বিধাতা বুঝি হীনজাতি বলিয়া ইহাকে স্পর্শ করেন নাই, মনে মনে কল্পনা করিয়াই ইহার রূপ লাবণ্য নির্ম্মাণ করিয়া থাকিবেন। তাহা না হইলে এরূপ রমণীয় কান্তি ও এরূপ অলৌকিক সৌন্দর্য্য কি রূপে হইতে পারে। যাহা হউক, চণ্ডালের গৃহে এরূপ সুন্দরী কুমারীর সমুদ্ভব নিতান্ত অসম্ভব ও আশ্চর্য্যের বিষয়। এইরূপ ভাবিতেছিলেন এমন সময়ে কন্যা সম্মুখে আসিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিল। বৃদ্ধ পিঞ্জর লইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া বিনয়বচনে নিবেদন করিল মহারাজ! পিঞ্জরস্থিত এই শুক সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, রাজনীতিপ্রয়োগ বিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ, সদ্বক্তা, চতুর, সকলকালাভিজ্ঞ; কাব্য নাটক ইতিহাসের মর্ম্মজ্ঞ ও গুণগ্রাহী। যে সকল বিদ্যা মনুষ্যেরাও অবগত নহেন সমুদয় ইহার কণ্ঠস্থ। ইহার নাম বৈশম্পায়ন। ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত নরপতি অপেক্ষা আপনি বিদ্বান্ ও গুণগ্রাহী। এই নিমিত্ত আমাদিগের স্বামিদুহিতা আপনকার নিকট এই শুকপক্ষী আনয়ন করিয়াছেন। অনুগ্রহ পূর্ব্বক গ্রহণ করিলে ইনি আপনাকে চরিতার্থ বোধ করেন। এই বলিয়া সম্মুখে পিঞ্জর রাখিয়া কিঞ্চিদ্দূরে দণ্ডায়মান হইল।

পিঞ্জরমধ্যবর্ত্তী শুক দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিল। রাজা শুকের মুখ হইতে অর্থযুক্ত সুস্পষ্ট বাক্য শ্রবণ করিয়া বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন। অনন্তর কুমারপালিতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন দেখ অমাত্য! পক্ষিজাতীও সুস্পষ্ট রূপে বর্ণোচ্চারণ করিতে ও মধুরস্বরে কথা কহিতে পারে। আমি জানিতাম পক্ষী ও পশুজাতি কেবল আহার, নিদ্রা, ভয় প্রভৃতিরই পরতন্ত্র, ইহাদিগের বুদ্ধিশক্তি অথবা বাক্‌শক্তি কিছুই নাই। কিন্তু শুকের এই ব্যাপার দেখিয়া অতি আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। প্রথমতঃ ইহাই আশ্চর্য্য যে, পক্ষী মনুষ্যের মত কথা কহিতে পারে; দ্বিতীয়তঃ আশীর্ব্বাদ প্রয়োগের সময় ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করেন, শুক পক্ষীও সেইরূপ দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া যথাবিহিত আশীর্ব্বাদ করিল। কি আশ্চর্য্য! ইহার বুদ্ধি ও মনোবৃত্তিও মনুষ্যের মত দেখিতেছি।

রাজার কথা শুনিয়া কুমারপালিত কহিলেন মহারাজ! পক্ষিজাতি যে মনুষ্যের ন্যায় কথা কহিতে পারে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। লোকেরা শুক শারিকা প্রভৃতি পক্ষীদিগকে প্রযত্নাতিশয় সহকারে শিক্ষা দেয় এবং উহারাও পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সংস্কারবশতঃ অনায়াসে শিখিতে পারে। পূর্ব্বে উহারা ঠিক্ মনুষ্যের মত সুস্পষ্ট রূপে কথা কহিতে পারিত; কিন্তু অগ্নির শাপে এক্ষণে উহাদিগের কথার জড়তা জন্মিয়াছে। এই কথা কহিতে কহিতে সভাভঙ্গসূচক মধ্যাহ্নকালীন শঙ্খধ্বনি হইল। স্নানসময় উপস্থিত দেখিয়া নরপতি, সমাগত রাজাদিগকে সম্মানসূচক বাক্য প্রয়োগ দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন, চণ্ডালকন্যাকে বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন এবং তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীকে কহিলেন তুমি বৈশম্পায়নকে অন্তঃপুরে লইয়া যাও ও স্নান ভোজন করাইয়া দাও।

অনন্তর আপনি সিংহাসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক কতিপয় সুহৃৎ সমভিব্যাহারে রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। তথায় স্নান, পূজা, আহার প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সমাপন করিয়া শয়নাগারে প্রবেশ পূর্ব্বক শয্যায় শয়ন করিয়া বৈশম্পায়নের আনয়নের নিমিত্ত প্রতীহারীকে আদেশ দিলেন। প্রতীহারী আজ্ঞামাত্র বৈশম্পায়নকে শয়নাগারে আনয়ন করিল। রাজা জিজ্ঞাসিলেন বৈশম্পায়ন! তুমি কোন্ দেশে কিরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছ? তোমার জননী কে? কিরূপে সমস্ত শাস্ত্র অভ্যাস করিলে? তুমি কি জাতিস্মর, অথবা কোন মহাপুরুষ, যোগবলে বিহগবেশ ধারণ করিয়া দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছ, কিম্বা অভীষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করিয়া বর প্রাপ্ত হইয়াছ? তুমি পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতে? কিরূপেই বা চণ্ডালহস্তগত হইয়া পিঞ্জরবদ্ধ হইলে এই সকল শুনিতে আমার অতিশয় কৌতুক জন্মিয়াছে, অতএব তোমার আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার কৌতুকাবিষ্ট চিত্তকে পরিতৃপ্ত কর।

বৈশম্পায়ন রাজার এই কথা শুনিয়া বিনয় বাক্যে কহিল যদি আমার জন্মবৃত্তান্ত শুনিতে মহাশয়ের নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ করুন।

ভারতবর্ষের মধ্যস্থলে বিন্ধ্যাচলের নিকটে এক অটবী আছে। উহাকে বিন্ধ্যাটবী কহে। ঐ অটবীর মধ্যে গোদাবরী নদীর তীরে ভগবান্ অগস্ত্যের আশ্রম ছিল। যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান্ রামচন্দ্র পিতৃ আজ্ঞা প্রতিপালনের নিমিত্ত সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত পঞ্চবটীতে পর্ণশালা নির্ম্মাণ করিয়া কিঞ্চিৎ কাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন। যে স্থানে দুর্ব্বৃত্ত দশাননপ্রেরিত নিশাচর মারীচ কনকমৃগরূপ ধারণ পূর্ব্বক জানকীর নিকট হইতে রামচন্দ্রকে হরণ করিয়াছিল। যে স্থানে মৈথিলীবিয়োগবিধুর রাম ও লক্ষ্মণ সাশ্রু নয়নে ও গদ্গদ বচনে নানাপ্রকার বিলাপ ও অনুতাপ করিয়া তত্রস্থ পশুপক্ষীদিগকেও দুঃখিত এবং বৃক্ষদিগকেও পরিতাপিত করিয়াছিলেন। ঐ আশ্রমের অনতিদূরে পম্পা নামক সরোবর আছে। ঐ সরোবরের পশ্চিম তীরে ভগবান্ রামচন্দ্র শর দ্বারা যে সপ্ততাল বিদ্ধ করিয়াছিলেন তাহার নিকটে এক প্রকাণ্ড শাল্মলী বৃক্ষ আছে; বৃহৎ এক অজগর সর্প সর্ব্বদা ঐ বৃক্ষের মূলদেশে বেষ্টন করিয়া থাকাতে, বোধ হয় যেন, আলবাল রহিয়াছে। উহার শাখা প্রশাখা সকল এরূপ উন্নত ও বিস্তৃত, বোধ হয় যেন, হস্তপ্রসারণ পূর্ব্বক গগনমণ্ডলের দৈর্ঘ্য পরিমাণ করিতে উঠিতেছে। স্কন্ধদেশ এরূপ উচ্চ, বোধ হয় যেন, একবারে পৃথিবীর চতুর্দ্দিক অবলোকন করিবার আশয়ে মুখ বাড়াইতেছে। ঐ তরুর কোটরে, শাখাগ্রে, স্কন্ধদেশে ও বল্কলবিবরে কুলায় নির্ম্মাণ করিয়া শুক শারিকা প্রভৃতি নানাবিধ পক্ষিগণ সুখে বাস করে। তরু অতিশয় প্রাচীন; সুতরাং বিরলপল্লব হইয়াও পক্ষিশাবকদিগের দিবানিশি অবস্থিতি প্রযুক্ত সর্ব্বদা নিবিড়পল্লবাকীর্ণ বোধ হয়। কোন কোন পক্ষিশাবকের পক্ষোদ্ভেদ হয় নাই তাহাদিগকে ঐ বৃক্ষের ফল বলিয়া ভ্রান্তি জন্মে। পক্ষীরা রাত্রিকালে বৃক্ষকোটরে আপন আপন নীড়ে নিদ্রা যায়। প্রভাত হইলে আহারের অন্বেষণে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গগনমার্গে উড্ডীন হয়। তৎকালে বোধ হয় যেন, হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলপরিপূর্ণ ক্ষেত্র আকাশমার্গ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা দিগ্দিগন্তে গমন করিয়া আহারদ্রব্য অন্বেষণ পূর্ব্বক আপনারা ভোজন করে এবং শাবকদিগের নিমিত্ত চঞ্চুপুটে করিয়া খাদ্য সামগ্রী আনে ও যত্নপূর্ব্বক আহার করাইয়া দেয়।

সেই মহীরুহের এক জীর্ণ কোটরে আমার পিতা মাতা বাস করিতেন। কালক্রমে মাতা গর্ভবতী হইলেন এবং আমাকে প্রসব করিয়া সূতিকাপীড়ায় অভিভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। পিতা তৎকালে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, আবার প্রিয়তমা জায়ার বিয়োগশোকে অতিশয় ব্যাকুল ও দুঃখিতচিত্ত হইলেন তথাপি স্নেহবশতঃ আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালনে ও রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান্ হইয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহার গমন করিবার কিছুমাত্র শক্তি ছিল না; তথাপি আস্তে আস্তে সেই আবাসতরুতলে নামিয়া পক্ষিকুলায়ভ্রষ্ট যে যৎকিঞ্চিৎ আহারদ্রব্য পাইতেন আমাকে আনিয়া দিতেন, আমার আহারাবশিষ্ট যাহা থাকিত আপনি ভোজন করিয়া যথাকথঞ্চিৎ জীবন ধারণ করিতেন।
একদা প্রভাতকালে চন্দ্রমা অস্তগত হইলে, পক্ষিগণের কলরবে অরণ্যানী কোলাহলময় হইলে, নবোদিত রবির আতপে গগনমণ্ডল লোহিতবর্ণ হইলে, গগনাঙ্গনবিক্ষিপ্ত অন্ধকার রূপ ভস্মরাশি দিনকরের কিরণরূপ সম্মার্জ্জনী দ্বারা দূরীকৃত হইলে, সপ্তর্ষিমণ্ডল অবগাহন মানসে মানসসরোবরতীরে অবতীর্ণ হইলে শাল্মলীবৃক্ষস্থিত পক্ষিগণ আহারের অন্বেষণে অভিমত প্রদেশে প্রস্থান করিল। পক্ষিশাবকেরা নিঃশব্দে কোটরে রহিয়াছে ও আমি পিতার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, ভয়াবহ মৃগয়াকোলাহল শুনিতে পাইলাম। কোন দিকে সিংহ সকল গভীর স্বরে গর্জ্জন করিতে লাগিল; কোন প্রদেশে তুরঙ্গ, কুরঙ্গ, মাতঙ্গ প্রভৃতি বনচর পশু সকল বন আন্দোলন করিয়া বেড়াইতে লাগিল; কোন স্থানে ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বরাহ প্রভৃতি ভীষণাকার জন্তু সকল ছুটাছুটী করিতে লাগিল, কোন স্থানে মহিষ, গণ্ডার প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ জন্তুগণ অতিবেগে দৌড়িতে লাগিল ও তাহাদিগের গাত্রঘর্ষণে বৃক্ষ সকল ভগ্ন হইতে আরম্ভ হইল। মাতঙ্গের চীৎকারে, তুরঙ্গের হেষারবে, সিংহের গর্জ্জনে ও পক্ষীদিগের কলরবে বন আকুল হইয়া উঠিল এবং তরুগণও ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। আমি সেই কোলাহল শ্রবণে ভয়বিহ্বল ও কম্পিতকলেবর হইয়া পিতার জীর্ণ পক্ষপুটের অন্তরালে লুকাইলাম। তথা হইতে ব্যাধদিগের ঐ বরাহ যাইতেছে, ঐ হরিণ দৌড়িতেছে, ঐ করভ পলাইতেছে ইত্যাদি নানাপ্রকার কোলাহল শুনিতে লাগিলাম।

মৃগয়াকোলাহল নিবৃত্ত হইলে অরণ্যানী নিস্তব্ধ হইল। তখন আমি পিতার পক্ষপুট হইতে আস্তে আস্তে বিনির্গত হইয়া কোটর হইতে মুখ বাড়াইয়া যে দিকে কোলাহল হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম কৃতান্তের সহোদরের ন্যায়, পাপের সারথির ন্যায়, নরকের দ্বারপালের ন্যায় বিকটমূর্ত্তি এক সেনাপতি সমভিব্যাহারে যমদূতের ন্যায় কতকগুলি কুরূপ ও কদাকার শবরসৈন্য আসিতেছে। তাহাদিগকে দেখিলে ভূতবেষ্টিত ভৈরব ও দূতমধ্যবর্ত্তী কালান্তকের স্মরণ হয়। সেনাপতির নাম মাতঙ্গ পশ্চাৎ অবগত হইলাম। সুরাপানে দুই চক্ষু জবাবর্ণ; সর্ব্বশরীরে বিন্দু বিন্দু রক্তকণিকা লাগিয়াছে; সঙ্গে কতকগুলি বড় বড় শিকারী কুকুর আছে। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন বিকটাকার অসুর বন্য পশু ধরিয়া খাইতে আসিয়াছে। শবরসৈন্য অবলোকন করিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলাম যে, ইহারা কি দুরাচার ও দুষ্কর্ম্মান্বিত। জনশূন্য অরণ্য ইহাদিগের বাসস্থান, মদ্য মাংস আহার, ধনুঃ ধন, কুক্কুর সুহৃৎ, ব্যাঘ্র ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর সহিত একত্র বাস এবং পশুদিগের প্রাণবধ করাই জীবিকা ও ব্যবসায়। অন্তঃকরণে দয়ার লেশ নাই, অধর্ম্মের ভয় নাই ও সদাচারে প্রবৃত্তি নাই। ইহারা সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সকলের নিকটে নিন্দাস্পদ ও ঘৃণাস্পদ হইতেছে, সন্দেহ নাই। এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম এমন সময়ে মৃগয়াজন্য শ্রান্তি দূর করিবার নিমিত্ত তাহারা আমাদিগের আবাসতরুতলের ছায়ায় আসিয়া উপবিষ্ট হইল। অনতিদূরস্থিত সরোবর হইতে জল ও মৃণাল আনিয়া পিপাসা ও ক্ষুধা শান্তি করিল। শ্রান্তি দূর করিয়া চলিয়া গেল।

শবরসৈন্যের মধ্যে এক বৃদ্ধ সে দিন কিছুই শিকার করিতে পারে নাই ও মাংস প্রভৃতি কিছুই পায় নাই; সে উহাদিগের সঙ্গে না গিয়া তরুতলে দণ্ডায়মান থাকিল। সকলে দৃষ্টিপথের অগোচর হইলে, রক্তবর্ণ দুইচক্ষু দ্বারা সেই তরুর মূল অবধি অগ্রভাগ পর্য্যন্ত এক বার নিরীক্ষণ করিল। তাহার নেত্রপতনমাত্রেই কোটরস্থিত পক্ষিশাবকদিগের প্রাণ উড়িয়া গেল। হায়, নৃশংসের অসাধ্য কি আছে! সোপানশ্রেণীতে পাদক্ষেপ পূর্ব্বক অট্টালিকায় যেরূপ অনায়াসে উঠা যায়, নৃশংস কণ্টকাকীর্ণ দুরারোহ সেই প্রকাণ্ড মহীরুহে সেইরূপ অবলীলাক্রমে আরোহণ করিল এবং কোটরে কর প্রসারিত করিয়া পক্ষিশাবকদিগকে ধরিয়া একে একে বহির্গত করিয়া প্রাণসংহারপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিল। পিতার একে বৃদ্ধ বয়স, তাহাতে অকস্মাৎ এ বিষম সঙ্কট উপস্থিত হওয়াতে নিতান্ত ভীত হইলেন। ভয়ে কলেবর দ্বিগুণ কাঁপিতে লাগিল এবং তালুদেশ শুষ্ক হইয়া গেল। ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন কিন্তু প্রতীকারের কোন উপায় না দেখিয়া আমাকে পক্ষপুটে আচ্ছাদন করিলেন ও আপন বক্ষস্থলের নিম্নে লুকাইয়া রাখিলেন। আমাকে যখন পক্ষপুটে আচ্ছাদন করেন তখন দেখিলাম তাঁহার নয়নযুগল হইতে জলধারা পড়িতেছে। নৃশংস, ক্রমে ক্রমে আমাদিগের কুলায়ের সমীপবর্ত্তী হইয়া কালসর্পাকার বামকর কোটরে প্রবেশিত করিয়া পিতাকে ধরিল। তিনি চঞ্চুপুট দ্বারা যথাশক্তি আঘাত ও দংশন করিলেন, কিছুতেই ছাড়িল না। কোটর হইতে বহির্গত করিল, যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিল, পরিশেষে প্রাণ বিনষ্ট করিয়া নিম্নে নিক্ষেপ করিল। পিতার পক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত ও ভয় সঙ্কুচিত হইয়াছিলাম বলিয়া আমাকে দেখিতে পাইল না। ঐ তরুতলে শুষ্ক পর্ণরাশি একত্রিত ছিল তাহারই উপর পতিত হইলাম, অধিক আঘাত লাগিল না।

অধিক বয়স না হইলে অন্তঃকরণে স্নেহের সঞ্চার হয় না কিন্তু ভয়ের সঞ্চার জন্মাবধিই হইয়া থাকে। শৈশব প্রযুক্ত আমার অন্তঃকরণে স্নেহসঞ্চার না হওয়াতে কেবল ভয়েরই পরতন্ত্র হইলাম। প্রাণ পরিত্যাগের উপযুক্ত কালেও নিতান্ত নৃশংস ও নির্দ্দয়ের ন্যায় উপরত পিতাকে পরিত্যাগ করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। অস্থির চরণ ও অসমগ্রোদিত পক্ষপুটের সাহায্যে আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করাতে বারংবার ভূতলে পড়িতে ও তথা হইতে উঠিতে লাগিলাম। ভাবিলাম বুঝি এ যাত্রায় কৃতান্তের করাল গ্রাস হইতে পরিত্রাণ হইল। পরিশেষে মন্দ মন্দ গমন করিয়া নিকটস্থিত এক তমাল তরুর মূলদেশে লুকাইলাম। এমন সময়ে সেই নৃশংস চণ্ডাল শাল্মলীবৃক্ষ হইতে নামিয়া পক্ষিশাবকদিগকে একত্রিত ও লতাপাশে বদ্ধ করিল এবং যে পথে শবরসৈন্যেরা গিয়াছিল সেই পথ দিয়া চলিয়া গেল।

দূর হইতে পতিত ও ভয়ে নিতান্ত অভিভূত হওয়াতে আমার কলেবর কম্পিত হইতেছিল; আবার বলবতী পিপাসা কণ্ঠশোষ করিল। এতক্ষণে পিশাচ অনেক দূর গিয়া থাকিবে এই সম্ভাবনা করিয়া মুখ বাড়াইয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলাম। কোন দিকে কোন শব্দ শুনিবামাত্র অমনি শঙ্কিত হইয়া পদে পদে বিপদ্ আশঙ্কা করিয়া তমালমূল হইতে নির্গত হইলাম ও আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। যাইতে যাইতে কখন বা পার্শ্বে কখন বা সম্মুখে পতিত হওয়াতে শরীর ধূলিধূসরিত হইল ও ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতে লাগিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, কি আশ্চর্য্য! যত দুর্দ্দশা ও যত কষ্ট সহ্য করিতে হউক না কেন, তথাপি কেহ জীবনতৃষ্ণা পরিত্যাগ করিতে পারে না। আমার সমক্ষে পিতা প্রাণত্যাগ করিলেন, স্বচক্ষে দেখিলাম, আমিও বৃক্ষ হইতে পতিত হইয়া বিকলেন্দ্রিয় ও মৃতপ্রায় হইয়াছি; তথাপি বাঁচিবার বিলক্ষণ বাসনা আছে। হায়, আমার তুল্য নির্দ্দয় কে আছে? মাতা প্রসবসময়ে প্রাণ ত্যাগ করিলে পিতা জায়াশোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াও কেবল আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালন করিতেছিলেন এবং অত্যন্ত স্নেহ প্রযুক্ত বৃদ্ধ বয়সেও তাদৃশ বিষম ক্লেশ সহ্য করিয়া আমারই রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি সে সকল একবারে বিস্মৃত হইলাম। আমার পর কৃতঘ্ন আর নাই; আমার মত নৃশংস ও দুরাচার এই ভূমণ্ডলে কাহাকেও দেখিতে পাই না। কি আশ্চর্য্য! সেরূপ অবস্থাতে আমার জল পান করিবার অভিলাষ হইল। দূর হইতে সারস ও কলহংসের অনতিপরিস্ফুট কলরব শুনিয়া অনুমান করিলাম সরোবর দূরে আছে। কি রূপে সরোবরে যাইব, কি রূপে জলপান করিয়া প্রাণ বাঁচাইব, অনবরত এইরূপ ভাবিতে লাগিলাম।

এমন সময়ে মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত। গগনমণ্ডলের মধ্যভাগ হইতে দিনমণি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় প্রচণ্ড অংশুসমূহ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। রৌদ্রের উত্তাপে পথ উত্তপ্ত হইল। পথে পাদক্ষেপ করা কাহার সাধ্য? সেই উত্তপ্ত বালুকায় আমার পা দগ্ধ হইতে লাগিল। কোন প্রকারে মরিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সে সময়ে এরূপ কষ্ট ও যাতনা উপস্থিত হইল যে বিধাতার নিকট বারংবার মরণের প্রার্থনা করিতে হইল। চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক ও অঙ্গ অবশ হইল।

সেই স্থানের অনতিদূরে জাবালি নামে পরম পবিত্র মহাতপা মহর্ষি বাস করিতেন। তাঁহার পুত্ত্র হারীত কতিপয় বয়স্য সমভিব্যাহারে সেই দিক্ দিয়া সরোবরে স্নান করিতে যাইতেছিলেন। তিনি এরূপ তেজস্বী যে, হঠাৎ দেখিলে সাক্ষাৎ সূর্য্যদেবের ন্যায় বোধ হয়। তাঁহার মস্তকে জটাভার, ললাটে ভস্মত্রিপুণ্ড্রক, কর্ণে স্ফটিকমালা, বামকরে কমণ্ডলু, দক্ষিণ হস্তে আষাঢ়দণ্ড, স্কন্ধে কৃষ্ণাজিন ও গলদেশে যজ্ঞোপবীত। তাঁহার প্রশান্ত আকৃতি দেখিবামাত্র বোধ হইল যে, পরমকারুণিক ভূতভাবন ভগবান্ ভবানীপতি আমার রক্ষার নিমিত্ত ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। সাধুদিগের চিত্ত স্বভাবতই দয়ার্দ্র। আমার সেইরূপ দুর্দ্দশা ও যন্ত্রণা দেখিয়া তাঁহার অন্তঃকরণে করুণোদয় হইল এবং আমাকে নির্দ্দেশ করিয়া বয়স্যদিগকে কহিলেন দেখ দেখ একটী শুকশিশু পথে পতিত রহিয়াছে। বোধ হয়, এই শাল্মলীতরুর শিখরদেশ হইতে পতিত হইয়া থাকিবে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে ও বারংবার চঞ্চুপুট ব্যাদান করিতেছে। বোধ হয়, অতিশয় তৃষ্ণাতুর হইয়া থাকিবে। জল না পাইলে আর অধিকক্ষণ বাঁচিবে না। চল, আমরা ইহাকে সরোবরে লইয়া যাই। জল পান করাইয়া দিলে বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে। এই বলিয়া আমাকে ভূতল হইতে তুলিলেন। তাঁহার করস্পর্শে আমার উত্তপ্ত গাত্র কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। অনন্তর সরোবরে লইয়া গিয়া আমার মুখ উন্নত ও চঞ্চুপুট বিস্তৃত করিয়া অঙ্গুলির অগ্রভাগ দ্বারা বিন্দু বিন্দু বারি প্রদান করিলেন। জল পান করিয়া পিপাসাশান্তি হইল। পরে আমাকে স্নান করাইয়া নলিনীপত্রের শীতল ছায়ায় বসাইয়া রাখিলেন। অনন্তর ঋষিকুমারেরা স্নানান্তে অর্ঘ্য প্রদান পূর্ব্বক ভগবান্ ভাস্করকে প্রণাম করিলেন এবং আর্দ্র বস্ত্র পরিত্যাগ ও পবিত্র নূতন বসন পরিধান পূর্ব্বক আমাকে গ্রহণ করিয়া তপোবনাভিমুখে মন্দ মন্দ গমন করিতে লাগিলেন।

তপোবন সন্নিহিত হইলে দেখিলাম, তত্রস্থ তরু ও লতা সকল কুসুমিত, পল্লবিত ও ফলভরে অবনত হইয়া রহিয়াছে। এলা ও লবঙ্গলতার কুসুমগন্ধে দিক্ আমোদিত হইতেছে। মধুকর ঝঙ্কার করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধু পান করিতেছে। অশোক, চম্পক, কিংশুক, সহকার, মল্লিকা, মালতী প্রভৃতি নানাবিধ বৃক্ষ ও লতার সমাবেশে এবং তাহাদিগের শাখা ও পল্লবের পরস্পর সংযোগে মধ্যে মধ্যে রমণীয় গৃহ নির্ম্মিত হইয়াছে। উহার অভ্যন্তরে দিনকরের কিরণ প্রবেশ করিতে পারে না। মহর্ষিগণ মন্ত্রপাঠপূর্ব্বক প্রজ্জ্বলিত অনলে ঘৃতাহুতি প্রদান করিতেছেন এবং প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার উত্তাপে বৃক্ষের পল্লব সকল মলিন হইয়া যাইতেছে। গন্ধবহ হোমগন্ধ বিস্তারপূর্ব্বক মন্দ মন্দ বহিতেছে। মুনিকুমারেরা কেহ বা উচ্চৈঃস্বরে বেদ উচ্চারণ, কেহ বা প্রশান্ত ভাবে ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা করিতেছেন। মৃগকদম্ব নির্ভয়চিত্তে বনের চতুর্দ্দিকে খেলিয়া বেড়াইতেছে। শুকমুখভ্রষ্ট নীবারকণিকা তরুতলে পতিত রহিয়াছে।
তপোবন দেখিয়া আমার অন্তঃকরণ আহ্লাদে পুলকিত হইল। অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া দেখিলাম, রক্তপল্লবশোভিত রক্তাশোকতরুর ছায়ায় পরিষ্কৃত পবিত্র স্থানে বেত্রাসনে ভগবান্ মহাতপা মহর্ষি জাবালি বসিয়া আছেন। অন্যান্য মুনিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট রহিয়াছেন। মহর্ষি অতি প্রাচীন, জরার প্রভাবে মস্তকের জটাভার ও গাত্রের লোম সকল ধবলবর্ণ, কপালে ত্রিবলি, গণ্ডস্থল নিম্ন, শিরা ও পঞ্জরের অস্থি সকল বহির্গত এবং শ্বেতবর্ণ লোমে কর্ণবিবর আচ্ছাদিত। তাঁহার প্রশান্ত গভীর আকৃতি দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, তিনি করুণরসের প্রবাহ, ক্ষমা ও সন্তোষের আধার, শান্তি লতার মূল, ক্রোধভুজঙ্গের মহামন্ত্র, সৎপথের দর্শক এবং সৎস্বভাবের আশ্রয়। তাঁহাকে দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে একদা ভয় ও বিস্ময়ের আবির্ভাব হইল। ভাবিলাম মহর্ষির কি প্রভাব! ইঁহার প্রভাবে তপোবনে হিংসা, দ্বেষ, বৈর, মাৎসর্য্য, কিছুই নাই। ভুজঙ্গেরা আতপতাপিত হইয়া শিখীর শিখাকলাপের ছায়ায় সুখে শয়ন করিয়া আছে। হরিণশাবকেরা সিংহশাবকের সহিত সিংহীর স্তন পান করিতেছে। করভ সকল ক্রীড়া করিতে করিতে শুণ্ড দ্বারা সিংহকে আকর্ষণ করিতেছে। মৃগকুল অব্যাকুলচিত্তে বৃকের সহিত একত্র চরিতেছে। এবং শুষ্ক বৃক্ষও মুকুলিত হইয়াছে। বোধ হয় যেন, সত্যযুগ কলিকালের ভয়ে পলাইয়া তপোবনে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছে। অনন্তর ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, আশ্রমস্থিত তরুগণের শাখায় মুনিদিগের বল্কল শুখাইতেছে, কমণ্ডলু ও জপমালা ঝুলিতেছে এবং মূলদেশে বসিবার নিমিত্ত বেদি নির্ম্মিত হইয়াছে। বোধ হয় যেন, বৃক্ষ সকলও তপস্বিবেশ ধারণপূর্ব্বক তপস্যা করিতে আরম্ভ করিয়াছে।

এই সকল দেখিতেছিলাম, এমন সময়ে মুনিকুমার হারীত আমাকে সেই রক্তাশোকতরুর ছায়ায় বসাইয়া পিতার চরণারবিন্দ বন্দনা পূর্ব্বক স্বতন্ত্র এক আসনে উপবিষ্ট হইলেন। অন্যান্য মুনিকুমারেরা মদ্দর্শনে সাতিশয় কৌতুকাবিষ্ট ও ব্যগ্র হইয়া হারীতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সখে! এই শুকশিশুটী কোথায় পাইলে? হারীত কহিলেন, স্নান করিতে যাইবার সময় পথিমধ্যে দেখিলাম, এই শুকশিশু আপন কুলায় হইতে পতিত হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতেছে। ইহাকে তাদৃশ বিষম দুরবস্থাপন্ন দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে করুণোদয় হইল। কিন্তু যে বৃক্ষ হইতে পতিত হইয়াছিল, তাহাতে আরোহণ করা আমাদিগের অসাধ্য বোধ হওয়াতে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছি। এই স্থানে থাকুক, সকলকে যত্নপূর্ব্বক ইহার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে।

হারীতের এই কথা শুনিয়া ভগবান্ জাবালি কুতূহলাক্রান্ত হইয়া আমার প্রতি চক্ষু নিক্ষেপ করিলেন। তাঁহার প্রশান্ত দৃষ্টিপাত মাত্রেই আমি আপনাকে চরিতার্থ ও পবিত্র জ্ঞান করিলাম। তিনি পরিচিতের ন্যায় আমাকে বারংবার নেত্রগোচর করিয়া কহিলেন, এই পক্ষী আপন দুষ্কর্ম্মের ফল ভোগ করিতেছে। সেই মহর্ষি কালত্রয়দর্শী; তপস্যার প্রভাবে ভূত ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমানের ন্যায় দেখেন এবং জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সমস্ত জগৎ করতলস্থিত বস্তুর ন্যায় দেখিতে পান; সকলে তাঁহার প্রভাব জানিতেন; তাঁহার কথায় কাহারও অবিশ্বাস হইল না। মুনিকুমারেরা ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, কি রূপেই বা তাহার ফল ভোগ করিতেছে? জন্মান্তরে এ কোন্ জাতি ছিল, কেনই বা পক্ষী হইয়া জন্মগ্রহণ করিল। অনুগ্রহ পূর্ব্বক ইহার দুষ্কর্ম্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমাদিগের কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন।

মহর্ষি কহিলেন, সে কথা বিস্ময়জনক ও কৌতুকাবহ বটে, কিন্তু অতি দীর্ঘ; অল্প ক্ষণের মধ্যে সমাপ্ত হইবেক না। এক্ষণে দিবাবসান হইতেছে, আমাকে স্নান করিতে হইবেক। তোমাদিগেরও দেবার্চ্চনসময় উপস্থিত। আহারাদি সমাপন করিয়া সকলে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিলে, আমি ইহার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিব। আমি বর্ণন করিলেই সমুদায় জন্মান্তরবৃত্তান্ত ইহার স্মৃতিপথারূঢ় হইবেক। মহর্ষি এই কথা কহিলে মুনিকুমারেরা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক স্নান, পূজা প্রভৃতি সমুদায় দিবসব্যাপার সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।

ক্রমে দিবাবসান হইল। মুনিজনেরা রক্তচন্দনসহিত যে অর্ঘ্য দান করিয়াছিলেন, সেই রক্তচন্দনে অনুলিপ্ত হইয়াই যেন, রবি রক্তবর্ণ হইলেন। রবির কিরণ ধরাতল পরিত্যাগ করিয়া কমলবনে, কমলবন ত্যাগ করিয়া তরুশিখরে এবং তদনন্তর পর্ব্বতশৃঙ্গে আরোহণ করিল। বোধ হইল যেন, পর্ব্বতশিখর সুবর্ণে মণ্ডিত হইতেছে। রবি অস্তগত হইলে সন্ধ্যা উপস্থিত হইল। সন্ধ্যাসমীরণে তরুশাখা সকল সঞ্চালিত হইলে বোধ হইল যেন, তরুগণ বিহগদিগকে নিজ নিজ কুলায়ে আগমন করিবার নিমিত্ত অঙ্গুলীসঙ্কেত দ্বারা আহ্বান করিল। বিহগকুলও কলরব করিয়া যেন তাহার উত্তর প্রদান করিল। মুনিজনেরা ধ্যানে বসিলেন ও বদ্ধাঞ্জলি হইয়া সন্ধ্যার উপাসনা করিতে লাগিলেন। দুহ্যমান হোমধেনুর মনোহর মুগ্ধধারাধ্বনি আশ্রমের চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত করিল। হরিদ্বর্ণ কুশদ্বারা অগ্নিহোত্রবেদি আচ্ছাদিত হইল। দিনের বেলায় দিনকরের ভয়ে গিরিগুহার অভ্যন্তরে লুকাইয়া ছিল, এই সময় সময় পাইয়া অন্ধকার তথা হইতে সহসা বহির্গত হইল। সন্ধ্যা ক্ষয় প্রাপ্ত হইলে তাহার শোকে দুঃখিত ও তিমিররূপ মলিন বসনে অবগুণ্ঠিত হইয়া বিভাবরী আগমন করিল। ভাস্করের প্রতাপে গ্রহগণ তস্করের ন্যায় ভয়ে লুকাইয়া ছিল, অন্ধকার পাইয়া অমনি গগনমার্গে বহির্গত হইল। পূর্ব্বদিগ্‌ভাগে সুধাংশুর অংশু অল্প অল্প দৃষ্টিগোচর হওয়াতে বোধ হইল যেন, প্রিয়সমাগমে আহ্লাদিত হইয়া পূর্ব্ব দিক্ দশনবিকাশ পূর্ব্বক মন্দ মন্দ হাসিতেছে। প্রথমে কলামাত্র, ক্রমে অর্দ্ধমাত্র, ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণমণ্ডল শশধর প্রকাশিত হওয়াতে সমুদায় তিমির বিনষ্ট হইয়া গেল। কুমুদিনী বিকসিত হইল। মন্দ মন্দ সন্ধ্যাসমীরণ সুখাসীন আশ্রমমৃগগণকে আহ্লাদিত করিল। জীবলোক আনন্দময়, কুমুদ গন্ধময় ও তপোবন জ্যোৎস্নাময় হইল। ক্রমে ক্রমে চারি দণ্ড রাত্রি হইল।

হারীত আহারাদি সমাপন করিয়া আমাকে লইয়া ঋষিকুমারদিগের সমভিব্যাহারে পিতার সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, তিনি বেত্রাসনে বসিয়া আছেন; জালপাদনামা শিষ্য তালবৃন্ত ব্যজন করিতেছেন। হারীত পিতার সম্মুখে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া বিনয় বচনে কহিলেন, তাত! আমরা সকলেই এই শুকশিশুর বৃত্তান্ত শুনিতে অতিশয় উৎসুক। আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক বর্ণন করিলে কৃতার্থ হই।

মুনিকুমারেরা সকলেই কৌতুকাক্রান্ত ও একাগ্রচিত্ত হইয়াছেন দেখিয়া মহর্ষি কথা আরম্ভ করিলেন।

২.০১ কথারম্ভ – অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী

অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী আছে। যে স্থানে ভুবনত্রয়ের সর্গস্থিতিসংহারকারী মহাকালাভিধান ভগবান্ দেবাদিদেব মহাদেব অবস্থিতি করেন। যে স্থানে শিপ্রানদী তরঙ্গরূপ ভ্রুকুটি বিস্তার পূর্ব্বক ভাগীরথীর প্রতি উপহাস করিয়া বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। তথায় তারাপীড় নামে মহাযশস্বী তেজস্বী প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তিনি অর্জ্জুনের ন্যায় নিজভুজবলে অখণ্ড ভূমণ্ডল জয় ও প্রজাগণের ক্লেশ দূর করিয়া সুখে রাজ্য ভোগ করেন। তাঁহার গুণে বশীভূত হইয়া লক্ষ্মী কমলবন তুচ্ছ করিয়া, নারায়ণবক্ষঃস্থল পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহাকেই গাঢ় আলিঙ্গন করিয়াছিলেন; সরস্বতী চতুর্ম্মুখের মুখপরম্পরায় বাস করা ক্লেশকর বোধ করিয়া তাঁহারই রসনামণ্ডলে সুখে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। তাঁহার অমাত্যের নাম শুকনাস। শুকনাস ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, নীতিশাস্ত্রপ্রয়োগকুশল, ভূভারধারণক্ষম, অগাধবুদ্ধি, ধীরপ্রকৃতি, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। তাঁহার পত্নীর নাম মনোরমা। ইন্দ্রের বৃহস্পতি, নলের সুমতি, দশরথের বশিষ্ঠ ও রামচন্দ্রের বিশ্বামিত্র যেরূপ উপদেষ্টা ছিলেন; শুকনাসও সেইরূপ রাজকার্য্য পর্য্যালোচনাবিষয়ে রাজাকে যথার্থ সদুপদেশ দিতেন। মন্ত্রীর বুদ্ধি এরূপ তীক্ষ্ণ যে জটিল ও দুরবগাহ কোন কার্য্যসঙ্কট উপস্থিত হইলেও বিচলিত বা প্রতিহত হইত না। শৈশবাবধি অকৃত্রিম প্রণয় সঞ্চার হওয়াতে রাজা তাঁহাকে কোন বিষয়ে অবিশ্বাস করিতেন না। তিনিও বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে নৃপতির হিত কার্য্য অনুষ্ঠানে তৎপর ছিলেন। পৃথিবীতে তুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না এবং প্রজাদিগের উৎপাত ও অসুখ আকাশকুসুমের ন্যায় অলীক পদার্থ হইয়াছিল, সুতরাং সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া শুকনাসের প্রতি রাজ্যশাসনের ভার সমর্পণ পূর্ব্বক রাজা যৌবনসুখ অনুভব করিতেন। কখন জলবিহার, কখন বনবিহার, কখন বা নৃত্য, গীত, বাদ্যের আমোদে সুখে কাল হরণ করেন। শুকনাস সেই অসীম সাম্রাজ্যকার্য্য অনায়াসে সুশৃঙ্খলরূপে সম্পন্ন করিতেন। তাঁহার অপক্ষপাতিতা ও সদ্বিচারগুণে প্রজারা অত্যন্ত বশীভূত ও অনুরক্ত হইয়াছিল।

তারাপীড় এইরূপে সকল সুখের পার প্রাপ্ত হইয়াও সন্তানমুখাবলোকনরূপ সুখলাভ না হওয়াতে মনে মনে অতিশয় দুঃখিত থাকেন। সন্তান না হওয়াতে সংসারে অরণ্য জ্ঞান, জীবনে বিড়ম্বনা জ্ঞান ও শরীর ভারমাত্র বলিয়া বোধ হইয়াছিল এবং আপনাকে অসহায়, অনাশ্রয় ও হতভাগ্য বিবেচনা করিতেন। ফলতঃ তাঁহার পক্ষে সংসার অসার ও অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান হইয়াছিল। নৃপতির বিলাসবতীনাম্নী পরমরূপবতী পত্নী ছিলেন। কন্দর্পের রতি ও শিবের পার্ব্বতী যেরূপ পরমপ্রণয়িনী, বিলাসবতীও সেইরূপ রাজার পরমপ্রণয়াস্পদ ছিলেন। একদা মহিষী অতিশয় দুঃখিত অন্তঃকরণে অন্তঃপুরে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে নরপতি তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহিষী বামকরতলে কপোলদেশ সংস্থাপিত করিয়া বিষণ্ণ বদনে রোদন করিতেছেন; অঙ্গের ভূষণ অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন; অঙ্গরাগ বা অঙ্গসংস্কার কিছুমাত্র নাই। সখীগণ নিঃশব্দে ও দুঃখিত চিত্তে পার্শ্বে বসিয়া আছে। অন্তঃপুরবৃদ্ধারা অনতিদূরে উপবিষ্ট হইয়া প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিতেছে। রাজা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলে মহিষী আসন হইতে উঠিয়া সম্ভাষণ করিলেন। রাজাকে দেখিয়া তাঁহার দুঃখ দ্বিগুণতর হইল ও দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। মহিষীর আকস্মিক শোক ও রোদনের কারণ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নরপতি মনে মনে কত ভাবনা, কত শঙ্কা ও কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরে আসনে উপবিষ্ট হইয়া বসন দ্বারা চক্ষুর জল মুছাইয়া দিয়া মধুর বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রিয়ে! কি নিমিত্ত বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন করিয়া বিষণ্ণবদনে ও দীননয়নে রোদন করিতেছ? তোমার দুঃখের কারণ কিছু জানিতে না পারিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল ও বিষণ্ণ হইতেছে। আমি কি কোন অপরাধ করিয়াছি? অথবা অন্য কেহ প্রজ্বলিত অনলশিখায় হস্তক্ষেপ করিয়া থাকিবেক? যাহা হউক শোকের কারণ বর্ণন করিয়া আমার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর কর।

রাজা এত অনুনয় করিলেন, বিলাসবতী কিছুই উত্তর দিলেন না—বরং আরও শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজ্ঞীর তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি কোন অপরাধ করেন নাই এবং রাজমহিষীর নিকটে অন্যে অপরাধ করিবে এ কথাও অসম্ভব। মহিষী যে নিমিত্ত রোদন করিতেছেন তাহা শ্রবণ করুন। সন্তানের মুখাবলোকনরূপ সুখ লাভে বঞ্চিত হইয়া রাণী বহুদিবসাবধি শোকাকুল ছিলেন। কিন্তু মহারাজের মনঃপীড়া হইবে বলিয়া এত দিন দুঃখ প্রকাশ করেন নাই; মনের দুঃখ মনেই গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য চতুর্দ্দশী, মহাদেবের পূজা দিতে মহাকালের মন্দিরে গিয়াছিলেন, তথায় মহাভারত পাঠ হইতেছিল, তাহাতেই শুনিলেন সন্তানবিহীন ব্যক্তিদিগের সদ্গতি হয় না; পুত্ত্র না জন্মিলে পুন্নাম নরক হইতে উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই, পুত্ত্রহীন ব্যক্তির ইহলোকে সুখ ও পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার সম্ভাবনা নাই; তাহার জীবন, ধন, ঐশ্বর্য্য, সকলই নিষ্ফল। মহাভারতের এই কথা শুনিয়া অবধি রাজ্ঞী অতিশয় উন্মনা ও উৎকণ্ঠিতা হইলেন। বাটী আসিলে সকলে নানাপ্রকার প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিল ও আহার করিতে অনুরোধ করিল; কোন ক্রমেই শান্ত হইলেন না ও আহার করিলেন না। সেই অবধি কাহারও কোন কথার উত্তর দেন না, কাহারও সহিত আলাপ করেন না। কেবল বিষণ্ণবদনে অনবরত রোদন করিতেছেন। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন।

তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীর কথা শুনিয়া রাজা ক্ষণকাল নিস্তব্ধ ও নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, দেবি! দৈবায়ত্ত বিষয়ে শোক ও অনুতাপ করা কোন ক্রমেই বিধেয় নহে। মনুষ্যেরা যত যত্ন ও যত চেষ্টা করুক না কেন, দৈব অনুকূল না হইলে কোন প্রকারে মনোরথ সফল হয় না। পুত্ত্রের আলিঙ্গনে শরীর শীতল হইবে, মুখারবিন্দদর্শনে নেত্র পবিত্র হইবে, অপরিস্ফুট মধুর বচন শ্রবণে কর্ণ জুড়াইবে এমন কি পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছি! জন্মান্তরে কত পাপ করিয়া থাকিব, সেই জন্যে এত মনস্তাপ উপস্থিত হইতেছে। দৈব অনুকূল না হইলে কোন অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই। অতএব দৈব কর্ম্মে অত্যন্ত অনুরক্ত হও। মনোযোগপূর্ব্বক গুরুভক্তি, দেবপূজা ও মহর্ষিদিগের পরিচর্য্যা কর। অবিচলিত ও অকৃত্রিম ভক্তিপূর্ব্বক ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। পুরাণে শুনিয়াছি, মগধদেশের রাজা বৃহদ্রথ সন্তানলাভের আশয়ে চণ্ডকৌশিকের আরাধনা করেন এবং তাঁহার বরপ্রভাবে জরাসন্ধনামে প্রবলপরাক্রান্ত এক পুত্ত্র প্রাপ্ত হন। রাজা দশরথ মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসন্ন করিয়া রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন নামে মহাবলপরাক্রান্ত চারি পুত্ত্র লাভ করেন। ঋষিগণের আরাধনা কখন বিফল হয় না, অবশ্যই তাহার ফল দর্শে, সন্দেহ নাই। দৃঢ়ব্রত ও একান্ত অনুরক্ত হইয়া ভক্তিসহকারে দেব ও দেবর্ষিদিগের অর্চ্চনা কর তাহাতেই মনোরথ সফল হইবেক। হায়! কত দিনে সেই শুভ দিনের উদয় হইবে, যে দিনে স্নেহময় ও প্রীতিময় সন্তানের সুধাময় মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন ও নয়ন চরিতার্থ করিব; পরিজনেরা আনন্দে পূর্ণপাত্র গ্রহণ করিবে; নগর উৎসবময় হইয়া নৃত্য, গীত, বাদ্যের কোলাহলে পরিপূর্ণ হইবেক, শশিকলা উদিত হইলে গগনমণ্ডলের যেরূপ শোভা হয়, কত দিনে দেবী পুত্ত্র ক্রোড়ে করিয়া সেইরূপ শোভিত হইবেন; নিরপত্যতা এক্ষণে অতিশয় ক্লেশ দিতেছে। সংসার অরণ্য ও জগৎ শূন্য দেখিতেছি; রাজ্য ও ঐশ্বর্য্য নিষ্ফল বোধ হইতেছে। কিন্তু অপ্রতিবিধেয় বিষয়ে শোক ও দুঃখ করা বৃথা বলিয়াই ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক যথাকথঞ্চিৎ সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছি। এইরূপ নানা প্রবোধবাক্যে আশ্বাস দিয়া স্বহস্তে মহিষীর নেত্রজল মোচন করিয়া দিলেন। অনেক ক্ষণ অন্তঃপুরে থাকিয়া পরে বহির্গত হইলেন।

রাজা অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলে বিলাসবতী প্রবোধবাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া স্নান ভোজনাদি সমাপন করিলেন। যে সকল আভরণ ফেলিয়া দিয়াছিলেন তাহা পুনর্ব্বার অঙ্গে ধারণ করিলেন। তদবধি দেবতার আরাধনা, ব্রাহ্মণের সেবা ও গুরু জনের পরিচর্য্যায় অতিশয় অনুরক্ত হইলেন। দৈবকর্ম্মে অনুরক্ত হইয়া চণ্ডিকার গৃহে প্রতিদিন ধূপ গুগ্‌গুল প্রভৃতি সুগন্ধ দ্রব্যের গন্ধ বিস্তার করেন। দিবসবিশেষে তথায় কুশাসনে শয়ন করিয়া থাকেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণদিগকে স্বর্ণপাত্র দান করেন। কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দ্দশী রজনীতে চতুষ্পথে দেবতাদিগকে বলি উপহার দেন। অশ্বত্থ প্রভৃতি বনস্পতিদিগকে প্রদক্ষিণ করেন। ষোড়শোপচারে ষষ্ঠীদেবীর পূজা দেন। ফলতঃ যে যেরূপ ব্রতের অনুষ্ঠান করিতে কহে, অতিশয় ক্লেশসাধ্য হইলেও অপত্যতৃষ্ণায় উহার অনুষ্ঠান করেন, কিছুতেই পরাঙ্মুখ হয়েন না। গণক অথবা সিদ্ধপুরুষ দেখিলে সমাদর পূর্ব্বক সন্তানের গণনা করান। রাত্রিতে যে সকল স্বপ্ন দেখেন, প্রভাতে পুরন্ধ্রীদিগকে তাহার ফলাফল জিজ্ঞাসা করেন।

এই রূপে কিছুদিন অতীত হইলে, একদা রাত্রিশেষে রাজা স্বপ্নে দেখিলেন, বিলাসবতী সৌধশিখরে শয়ন করিয়া আছেন, তাঁহার মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্র প্রবেশ করিতেছে। স্বপ্নদর্শনানন্তর অমনি জাগরিত হইয়া শীঘ্র শয্যা হইতে উঠিলেন। অনন্তর শুকনাসকে আহ্বান করিয়া তাঁহার সাক্ষাতে স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। শুকনাস শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন ও প্রীতিপ্রফুল্ল বদনে কহিলেন, মহারাজ! বুঝি অনেক কালের পর আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইল। অচিরাৎ আপনি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমিও আজি রজনীতে স্বপ্নে প্রশান্তমূর্ত্তি, দিব্যাকৃতি এক ব্রাহ্মণকে মনোরমার উৎসঙ্গে বিকসিত পুণ্ডরীক নিক্ষেপ করিতে দেখিয়াছি। শাস্ত্রকারেরা কহেন, শুভ ফলোদয়ের পূর্ব্বে শুভ লক্ষণ সকল দেখিতে পাওয়া যায়। যদি আমাদিগের চিরপ্রার্থিত মনোরথ সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে, ইহা অপেক্ষা আহ্লাদের বিষয় কি আছে? রাত্রিশেষে যে স্বপ্ন দেখা যায় তাহা প্রায় বিফল হয় না। রাজমহিষী বিলাসবতী অচিরাৎ পুত্ত্রসন্তান প্রসব করিবেন, সন্দেহ নাই। রাজা মন্ত্রীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণে অধিকতর আহ্লাদিত হইলেন এবং তাঁহার হস্তধারণ পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া উভয়েই আপন আপন স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা রাজমহিষীর আনন্দোৎপাদন করিলেন।

কিছু দিন পরে বিলাসবতী গর্ভবতী হইলেন। শশধরের প্রতিবিম্ব পতিত হইলে সরোবর যেরূপ উজ্জ্বল হয়, পারিজাত কুসুম বিকসিত হইলে নন্দনবনের যেরূপ শোভা হয়, বিলাসবতী গর্ভ ধারণ করিয়া সেইরূপ অপূর্ব্বশ্রী প্রাপ্ত হইলেন। দিন দিন গর্ভের উপচয় হইতে লাগল। সলিলভারাক্রান্ত মেঘমালার ন্যায় বিলাসবতী গর্ভভারে মন্থরগতি হইলেন। মুখে বারংবার জৃম্ভিকা ও জল উঠিতে লাগিল। শরীর অলস ও পাণ্ডুবর্ণ হইল। এই সকল লক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া পরিজনেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিল রাণী গর্ভিণী হইয়াছেন।

একদা প্রদোষ সময়ে শুকনাস ও রাজা রাজভবনে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কুলবর্দ্ধনানাম্নী প্রধান পরিচারিকা তথায় উপস্থিত হইয়া রাজার কর্ণে মহিষীর গর্ভসঞ্চারের সংবাদ কহিল। নরপতি শুভ সংবাদ শুনিয়া আনন্দের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। আহ্লাদে কলেবর রোমাঞ্চিত ও কপোলমূল বিকসিত হইয়া উঠিল। তখন হর্ষোৎফুল্ল লোচনে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে তিনি রাজার ও কুলবর্দ্ধনার আকৃতি দেখিয়াই অনুমান করিলেন রাজার অভীষ্ট সিদ্ধ হইয়াছে। তথাপি সন্দেহনিবারণের নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ! স্বপ্নদর্শন কি সফল হইয়াছে? রাজা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, যদি কুলবর্দ্ধনার কথা মিথ্যা না হয় তাহা হইলে স্বপ্ন সফল বটে। চল, আমরা স্বয়ং গিয়া জানিয়া আসি। এই কথা বলিয়া গাত্র হইতে উন্মোচন করিয়া শুভ সংবাদের পারিতোষিকস্বরূপ বহুমূল্য অলঙ্কার কুলবর্দ্ধনাকে দিয়া বিদায় করিলেন। আপনারাও মহিষীর বাসভবনে চলিলেন। যাইতে যাইতে রাজার দক্ষিণ লোচন স্পন্দিত হইল।

তথায় গিয়া দেখিলেন, মহিষী গর্ভোচিত কোমল শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, গর্ভে সন্তানের উদয় হওয়াতে মেঘাবৃতশশিমণ্ডলশালিনী রজনীর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। শিরোভাগে মঙ্গলকলস রহিয়াছে, চতুর্দ্দিকে মণির প্রদীপ জ্বলিতেছে এবং গৃহে শ্বেত সর্ষপ বিকীর্ণ আছে। রাণী রাজাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে শয্যা হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, প্রিয়ে! আর কষ্ট পাইবার প্রয়োজন নাই। বিনা অভ্যুত্থানেই যথেষ্ট আদর প্রকাশ হইয়াছে। এই বলিয়া শয্যার এক পার্শ্বে বসিলেন। শুকনাস স্বতন্ত্র এক স্থানে উপবেশন করিলেন। রাজা মহিষীর আকার প্রকার দেখিয়াই গর্ভলক্ষণ জানিতে পারিলেন; তথাপি পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়ে! শুকনাস জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কুলবর্দ্ধনা যাহা কহিয়া আসিল সত্য কি না? মহিষী লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। বারংবার জিজ্ঞাসা ও অনুরোধ করাতে কহিলেন, কেন আর আমাকে লজ্জা দাও, আমি কিছুই জানি না; এই বলিয়া পুনর্ব্বার অধোমুখী হইলেন। এইরূপ অনেক পরিহাসকথার পর শুকনাস আপন আলয়ে প্রস্থান করিলেন।

ক্রমে ক্রমে গর্ভের উপচয় হওয়াতে মহিষীর যে কিছু গর্ভদোহদ হইতে লাগিল রাজা তৎক্ষণাৎ সম্পাদন করিতে লাগিলেন। প্রসবসময় সমাগত হইলে মহিষী শুভ দিনে শুভ লগ্নে এক পুত্ত্র সন্তান প্রসব করিলেন। নরপতির পুত্ত্র হইয়াছে শুনিয়া নগরবাসী লোকের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। রাজবাটী মহোৎসবময়, নগর আনন্দময় ও পথ কোলাহলময় হইল। গৃহে গৃহে নৃত্য, গীত, বাদ্য, আরম্ভ হইল। নরপতি সানন্দ চিত্তে দীন, দুঃখী, অনাথ প্রভৃতিকে অর্থ দান করিতে লাগিলেন। যে যাহা আকাঙ্ক্ষা করিল তাহাকে তাহাই দিলেন। কারাবদ্ধকে মুক্ত ও ধনহীনকে ঐশ্বর্য্যশালী করিলেন।

গণকেরা গণনা দ্বারা শুভলগ্ন স্থির করিয়া দিলে নরপতি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত মন্ত্রীর সহিত গৃহে গমন করিলেন। দেখিলেন, সূতিকাগৃহের দ্বারদেশে দুই পার্শ্বে সলিলপূর্ণ দুই মঙ্গলকলস, স্তম্ভের উপরিভাগে বিচিত্র কুসুমে গ্রথিত মঙ্গলমালা। পুরন্ধ্রীবর্গ কেহ বা ষষ্ঠীদেবীর পূজা করিতেছে, কেহ বা মাতৃকাগণের বিচিত্র মূর্ত্তি চিত্রপটে লিখিতেছে। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে শান্তিজল নিক্ষেপ করিতেছেন। পুরোহিতেরা নারায়ণের সহস্র নাম পাঠ করিয়া শুভ স্বস্ত্যয়ন করিতেছেন। রাজা জল ও অনল স্পর্শ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রাজকুমার মহিষীর অঙ্কে শয়ন করিয়া সূতিকাগৃহ উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছেন। দেহপ্রভায় দীপপ্রভা তিরোহিত হইয়াছে। এরূপ অঙ্গসৌষ্ঠব ও রূপলাবণ্য, যে হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় যেন, সাক্ষাৎ কুমার রাজকুমাররূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। রাজা নিমেষশূন্য লোচনে বারংবার দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু অন্তঃকরণ তৃপ্ত হইল না। যত বার দেখেন অদৃষ্টপূর্ব্ব ও অভিনব বোধ হয়। সস্পৃহ ও প্রীতিবিস্ফারিত নেত্র দ্বারা পুনঃপুনঃ অবলোকন করিয়া নব নব আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন এবং আপনাকে চরিতার্থ ও পরমসৌভাগ্যশালী জ্ঞান করিলেন। শুকনাস সতর্কতা পূর্ব্বক বিস্ময়বিকসিত নয়নে রাজকুমারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিলক্ষণ রূপে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, মহারাজ! দেখুন, কুমারের অঙ্গে চক্রবর্ত্তী ভূপতির লক্ষণ সকল লক্ষিত হইতেছে। করতলে শঙ্খচক্ররেখা, চরণতলে পতাকারেখা, প্রশস্ত ললাট, দীর্ঘ লোচন, উন্নত নাসিকা, লোহিত অধর এই সকল চিহ্ন দ্বারা মহাপুরুষলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে।

মন্ত্রী রাজকুমারের এইরূপ রূপ বর্ণনা করিতেছেন এমন সময়ে মঙ্গলকনামা এক পুরুষ প্রবেশিয়া রাজাকে নমস্কার করিল ও হর্ষোৎফুল্ললোচনে কহিল, মহারাজ! মনোরমার গর্ভে শুকনাসের এক পুত্ত্র সন্তান জন্মিয়াছে। নরপতি এই শুভ সংবাদ শ্রবণ করিয়া অমৃতবৃষ্টিতে অভিষিক্ত হইলেন এবং আহ্লাদিত চিত্তে কহিলেন, আজি কি শুভ দিন, কি শুভ সংবাদ শুনিলাম! বিপদ্ বিপদের ও সম্পদ সম্পদের অনুসরণ করে এই জনপ্রবাদ কখন মিথ্যা নহে। এই বলিয়া প্রীতিবিকসিত মুখে হাসিতে হাসিতে সমাগত পুরুষকে শুভ সংবাদের অনুরূপ পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলেন। পরে নর্ত্তক, বাদক ও গায়কগণ সমভিব্যাহারে শুকনাসের মন্দিরে গমন করিয়া মহামহোৎসবে প্রবৃত্ত হইলেন। দশম দিবসে পবিত্র মুহূর্ত্তে কোটি কোটি গাভী ও সুবর্ণ ব্রাহ্মণসাৎ করিয়া ও দীন দুঃখীকে অনেক ধন দিয়া নরপতি পুত্ত্রের নামকরণ করিলেন। স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, পূর্ণচন্দ্র রাজ্ঞীর মুখমণ্ডলে প্রবেশ করিতেছে, সেই নিমিত্ত পুত্ত্রের নাম চন্দ্রাপীড় রাখিলেন। মন্ত্রীও আপন ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন পূর্ব্বক রাজার অভিমতে আপন পুত্ত্রের নাম বৈশম্পায়ন রাখিলেন। ক্রমে চূড়াকরণ প্রভৃতি সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন হইল।

 ২.০২ কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ

কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ না হয় এই নিমিত্ত রাজা নগরের প্রান্তে শিপ্রানদীর তীরে এক বিদ্যামন্দির প্রস্তুত করাইলেন। বিদ্যামন্দিরের এক পার্শ্বে অশ্বশালা ও নিম্নে ব্যায়ামশালা প্রস্তুত হইল; চতুর্দ্দিক্ উন্নত প্রাচীর দ্বারা পরিবৃত হইল। অশেষবিদ্যাপারদর্শী মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকগণ অতিযত্নে আনীত ও শিক্ষাপ্রদানে নিয়োজিত হইলেন। নরপতি শুভ দিনে স্বপুত্ত্র চন্দ্রাপীড় ও মন্ত্রিপুত্ত্র বৈশম্পায়নকে তাঁহাদিগের নিকটে সমর্পণ করিলেন। প্রতিদিন মহিষীর সহিত স্বয়ং বিদ্যামন্দিরে উপস্থিত হইয়া তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। রাজকুমার এরূপ বুদ্ধিমান্ ও চতুর ছিলেন যে, অধ্যাপকগণ তাঁহার নব নব বুদ্ধি-কৌশল দর্শনে চমৎকৃত ও উৎসাহিত হইয়া সমধিক পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক শিক্ষা দিতে লাগিলেন। তিনিও অনন্যমনা ও ক্রীড়াসক্তিরহিত হইয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত বিদ্যা অধ্যয়ন করিলেন। তাঁহার হৃদয়দর্পণে সমুদায় কলা সংক্রান্ত হইল। অল্পকালের মধ্যেই শব্দশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র, রাজনীতি, ব্যায়ামকৌশল, অস্ত্র ও সঙ্গীত বিদ্যা, সর্ব্বদেশভাষা এবং কাব্য, নাটক, ইতিহাস প্রভৃতি সমুদায় শিখিলেন। ব্যায়ামপ্রভাবে শরীর এরূপ বলিষ্ঠ হইল যে, করভ সকল সিংহ দ্বারা আক্রান্ত হইলে যেরূপ নড়িতে পারে না, সেইরূপ তিনি ধরিলেও এক পা চলিতে পারিত না। ফলতঃ এরূপ পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী হইলেন যে, দশজন বলবান্ পুরুষ যে মুদ্গর তুলিতে পারেন না, তিনি অবলীলাক্রমে সেই মুদ্গর ধারণ পূর্ব্বক ব্যায়াম করিতেন।

ব্যায়াম ব্যতিরেকে আর সকল বিদ্যায় বৈশম্পায়ন চন্দ্রাপীড়ের অনুরূপ হইলেন। শৈশবাবধি একত্র বিদ্যাভ্যাস প্রযুক্ত পরস্পরের অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট মিত্রতা জন্মিল। বৈশম্পায়ন ব্যতিরেকে রাজকুমার একমুহূর্ত্তও একাকী থাকিতে পারিতেন না। বৈশম্পায়ন সর্ব্বদা রাজকুমারের নিকটবর্ত্তী থাকিতেন। এই রূপে বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস করিতে করিতে শৈশবকাল অতীত ও যৌবনকাল সমাগত হইল। চন্দ্রোদয়ে প্রদোষের যেরূপ রমণীয়তা হয়, গগনমণ্ডলে ইন্দ্রধনু উদিত হইলে বর্ষাকালের যেরূপ শোভা হয়, কুসুমোদ্গমে কল্পপাদপের যেরূপ শ্রী হয়, যৌবনারম্ভে রাজকুমার সেইরূপ পরমরমণীয়তা ধারণ করিলেন। বক্ষঃস্থল বিশাল, ঊরুযুগল মাংসল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, ভুজদ্বয় দীর্ঘ, স্কন্ধদেশ স্থূল এবং স্বর গম্ভীর হইল।

উত্তম রূপে বিদ্যাশিক্ষা হইলে আচার্য্যেরা বিদ্যালয় হইতে গৃহে যাইবার অনুমতি দিলেন। তদনুসারে রাজা চন্দ্রাপীড়কে বাটীতে আনাইবার নিমিত্ত শুভ দিনে অনেক তুরঙ্গ, মাতঙ্গ, পদাতি সৈন্য, সমভিব্যাহারে দিয়া সেনাধ্যক্ষ বলাহককে বিদ্যামন্দিরে পাঠাইয়া দিলেন। সমাগত অন্যান্য রাজগণও চন্দ্রাপীড়ের দর্শনলালসায় বিদ্যালয়ে গমন করিলেন। বলাহক বিদ্যামন্দিরে প্রবেশিয়া রাজকুমারকে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, কুমার! মহারাজ কহিলেন, “আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে। তুমি সমস্ত শাস্ত্র, সকল কলা ও সমুদায় আয়ুধবিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ। এক্ষণে আচার্য্যেরা বাটী আসিতে অনুমতি দিয়াছেন। প্রজারা ও পরিজনেরা দেখিতে অতিশয় উৎসুক হইয়াছে। অতএব আমার অভিলাষ, তুমি অবিলম্বে বাটী আসিয়া দর্শনোৎসুক পরিজনদিগকে দর্শন দিয়া পরিতৃপ্ত কর এবং ব্রাহ্মণদিগের সমাদর, মানিলোকের মানরক্ষা, সন্তানের ন্যায় প্রজাদিগের প্রতিপালন ও বন্ধুবর্গের আনন্দোৎপাদন পূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্য সম্ভোগ কর।” আপনার আরোহণের নিমিত্ত মহরাজ ত্রিভুবনের এক অমূল্য রত্নস্বরূপ, বায়ু ও গরুড়ের ন্যায় অতিবেগগামী, ইন্দ্রায়ুধনামা অপূর্ব্ব ঘোটক প্রেরণ করিয়াছেন। ঐ ঘোটক সাগরের প্রবাহমধ্য হইতে উত্থিত হয়, পারস্যদেশের অধিপতি মহারত্ন ও আশ্চর্য্য পদার্থ বলিয়া উহা মহারাজকে উপহার দেন। অনেক অশ্বলক্ষণবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, উচ্চৈঃশ্রবার যে সকল সুলক্ষণ শুনিতে পাওয়া যায়, উহারও সেই সকল সুলক্ষণ আছে। ফলতঃ ইন্দ্রায়ুধ সামান্য ঘোটক নয়। আমরা ঐরূপ ঘোটক কখন দেখি নাই। দ্বারদেশে বদ্ধ আছে, অনুমতি হইলে আনয়ন করা যায়। দর্শনাভিলাষী রাজারাও সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া বাহিরে আপনার প্রতীক্ষা করিতেছেন।

বলাহক এই কথা কহিলে চন্দ্রাপীড় গম্ভীর স্বরে আদেশ করিলেন, ইন্দ্রায়ুধকে এই স্থানে লইয়া আইস। আজ্ঞামাত্র, অতি বৃহৎ, স্থূলকায়, মহাতেজস্বী, প্রচণ্ডবেগশালী, বলবান্ ইন্দ্রায়ুধ আনীত হইল। ঐ ঘোটক এরূপ বলিষ্ঠ ও তেজস্বী যে দুই বীর পুরুষ উভয় পার্শ্বে মুখের বল্‌গা ধরিয়াও উন্নমনের সময় মুখ নিম্ন করিয়া রাখিতে পারেন না, এরূপ উচ্চ যে, উন্নত পুরুষেরাও কর প্রসারিত করিয়া পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করিতে পারে না। চন্দ্রাপীড় সুলক্ষণসম্পন্ন অদ্ভুত অশ্ব অবলোকন করিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, অসুর ও দেবগণ সাগর মন্থন করিয়া কি রত্ন লাভ করিয়াছেন? দেবরাজ ইন্দ্র ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করেন নাই তাঁহার ত্রৈলোক্যাধিপত্যই বিফল। জলনিধি তাঁহাকে সামান্য উচ্চৈঃশ্রবা ঘোটক প্রদান করিয়া প্রতারণা করিয়াছেন। দেবাদিদেব নারায়ণ যদি ইহাকে একবার নেত্রগোচর করেন, বোধ হয় পক্ষিরাজ গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ জন্য তাঁহার আর অহঙ্কার থাকে না। পিতার কি আধিপত্য! ত্রিভুবনদুর্লভ এতাদৃশ রত্ন সকলও তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন। ইহার আকার ও লক্ষণ দেখিয়া বোধ হইতেছে, এ প্রকৃত ঘোটক নয়। কোন মহাত্মা শাপগ্রস্ত হইয়া অশ্বরূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবেন।

এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। অশ্বের নিকট উপস্থিত হইয়া মনে মনে নমস্কার ও আরোহণজন্য অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা পূর্ব্বক পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও বিদ্যালয় হইতে বহির্গত হইলেন। বহিঃস্থিত অশ্বারূঢ় নৃপতিগণ চন্দ্রাপীড়কে দেখিবামাত্র আপনাদিগকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং সাক্ষাৎকারলালসায় ক্রমে ক্রমে সকলেই সম্মুখে আসিতে লাগিলেন। বলাহক একে একে সকলের নাম ও বংশের নির্দ্দেশ পূর্ব্বক পরিচয় দিয়া দিল। রাজকুমার মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা যথোচিত সমাদর করিলেন। তাঁহাদিগের সহিত নানাপ্রকার সদালাপ করিতে করিতে সুখে নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। বন্দিগণ উচ্চৈঃস্বরে সুললিত মধুর প্রবন্ধে স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। ভৃত্যেরা চামর ব্যজন ও মস্তকে ছত্রধারণ করিল। বৈশম্পায়নও অন্য এক তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

চন্দ্রাপীড় ক্রমে ক্রমে নগরের মধ্যবর্ত্তী পথে সমাগত হইলেন। নগরবাসীরা সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক রাজকুমারের সুকুমার আকার অবলোকন করিতে লাগিল। নগরস্থ সমস্ত বাটীর দ্বার উদ্ঘাটিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, নগরী, চন্দ্রাপীড়কে দেখিবার নিমিত্ত একেবারে সহস্র সহস্র নেত্র উন্মীলন করিল। চন্দ্রাপীড় নগরে আসিতেছেন শুনিয়া রমণীগণ অতিশয় উৎসুক হইল এবং আপন আপন আরদ্ধ কর্ম্ম সমাপন না করিয়াই কেহ বা অলক্তক পরিতে পরিতে, কেহ বা কেশ বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বহির্গত হইয়া, কেহ বা প্রাসাদোপরি আরোহণ করিয়া এক দৃষ্টিতে পথ পানে চাহিয়া রহিল। একবারে সোপানপরম্পরায় শত শত কামিনীজনের অসম্ভ্রমে পাদনিঃক্ষেপ করায় প্রাসাদমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও অশ্রুতপূর্ব্ব ভূষণশব্দ সমুৎপন্ন হইল। গবাক্ষজালের নিকটে কামিনীগণের মুখপরম্পরা বিকসিত কমলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। স্ত্রীগণের চরণ হইতে আর্দ্র অলক্তক পতিত হওয়াতে ক্ষিতিতল পল্লবময় বোধ হইল। তাহাদিগের অঙ্গশোভায় নগর লাবণ্যময়, অলঙ্কারপ্রভায় দিগ্বলয় ইন্দ্রায়ুধময়, মুখমণ্ডলে ও লোচনপরম্পরায় গগনমণ্ডল চন্দ্রময়, পথ নীলোৎপলময় বোধ হইতে লাগিল। রাজকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি দেখিয়া বিলাসিনীগণ চমৎকৃত ও মোহিত হইয়া পরস্পর পরিহাস পূর্ব্বক কহিতে লাগিল সখি! এই পৃথিবীতে সেই ধন্য ও সৌভাগ্যবতী, এই পুরুষরত্ন যাহার কর গ্রহণ করিবেন। আহা! এরূপ পরমসুন্দর পুরুষ ত কখন দেখি নাই। বিধি বুঝি পুরুষনিধি করিয়া ইঁহার সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। যাহা হউক, আজি আমরা অঙ্গবিশিষ্ট অনঙ্গকে প্রত্যক্ষ করিলাম। ফলতঃ নির্ম্মল জলে ও স্বচ্ছ স্ফটিকে যেরূপ প্রতিবিম্ব পতিত হয়, সেইরূপ কামিনীগণের হৃদয়দর্পণে চন্দ্রাপীড়ের মোহিনী মূর্ত্তি প্রতিবিম্বিত হইল। রাজকুমার ক্ষণকাল পরে তাহাদিগের দৃষ্টির অগোচর হইলেন, হৃদয়ের অগোচর কোন কালেই হইতে পারিলেন না। রাজকুমার রাজবাটীর সমীপবর্ত্তী হইলে পৌরাঙ্গণারা পুষ্পবৃষ্টির ন্যায় তাঁহার মস্তকে মঙ্গললাজাঞ্জলি বর্ষণ করিল।

ক্রমে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া ঘোটক হইতে অবতীর্ণ হইলেন। বলাহক অগ্রে অগ্রে পথ দেখাইয়া চলিল। রাজকুমার বৈশম্পায়নের হস্তধারণপূর্ব্বক রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, শত শত বলবান দ্বারপাল অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দ্বারে দণ্ডায়মান আছে। দ্বারদেশ অতিক্রম করিয়া দেখিলেন, কোন স্থানে ধনু, বাণ, তরবারি প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্রে পরিপূর্ণ অস্ত্রশালা; কোন স্থানে সিংহ, গণ্ডার, করী, করভ, ব্যাঘ্র ভল্লূক প্রভৃতি ভয়ঙ্করপশুসমাকীর্ণ পশুশালা; কোন স্থানে নানা দেশীয়, সুলক্ষণসম্পন্ন, নানাপ্রকার অশ্বে বেষ্টিত মন্দুরা; কোন স্থানে কুররী, কোকিল, রাজহংস, চাতক, শিখণ্ডী, শুক, শারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণের মধুর কোলাহলে পরিপূর্ণ পক্ষিশালা; কোন স্থানে বেণু, বীণা, মুরজ, মৃদঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রে বিভূষিত সঙ্গীতশালা; কোন স্থানে বিচিত্রচিত্রশোভিত চিত্রশালিকা শোভা পাইতেছে। কৃত্রিম ক্রীড়াপর্ব্বত, মনোহর সরোবর, সুরম্য জলযন্ত্র, রমণীয় উপবন স্থানে স্থানে রহিয়াছে। অশেষদেশভাষাজ্ঞ নীতিপরায়ণ ধার্ম্মিক পুরুষেরা ধর্ম্মাধিকরণমন্দিরে উপবেশন পূর্ব্বক ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মানুসারে বিচার করিতেছেন। সমাগত পুরুষেরা বিবিধরত্নাসনভূষিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। কোন স্থানে নর্ত্তকীরা নৃত্য, গায়কেরা সঙ্গীত ও বন্দিগণ স্তুতিপাঠ করিতেছে। জলচর পক্ষী সকল কেলি করিয়া বেড়াইতেছে। বালকবালিকাগণ ময়ূর ও ময়ূরীর সহিত ক্রীড়া করিতেছে। হরিণ ও হরিণীগণ মানুষসমাগমে ত্রস্ত হইয়া ভয়চকিতলোচনে বাটীর চতুর্দ্দিকে দৌড়িতেছে।

অনন্তর ছয় প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া সপ্তম প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া মহারাজের আবাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। অন্তঃপুরপুরন্ধ্রীরা রাজকুমারকে দেখিবামাত্র আনন্দিত মনে মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। মহারাজ পরিষ্কৃত শয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে নিষণ্ণ আছেন, শরীররক্ষাধিকৃত অস্ত্রধারী দ্বারপালেরা সতর্কতা পূর্ব্বক প্রহরীর কার্য্য করিতেছে; এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় পিতার নিকটে উপস্থিত হইলেন। “মহারাজ! অবলোকন করুন” দ্বারপাল এই কথা কহিলে, রাজা দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন সমভিব্যাহারী চন্দ্রাপীড়কে সমাগত দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। করপ্রসারণ পূর্ব্বক প্রণত পুত্ত্রকে আলিঙ্গন করিলেন। তাঁহার স্নেহবিকসিত লোচন হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বৈশম্পায়নকেও সমাদরে আলিঙ্গন করিয়া আসনে উপবেশন করিতে কহিলেন। ক্ষণকাল তথায় বসিয়া রাজকুমার জননীর নিকট গমন করিলেন। পুত্ত্রবৎসলা বিলাসবতী স্নিগ্ধ ও প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে পুত্ত্রকে পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ ও হস্ত দ্বারা গাত্রস্পর্শ পূর্ব্বক আপন উৎসঙ্গ দেশে বসাইলেন ও স্নেহসংবলিত মধুর বচনে বলিলেন, বৎস! তোমাকে নানা বিদ্যায় বিভূষিত দেখিয়া নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত হইল। এক্ষণে বধূসহচারী দেখিলে সকল মনোরথ পূর্ণ হয়। এই কথা কহিয়া লজ্জাবনত পুত্ত্রের কপোলদেশে চুম্বন করিতে লাগিলেন।

রাজকুমার এই রূপে সমস্ত অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে দর্শন দিয়া আহ্লাদিত করিলেন। পরিশেষে শুকনাসের ভবনে উপস্থিত হইলেন। অমাত্যের ভবনও এরূপ সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, রাজবাটী হইতে বিভিন্ন বোধ হয় না। শুকনাস সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। সমাগত সামন্ত ও ভূপতিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন, এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়ন তথায় প্রবেশিলেন। সকলে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সমাদরে সম্ভাষণ করিল। শুকনাস প্রণত পুত্ত্র ও রাজকুমারকে যুগপৎ আলিঙ্গন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পরে রাজনন্দনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! অদ্য তোমাকে কৃতবিদ্য দেখিয়া মহারাজ যেরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছেন, শত শত সাম্রাজ্যলাভেও তাদৃশ সন্তোষের সম্ভাবনা নাই। আজি গুরুজনের আশীর্ব্বাদ ও মহারাজের পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সুকৃতি ফলিল। আজি কুলদেবতা প্রসন্ন হইলেন। প্রজাগণ কি ধন্য ও পুণ্যবান্! যাহাদিগের প্রতিপালনের নিমিত্ত তুমি ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছ। বসুমতী কি সৌভাগ্যবতী! যিনি পতিভাবে তোমার আরাধনা করিবেন। ভগবান্ যেরূপ নানা অবতার হইয়া ভূভার বহন করিয়া থাকেন, তুমিও সেইরূপ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া ভূভার বহন ও প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। রাজকুমার শুকনাসের সভায় ক্ষণকাল অবস্থিতি করিয়া মনোরমার নিকট গমন ও ভক্তিপূর্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। তথা হইতে বাটী আসিয়া স্নান ভোজন প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া মহারাজের আজ্ঞানুসারে শ্রীমণ্ডপনামক প্রাসাদে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। শ্রীমণ্ডপের নিকটে ইন্দ্রায়ুধের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।

দিবাবসানে দিঙ্মণ্ডল লোহিত বর্ণ হইল। সন্ধ্যারাগে রক্তবর্ণ হইয়া চক্রবাকমিথুন ভিন্ন ভিন্ন দিকে উৎপতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, বিরহবেদনা স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে তাহাদিগের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছে ও গাত্র হইতে রক্তধারা পড়িতেছে। সম্মানিত ব্যক্তিরা বিপদ্‌কালেও নীচ পদবীতে পদার্পণ করেন না, ইহাই জানাইবার নিমিত্ত রবি অস্তগমনকালেও পশ্চিমাচলের উন্নত শিখর আশ্রয় করিলেন। দিনকর অস্তগত হইলেন, কিন্তু রজনী সমাগতা হয় নাই। এই সময়ে তাপের বিগম ও অন্ধকারের অনুদয় প্রযুক্ত লোকের অন্তঃকরণ আনন্দে প্রফুল্ল হইল। সূর্য্যরূপ সিংহ অস্তাচলের গুহাশায়ী হইলে ধ্বান্তরূপ দন্তিযূথ নির্ভয়ে জগৎ আক্রমণ করিল। নলিনী দিনমণির বিরহে অলিরূপ অশ্রুজল পরিত্যাগ পূর্ব্বক কমলরূপ নেত্র নিমীলন করিল। বিহঙ্গমকুল কোলাহল করিয়া উঠিল। অনন্তর প্রজ্বলিত প্রদীপশিখা ও উজ্জ্বল মণির আলোকে রাজবাটীর তিমির নিরস্ত হইয়া গেল। চন্দ্রাপীড় পিতা মাতার নিকটে নানা কথা প্রসঙ্গে ক্ষণকাল ক্ষেপ করিয়া আহারাদি করিলেন। পরে আপন প্রাসাদে আগমন পূর্ব্বক কোমলশয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে সুখে নিদ্রা গেলেন।

প্রভাত হইলে পিতার অনুমতি লইয়া শিকারী কুক্কুর, শিক্ষিত হস্তী, বেগগামী অশ্ব ও অসংখ্য অস্ত্রধারী বীরপুরুষ সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ার্থ বনে প্রবেশিলেন। দেখিলেন, উদারস্বভাব সিংহ সম্রাটের ন্যায় নির্ভয়ে গিরিগুহায় শয়ন করিয়া আছে। হিংস্র শার্দ্দূল ভয়ঙ্কর আকার স্বীকার পূর্ব্বক পশুদিগকে আক্রমণ করিতেছে। মৃগকুল ত্রস্ত ও শশব্যস্ত হইয়া ত্বরিত বেগে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে। বন্য হস্তী দলবদ্ধ হইয়া চলিতেছে। মহিষকুল রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা ভয় প্রদর্শন করিয়া নির্ভয়ে বেড়াইতেছে। বরাহ, ভল্লূক, গণ্ডার প্রভৃতির ভীষণ আকার দেখিলে ও চীৎকার শব্দ শুনিলে কলেবর কম্পিত হয়। নিবিড় বন, তথায় সূর্য্যের কিরণ প্রায় প্রবেশ করিতে পারে না। রাজকুমার এতাদৃশ ভীষণ গহনে প্রবেশিয়া ভল্ল ও নারাচ দ্বারা ভল্লূক, সারঙ্গ, শূকর প্রভৃতি বহুবিধ বন্য পশু মারিয়া ফেলিলেন। কোন কোন পশুকে আঘাত না করিয়া কেবল কৌশলক্রমে ধরিলেন। মৃগয়াবিষয়ে এরূপ সুশিক্ষিত ছিলেন যে, উড্ডীন বিহগাবলীকেও অবলীলাক্রমে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

বেলা দুই প্রহর হইল। সূর্য্যমণ্ডল ঠিক্ মস্তকের উপরিভাগ হইতে অগ্নিময় কিরণ বিস্তার করিল। সূর্য্যের আতপে ও মৃগয়াজন্য শ্রমে একান্ত ক্লান্ত হওয়াতে রাজকুমারের সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মবারিতে পরিপ্লুত হইল। স্বেদার্দ্র শরীরে কুসুমরেণু পতিত হওয়াতে ও বিন্দু বিন্দু রক্ত লাগাতে যেন অঙ্গে অঙ্গরাগ ও রক্তচন্দন লেপন করিয়াছেন, বোধ হইল। ইন্দ্রায়ুধের মুখে ফেনপুঞ্জ ও শরীরে স্বেদজল বহির্গত হইল। সেই রৌদ্রে স্বহস্তে নব পল্লবের ছত্র ধরিয়া সমভিব্যাহারী রাজগণের সহিত মৃগয়ার কথা কহিতে কহিতে বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তথায় মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ ও ক্ষণকাল বিশ্রামের পর স্নান করিয়া অঙ্গে অঙ্গরাগলেপন ও পট্টবসন পরিধান পূর্ব্বক আহারমণ্ডপে গমন করিলেন। আপনি আহার করিয়া স্বহস্তে ইন্দ্রায়ুধের ভোজনসামগ্রী আনিয়া দিলেন। সে দিন এইরূপে অতিবাহিত হইল।

পর দিন প্রাতঃকালে আপন প্রাসাদে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কৈলাসনামক কঞ্চুকী স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা এক সুন্দরী কুমারীকে সঙ্গে করিয়া তথায় উপস্থিত হইল, বিনীত বচনে কহিল, কুমার দেবী আদেশ করিলেন, এই কন্যাকে আপনার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী করুন। ইনি কুলুতদেশীয় রাজার দুহিতা, নাম পত্রলেখা। মহারাজ কুলুতরাজধানী জয় করিয়া এই কন্যাকে বন্দী করিয়া আনেন ও অন্তঃপুরপরিচারিকার মধ্যে নিবেশিত করেন। রাণী পরিচয় পাইয়া আপন কন্যার ন্যায় লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন এবং অতিশয় ভাল বাসিয়া থাকেন, ইহাকে সামান্য পরিচারিকার ন্যায় জ্ঞান করিবেন না। সখী ও শিষ্যার ন্যায় বিশ্বাস করিবেন। রাজকন্যার সমুচিত সমাদর করিবেন। ইনি অতিশয় সুশীল ও সরলস্বভাব এবং এরূপ গুণবতী যে আপনাকে ইঁহার গুণে অবশ্য বশীভূত হইতে হইবেক। আপাততঃ ইঁহার কুল শীলের বিষয় কিছুই জানেন না বলিয়া কিঞ্চিৎ পরিচয় দিলাম। কঞ্চুকীর মুখে জননীর আজ্ঞা শুনিয়া নিমেষশূন্য লোচনে পত্রলেখাকে দেখিতে লাগিলেন। তাহার আকার দেখিয়াই বুঝিলেন ঐ কন্যা সামান্য কন্যা নহে। অনন্তর জননীর আদেশ গ্রহণ করিলাম বলিয়া কঞ্চুকীকে বিদায় দিলেন। পত্রলেখা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী হইয়া ছায়ার ন্যায় রাজকুমারের অনুবর্ত্তিনী হইল। রাজকুমারও তাহার গুণে প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া দিন দিন নব নব অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

২.০৩ রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক

কিছু দিন পরে রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক করিতে অভিলাষ করিলেন। রাজকুমার যুবরাজ হইবেন এই ঘোষণা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। রাজবাটী মহোৎসবময় ও নগর আনন্দকোলাহলে পরিপূর্ণ হইল। অভিষেকের সামগ্রীসম্ভার সংগ্রহের নিমিত্ত লোক সকল দিগ্‌দিগন্তে গমন করিল।

একদা কার্য্যক্রমে চন্দ্রাপীড় অমাত্যের বাটীতে গিয়াছেন; তথায় শুকনাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া মধুর বচনে কহিলেন, কুমার! তুমি সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সমুদায় বিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ, সকল কলা শিখিয়াছ, ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া যাহা জ্ঞাতব্য সমুদায় জানিয়াছ। তোমার অজ্ঞাত ও উপদেষ্টব্য কিছুই নাই। তুমি যুবা, মহারাজ তোমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও ধনসম্পত্তির অধিকারী করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। সুতরাং যৌবন, ধনসম্পত্তি, প্রভুত্ব, তিনেরই অধিকারী হইলে। কিন্তু যৌবন অতি বিষম কাল। যৌবনরূপ বনে প্রবেশিলে বন্য জন্তুর ন্যায় ব্যবহার হয়। যুবা পুরুষেরা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি পশুধর্ম্মকে সুখের হেতু ও স্বর্গের সেতু জ্ঞান করে। যৌবনপ্রভাবে মনে একপ্রকার তমঃ উপস্থিত হয়, উহা কিছুতেই নিরস্ত হয় না। যৌবনের আরম্ভে অতি নির্ম্মল বুদ্ধিও বর্ষাকালীন নদীর ন্যায় কলুষিতা হয়। বিষয়তৃষ্ণা ইন্দ্রিয়দিগকে আক্রমণ করে। তখন অতিগর্হিত অসৎ কর্ম্মকেও দুষ্কর্ম্ম বলিয়া বোধ হয় না। তখন লোকের প্রতি অত্যাচার করিয়া স্বার্থসম্পাদন করিতেও লজ্জা বোধ হয় না। সুরাপান না করিলে ও চক্ষুর দোষ না থাকিলেও ধনমদে মত্ততা ও অন্ধতা জন্মে। ধনমদে উন্মত্ত হইলে হিতাহিত বা সদসদ্বিবেচনা থাকে না। অহঙ্কার ধনের অনুগামী। অহঙ্কৃত পুরুষেরা মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। আপনাকেই সর্ব্বাপেক্ষা গুণবান্, বিদ্বান্, ও প্রধান বলিয়া ভাবে; অন্যের নিকটেও সেইরূপ প্রকাশ করে। তাহার স্বভাব এরূপ উদ্ধত হয় যে, আপনার মতের বিপরীত কথা শুনিলে তৎক্ষণাৎ খড়্গহস্ত হইয়া উঠে। প্রভুত্বরূপ হলাহলের ঔষধ নাই। প্রভুজনেরা অধীন লোকদিগকে দাসের ন্যায় জ্ঞান করে। আপন সুখে সন্তুষ্ট থাকিয়া পরের দুঃখ সন্তাপ কিছুই দেখিতে পায় না। তাহারা প্রায় স্বার্থপর ও অন্যের অনিষ্টকারক হইয়া উঠে। যৌবরাজ্যে, যৌবন, প্রভুত্ব ও অতুল ঐশ্বর্য্য, এ সকল কেবল অনর্থপরম্পরা। অসামান্যধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ইহার তরঙ্গ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধিরূপ দৃঢ় নৌকা না থাকিলে উহার প্রবল প্রবাহে মগ্ন হইতে হয়। একবার মগ্ন হইলে আর উঠিবার সামর্থ্য থাকে না।

সদ্বংশে জন্মিলেই যে, সৎ ও বিনীত হয় একথা অগ্রাহ্য। উর্ব্বরা ভূমিতে কি কণ্টকবৃক্ষ জন্মে না? চন্দনকাষ্ঠের ঘর্ষণে যে অগ্নি নির্গত হয় উহার কি দাহশক্তি থাকে না? ভবাদৃশ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরাই উপদেশের যথার্থ পাত্র। মূর্খকে উপদেশ দিলে কোন ফল হয় না। দিবাকরের কিরণ কি স্ফটিকমণির ন্যায় মৃৎপিণ্ডে প্রতিফলিত হইতে পারে? সদুপদেশ অমূল্য ও অসমুদ্রসম্ভূত রত্ন। উহা শরীরের বৈরূপ্য প্রভৃতি জরার কার্য্য প্রকাশ না করিয়াও বৃদ্ধত্ব সম্পাদন করে। ঐশ্বর্য্যশালীকে উপদেশ দেয় এমন লোক অতি বিরল। যেমন গিরিগুহার নিকটে শব্দ করিলে প্রতিশব্দ হয়, সেইরূপ পার্শ্ববর্ত্তী লোকের মুখে প্রভুবাক্যের প্রতিধ্বনি হইতে থাকে; অর্থাৎ প্রভু যাহা কহেন, পারিষদেরা তাহাই যুক্তিযুক্ত বলিয়া অঙ্গীকার করে। প্রভুর নিতান্ত অসঙ্গত ও অন্যায় কথাও পারিষদদিগের নিকট সুসঙ্গত ও ন্যায়ানুগত হয় এবং সেই কথার পুনঃপুনঃ উল্লেখ করিয়া তাহারা প্রভুর কতই প্রশংসা করিতে থাকে। তাঁহার কথার বিপরীত কথা বলিতে কাহারও সাহস হয় না। যদি কোন সাহসিক পুরুষ ভয় পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার কথা অন্যায় ও অযুক্ত বলিয়া বুঝাইয়া দেন, তথাপি তাহা গ্রাহ্য হয় না। প্রভু সে সময় বধির হন অথবা ক্রোধান্ধ হইয়া আত্মমতের বিপরীতবাদীর অপমান করেন। অর্থ অনর্থের মূল। মিথ্যা অভিমান, অকিঞ্চিৎকর অহঙ্কার ও বৃথা ঔদ্ধত্য প্রায় অর্থ হইতে উৎপন্ন হয়।

প্রথমতঃ লক্ষ্মীর প্রকৃতি বিবেচনা করিয়া দেখ। ইনি অতিদুঃখে লব্ধ ও অতিযত্নে রক্ষিত হইলেও কখন একস্থানে স্থির হইয়া থাকেন না। রূপ, গুণ, বৈদগ্ধ, কুল, শীল কিছুই বিবেচনা করেন না। রূপবান্, গুণবান্, বিদ্বান্, সদ্বংশজাত, সুশীল ব্যক্তিকেও পরিত্যাগ করিয়া জঘন্য পুরুষাধমের আশ্রয় লন। দুরাচার লক্ষ্মী যাহাকে আশ্রয় করে, সে স্বার্থনিষ্পাদনপর ও লুব্ধপ্রকৃতি হইয়া দ্যূতক্রীড়াকে বিনোদ, পশুধর্ম্মকে রসিকতা, যথেষ্টাচারকে প্রভুত্ব ও মৃগয়াকে ব্যায়াম বলিয়া গণনা করে। মিথ্যা স্তুতিবাদ করিতে না পারিলে ধনিদিগের নিকট জীবিকালাভ করা কঠিন। যাহারা অন্যকার্য্যপরাঙ্মুখ ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হয় এবং সর্ব্বদা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ধনেশ্বরকে জগদীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করে, তাহারাই ধনিগণের সন্নিধানে বসিতে পায় ও প্রশংসাভাজন হয়। প্রভু স্তুতিবাদককে যথার্থবাদী বলিয়া জ্ঞান করেন, তাহার সহিতই আলাপ করেন, তাহাকেই সদ্বিবেচক ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া ভাবেন, তাহার পরামর্শক্রমেই কার্য্য করিয়া থাকেন। স্পষ্টবক্তা উপদেষ্টাকে নিন্দুক বলিয়া অবজ্ঞা করেন, নিকটেও বসিতে দেন না। তুমি দুরবগাহ নীতিপ্রয়োগ ও দুর্ব্বোধ রাজ্যতন্ত্রের ভারগ্রহণে প্রবৃত্ত হইয়াছ; সাবধান, যেন সাধুদিগের উপহাসাস্পদ ও চাটুকারের প্রতারণাস্পদ হইও না। চাটুকারের প্রিয় বচনে তোমার যেন ভ্রান্তি জন্মে না। যথার্থবাদীকে নিন্দুক বলিয়া যেন অবজ্ঞা করিও না। রাজারা আপন চক্ষে কিছুই দেখিতে পান না এবং এরূপ হতভাগ্য লোক দ্বারা পরিবৃত থাকেন, প্রতারণা করাই যাহাদিগের সম্পূর্ণ মানস। তাহারা প্রভুকে প্রতারণা করিয়া আপন অভিপ্রায় সিদ্ধ করিতে পারিলেই চরিতার্থ হয় ও সর্ব্বদা উহারই চেষ্টা পায়। বাহ্য ভক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক আপনাদিগের দুষ্ট অভিপ্রায় গোপন করিয়া রাখে, সময় পাইলেই চাটুবচনে প্রভুকে প্রতারিত করিয়া লোকের সর্ব্বনাশ করে। তুমি স্বভাবতঃ ধীর; তথাপি তোমাকে বারংবার উপদেশ দিতেছি, সাবধান, যেন ধন ও যৌবনমদে উন্মত্ত হইয়া কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ ও অসদাচরণে প্রবৃত্ত হইও না। এক্ষণে মহারাজের ইচ্ছাক্রমে অভিনব যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া কুলক্রমাগত ভূভার বহন কর, অরাতিমণ্ডলের মস্তক অবনত কর, এবং সমুদায় দেশ জয় করিয়া অখণ্ড ভূমণ্ডলে আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। এইরূপ উপদেশ দিয়া অমাত্য ক্ষান্ত হইলেন। চন্দ্রাপীড় শুকনাসের গভীর অর্থযুক্ত উপদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে উহারই আন্দোলন করিতে করিতে বাটী গমন করিলেন।

অভিষেকসামগ্রী সমাহৃত হইলে, অমাত্য ও পুরোহিতের সহিত রাজা শুভ দিনে ও শুভ লগ্নে তীর্থ, নদী ও সাগর হইতে আনীত মন্ত্রপূত বারি দ্বারা রাজকুমারের অভিষেক করিলেন। লতা যেরূপ এক বৃক্ষ হইতে শাখা দ্বারা বৃক্ষান্তর আশ্রয় করে, সেরূপ রাজসংক্রান্ত রাজলক্ষ্মী অংশক্রমে যুবরাজকে অবলম্বন করিলেন। পবিত্র তীর্থজলে স্নান করিয়া রাজকুমার উজ্জ্বল শ্রী প্রাপ্ত হইলেন। অভিষেকানন্তর ধবল বসন, উজ্জ্বল ভূষণ ও মনোহর মাল্য ধারণ পূর্ব্বক অঙ্গে সুগন্ধি গন্ধদ্রব্য লেপন করিলেন। অনন্তর সভামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক শশধর যেরূপ সুমেরুশৃঙ্গে আরোহণ করিলে শোভা হয়, যুবরাজ সেইরূপ রত্নসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সভার পরম শোভা সম্পাদন করিলেন। নব নব উপায় দ্বারা প্রজাদিগের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি ও রাজ্যের সুনিয়ম সংস্থাপন করিয়া পরম সুখে যৌবরাজ্য সম্ভোগ করিতে লাগিলেন। রাজাও পুত্ত্রকে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।

২.০৪ যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন

কিছু দিনের পর যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন। ঘনঘটার ঘোর ঘর্ঘর ঘোষের ন্যায় দুন্দুভিধ্বনি হইল। সৈন্যগণের কলরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। রাজকুমার স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করেণুকায় আরোহণ করিলেন। পত্রলেখাও ঐ হস্তিনীর উপর উঠিয়া বসিল। বৈশম্পায়ন আর এক করিণীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পার্শ্ববর্ত্তী হইলেন। ক্ষণ কালের মধ্যে মহীতল তুরঙ্গময়, দিঙ্মণ্ডল মাতঙ্গময়, অন্তরীক্ষ আতপত্রময়, সমীরণ মদগন্ধময়, পথ সৈন্যময় ও নগর জয়শব্দময় হইল। সেনাগণ সুসজ্জিত হইয়া বহির্গত হইলে তাহাদিগের পাদবিক্ষেপে মেদিনী কাঁপিতে লাগিল। শাণিত অস্ত্র শস্ত্রে দিনকরের করপ্রভা প্রতিবিম্বিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, শিখিকুল গগনমণ্ডলে শিখাকলাপ বিস্তীর্ণ করিয়া রহিয়াছে, সৌদামিনী প্রকাশ পাইতেছে, ইন্দ্রধনু উদিত হইয়াছে। করীদিগের বৃংহিত, অশ্বদিগের হেষারব, দুন্দুভির ভীষণ শব্দ, সৈন্যদিগের কলরবে বোধ হইল যেন, প্রলয়কাল উপস্থিত। ধূলি উত্থিত হইয়া গগনমণ্ডল অন্ধকারাবৃত করিল। আকাশ ও ভূমির কিছুই বিশেষ রহিল না। বোধ হইল যেন, সৈন্যভার সহ্য করিতে না পারিয়া ধরা উপরে উঠিতেছে। এক এক বার এরূপ কলরব হয় যে কিছুই শুনা যায় না।

কতক দূর যাইয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে যুবরাজ এক রমণীয় প্রদেশে উপস্থিত হইলেন। সেই দিন তথায় বাসস্থান নিরূপিত হইল! সেনাগণ আহারাদি করিয়া পটগৃহে নিদ্রা গেল। রাজকুমারও শয়ন করিলেন। প্রত্যূষে সেনাগণ পুনর্ব্বার শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিল। যাইতে যাইতে বৈশম্পায়ন রাজকুমারকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, যুবরাজ! মহারাজ যে দেশ জয় করেন নাই, যে দুর্গ আক্রমণ করেন নাই এরূপ দেশ ও দুর্গই দেখিতে পাই না। আমরা যে দিকে যাইতেছি, দেখিতেছি সকলই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত। মহারাজের বিক্রম ও ঐশ্বর্য্য দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। তিনি সমুদায় দেশ জয় করিয়াছেন, সকল রাজাকে আপন অধীনে রাখিয়াছেন, সমুদায় রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।

অনন্তর যুবরাজ পরাক্রান্ত ও বলশালী সৈন্য দ্বারা পূর্ব্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ক্রমে ক্রমে অবশিষ্ট সকল দেশ জয় করিয়া কৈলাসপর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী হেমজটনামক কিরাতদিগের সুবর্ণপুরনাম্নী নগরীতে উপস্থিত হইলেন। সংগ্রামে কিরাতদিগকে পরাজিত করিয়া পরিশ্রান্ত ও একান্ত ক্লান্ত সেনাগণকে কিঞ্চিৎ কাল বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন। আপনিও তথায় আরাম করিতে লাগিলেন।

একদা তথা হইতে মৃগয়ার্থ নির্গত হইয়া একটী কিন্নর ও একটী কিন্নরী বনে ভ্রমণ করিতেছে দেখিলেন। অদৃষ্টপূর্ব্ব কিন্নরমিথুন দর্শনে অত্যন্ত কৌতুকাক্রান্ত হইয়া ধরিবার আশয়ে সেই দিকে অশ্ব চালনা করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে ধাবিত হইল। কিন্নরমিথুনও মানুষ দর্শনে ভীত হইয়া দ্রুত বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। শীঘ্র গমনে কেহই অপারগ নহে। ঘোটক এরূপ দ্রুতবেগে দৌড়িল যে, কিন্নরমিথুন এই ধরিলাম বলিয়া রাজকুমারের ক্ষণে ক্ষণে বোধ হইতে লাগিল। এ দিকে কিন্নরমিথুনও প্রাণপণে দৌড়িয়া গিয়া এক পর্ব্বতের উপরি আরোহণ করিল। ঘোটক তথায় উঠিতে পারিল না। রাজকুমার পর্ব্বতের উপত্যকা হইতে ঊর্দ্ধ দৃষ্টে দেখিতে লাগিলেন। উহারা পর্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণ পূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিপথের অগোচর হইল।

কিন্নরমিথুনগ্রহণে হতাশ হইয়া মনে মনে কহিলেন, কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি; কিন্নরমিথুন কিরূপে ধরিব, ধরিয়াই বা কি হইবে, একবারও বিবেচনা হয় নাই। বোধ হয় সেনানিবেশ হইতে অধিক দূর আসিয়াছি। এক্ষণে কি করি, কিরূপে পুনর্ব্বার তথায় যাই। এ দিকে কখন আসি নাই, কোন্ পথ দিয়া যাইতে হয় কিছুই জানি না। এই নির্জ্জন গহনে মানবের সমাগম নাই। কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়া যে, পথের নিদর্শন পাইব তাহারও উপায় নাই। শুনিয়াছি সুবর্ণপুরের উত্তরে নিবিড় বন, বন পার হইলেই কৈলাসপর্ব্বত। কিন্নরমিথুন যে পর্ব্বতে আরোহণ করিল বোধ হয়, উহা কৈলাসপর্ব্বত। দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত প্রতিগমন করিলে স্কন্ধাবারে পঁহুছিবার সম্ভাবনা। অদৃষ্টে কত কষ্ট আছে বলিতে পারি না। আপনি কুকর্ম্ম করিয়াছি, কাহার দোষ দিব? কেই বা ইহার ফলভোগ করিবে, যে রূপে হউক যাইতে হইবেক। এই স্থির করিয়া ঘোটককে দক্ষিণ দিকে ফিরাইলেন। তখন বেলা দুই প্রহর। দিনকর গগনমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতিশয় উত্তাপ দিতেছেন। পক্ষিগণ নীরব, বন নিস্তব্ধ, ঘোটক অতিশয় পরিশ্রান্ত ও ঘর্ম্মাক্তকলেবর। আপনিও তৃষ্ণাতুর হইয়াছেন দেখিয়া তরুতলের ছায়ায় অশ্ব বাঁধিলেন এবং হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলের আসনে উপবেশন পূর্ব্বক ক্ষণকাল বিশ্রামের পর জলপ্রাপ্তির আশয়ে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। এক পথে হস্তীর পদচিহ্ন ও মদচিহ্ন রহিয়াছে এবং কুমুদ, কহ্লার ও মৃণাল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পতিত আছে দেখিয়া স্থির করিলেন, গিরিচর করিযূথ এই পথে জলপান করিতে যায়, সন্দেহ নাই। এই পথ দিয়া যাইলে অবশ্য জলাশয় পাইতে পারিব।

অনন্তর সেই পথে চলিলেন। পথের ধারে উন্নত পাদপ সকল বিস্তৃত শাখা প্রশাখা দ্বারা গগন আকীর্ণ করিয়া রহিয়াছে। বোধ হয় যেন, বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক অঙ্গুলি সঙ্কেত দ্বারা তৃষ্ণার্ত্ত পথিকদিগকে জল পান করিবার নিমিত্ত ডাকিতেছে। স্থানে স্থানে কুঞ্জবন ও লতামণ্ডপ, মধ্যে মধ্যে মসৃণ ও উজ্জ্বলশিলা পতিত রহিয়াছে। নানাবিধ রমণীয় প্রদেশ ও বিচিত্র উপবন দেখিতে দেখিতে কতক দূর যাইয়া বারিশীকরসম্পৃক্ত সুশীতল সমীরণস্পর্শে বিগতক্লম হইলেন। বোধ হইল যেন, তুষারে অবগাহন করিতেছেন। সরোবর নিকটবর্ত্তী হওয়াতে মনে মনে অতিশয় আহ্লাদ জন্মিল। অনন্তর মধুপানমত্ত মধুকর ও কেলিপর কলহংসের কোলাহলে আহূত হইয়া সরোবরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। চতুর্দ্দিকে শ্রেণীবদ্ধ তরুমধ্যে ত্রৈলোক্যলক্ষ্মীর দর্পণস্বরূপ বসুন্ধরাদেবীর স্ফটিকগৃহস্বরূপ, অচ্ছোদননামক সরোবর নেত্রগোচর করিলেন। সরোবরের জল অতি নির্ম্মল। জলে কমল, কুমুদ, কহ্লার প্রভৃতি নানাবিধ কুসুম বিকসিত হইয়াছে। মধুকর গুন্ গুন্ ধ্বনি করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধুপান করিতেছে। কলহংস সকল কলরব করিয়া কেলি করিতেছে। কুসুমের সুরভিরেণু হরণ করিয়া শীতল সমীরণ নানা দিকে সুগন্ধ বিস্তার করিতেছে। সরোবরের শোভা দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, কিন্নরমিথুনের অনুসরণ নিষ্ফল হইলেও এই মনোহর সরোবর দেখিয়া আমার নেত্রযুগল সফল ও চিত্ত সফল হইল। এতাদৃশ রমণীয় বস্তু কখন দেখিও নাই, দেখিবও না; বোধ হয়, ভগবান্ ভবানীপতি এই সরোবরের শোভায় মোহিত হইয়া কৈলাসনিবাস পরিত্যাগ করিতে পারেন না। অনন্তর সরোবরের দক্ষিণ তীরে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পৃষ্ঠ হইতে পর্য্যাণ উপনীত হইলে ইন্দ্রায়ুধ এক বার ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠিত হইল। পরে ইচ্ছাক্রমে স্নান ও জলপান করিয়া তীরে উঠিলে রাজকুমার উহার পশ্চাদ্ভাগের পদদ্বয় পাশ দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দিলেন। সে তীরপ্ররূঢ় নবীন দূর্ব্বা ভক্ষণ করিতে লাগিল। রাজকুমারও সরোবরে অবগাহন পূর্ব্বক মৃণাল ভক্ষণ ও জল পান করিয়া তীরে উঠিলেন। এক লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে নলিনীপত্রের শয্যা ও উত্তরীয় বস্ত্রের উপাধান প্রস্তুত করিয়া শয়ন করিলেন।

ক্ষণ কাল বিশ্রামের পর সরসীর উত্তর তীরে বীণাতন্ত্রীঝঙ্কারমিশ্রিত সঙ্গীত শুনিলেন। ইন্দ্রায়ুধ শব্দ শুনিবামাত্র কবল পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই দিকে কর্ণপাত করিল। এই জনশূন্য অরণ্যে কোথায় সঙ্গীত হইতেছে জানিবার নিমিত্ত রাজকুমার যে দিকে শব্দ হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। কেবল অস্ফুট মধুর শব্দ কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ করিতে লাগিল। সঙ্গীতশ্রবণে কুতূহলাক্রান্ত হইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক সরসীর পশ্চিম তীর দিয়া শব্দানুসারে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কতক দূর গিয়া, চতুর্দ্দিকে পরমরমণীয় উপবনমধ্যে কৈলাসাচলের এক প্রত্যন্ত পর্ব্বত দেখিতে পাইলেন। ঐ পর্ব্বতের নাম চন্দ্রপ্রভা; উহার নিম্নে এক মন্দিরের অভ্যন্তরে চরাচরগুরু ভগবান্ শূলপাণির প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। ঐ প্রতিমার সম্মুখে পাশুপতব্রতধারিণী নির্ম্মমা, নিরহঙ্কারা, নির্ম্মৎসরা অমানুষাকৃতি, অষ্টাদশবর্ষদেশীয়া এক কন্যা বীণাবাদন পূর্ব্বক তানলয়বিশুদ্ধ মধুরস্বরে মহাদেবের স্তুতিবাদ করিয়া গান করিতেছেন। কন্যার দেহপ্রভায় উপবন উজ্জ্বল ও মন্দির আলোকময় হইয়াছে। তাঁহার স্কন্ধে জটাভার, গলে রুদ্রাক্ষমালা ও গাত্রে ভস্মলেপ। দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, পার্ব্বতী শিবের আরাধনায় ভক্তিমতী হইয়াছেন।

রাজকুমার তরুশাখায় ঘোটক বাঁধিয়া ভক্তিপূর্ব্বক ভগবান্ ত্রিলোচনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। নিমেষশূন্য লোচনে সেই অঙ্গনাকে নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে ভাবিলেন, কি আশ্চর্য্য? কত অসম্ভাবিত ও অচিন্তিত বিষয় স্বপ্নকল্পিতের ন্যায় সহসা উপস্থিত হয়, তাহা নিরূপণ করা যায় না। আমি মৃগয়ায় নির্গত ও যদৃচ্ছাক্রমে কিন্নরমিথুনের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত ভয়ঙ্কর ও কত রমণীয় প্রদেশ দেখিলাম। পরিশেষে গীতধ্বনিরব অনুসারে এই স্থানে উপস্থিত হইয়া এই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতেছি। কন্যার যেরূপ মনোহর আকার ও মধুর স্বর, তাহাতে কোন ক্রমে মানুষী বোধ হয় না, দেবকন্যা সন্দেহ নাই। ধরণীতলে কি সৌদামিনীর উদ্ভব হইতে পারে? যাহা হউক, যদি আমার দর্শনপথ হইতে সহসা অন্তর্হিত না হন, যদি কৈলাসশিখরে অথবা গগনমণ্ডলে হঠাৎ আরোহণ না করেন, তাহা হইলে, আমি ইঁহার নাম, ধাম ও তপস্যায় অভিনিবেশের কারণ, সমুদায় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব। এই স্থির করিয়া সেই মন্দিরের এক পার্শ্বে উপবেশন পূর্ব্বক সঙ্গীতসমাপ্তির অবসর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন।

সঙ্গীত সমাপ্ত হইলে বীণা নিস্তব্ধ হইল। কন্যা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক ভক্তিভাবে ভগবান্ ত্রিলোচনকে প্রদক্ষিণ করিয়া প্রণাম করিলেন। অনন্তর পবিত্র নেত্রপাত দ্বারা রাজকুমারকে পরিতৃপ্ত করিয়া সাদর সম্ভাষণে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন ও বিনীত ভাবে কহিলেন, মহাশয়! আশ্রমে চলুন ও অতিথিসৎকার গ্রহণ করিয়া চরিতার্থ করুন। রাজকুমার সম্ভাষণমাত্রেই আপনাকে পরিগৃহীত ও চরিতার্থ বোধ করিয়া ভক্তি পূর্ব্বক তাপসীকে প্রণাম করিলেন ও শিষ্যের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। যাইতে যাইতে চিন্তা করিলেন, তাপসী আমাকে দেখিয়া অন্তর্হিত হইলেন না; প্রত্যুত দাক্ষিণ্য প্রকাশ করিয়া অতিথিসৎকার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিলে আত্মবৃত্তান্তও বলিতে পারেন।

কতক দূর যাইয়া এক গিরিগুহা দেখিলেন। উহার পুরোভাগ তমালবনে আবৃত, তথায় দিনমণি দৃষ্টিগোচর হয় না। পার্শ্বে নির্ঝরবারি ঝর্ঝর শব্দে পতিত হইতেছে। দূর হইতে উহার শব্দ কি মনোহর! অভ্যন্তরে বল্কল, কমণ্ডলু ও ভিক্ষাকপাল রহিয়াছে। দেখিবামাত্র মনে শান্তিরসের সঞ্চার হয়। তাপসী তথায় প্রবেশিয়া অর্ঘ্যসামগ্রী আহরণ পূর্ব্বক অর্ঘ্য আনয়ন করিলেন। রাজকুমার মৃদু মধুর সম্ভাষণে কহিলেন, ভগবতি! প্রসন্ন হউন, আপনকার দর্শনমাত্রেই আমি পবিত্র হইয়াছি এবং অর্ঘ্যও প্রদত্ত হইয়াছে। অত্যাদর প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই। আপনি উপবেশন করুন। পরিশেষে তাপসীর অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া রাজকুমার যথাবিহিত অর্ঘ্য গ্রহণ করিলেন। দুই জন শিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন। তাপসী রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি আপনার নাম, ধাম ও দিগ্বিজয়ের কথা বিশেষ করিয়া কহিলেন এবং কিন্নরমিথুনের অনুসরণক্রমে আপন আগমনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন।

অনন্তর তাপসী ভিক্ষাকপাল গ্রহণ করিয়া আশ্রমস্থিত তরুতলে ভ্রমণ করাতে তাঁহার ভিক্ষাভাজন, বৃক্ষ হইতে পতিত নানাবিধ সুস্বাদু ফলে পরিপূর্ণ হইল। চন্দ্রাপীড়কে সেই সকল ফল ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন। চন্দ্রাপীড় ফল ভক্ষণ করিবেন কি, এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। মনে মনে চিন্তা করিলেন, কি আশ্চর্য্য! এরূপ বিস্ময়কর ব্যাপার ত কখন দেখি নাই। অথবা তপস্যার অসাধ্য কি আছে! তপস্যাপ্রভাবে বশীভূত হইয়া অচেতনেরাও কামনা সফল করে, সন্দেহ নাই। অনন্তর তাপসীর অনুরোধে সুস্বাদু নানাবিধ ফল ভক্ষণ ও শীতল জল পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইলেন। তাপসীও আহার করিলেন ও সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে যথাবিধ সন্ধ্যার উপাসনা করিয়া এক শিলাতলে উপবেশন পূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।

চন্দ্রাপীড় অবসর বুঝিয়া বিনয় বাক্যে কহিলেন, ভগবতি! মানুষদিগের প্রকৃতি অতি চঞ্চল, প্রভুর কিঞ্চিৎ প্রসন্নতা দেখিলেই অমনি অধীর ও গর্ব্বিত হইয়া উঠে। আপনার অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা দর্শনে উৎসাহিত হইয়া আমার অন্তঃকরণ কিছু জিজ্ঞাসা করিতে অভিলাষ করিতেছে। যদি আপনার ক্লেশকর না হয়, তাহা হইলে, আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা আমার কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন। কি দেবতাদিগের কুল, কি মহর্ষিদিগের কুল, কি গন্ধর্ব্বদিগের কুল, কি অপ্সরাদিগের কুল—আপনি জন্মপরিগ্রহ দ্বারা কোন্ কুল উজ্জ্বল করিয়াছেন? কি নিমিত্ত কুসুমসুকুমার নবীন বয়সে আয়াসসাধ্য তপস্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন? কি নিমিত্তই বা দিব্য আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন বনে একাকিনী অবস্থিতি করিতেছেন? তাপসী কিঞ্চিৎ কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড় তাঁহাকে অশ্রুমুখী দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, এ আবার কি! শোক, তাপ কি সকল শরীরকেই আশ্রয় করিয়াছে? যাহা হউক, ইঁহার বাস্পসলিলপাতে আমার আরও কৌতুক জন্মিল। বোধ হয়, শোকের কোন মহৎ কারণ থাকিবেক। সামান্য শোক এতাদৃশ পবিত্র মূর্ত্তিকে কখন কলুষিত ও অভিভূত করিতে পারে না। বায়ুর আঘাতে কি বসুধা চালিত হয়? চন্দ্রাপীড় আপনাকে শোকোদ্দীপনহেতু ও তজ্জন্য অপরাধী বোধ করিয়া মুখপ্রক্ষালনের নিমিত্ত প্রস্রবণ হইতে জল আনিয়া দিলেন ও সান্ত্বনাবাক্যে নানাপ্রকার বুঝাইলেন। তাপসী চন্দ্রাপীড়ের সান্ত্বনাবাক্যে রোদনে ক্ষান্ত হইয়া মুখপ্রক্ষালন পূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্র! এই পাপীয়সী হতভাগিনীর অশ্রোতব্য বৈরাগ্যবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কি হইবে? উহা কেবল শোকানল ও দুঃখার্ণব। যদি শুনিতে নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, শ্রবণ করুন।

 ২.০৫ দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে

দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে শুনিয়া থাকিবেন। ইহাদিগের চতুর্দ্দশ কুল। ভগবান্ কমলযোনির মানস হইতে এক কুল উৎপন্ন হয়। দেব, অনল, জল, ভূতল, পবন, সূর্য্যরশ্মি, চন্দ্রকিরণ, সৌদামিনী, মৃত্যু ও মকরকেতু এই একাদশ হইতে একাদশ কুল। দক্ষপ্রজাপতির কন্যা মুনি ও অরিষ্টার সহিত গন্ধর্ব্বদিগের সমাগমে আর দুই কুল উৎপন্ন হয়। এই সমুদায়ে চতুর্দ্দশ কুল। মুনির গর্ভে চিত্ররথ জন্মগ্রহণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র আপন সুহৃন্মধ্যে পরিগণিত করিয়া প্রভাব ও কীর্ত্তিবর্দ্ধন পূর্ব্বক তাঁহাকে গন্ধর্ব্বলোকের অধিপতি করিয়া দেন। ভারতবর্ষের উত্তরে কিম্পুরুষবর্ষে হেমকূট নামে বর্ষপর্ব্বত তাঁহার বাসস্থান। তথায় তাঁহার অধীনে সহস্র সহস্র গন্ধর্ব্বলোক বাস করে। তিনিই চৈত্ররথ নামে এই রমণীয় কানন, অচ্ছোদননামক ঐ সরোবর ও ভবানীপতির এই প্রতিমূর্ত্তি প্রস্তুত করিয়াছেন। অরিষ্টার গর্ভে হংস নামে জগদ্বিখ্যাত গন্ধর্ব্ব জন্মগ্রহণ করেন। গন্ধর্ব্বরাজ চৈত্ররথ ঔদার্য্য ও মহত্ত্ব প্রকাশ পূর্ব্বক আপন রাজ্যের কিঞ্চিৎ অংশ প্রদান করিয়া তাঁহাকে রাজ্যাভিষিক্ত করেন। তাঁহার বাসস্থান হেমকূট। গৌরী নামে এক পরম সুন্দরী অপ্সরা তাঁহার সহধর্ম্মিণী! এই হতভাগিনী ও চিরদুঃখিনী তাঁহাদিগের একমাত্র কন্যা। আমার নাম মহাশ্বেতা। পিতা মাতার অন্য সন্তান সন্ততি ছিল না। আমিই একমাত্র অবলম্বন ছিলাম। শৈশবকালে বীণার ন্যায় এক অঙ্ক হইতে অঙ্কান্তরে যাইতাম ও অপরিস্ফুট মধুর বচনে সকলের মন হরণ করিতাম। সকলের স্নেহপাত্র হইয়া পরমপবিত্র বাল্যকাল বাল্যক্রীড়ায় অতিক্রান্ত হইল। যেরূপ বসন্তকালে নব পল্লবের ও নব পল্লবে কুসুমের উদয় হয় সেইরূপ আমার শরীরে যৌবনের উদয় হইল।

একদা মধুমাসের সমাগমে কমলবন বিকসিত হইলে, চূতকলিকা অঙ্কুরিত হইলে, মলয়মারুতের মন্দ মন্দ হিল্লোলে আহ্লাদিত হইয়া কোকিল সহকারশাখায় উপবেশন পূর্ব্বক সুস্বরে কুহুরব করিলে, অশোক কিংশুক প্রস্ফুটিত হইলে, আমি মাতার সহিত এই আচ্ছোদ সরোবরে স্নান করিতে আসিয়াছিলাম! এখানে আসিয়া মনোহর তীর, বিচিত্র তরু ও রমণীয় লতাকুঞ্জ অবলোকন করিয়া ভ্রমণ করিতে ছিলাম। ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা বনানিলের সহিত সমাগত অতি সুরভি পরিমল আঘ্রাণ করিলাম; মধুকরের ন্যায় সেই সুরভি গন্ধে অন্ধ হইয়া তদনুসরণ ক্রমে কিঞ্চিৎ দূর গমন করিয়া দেখিলাম, অতি তেজস্বী, পরমরূপবান, সুকুমার, এক মুনিকুমার সরোবরে স্নান করিতে আসিতেছেন। তাঁহার সমভিব্যাহারে আর এক জন তাপসকুমার আছেন। উভয়েরই এরূপ সৌন্দর্য্য ও সৌকুমার্য্য বোধ হইল যেন, রতিপতি প্রিয় সহচর বসন্তের সহিত মিলিত হইয়া ক্রোধান্ধ চন্দ্রশেখরকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তপস্বিবেশ ধারণ করিয়াছেন। প্রথম মুনিকুমারের কর্ণে অমৃতনিস্যন্দিনী ও পরিমলবাহিনী এক কুসুমমঞ্জরী ছিল। ঐরূপ আশ্চর্য্য কুসুমমঞ্জরী কেহ কখন দেখে নাই। উহার গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া স্থির করিলাম, উহার গন্ধে বন আমোদিত হইয়াছে। অনন্তর অনিমিষ লোচনে মুনিকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি নেত্রগোচর করিয়া বিস্মিত হইলাম। ভাবিলাম, বিধাতা বুঝি কমল ও চন্দ্রমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া ইঁহার বদনারবিন্দ নির্ম্মাণের কৌশল অভ্যাস করিয়া থাকিবেন। ঊরু ও বাহুযুগ সৃষ্টি করিবার পূর্ব্বে রম্ভাতরু ও মৃণালের সৃষ্টি করিয়া নির্ম্মাণকৌশল শিখিয়া থাকিবেন। নতুবা সমানাকার দুই তিন বস্তু সৃষ্টি করিবার প্রয়োজন কি? ফলতঃ মুনিকুমারের রূপ যতবার দেখি তত বারই অভিনব বোধ হয়। এইরূপ তাঁহার রমণীয় রূপের পক্ষপাতিনী হইয়া ক্রমে ক্রমে কুসুমশরের শরসন্ধানের পথবর্ত্তিনী হইলাম। কি মুনিকুমারের রূপসম্পত্তি, কি যৌবনকাল, কি বসন্তকাল, কি সেই সেই প্রদেশ, কি অনুরাগ, জানি না কে আমাকে উন্মাদিনী করিল। বারংবার মুনিকুমারকে সস্পৃহ লোচনে দেখিতে লাগিলাম। বোধ হইল যেন, আমার হৃদয়কে রজ্জুবদ্ধ করিয়া কেহ আকর্ষণ করিতেছে।

অনন্তর স্বেদসলিলের সহিত লজ্জা গলিত হইল। মকরধ্বজের নিশিত শরপাতভয়ে ভীত হইয়াই যেন, কলেবর কম্পিত হইল। মুনিকুমারকে আলিঙ্গন করিবার আশয়েই যেন, শরীর রোমাঞ্চরূপ কর প্রসারণ করিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, শান্তপ্রকৃতি তাপসজনের প্রতি আমাকে অনুরাগিণী করিয়া দুরাত্মা মন্মথ কি বিসদৃশ কর্ম্ম করিল। অঙ্গনাজনের অন্তঃকরণ কি বিমূঢ়! অনুরাগের পাত্রাপাত্র কিছুই বিবেচনা করিতে পারে না। তেজঃপুঞ্জ তপোরাশি, মুনিকুমারই বা কোথায়? সামান্য জনসুলভ চিত্তবিকারই বা কোথায়? বোধ হয় ইনি আমার ভাবভঙ্গি দেখিয়া মনে মনে কত উপহাস করিয়াছেন। কি আশ্চর্য্য! চিত্ত বিকৃত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়াও বিকার নিবারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। দুরাত্মা কন্দর্পের কি প্রভাব! ইহার প্রভাবে কত শত কন্যা লজ্জা ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া স্বয়ং প্রিয়তমের অনুগামিনী হয়। অনঙ্গ কেবল আমাকেই এইরূপ করিতেছে এমন নহে, কত শত কুলবালাকে এইরূপ অপথে পদার্পণ করায়। যাহা হউক, মদনদুশ্চেষ্টিত পরিস্ফুটরূপে প্রকাশ না হইতে হইতে এখান হইতে প্রস্থান করাই শ্রেয়ঃ। কি জানি পাছে ইনি কুপিত হইয়া শাপ দেন। শুনিয়াছি মুনিজনের প্রকৃতি অতিশয় রোষপরবশ। সামান্য অপরাধেও তাঁহারা ক্রোধান্বিত হইয়া উঠেন ও অভিসম্পাত করেন। অতএব এখানে আর আমার থাকা বিধেয় নয়। এই স্থির করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিবার অভিপ্রায় করিলাম। মুনিজনেরা সকলের পূজনীয় ও নমস্য বিবেচনা করিয়া প্রণাম করিলাম। আমি প্রণাম করিলে পর কুসুমশরশাসনের অলঙ্ঘ্যতা, বসন্ত কালের ও সেই সেই প্রদেশের রমণীয়তা, ইন্দ্রিয়গণের অবাধ্যতা, সেই সেই ঘটনার ভবিতব্যতা এবং আমার ঈদৃশ ক্লেশ ও দৌর্ভাগ্যের অবশ্যম্ভাবিতা প্রযুক্ত আমার ন্যায় সেই মুনিকুমারও মোহিত ও অভিভূত হইলেন। স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সকল তাঁহার শরীরে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইল। তাঁহার অন্তঃকরণের তদানীন্তন ভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার সহচর দ্বিতীয় ঋষিকুমারের নিকট গমন ও ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ভগবন! ইঁহার নাম কি? ইনি কোন্ তপোধনের পুত্ত্র? ইঁহার কর্ণে যে কুসুমমঞ্জরী দেখিতেছি উহা কোন্ তরুর সম্পত্তি। আহা উহার কি সৌরভ! আমি কখন ঐরূপ সৌরভ আঘ্রাণ করি নাই। আমার কথায় তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, বালে! তোমার উহা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি? যদি শুনিতে নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ কর।

শ্বেতকেতু নামে মহাতপা মহর্ষি দিব্য লোকে বাস করেন। তাঁহার রূপ জগদ্বিখ্যাত। তিনি একদা দেবার্চ্চনার নিমিত্ত কমল কুসুম তুলিতে মন্দাকিনীপ্রবাহে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কমলাসনা লক্ষ্মী তাঁহার রূপ লাবণ্য দেখিয়া মোহিত হন। তথায় পরস্পর সমাগমে এক কুমার জন্মে। ইনি তোমার পুত্ত্র হইলেন গ্রহণ কর বলিয়া লক্ষ্মী শ্বেতকেতুকে সেই পুত্ত্র সন্তান সমর্পণ করেন। মহর্ষি পুত্ত্রের সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন করিয়া পুণ্ডরীকে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া পুণ্ডরীক নাম রাখেন। যাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ, ইনি সেই পুণ্ডরীক। পূর্ব্বে অসুর ও সুরগণ যখন ক্ষীরসাগর মন্থন করেন, তৎকালে পারিজাত বৃক্ষ তথা হইতে উদ্গত হয়। এই কুসুমমঞ্জরী সেই পারিজাত বৃক্ষের সম্পত্তি। ইহা যেরূপে ইঁহার শ্রবণগত হইয়াছে তাহাও শ্রবণ কর। অদ্য চতুর্দ্দশী, ইনি ও আমি ভগবান্ ভবানীপতির অর্চ্চনার নিমিত্ত নন্দনবনের নিকট দিয়া কৈলাসপর্ব্বতে আসিতেছিলাম। পথিমধ্যে নন্দনবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই পারিজাতকুসুমমঞ্জরী হস্তে লইয়া আমাদের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন; প্রণাম করিয়া ইঁহাকে বিনীত বচনে কহিলেন, ভগবন্! আপনার যেরূপ আকার তাহার সদৃশ এই অলঙ্কার, আপনি এই কুসুমমঞ্জরীকে শ্রবণমণ্ডলে স্থান দান করিলে আমি চরিতার্থ হই। বনদেবতার কথায় অনাদর করিয়া ইনি চলিয়া যাইতেছিলেন, আমি তাঁহার হস্ত হইতে মঞ্জরী লইয়া কহিলাম, সখে! দোষ কি! বনদেবতার প্রণয় পরিগ্রহ করা উচিত, এই বলিয়া ইঁহার কর্ণে পরাইয়া দিলাম।

তিনি এইরূপ পরিচয় দিতেছিলেন এমন সময়ে সেই তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, অয়ি কুতূহলাক্রান্তে! তোমার এত অনুসন্ধানে প্রয়োজন কি? যদি কুসুমমঞ্জরী লইবার বাসনা হইয়া থাকে, গ্রহণ কর এই বলিয়া আমার নিকটবর্ত্তী হইলেন এবং আপনার কর্ণদেশ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার শ্রবণপুটে পরাইয়া দিলেন। আমার গণ্ডস্থলে তাঁহার হস্তস্পর্শ হইবামাত্র অন্তঃকরণে কোন অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হওয়াতে তিনি অবশেন্দ্রিয় হইলেন। করতলস্থিত অক্ষমালা হৃদয়স্থিত লজ্জার সহিত গলিত হইল জানিতে পারিলেন না। অক্ষমালা তাঁহার পাণিতল হইতে ভূতলে পড়িতে না পড়িতেই আমি ধরিলাম ও আপন কণ্ঠের আভরণ করিলাম। এই সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া বলিল, ভর্ত্তৃদারিকে! দেবী স্নান করিয়া তোমার অপেক্ষা করিতেছেন, তোমার আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। নবধৃতা করিণী অঙ্কুশের আঘাতে যেরূপ কুপিত ও বিরক্ত হয়, আমি সেই দাসীর বাক্যে বিরক্ত হইয়া, কি করি, মাতা অপেক্ষা করিতেছেন শুনিয়া, সেই যুবা পুরুষের মুখমণ্ডল হইতে অতিকষ্টে আপনার অনুরাগাকৃষ্ট নেত্রযুগল আকর্ষণ করিয়া স্নানার্থ গমন করিলাম।

কিঞ্চিৎ দূর গমন করিলে দ্বিতীয় ঋষিকুমার সেই তপোধনযুবার এরূপ চিত্তবিকার দেখিয়া প্রণয়কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, সখে পুণ্ডরীক! এ কি! তোমার অন্তঃকরণ এরূপ বিকৃত হইল কেন? ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র লোকেরাই অপথে পদার্পণ করে। নির্ব্বোধেরাই সদসদ্বিবেচনা করিতে পারে না। মূঢ় ব্যক্তিরাই চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে অসমর্থ। তুমি কি তাহাদিগের ন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া দুষ্কর্ম্মে অনুরক্ত হইলে? তোমার আজি অভূতপূর্ব্ব এরূপ ইন্দ্রিয়বিকার কেন হইল? ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিনয়, লজ্জা, জিতেন্দ্রিয়তা প্রভৃতি তোমার স্বাভাবিক সদ্‌গুণ সকল কোথায় গেল? কুলক্রমাগত ব্রহ্মচর্য্য, বিষয়বৈরাগ্য, গুরুদিগের উপদেশ, তপস্যায় অভিনিবেশ, শাস্ত্রের আলোচনা, যৌবনের শাসন, মনের বশীকরণ, সমুদায় একেবারে বিস্মৃত হইলে? তোমার বুদ্ধি কি এইরূপে পরিণত হইল? ধর্ম্মশাস্ত্রাভ্যাসের কি এই গুণ দর্শিল? গুরুজনের উপদেশে কি উপকার হইল? এত দিনে বুঝিলাম বিবেকশক্তি ও নীতিশিক্ষা নিষ্ফল, জ্ঞানাভ্যাস ও সদুপদেশে কোন ফল নাই, জিতেন্দ্রিয়তা কেবল কথামাত্র, যেহেতুক ভবাদৃশ ব্যক্তিকেও অনুরাগে কলুষিত ও অজ্ঞানে অভিভূত দেখিতেছি। তোমার অক্ষমালা কোথায়? উহা করতল হইতে গলিত ও অপহৃত হইয়াছে দেখিতে পাও নাই? কি আশ্চর্য্য! একেবারে জ্ঞানশূন্য ও চৈতন্যশূন্য হইয়াছ! ঐ অনার্য্যা বালা অক্ষমালা হরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে এবং মন হরণ করিবার উদ্যোগে আছে এই বেলা সাবধান হও। তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া, সখে! কি হেতু আমাকে অন্যরূপ সম্ভাবনা করিতেছ? আমি ঐ দুর্ব্বিনীত কন্যার অক্ষমালাহরণাপরাধ ক্ষমা করিব না বলিয়া ভ্রূকুটিভঙ্গি দ্বারা অলীক কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক আমাকে কহিলেন, চপলে! আমার অক্ষমালা না দিয়া এখান হইতে যাইতে পাইবে না। আমি তাঁহার নিরূপম রূপলাবণ্যের অনুরাগিণী ও ভাবভঙ্গির পক্ষপাতিনী হইয়া এরূপ শূন্যহৃদয় হইয়াছিলাম যে, অক্ষমালা ভ্রমে কণ্ঠ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার একাবলীমালা তাঁহার করে প্রদান করিলাম। তিনিও এরূপ অন্যমনস্ক হইয়া আমার মুখপানে চাহিয়াছিলেন যে উহা অক্ষমালা বলিয়াই গ্রহণ করিলেন। মুনিকুমারের সন্নিধানে স্বেদজলে বারংবার স্নান করিয়া পরে সরোবরে স্নান করিতে গেলাম। স্নানানন্তর মুনিকুমারের মনোহারিণী মূর্ত্তি মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে বাটী গমন করিলাম।

অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া যে দিকে নেত্রপাত করি, পুণ্ডরীকের মুখপুণ্ডরীক ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাই না। মুনিকুমারের অদর্শনে এরূপ অধীর হইলাম যে, তৎকালে জাগরিত কি নিদ্রিত, একাকিনী কি অনেকের নিকটবর্ত্তিনী ছিলাম, সুখের অবস্থা কি দুঃখের দশা ঘটিয়াছিল, উৎকণ্ঠা কি ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলাম, কিছুই বুঝিতে পারি নাই। ফলতঃ কোন জ্ঞান ছিল না। একবারে চৈতন্যশূন্য হইয়াছিলাম। তৎকালে কি কর্ত্তব্য কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, কেহ যেন আমার নিকট না যায়, পরিচারিকাদিগকে এইমাত্র আদেশ দিয়া, প্রাসাদের উপরিভাগে উঠিলাম। যে স্থানে সেই ঋষিকুমারের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল সেই প্রদেশকে মহারত্নাধিষ্ঠিত, অমৃতরসাভিষিক্ত, চন্দ্রোদয়ালঙ্কৃত বোধ করিয়া বারংবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে এরূপ উন্মত্ত ও ভ্রান্ত হইলাম যে, সেই দিক্ হইতে যে অনিল ও পক্ষী সকল আসিতেছিল তাহাদিগকেও প্রিয়তমের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা জন্মিল। আমার অন্তঃকরণ তাঁহার প্রতি এরূপ অনুরক্ত হইল যে, তিনি যে যে কর্ম্ম করিতেন, তাহাতেও পক্ষপাতী হইয়া উঠিল। তিনি তপস্বী ছিলেন বলিয়া তপস্যায় আর বিদ্বেষ থাকিল না। তিনি মুনিবেশ ধারণ করিতেন সুতরাং মুনিবেশে আর গ্রাম্যতা রহিল না। পারিজাতকুসুম তাঁহার কর্ণে ছিল বলিয়াই মনোহর হইল। সুরলোক তাঁহার বাসস্থান বলিয়াই রমণীয় বোধ হইতে লাগিল। ফলতঃ নলিনী যেরূপ রবির পক্ষপাতিনী, আমিও সেইরূপ ঋষিকুমারের পক্ষপাতিনী হইয়া নিমেষশূন্য দৃষ্টিতে সেই দিক্ দেখিতে লাগিলাম।

আমার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী তরলিকাও স্নান করিতে গিয়াছিল। সে অনেক ক্ষণের পর বাটী আসিয়া আমাকে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা সরোবরের তীরে যে দুই জন তাপসকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদিগের এক জন, যিনি তোমার কর্ণে কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরী পরাইয়া দেন, তিনি গুপ্ত ভাবে আমার নিকটে আসিয়া সুমধুর বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, বালে! যাঁহার কর্ণে আমি পুষ্প মঞ্জরী পরাইয়া দিলাম ইনি কে? ইঁহার নাম কি? কাহার অপত্য? কোথায় বা গমন করিলেন? আমি বিনীত বচনে কহিলাম, ভগবন্! ইনি গন্ধর্ব্বের অধিপতি হংসের দুহিতা, নাম মহাশ্বেতা। হেমকূট পর্ব্বতে গন্ধর্ব্বলোকে বাস করেন, তথায় গমন করিলেন। অনন্তর অনিমিষ লোচনে ক্ষণ কাল অনুধ্যান করিয়া পুনর্ব্বার বলিলেন, ভদ্রে! তুমি বালিকা বট; কিন্তু তোমার আকৃতি দেখিয়া বোধ হইতেছে চঞ্চলপ্রকৃতি নও। একটী কথা বলি শুন। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া সমাদর প্রদর্শন পূর্ব্বক সবিনয়ে নিবেদন করিলাম, মহাভাগ! আদেশ দ্বারা এই ক্ষুদ্র জনের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিবেন ইহার পর আর সৌভাগ্য কি? ভবাদৃশ মহাত্মারা মদ্বিধ ক্ষুদ্র জনের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেই তাহারা চরিতার্থ হয়। আপনি বিশ্বাস পূর্ব্বক কোন বিষয়ে আদেশ করিলে আমি চিরক্রীত ও অনুগৃহীত হইব, সন্দেহ নাই। আমার বিনয়গর্ভ বাক্য শুনিয়া সখীর ন্যায়, উপকারিণীর ন্যায় ও প্রাণদায়িনীর ন্যায় আমাকে জ্ঞান করিলেন। স্নিগ্ধ দৃষ্টি দ্বারা প্রসন্নতা প্রকাশ পূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী এক তমালতরুর পল্লব গ্রহণ করিয়া পল্লবের রসে আপন পরিধেয় বল্কলের এক খণ্ডে নখ দ্বারা এই পত্রিকা লিখিয়া আমাকে দিলেন। কহিলেন, আর কেহ যেন জানিতে না পারে, মহাশ্বেতা যখন একাকিনী থাকিবেন তাঁহার করে সমর্পণ করিও।

আমি হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তরলিকার হস্ত হইতে পত্রিকা গ্রহণ করিলাম। তাহাতে লিখিত ছিল, হংস যেমন মুক্তামালায় মৃণালভ্রমে প্রতারিত হয়, তেমনি আমার মন মুক্তাময় একাবলীমালায় প্রতারিত হইয়া তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত হইয়াছে। পথভ্রান্ত পথিকের দিগ্‌ভ্রম, মূকের জিহ্বাচ্ছেদ, অসম্বদ্ধভাষীর জ্বরপ্রলাপ, নাস্তিকের চার্ব্বাকশাস্ত্র, উন্মত্তের সুরাপান যেরূপ ভয়ঙ্কর, পত্রিকাও আমার পক্ষে সেইরূপ ভয়ঙ্কর বোধ হইল। পত্রিকা পাঠ করিয়া উন্মত্ত ও অবশেন্দ্রিয় হইলাম। পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তরলিকে! তুমি তাঁহাকে কোথায় কি রূপে দেখিলে? তিনি কি কহিলেন? তুমি তথায় কতক্ষণ ছিলে? তিনি আমাদের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত দূর পর্য্যন্ত আসিয়াছিলেন? প্রিয়জনসম্বদ্ধ এক কথাও বারংবার বলিতে ও শুনিতে ভাল লাগে। আমি পরিজনদিগকে তথা হইতে বিদায় করিয়া কেবল তরলিকার সহিত মুনিকুমারসম্বদ্ধ কথায় দিবসক্ষেপ করিলাম।

২.০৬ দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে

দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে পূর্ব্ব দিক্ আমার ন্যায় মলিন হইল। মদীয় হৃদয়ের ন্যায় পশ্চিম দিকের রাগ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দুই এক দণ্ড বেলা আছে এমন সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা স্নান করিতে গিয়া যে দুই জন মুনিকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদের এক জন দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন। বলিলেন, অক্ষমালা লইতে আসিয়াছি। মুনিকুমার, এই শব্দ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া কহিলাম, শীঘ্র সঙ্গে করিয়া লইয়া আইস। যেরূপ রূপের সহায় যৌবন, যৌবনের সহায় মকরকেতন, মকরকেতনের সহায় বসন্তকাল, বসন্তকালের সহায় মলয়পবন, সেইরূপ তিনি পুণ্ডরীকের সখা, নাম কপিঞ্জল, দেখিবামাত্র চিনিলাম। তাঁহার বিষণ্ণ আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন অভিপ্রায়ে আমাকে কিছু বলিতে আসিয়াছেন। আমি উঠিয়া প্রণাম করিয়া সমাদরে আসন প্রদান করিলাম। আসনে উপবেশন করিলে চরণ ধৌত করিয়া দিলাম। অনন্তর কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়া আমার নিকটে উপবিষ্ট তরলিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে আমি তাঁহার দৃষ্টিতেই অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বিনয়বাক্যে কহিলাম, ভগবন্! আমা হইতে ইহাকে ভিন্ন ভাবিবেন না। যাহা আদেশ করিতে অভিলাষ হয় অশঙ্কিত ও অসঙ্কুচিত চিত্তে আজ্ঞা করুন।

কপিঞ্জল কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! কি কহিব, লজ্জায় বাক্যস্ফূর্ত্তি হইতেছে না। কন্দমূলফলাশী বনবাসীর মনে অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শান্তস্বভাব তাপসকে প্রণয়পরবশ করিয়া বিধি কি বিড়ম্বনা করিলেন! দগ্ধ মন্মথ অনায়াসেই লোকদিগকে উপহাসাস্পদ ও অবজ্ঞাস্পদ করিতে পারে। অন্তঃকরণে একবার অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইলে আর ভদ্রতা নাই। তখন প্রগাঢ় ধীশক্তিসম্পন্ন লোকেরাও নিতান্ত অসার ও অপদার্থ হইয়া যান। তখন আর লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয়, গাম্ভীর্য্য কিছুই থাকে না। বন্ধু যে পথে পদার্পণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, জানি না, উহা কি বল্কলধারণের উপযুক্ত, কি জটাধারণের সমুচিত, কি তপস্যার অনুরূপ, কি ধর্ম্মের অঙ্গ, কি অপবর্গ লাভের উপায়! কি দৈবদুর্ব্বিপাক উপস্থিত! না বলিলে চলে না, উপায়ান্তর ও শরণান্তরও দেখি না, কি করি বলিতে হইল। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, স্বীয় প্রাণবিনাশেও যদি সুহৃদের প্রাণরক্ষা হয় তথাপি তাহা কর্ত্তব্য; সুতরাং আমাকে লজ্জায় জলাঞ্জলি দিতে হইল।

তোমার সমক্ষে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক বন্ধুরে সেই প্রকার তিরস্কার করিয়া আমি তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। স্নানানন্তর সরোবর হইতে উঠিয়া তুমি বাটী আসিলে ভাবিলাম, বন্ধু এক্ষণে একাকী কি করিতেছেন গুপ্ত ভাবে এক বার দেখিয়া আসি। অনন্তর আস্তে আস্তে আসিয়া বৃক্ষের অন্তরাল হইতে দৃষ্টিপাত করিলাম; কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। তৎকালে আমার অন্তঃকরণে কত বিতর্ক, কত সন্দেহ ও কতই বা ভয় উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, অনঙ্গের মোহন শরে মুগ্ধ হইয়া বন্ধু বুঝি, সেই কামিনীর অনুগামী হইয়া থাকিবেন। আবার মনে করিলাম সেই সুন্দরীর গমনের পর চৈতন্যোদয় হওয়াতে লজ্জায় আমাকে মুখ দেখাইতে না পারিয়া বুঝি কোন স্থানে লুকাইয়া আছেন; কি আমি ভর্ৎসনা করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া কোন স্থানে প্রস্থান করিয়াছেন; কিংবা আমাকেই অন্বেষণ করিতেছেন। আমরা দুই জনে চিরকাল একত্র ছিলাম; কখন পরস্পর বিরহদুঃখ সহ্য করিতে হয় নাই। সুতরাং বন্ধুকে না দেখিয়া যে কত ভাবনা উপস্থিত হইল তাহা বাক্য দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। পুনর্ব্বার চিন্তা করিলাম, বন্ধু আমার সমক্ষে সেই রূপ অধীরতা প্রকাশ করিয়া অতিশয় লজ্জিত হইয়া থাকিবেন। লজ্জায় কে কি না করে। কত লোক লজ্জার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কত অসদুপায় অবলম্বন করে। জলে, অনলে ও উদ্বন্ধনেও প্রাণত্যাগ করিয়া থাকে; যাহা হউক, নিশ্চিন্ত থাকা হইবে না অন্বেষণ করি। ক্রমে তরুলতাগহন, চন্দনবীথিকা, লতামণ্ডপ, সরোবরের কূল সর্ব্বত্র অন্বেষণ করিলাম, কুত্রাপি দেখিতে পাইলাম না; তখন স্নেহকাতর মনে অনিষ্ট শঙ্কাই প্রবল হইয়া উঠিল।

পুনর্ব্বার সতর্কতা পূর্ব্বক ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে দেখিলাম সরোবরের তীরে নানাবিধলতাবেষ্টিত নিভৃত এক লতাগহনের অভ্যন্তরবর্ত্তী শিলাতলে বসিয়া বাম করে বাম গণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক চিন্তা করিতেছেন। দুই চক্ষু মুদ্রিত, নেত্রজলে কপোলযুগল ভাসিতেছে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে। শরীর স্পন্দরহিত, কান্তিশূন্য ও পাণ্ডুবর্ণ। হঠাৎ দেখিলে চিত্রিতের ন্যায় বোধ হয়; এরূপ জ্ঞানশূন্য যে, কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরীর অবশিষ্টরেণুগন্ধলোভে ভ্রমর ঝঙ্কার পূর্ব্বক বারংবার কর্ণে বসিতেছে এবং লতা হইতে কুসুম ও কুসুমরেণু গাত্রে পড়িতেছে তথাপি সংজ্ঞা নাই, কলেবর এরূপ শীর্ণ যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। উদ্বিগ্ন চিত্তে চিন্তা করিলাম মকরকেতুর কি প্রভাব! যে ব্যক্তি উহার শরসন্ধানের পথবর্ত্তী হয় নাই সেই ধন্য ও নিরুদ্বেগে সংসারযাত্রা সংবরণ করিয়া থাকে। এক বার উহার বাণপাতের সম্মুখবর্ত্তী হইলে আর কোন জ্ঞান থাকে না। কি আশ্চর্য্য! ক্ষণকালের মধ্যে এরূপ জ্ঞানরাশি ঈদৃশ অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইনি শৈশবাবধি ধীর ও শান্তপ্রকৃতি ছিলেন। সকলে আদর্শস্বরূপ জ্ঞান করিয়া ইঁহার স্বভাবের অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত ও গুণের কথা উল্লেখ করিয়া যথেষ্ট প্রশংসা করিত। আজি কি রূপে বিবেকশক্তি ও তপঃপ্রভাবের পরাভব করিয়া এবং গাম্ভীর্য্যের উন্মূলন ও ধৈর্য্যের সমূলচ্ছেদ করিয়া দগ্ধ মন্মথ এই অসামান্য সৎস্বভাবসম্পন্ন মহাত্মাকে ইতর জনের ন্যায় অভিভূত ও উন্মত্ত করিল! শাস্ত্রকারেরা কহেন, নির্দ্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক রূপে যৌবনকাল অতিবাহিত করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ইঁহার অবস্থা শাস্ত্রকারদিগের কথাই সপ্রমাণ করিতেছে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিকটবর্ত্তী হইলাম এবং শিলাতলের এক পার্শ্বে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সখে! তোমাকে এরূপ দেখিতেছি কেন? বল আজি তোমার কি ঘটিয়াছে?

তিনি অনেক ক্ষণের পর নয়ন উন্মীলন ও দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক, সখে! তুমি আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াও অজ্ঞের ন্যায় কি জিজ্ঞাসা করিতেছ! এই মাত্র উত্তর দিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সেইরূপ অবস্থা ও আকার দেখিয়া স্থির করিলাম, এক্ষণে উপদেশ দ্বারা ইঁহার কোন প্রতিকার হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু অসন্মার্গপ্রবৃত্ত সুহৃদ্‌কে কুপথ হইতে নিবৃত্ত করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য কর্ম্ম। যাহা হউক, আর কিছু উপদেশ দিই। এই স্থির করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, সখে! হাঁ আমি সকলই অবগত হইয়াছি; কিন্তু ইহাই জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে পদবীতে পদার্পণ করিয়াছ উহা কি সাধুসঙ্গত? কি ধর্ম্মশাস্ত্রোপদিষ্ট পথ? কি তপস্যার অঙ্গ? কি স্বর্গ ও অপবর্গ লাভের উপায়? এই বিগর্হিত পথ অবলম্বন করা দূরে থাকুক এরূপ সঙ্কল্পকেও মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়। মূঢ়েরাই অনঙ্গপীড়ায় অধীর হয়। নির্ব্বোধেরাই হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে না। তুমিও কি তাহাদিগের ন্যায় অসৎ পথে প্রবৃত্ত হইয়া সাধুদিগের নিকট উপহাসাস্পদ হইবে? সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সুখাভিলাষ কি? পরিণামবিরস বিষয়ভোগে যাহারা সুখ প্রাপ্তির আশা করে, ধর্ম্মবুদ্ধিতে বিষলতাবনে তাহাদিগের জলসেক করা হয়, তাহারা কুবলয়মালা বলিয়া অসিলতা গলে দেয়, মহারত্ন বলিয়া জ্বলন্ত অঙ্গার স্পর্শ করে, মৃণাল বলিয়া মত্ত হস্তীর দন্ত উৎপাটন করিতে যায়, রজ্জু বলিয়া কালসর্প ধরে। দিবাকরের ন্যায় জ্যোতি ধারণ করিয়াও খদ্যোতের ন্যায় আপনাকে দেখাইতেছ কেন? সাগরের ন্যায় গম্ভীরস্বভাব হইয়াও উন্মার্গপ্রস্থিত ও উদ্বেল ইন্দ্রিয়স্রোতের সংযম করিতেছ না কেন? এক্ষণে আমার কথা রাখ, ক্ষুভিতচিত্তকে সংযত কর, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্য অবলম্বন করিয়া চিত্তবিকার দূর করিয়া দেও।

এইরূপ উপদেশ দিতেছি এমন সময়ে ধারাবাহী অশ্রুবারি তাঁহার নেত্রযুগল হইতে গলিত হইল। আমার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক বলিলেন, সখে! অধিক কি বলিব, আশীবিষবিষের ন্যায় বিষম কুসুমশরের শরসন্ধানে পতিত হও নাই, সুখে উপদেশ দিতেছ! যাহার ইন্দ্রিয় আছে, মন আছে, দেখিতে পায়, শুনিতে পায়, হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে, সেই উপদেশের পাত্র। আমার তাহা কিছুই নাই। আমার নিকটে ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিবেচনা এ সকল কথাও অস্তগত হইয়াছে। এ সময় উপদেশের সময় নয়; যাবৎ জীবিত থাকি এই অচিকিৎসনীয় রোগের প্রতীকারের চেষ্টা পাও। আমার অঙ্গ দগ্ধ ও হৃদয় জর্জ্জরিত হইতেছে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য কর, এই বলিয়া নিস্তব্ধ হইলেন।

যখন উপদেশবাক্যের কোন ফল দর্শিল না এবং দেখিলাম তাঁহার হৃদয়ে অনুরাগ এরূপ দৃঢ় রূপে বদ্ধমূল হইয়াছে যে, তাহা উন্মূলিত করা নিতান্ত অসাধ্য, তখন প্রাণরক্ষার নিমিত্ত সরোবরের সরস মৃণাল, শীতল কমলিনীদল ও স্নিগ্ধ শৈবাল তুলিয়া শয্যা করিয়া দিলাম এবং তথায় শয়ন করাইয়া কদলীপত্র দ্বারা বীজন করিতে লাগিলাম। তৎকালে মনে হইল, দুরাত্মা দগ্ধ মদনের কিছুই অসাধ্য নাই। কোথায় বা বনবাসী তপস্বী, কোথায় বা বিলাসরাশি গন্ধর্ব্বকুমারী। ইহাদিগের মনে পরস্পর অনুরাগ সঞ্চার হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শুষ্ক তরু মঞ্জরিত হইবে এবং মাধবীলতা তাহাকে অবলম্বন করিয়া উঠিবে ইহা কাহার মনে বিশ্বাস ছিল? চেতনের কথা কি, অচেতন তরু লতা প্রভৃতিও উহার আজ্ঞার অধীন। দেবতারাও উহার শাসন উল্লঙ্ঘন করিতে পারেন না। কি আশ্চর্য্য! দুরাত্মা এই অগাধ গাম্ভীর্য্যসাগরকেও ক্ষণ কালের মধ্যে তৃণের ন্যায় অসার ও অপদার্থ করিয়া ফেলিল। এক্ষণে কি করি, কোন্ দিকে যাই, কি উপায়ে বান্ধবের প্রাণরক্ষা হয়। দেখিতেছি মহাশ্বেতা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। বন্ধু স্বভাবতঃ ধীর, প্রগল্‌ভতা অবলম্বন করিয়া আপনি কদাচ তাহার নিকট যাইতে পারিবেন না। শাস্ত্রকারেরা গর্হিত অকার্য্য দ্বারা সুহৃদের প্রাণরক্ষা কর্ত্তব্য বলিয়া থাকেন; সুতরাং অতি লজ্জাকর ও মানহানির কর্ম্মও আমার কর্ত্তব্যপক্ষে পরিগণিত হইল। ভাবিলাম, যদি বন্ধুকে বলি যে, তোমার মনোরথ সফল করিবার জন্য মহাশ্বেতার নিকট চলিলাম, তাহা হইলে, পাছে লজ্জাক্রমে বারণ করেন এই নিমিত্ত তাঁহাকে কিছু না বলিয়া ছলক্রমে তোমার নিকট আসিয়াছি। এই সময়ের সমুচিত, সেইরূপ অনুরাগের সমুচিত ও আমার আগমনের সমুচিত যাহা হয় কর, বলিয়া কি উত্তর দি শুনিবার আশয়ে আমার মুখ পানে চাহিয়া রহিলেন।

আমি তাঁহার সেই কথা শুনিয়া সুখময় হ্রদে, অমৃতময় সরোবরে নিমগ্ন হইলাম। লজ্জা ও হর্ষ একদা আমার মুখমণ্ডলে আপন আপন ভাব প্রকাশ করিতে লাগিল। ভাবিলাম, অনঙ্গ সৌভাগ্যক্রমে আমার ন্যায় তাঁহাকেও সন্তাপ দিতেছে। শান্তস্বভাব তপস্বী কপিঞ্জল স্বপ্নেও মিথ্যা কহেন না; ইনি সত্যই কহিতেছেন, সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমার কি কর্ত্তব্য ও কি বক্তব্য এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে প্রতিহারী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! তোমার শরীর অসুস্থ হইয়াছে শুনিয়া মহাদেবী দেখিতে আসিতেছেন। কপিঞ্জল এই কথা শুনিয়া সত্বরে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! ভগবান্ ভুবনত্রয়চূড়ামণি দিনমণি অস্তগমনের উপক্রম করিতেছেন। আর আমি অপেক্ষা করিতে পারি না; যাহা কর্ত্তব্য করিও, বলিয়া আমার উত্তরবাক্য না শুনিয়াই শীঘ্র প্রস্থান করিলেন। তিনি প্রস্থান করিলে, এরূপ অন্যমনস্ক হইয়াছিলাম যে, জননী আসিয়া কি বলিলেন, কি করিলেন, কিছুই জানিতে পারি নাই। কেবল এইমাত্র স্মরণ হয়, তিনি অনেকক্ষণ আমার নিকটে ছিলেন।

তিনি আপন আলয়ে প্রস্থান করিলে ঊর্দ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, দিনমণি অস্তগত হইয়াছেন। চতুর্দ্দিক্ অন্ধকারে আচ্ছন্ন; তরলিকাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তরলিকে! তুমি দেখিতেছ না আমার হৃদয় আকুল হইতেছে ও ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া যাইতেছে? কি কর্ত্তব্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কপিঞ্জল যাহা বলিয়া গেলেন, স্বকর্ণে শুনিলে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য উপদেশ দাও। যদি ইতর কন্যার ন্যায় লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয় ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া, জনাপবাদ অবহেলন ও সদাচার উল্লঙ্ঘন করিয়া, পিতা মাতা কর্ত্তৃক অননুজ্ঞাত হইয়া স্বয়ং অভিসারিকাবৃত্তি অবলম্বন করি, তাহা হইলে, গুরুজনের অতিক্রম ও কুলমর্য্যাদার উল্লঙ্ঘন জন্য অধর্ম্ম হয়। যদি কুলধর্ম্মের অনুরোধে মৃত্যু অঙ্গীকার করি তাহা হইলে প্রথমপরিচিত, স্বয়মাগত, কপিঞ্জলের প্রণয়ভঙ্গজন্য পাপ এবং আশাভঙ্গ দ্বারা সেই তপোধনযুবার কোন অনিষ্ট ঘটিলে ব্রহ্মহত্যা ও তপস্বিহত্যা জন্য মহাপাতকে লিপ্ত হইতে হয়।

২.০৭ চন্দ্রোদয় হইল

এই কথা বলিতে বলিতে চন্দ্রোদয় হইল। নবোদিত চন্দ্রের আলোক অন্ধকারমধ্যে পতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, জাহ্নবীর তরঙ্গ যমুনার জলের সহিত মিলিত হইয়াছে। সুধাংশুসমাগমে যামিনী জ্যোৎস্নারূপ দশনপ্রভা বিস্তার করিয়া যেন আহ্লাদে হাসিতে লাগিল। চন্দ্রোদয়ে গাম্ভীর্য্যশালী সাগরও ক্ষুব্ধ হইয়া তরঙ্গরূপ বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক বেলা আলিঙ্গন করে। সে সময়ে অবলার মন চঞ্চল হইবে আশ্চর্য্য কি? চন্দ্রের সহায়তা ও মলয়ানিলের অনুকূলতায় আমার হৃদয়স্থিত মদনানল প্রবল হইয়া জ্বলিয়া উঠিল। চন্দ্রের দিকে নেত্রপাত করিয়াও চারি দিকে মৃত্যুমুখ দেখিতে লাগিলাম। অন্ধকারে লক্ষ্য স্থির করিতে না পারিয়া কুসুমচাপ নিস্তব্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে সময় পাইয়া শরাসনে শরসন্ধান পূর্ব্বক বিরহিণীদিগের অন্বেষণ করিতে লাগিল। আমিই উহার প্রথম লক্ষ্য হইলাম। নেত্রযুগল নিমীলিত ও অঙ্গ অবশ করিয়া মূর্চ্ছা অজ্ঞাতসারে আমাকে আক্রমণ করিল। তরলিকা সভয়ে ও সসম্ভ্রমে গাত্রে শীতল চন্দনজল সেচন পূর্ব্বক তালবৃন্ত দ্বারা বীজন করিতে লাগিল। ক্রমে চৈতন্য প্রাপ্ত হইয়া নয়ন উন্মীলন পূর্ব্বক দেখিলাম, তরলিকা বিষণ্ণ বদনে ও দীন নয়নে রোদন করিতেছে। আমি লোচন উন্মীলন করিলে আমাকে জীবিত দেখিয়া অতিশয় হৃষ্ট হইল, বিনয়বাক্যে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! লজ্জা ও গুরুজনের অপেক্ষা পরিহার পূর্ব্বক, প্রসন্ন চিত্তে আমাকে পাঠাইয়া দাও, আমি তোমার চিত্তচোরকে এই স্থানে আনিতেছি। অথবা ইচ্ছা হয় চল, তথায় তোমাকে লইয়া যাই। তোমার আর এরূপ সাংঘাতিক সঙ্কট পুনঃ পুনঃ দেখিতে পারি না। তরলিকে! আমিও আর এরূপ ক্লেশকর বিরহবেদনা সহ্য করিতে পারি না। চল, প্রাণ থাকিতে থাকিতে সেই প্রাণবল্লভের শরণাপন্ন হই। এই বলিয়া তরলিকাকে অবলম্বন করিয়া উঠিলাম।
প্রাসাদ হইতে অবরোহণ করিবার উপক্রম করিতেছি এমন সময়ে দক্ষিণ লোচন স্পন্দ হইল। দুর্নিমিত্ত দর্শনে শঙ্কাতুর হইয়া ভাবিলাম, এ আবার কি! মঙ্গলকর্ম্মে অমঙ্গলের লক্ষণ উপস্থিত হয় কেন? ক্রমে ক্রমে শশধর আকাশমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া সুধাসলিলের ন্যায়, চন্দনরসের ন্যায় জ্যোৎস্না বিস্তার করিলে, ভূমণ্ডল কৌমুদীময় হইয়া শ্বেতবর্ণ দ্বীপের ন্যায় ও চন্দ্রলোকের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। কুমুদিনী বিকসিত হইল। মধুকর মধুলোভে তথায় বসিতে লাগিল। নানাবিধ কুসুমরেণু হরণ করিয়া সুগন্ধ গন্ধবহ দক্ষিণ দিক্ হইতে মন্দ মন্দ বহিতে লাগিল। ময়ূরগণ উন্মত্ত হইয়া মনোহর স্বরে গান আরম্ভ করিল। কোকিলের কলরবে চতুর্দ্দিক ব্যাপ্ত হইল। আমি কণ্ঠস্থিত সেই অক্ষমালা ও কর্ণস্থিত সেই পারিজাতমঞ্জরী ধারণ করিয়া, রক্তবর্ণ বসনে অবগুণ্ঠিত হইয়া তরলিকার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক প্রাসাদের শিখরদেশ হইতে নামিলাম। সৌভাগ্যক্রমে কেহ আমাকে দেখিতে পাইল না। প্রমদবনের নিকটে যে দ্বার ছিল তাহা উদ্ঘাটন পূর্ব্বক বাটী হইতে নির্গত হইয়া প্রিয়তমের সমীপে চলিলাম। যাইতে যাইতে ভাবিলাম, অভিসারপথে প্রস্থিত ব্যক্তির দাস দাসী ও বাহ্য আড়ম্বরের প্রয়োজন থাকে না। যেহেতু কন্দর্প সদর্পে শরাসনে শরসন্ধান পূর্ব্বক অগ্রে অগ্রে গমন করিয়া সহায়তা করেন। চন্দ্র পথ আলোকময় করিয়া পথপ্রদর্শক হন। হৃদয় পুরোবর্ত্তী হইয়া অভয় প্রদান করে।

কিঞ্চিৎ দূর যাইয়া তরলিকাকে কহিলাম, তরলিকে! চন্দ্র যেরূপ আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইতেছেন এমনি তাঁহাকে কি আমার নিকটে লইয়া আসিতে পারেন না? তরলিকা হাসিয়া বলিল, ভর্ত্তৃদারিকে! চন্দ্র কিজন্য আপনার বিপক্ষের উপকার করিবেন? পুণ্ডরীক যেরূপ তোমার রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়াছেন, চন্দ্রও সেইরূপ তোমার নিরুপম সৌন্দর্য্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া প্রতিবিম্বচ্ছলে তোমার গাত্র স্পর্শ ও কর দ্বারা পুনঃ পুনঃ চরণ ধারণ করিতেছেন। বিরহীর ন্যায় ইঁহার শরীরও পাণ্ডুবর্ণ হইয়াছে। তৎকালোচিত এই সকল পরিহাসবাক্য কহিতে কহিতে সরোবরের নিকটবর্ত্তী হইলাম। কৈলাসপর্ব্বত হইতে প্রবাহিত চন্দ্রকান্তমণির প্রস্রবণে চরণ ধৌত করিতেছিলাম এমন সময়ে সরোবরের পশ্চিম তীরে রোদনধ্বনি শুনিলাম। কিন্তু দূরপ্রযুক্ত সুস্পষ্ট কিছু বুঝা গেল না। আগমনকালে দক্ষিণ চক্ষু স্পন্দ হওয়াতে মনে মনে সাতিশয় শঙ্কা ছিল; এক্ষণে অকস্মাৎ রোদনধ্বনি শুনিয়া নিতান্ত ভীত হইলাম। ভয়ে কলেবর কাঁপিতে লাগিল। যে দিকে শব্দ হইতেছিল, ঊর্দ্ধশ্বাসে সেই দিকে দৌড়িতে লাগিলাম।

অনন্তর নিঃশব্দ নিশীথপ্রভাবে দূর হইতেই “হা হতোঽস্মি—হা দগ্ধোঽস্মি—হায় কি হইল—রে দুরাত্মন্ পাপকারিন্ পিশাচ মদন! কি কুকর্ম্ম করিলি—আঃ পাপীয়সি দুর্ব্বিনীতে মহাশ্বেতে! ইনি তোমার কি অপকার করিয়াছিলেন—রে দুশ্চরিত্র চন্দ্র চণ্ডাল! এক্ষণে তুই কৃতকার্য্য হইলি—রে দক্ষিণানিল! তোর মনোরথ পূর্ণ হইল—হা পুত্ত্রবৎসল ভগবন্ শ্বেতকেতো! তোমার সর্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে বুঝিতে পারিতেছ না? হে ধর্ম্ম তোমাকে আর অতঃপর কে আশ্রয় করিবে? হে তপঃ! এত দিনের পর তুমি নিরাশ্রয় হইলে। সরস্বতি! তুমি বিধবা হইলে। সত্য! তুমি অনাথ হইলে। হায়! এত দিনের পর সুরলোক শূন্য হইল। সখে! ক্ষণকাল অপেক্ষা কর, আমি তোমার অনুগমন করি। চিরকাল একত্র ছিলাম, এক্ষণে সহায়হীন, বান্ধবহীন হইয়া কিরূপে এই দেহভার বহন করিব? কি আশ্চর্য্য! আজন্মপরিচিত ব্যক্তিকেও অপরিচিতের ন্যায় অদৃষ্টপূর্ব্বের ন্যায় পরিত্যাগ করিয়া গেলে? যাইবার সময় এক বার জিজ্ঞাসাও করিলে না? এরূপ কৌশল কোথায় শিখিলে? এরূপ নিষ্ঠুরতা কাহার নিকট অভ্যাস করিলে? হায়! এক্ষণে সুহৃৎশূন্য, সহোদরশূন্য হইয়া কোথায় যাইব? কাহার শরণাপন্ন হইব? কাহার সহিত আলাপ করিব? এত দিনের পর অন্ধ হইলাম। দশ দিক্ শূন্য দেখিতেছি। সকলই অন্ধকারময় বোধ হইতেছে। এই ভারভূত জীবনে আর প্রয়োজন কি? সখে! এক বার আমার কথায় উত্তর দাও। এক বার নয়ন উন্মীলন কর। আমি তোমার প্রফুল্ল মুখকমল এক বার অবলোকন করিয়া জন্মের মত বিদায় হই। আমার সহিত তোমার সেই অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট সৌহার্দ্দ কোথায় গেল? তোমার সেই অমৃতময় বাক্য, স্নেহময় দৃষ্টি স্মরণ করিয়া আমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইতেছে।” কপিঞ্জল আর্ত্ত স্বরে মুক্তকণ্ঠে এইরূপ ও অন্যরূপ নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন শুনিতে পাইলাম।

কপিঞ্জলের বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল। মুক্ত কণ্ঠে রোদন করিতে করিতে দ্রুত বেগে দৌড়িলাম। পদে পদে পদস্খলন হইতে লাগিল, তথাপি গতির প্রতিরোধ জন্মিল না। তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, যাঁহার শরণাপন্ন হইতে বাটীর বহির্গত হইয়াছিলাম, তিনি সরোবরের তীরে লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে শৈবালরচিত শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন। কমল, কুমুদ, কুবলয় প্রভৃতি নানাবিধ কুসুম, শয্যার পার্শ্বে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। মৃণাল ও কদলীপল্লব চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ আছে। তাঁহার শরীর নিস্পন্দ, বোধ হইল যেন, মনোযোগ পূর্ব্বক আমার পদশব্দ শুনিতেছেন; মনঃক্ষোভ হইয়াছিল বলিয়া যেন একমনা হইয়া প্রাণায়াম দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করিতেছেন; আমা হইতেও আর এক জন প্রিয়তম হইল বলিয়া যেন, ঈর্ষ্যা প্রযুক্ত প্রাণ দেহকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে। ললাটে ত্রিপুণ্ড্রক, স্কন্ধে বল্কলের উত্তরীয়, গলে একাবলী মালা, হস্তে মৃণালবলয়ধারণ পূর্ব্বক অপূর্ব্ব বেশ রচনা করিয়া যেন, আমার সহিত সমাগমের নিমিত্ত অনন্যমনা হইয়া মন্ত্র সাধন করিতেছেন। কপিঞ্জল তাঁহার কণ্ঠ ধারণ করিয়া রোদন করিতেছেন। অচিরমৃত সেই মহাপুরুষকে এই হতভাগিনী ও পাপকারিণী আমি গিয়া দেখিলাম। আমাকে দেখিয়া কপিঞ্জলের দুই চক্ষু হইতে অশ্রুস্রোত বহিতে লাগিল। দ্বিগুণ শোকাবেগ হইল। অতিশয় পরিতাপ পূর্ব্বক হা হতোস্মি বলিয়া আরও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।

তখন মূর্চ্ছা দ্বারা আক্রান্ত ও মোহে নিতান্ত অভিভূত হইয়া বোধ হইল যেন, অন্ধকারময় পাতালতলে অবতীর্ণ হইতেছি। তদনন্তর কোথায় গেলাম, কি বলিলাম কিছুই মনে পড়ে না। স্ত্রীলোকের হৃদয় পাষাণময় এজন্যই হউক, এই হতভাগিনীকে দীর্ঘ শোক ও চিরকাল দুঃখ সহ্য করিতে হইবে বলিয়াই হউক, দৈবের অত্যন্ত প্রতিকূলতাবশতই বা হউক, জানি না কি নিমিত্ত এই হতভাগিনীর প্রাণ বহির্গত হইল না। অনেক ক্ষণের পর চেতন হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত ও ধূলিধূসরিত আত্মদেহ অবলোকন করিলাম। প্রাণেশ্বর প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, আমি জীবিত আছি, প্রথমতঃ ইহা নিতান্ত অসম্ভাব্য, অবিশ্বাস্য ও স্বপ্নকল্পিত বোধ হইল। কিন্তু কপিঞ্জলের বিলাপ শুনিয়া সে ভ্রান্তি দূর হইল। তখন হা হতোঽস্মি বলিয়া আর্ত্তনাদ ও পিতা মাতা সখিদিগকে সম্বোধন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলাম।

হে জীবিতেশ্বর! এই অনাথাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গেলে? তুমি তরলিকাকে জিজ্ঞাসা কর আমি তোমার নিমিত্ত কত কষ্ট ভোগ ও কত ক্লেশ সহ্য করিয়াছি। তোমার বিরহে একদিন যুগসহস্রের ন্যায় বোধ হইয়াছে। প্রসন্ন হও, একবার আমার কথায় উত্তর দাও। আমি লজ্জা, ভয়, কুলে জলাঞ্জলি দিয়া তোমার শরণাপন্ন হইতে আসিয়াছি, তুমি রক্ষা না করিলে আর কে রক্ষা করিবে? একবার নেত্র উন্মীলন করিয়া এই অভাগিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত কর, তাহা হইলে কৃতার্থ হই। আমার আর উপায়ান্তর নাই। আমি তোমার ভক্ত ও তোমার প্রতিই সাতিশয় অনুরক্ত। তোমা বই কাহাকেও জানি না। তুমি দয়া না করিলে আর কে দয়া করিবে? আঃ! এখনও জীবিত আছি! না পিতা মাতার বশবর্ত্তিনী হইলাম, না বন্ধুবর্গের ভয় রাখিলাম, না আত্মীয়গণের অপেক্ষা করিলাম। সমুদায় পরিত্যাগ করিয়া যাঁহার আশ্রয় লইতে আসিয়াছি, সেই প্রাণেশ্বর কোথায়? তিনি কি আমার নিমিত্ত প্রাণত্যাগ করিয়াছেন? অরে কৃতঘ্ন প্রাণ! তুই আর কেন যাতনা দিস্? আ—এই হতভাগিনীর মৃত্যু নাই! যমও এই পাপকারিণীকে স্পর্শ করিতে ঘৃণা করেন। কি জন্য আমি তোমাকে তাদৃশ অনুরক্ত দেখিয়াও গৃহে গমন করিয়াছিলাম? আর গৃহে প্রয়োজন কি? পিতা, মাতা, বন্ধুজন ও পরিজনের ভয় কি? হায়—এক্ষণে কাহার শরণাপন্ন হই। কোথায় যাই। অয়ি বনদেবতে! ভগবতি ভবিতব্যতে! অম্ব বসুন্ধরে! করুণা প্রকাশ করিয়া দয়িতের জীবন প্রদান কর। গ্রহাবিষ্টার ন্যায়, উন্মত্তার ন্যায় এইরূপ কত প্রকার বিলাপ করিয়াছিলাম সকল এক্ষণে স্মরণ হয় না। আমার বিলাপ শ্রবণে অজ্ঞান পশু পক্ষীরাও হাহাকার করিয়াছিল এবং পল্লবপাতচ্ছলে তরুগণেরও অশ্রুপাত হইয়াছিল। এত ক্ষণে পুনর্জীবিত হইয়াছেন মনে করিয়া প্রাণেশ্বরের হৃদয় স্পর্শ করিয়া দেখিলাম, কিন্তু জীবন কোথায়? প্রাণবায়ু একবার প্রয়াণ করিলে আর কি প্রত্যাগত হয়? দৈব প্রতিকূল হইলে আর কি শুভগ্রহ সঞ্চার হয়? আমার আগমন পর্য্যন্ত তুই প্রিয়তমের প্রাণ রক্ষা করিতে পারিস্ নাই বলিয়া একাবলী মালাকে কত তিরস্কার করিলাম। প্রসন্ন হও, প্রাণেশ্বরের প্রাণ দান কর বলিয়া কপিঞ্জলের চরণ ও তরলিকার কণ্ঠ ধারণ পূর্ব্বক দীন নয়নে রোদন করিতে লাগিলাম। সে সময়ে অভূতপূর্ব্ব, অশিক্ষিতপূর্ব্ব, অনুপদিষ্টপূর্ব্ব, যে সকল করুণ বিলাপ মুখ হইতে নির্গত হইয়াছিল তাহা চিন্তা করিলেও আর মনে পড়ে না। সে এক সময়, তখন সাগরের তরঙ্গের ন্যায় দুই চক্ষু দিয়া অনবরত অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল ও ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছা হইতে লাগিল।

এই রূপে অতীত আত্মবৃত্তান্তের পরিচয় দিতে দিতে, অতীত শোকদুঃখের অবস্থা স্মৃতিপথবর্ত্তিনী হওয়াতে, মহাশ্বেতা মূর্চ্ছাপন্ন ও চৈতন্যশূন্য হইয়া যেমন শিলাতল হইতে ভূতলে পড়িতেছিলেন অমনি চন্দ্রাপীড় কর প্রসারিত করিয়া ধরিলেন এবং অশ্রুজলার্দ্র তদীয় উত্তরীয় বল্কল দ্বারা বীজন করিতে লাগিলেন। ক্ষণকালের পর সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইলে চন্দ্রাপীড় বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিত চিত্তে কহিলেন, কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি! আপনার নির্ব্বাপিত শোক পুনরুদ্দীপিত করিয়া দিলাম। আর সে সকল কথায় প্রয়োজন নাই। উহা শুনিতে আমারও কষ্ট বোধ হইতেছে। অতিক্রান্ত দুরবস্থাও কীর্ত্তনের সময় প্রত্যক্ষানুভূতের ন্যায় ক্লেশজনক হয়। যাহা হউক পতনোন্মুখ প্রাণকে, অতীব দুঃখের পুনঃ পুনঃ স্মরণরূপ হুতাশনে নিক্ষিপ্ত করিবার আর আবশ্যকতা নাই।

মহাশ্বেতা দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ এবং নির্ব্বেদ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, রাজকুমার! সেই দারুণ ভয়ঙ্করী বিভাবরীতে যে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া যায় নাই, সে যে কখন পরিত্যাগ করিবে এমন বিশ্বাস হয় না। আমি এরূপ পাপীয়সী যে, মৃত্যুও আমার দর্শনপথ পরিহার করেন। এই নির্দ্দয় পাষাণময় হৃদয়ের শোক দুঃখ সকলই অলীক। এ নির্লজ্জ এবং আমাকেও স্বয়ং নির্লজ্জের অগ্রগণ্য করিয়াছে। যে শোক অবলীলাক্রমে সহ্য করিয়াছি, এক্ষণে কথা দ্বারা তাহা ব্যক্ত করা কঠিন কর্ম্ম কি? যে হলাহল পান করে হলাহলের স্মরণে তাহার কি হইতে পারে? আপনার সাক্ষাতে সেই বিষম বৃত্তান্তের যে ভাগ বর্ণনা করিলাম, তাহার পর এরূপ শোকোদ্দীপক কি আছে যাহা বলিতে ও শুনিতে পারা যাইবেক না। যে দুরাশা—মৃগতৃষ্ণিকা অবলম্বন করিয়া এই অকৃতজ্ঞ দেহভার বহন করিতেছি এবং সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারের পর প্রাণধারণের হেতুভূত যে অদ্ভুত ঘটনা হইয়াছিল তাহাই এই বৃত্তান্তের পরভাগ, শ্রবণ করুন।

সেই রূপ বিলাপের পর প্রাণপরিত্যাগ করাই প্রাণেশ্বরের বিরহের প্রায়শ্চিত্ত স্থির করিয়া তরলিকাকে কহিলাম, অয়ি নৃশংসে! আর কত ক্ষণ রোদন করিব, কতই বা যন্ত্রণা সহিব। শীঘ্র কাষ্ঠ আহরণ করিয়া চিতা সাজাইয়া দাও, জীবিতেশ্বরের অনুগমন করি। বলিতে বলিতে মহাপ্রমাণ এক মহাপুরুষ চন্দ্রমণ্ডল হইতে গগনমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেন। তাঁহার পরিধান শুভ্র বসন, কর্ণে সুবর্ণকুণ্ডল, বক্ষঃস্থলে হার ও হস্তে কেয়ূর। সেরূপ উজ্জ্বল আকৃতি কেহ কখন দেখে নাই। দেহপ্রভায় দিগ্বলয় আলোকময় করিয়া গগন হইতে ভূতলে পদার্পণ করিলেন। শরীরের সৌরভে চতুর্দ্দিক্ আমোদিত হইল। চারি দিকে অমৃতবৃষ্টি হইতে লাগিল; পীবর বাহুযুগল দ্বারা প্রিয়তমের মৃত দেহ আকর্ষণ পূর্ব্বক “বৎসে মহাশ্বেতে! প্রাণত্যাগ করিও না, পুনর্ব্বার পুণ্ডরীকের সহিত তোমার সমাগম সম্পন্ন হইবেক।” গম্ভীর স্বরে এই কথা বলিয়া গগনমার্গে উঠিলেন। আকস্মিক এই বিস্ময়কর ব্যাপার দর্শনে বিস্মিত ও ভীত হইয়া কপিঞ্জলকে ইহার তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলাম। কপিঞ্জল আমার কথায় কিছুই উত্তর না দিয়া “রে দুরাত্মন্! বন্ধুকে লইয়া কোথায় যাইতেছিস্?” রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক এই কথা কহিতে কহিতে তাঁহার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। আমি উন্মুখী হইয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে তাঁহারা তারাগণের মধ্যে মিশাইয়া গেলেন। কপিঞ্জলের অদর্শন, প্রিয়তমের মৃত্যু অপেক্ষাও দুঃখজনক বোধ হইল। যে ঘটনা উপস্থিত ইহার মর্ম্ম বুঝাইয়া দেয় এরূপ একটী লোক নাই। তৎকালে কি কর্ত্তব্য কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, তরলিকে! তুমি ইহার কিছু মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়াছ? স্ত্রীস্বভাবসুলভ ভয়ে অভিভূত এবং আমার মরণাশঙ্কায় উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ ও কম্পিতকলেবর হইয়া তরলিকা স্খলিত গদ্গদ বচনে বলিল, ভর্ত্তৃদারিকে! না, আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। এ অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার। আমার বোধ হয় ঐ মহাপুরুষ মানুষ নহেন। যাহা বলিয়া গেলেন তাহাও মিথ্যা হইবেক না। মিথ্যা কথা দ্বারা প্রতারণা করিবার কোন অভিসন্ধি দেখি না। এরূপ ঘটনাকে আশা ও আশ্বাসের আস্পদ বলিতে হইবেক; যাহা হউক, এক্ষণে চিতাধিরোহণের অধ্যবসায় হইতে পরাঙ্মুখ হও। অন্ততঃ কপিঞ্জলের আগমনকাল পর্য্যন্ত প্রতীক্ষা কর। তাঁহার মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া যাহা কর্ত্তব্য পরে করিও।

জীবিততৃষ্ণার অলঙ্ঘ্যতা ও স্ত্রীজনসুলভ ক্ষুদ্রতা প্রযুক্ত আমি সেই দুরাশায় আকৃষ্ট হইয়া তরলিকার বাক্যই যুক্তিযুক্ত স্থির করিলাম। আশার কি অসীম প্রভাব! যাহার প্রভাবে লোকেরা তরঙ্গাকুল ভীষণ সাগর পার হইয়া অপরিচিত ও অজ্ঞাত দেশে প্রবেশ করে; যাহার প্রভাবে অতি দীন হীন জনেরও মুখমণ্ডল উজ্জ্বল থাকে; যাহার প্রভাবে পুত্ত্রকলত্রাদির বিরহদুঃখও অবলীলাক্রমে সহ্য করা যায়; কেবল সেই আশা হস্তাবলম্বন দেওয়াতে জনশূন্য সরোবরতীরে যাতনাময়ী সেই কালযামিনী কথঞ্চিৎ অতিবাহিত হইল। কিন্তু ঐ যামিনী যুগশতের ন্যায় বোধ হইয়াছিল। প্রাতঃকালে উঠিয়া সরোবরে স্নান করিলাম। সংসারের অসারতা, সমুদায় পদার্থের অনিত্যতা, আপনার হতভাগ্যতা ও বিপৎপাতের অপ্রতীকারিতা দেখিয়া মনে মনে বৈরাগ্যোদয় হইল এবং প্রিয়তমের সেই কমণ্ডলু, সেই অক্ষমালা লইয়া ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক অবিচলিত ভক্তি সহকারে এই অনাথনাথ ত্রৈলোক্যনাথের শরণাপন্ন হইলাম। বিষয়বাসনার সহিত পিতা মাতার স্নেহ পরিত্যাগ করিলাম। ইন্দ্রিয়সুখের সহিত বন্ধুদিগের অপেক্ষা পরিহার করিলাম।

পরদিন পিতা মাতা এই সকল বৃত্তান্ত অবগত হইয়া পরিজন ও বন্ধুজনের সহিত এই স্থানে আইসেন ও নানাপ্রকার সান্ত্বনাবাক্যে প্রবোধ দিয়া বাটী গমন করিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু যখন দেখিলেন, কোন প্রকারে অবলম্বিত অধ্যবসায় হইতে পরাঙ্মুখ হইলাম না, তখন আমার গমনবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়াও অপত্যস্নেহের গাঢ়বন্ধনবশতঃ অনেক দিন পর্য্যন্ত এই স্থানে অবস্থিতি করিলেন ও প্রতিদিন নানাপ্রকার বুঝাইতে লাগিলেন; পরিশেষে হতাশ হইয়া দুঃখিত চিত্তে বাটী গমন করিলেন। তদবধি কেবল অশ্রুমোচন দ্বারা প্রিয়তমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিতেছি। জপ করিবার ছলে তাঁহার গুণ গণনা করিয়া থাকি। বহুবিধ নিয়ম দ্বারা পরাভূত এই দগ্ধ শরীর পোষণ করিতেছি। এই গিরিগুহায় বাস করি, ঐ সরোবরে ত্রিসন্ধ্যা স্নান করি, প্রতিদিন এই দেবাদিদেব মহাদেব অর্চ্চনা করিয়া থাকি। তরলিকা ভিন্ন আর কেহ নিকটে নাই। আমার ন্যায় পাপকারিণী ও হতভাগিনী এই ধরণীতলে কাহাকেও দেখিতে পাই না। পাপকর্ম্মের একশেষ করিয়াছি, ব্রহ্মহত্যারও ভয় রাখি নাই। আমাকে দেখিলে ও আমার সহিত আলাপ করিলেও দুরদৃষ্ট জন্মে। এই কথা বলিয়া পাণ্ডুবর্ণ বল্কল দ্বারা মুখ আচ্ছাদন করিয়া বাষ্পাকুল নয়নে রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। বোধ হইল যেন, শরৎকালীন শুভ্র মেঘ চন্দ্রমাকে আবৃত করিল ও বৃষ্টি হইতে লাগিল।

মহাশ্বেতার বিনয়, দাক্ষিণ্য, সুশীলতা ও মহানুভাবতায় মোহিত হইয়া চন্দ্রাপীড় তাঁহাকে প্রথমেই স্ত্রীরত্ন বলিয়া জ্ঞান করিয়াছিলেন। তাহাতে আবার আদ্যোপান্ত আত্মবৃত্তান্ত বর্ণনা দ্বারা সরলতা প্রকাশ ও পতিব্রতাধর্ম্মের চমৎকার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করাতে বিধাতার অলৌকিক সৃষ্টি বলিয়া বোধ হইল ও সাতিশয় বিস্ময় জন্মিল। তখন প্রীত ও প্রসন্ন চিত্তে কহিলেন, যাহারা স্নেহের উপযুক্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে অসমর্থ হইয়া কেবল অশ্রুপাত দ্বারা লঘুতা প্রকাশ করে তাহারাই অকৃতজ্ঞ। আপনি অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট অনুরাগের উপযুক্ত কর্ম্ম করিয়াও কি জন্য আপনাকে অকৃতজ্ঞ ও ক্ষুদ্র বোধ করিতেছেন? বিশুদ্ধ প্রেম প্রকাশের নবীন পথ উদ্ভাবন পূর্ব্বক অপরিচিতের ন্যায় আজন্মপরিচিত বান্ধবজনের পরিত্যাগ এবং অকিঞ্চিৎকর পদার্থের ন্যায় সাংসারিক সুখে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়াছেন; ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক তপস্বিনীবেশে জগদীশ্বরের আরাধনা করিতেছেন; অনন্যমনা হইয়া প্রাণেশ্বরের সহিত সমাগমের উপায় চিন্তা করিতেছেন। এতদ্ব্যতিরিক্ত বিশুদ্ধ প্রণয় পরিশোধের আর পন্থা কি?

শাস্ত্রকারেরা অনুমরণকে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রণালী বলিয়া নির্দ্দেশ করেন উহা ব্যামোহমাত্র। মূঢ় ব্যক্তিরাই মোহবশতঃ ঐ পথে পদার্পণ করে। ভর্ত্তা উপরত হইলে তাঁহার অনুগমন করা মূর্খতা প্রকাশ করা মাত্র উহাতে কিছুই উপকার নাই। না উহা মৃত ব্যক্তির পুনর্জীবনের উপায়, না তাঁহার শুভলোকপ্রাপ্তির হেতু, না পরস্পর দর্শন ও সমাগমের সাধন। জীবগণ নিজ নিজ ধর্ম্মানুসারে শুভাশুভ লোক প্রাপ্ত হয়। সুতরাং অনুমরণ দ্বারা যে পরস্পর সাক্ষাৎ হইবে তাহার নিশ্চয় কি? লাভ এই, অনুমৃত ব্যক্তিকে আত্মহত্যাজন্য মহাপাপে লিপ্ত হইয়া ঘোর নরকে চিরকাল বাস করিতে হয়। বরং জীবিত থাকিলে সৎকর্ম্ম দ্বারা স্বীয় উপকার ও শ্রাদ্ধতর্পণাদি দ্বারা উপরতের উপকার করিতে পারা যায়, মরিলে কাহার কিছুই উপকার নাই। অনুমরণ পতিব্রতার লক্ষণ নয়। দেখ, রতি, পতির মরণের পর ত্রিলোচনের নয়নানলে আত্মার আহুতি প্রদান করেন নাই। শূরসেন রাজার দুহিতা পৃথা, পাণ্ডুর মরণোত্তর অনুমৃতা হন নাই। বিরাটরাজের কন্যা উত্তরা, অভিমন্যুর মরণে আপন প্রাণ পরিত্যাগ করেন নাই। ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা দুঃশলা, জয়দ্রথের মরণোত্তর অর্জ্জুনের শরানলে আপনারে আহুতি দেন নাই। কিন্তু উঁহারা সকলেই পতিব্রতা বলিয়া জগতে বিখ্যাত। এইরূপ শত শত পতিপ্রাণা যুবতী পতির মরণেও জীবিত ছিলেন শুনিতে পাওয়া যায়। তাঁহারাই যথার্থ বুদ্ধিমতী ও যথার্থ ধর্ম্মের গতি বুঝিতে পারিয়াছিলেন। বিবেচনা করিলে স্বার্থপর লোকেরাই দুঃসহ বিরহযন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া অনুমরণ অবলম্বন করে। কেহ বা অহঙ্কার প্রকাশের নিমিত্ত এই পথে প্রবৃত্ত হয়। ফলতঃ ধর্ম্মবুদ্ধিতে প্রায় কেহ অনুমৃত হয় না। আপনি মহাপুরুষ কর্ত্তৃক আশ্বাসিত হইয়াছেন, তিনি যে মিথ্যা কথা দ্বারা প্রতারণা করিবেন এমন বোধ হয় না। দৈব অনুকূল হইয়া আপনার প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ করিবেন, সন্দেহ নাই। মরিলে পুনর্ব্বার জীবিত হয়, এ কথা নিতান্ত অসম্ভাবিত নহে। পূর্ব্ব কালে গন্ধর্ব্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরসে মেনকার গর্ভে প্রমদ্বরা নামে এক কন্যা জন্মে। ঐ কন্যা আশীবিষদষ্ট ও বিষবেগে উপরত হইয়াছিল; কিন্তু রুরুনামক ঋষিকুমার আপন পরমায়ুর অর্দ্ধেক প্রদান করিয়া উহাকে পুনর্জীবিত করেন। অভিমন্যুর তনয় পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার অস্ত্র দ্বারা আহত ও প্রাণবিযুক্ত হইয়াও পরমকারুণিক বাসুদেবের অনুকম্পায় পুনর্ব্বার জীবিত হন। জগদীশ্বর সানুগ্রহ ও অনুকূল হইলে কিছুই অসাধ্য থাকে না। চিন্তা করিবেন না, অচিরাৎ অভীষ্টসিদ্ধ হইবেক। সংসারে পদার্পণ করিলেই পদে পদে বিপদ আছে। কিছুই স্থায়ী নহে। বিশেষতঃ দগ্ধ বিধি অকৃত্রিম প্রণয় অধিক কাল দেখিতে পারেন না। দেখিলেই অমনি যেন ঈর্ষান্বিত হন ও তৎক্ষণাৎ ভঙ্গের চেষ্টা পান। এক্ষণে ধৈর্য্য অবলম্বন করুন; অনিন্দনীয় আত্মাকে আর মিথ্যা তিরস্কার করিবেন না। এইরূপ নানাবিধ সান্ত্বনাবাক্যে মহাশ্বেতাকে ক্ষান্ত করিলেন। মনে মনে মহাশ্বেতার এই আশ্চর্য্য ঘটনাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। ক্ষণ কাল পরে পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, ভদ্রে! আপনার সমভিব্যাহারিণী ও দুঃখের অংশভাগিনী পরিচারিকা তরলিকা এক্ষণে কোথায়?

২.০৮ মহাশ্বেতা কহিলেন

মহাশ্বেতা কহিলেন, মহাভাগ! অপ্সরাদিগের এক কুল অমৃত হইতে সমুদ্ভূত হয় আপনাকে কহিয়াছি। সেই কুলে মদিরা নামে এক কন্যা জন্মে। গন্ধর্ব্বের অধিপতি চিত্ররথ তাঁহার পাণিগ্রহণ করেন এবং তাঁহার গুণে বশীভূত হইয়া ছত্র চামর প্রভৃতি প্রদান পূর্ব্বক তাঁহাকে মহিষী করেন। কালক্রমে মহিষী গর্ভবতী হইয়া যথাকালে এক কন্যা প্রসব করেন। কন্যার নাম কাদম্বরী। কাদম্বরী নির্ম্মলা শশিকলার ন্যায় ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া এরূপ রূপবতী ও গুণবতী হইলেন যে, সকলেই তাঁহাকে দেখিলে আনন্দিত হইত ও অত্যন্ত ভাল বাসিত। শৈশবাবধি একত্র শয়ন, একত্র অশন, একত্র অবস্থান প্রযুক্ত আমি কাদম্বরীর প্রণয়পাত্র ও স্নেহপাত্র হইলাম। সর্ব্বদা একত্র ক্রীড়া কৌতুক করিতাম, এক শিক্ষকের নিকট নৃত্য, গীত, বাদ্য, বিদ্যা শিখিতাম, এক শরীরের মত দুই জনে একত্র থাকিতাম। ক্রমে এরূপ অকৃত্রিম সৌহার্দ্দ জন্মিল যে, আমি তাঁহাকে সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করিতাম; তিনিও আমাকে আপন হৃদয়ের ন্যায় ভাবিতেন। এক্ষণে আমার এই দুরবস্থা শুনিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, যাবৎ মহাশ্বেতা এই অবস্থায় থাকিবেন তাবৎ আমি বিবাহ করিব না। যদি পিতা মাতা অথবা বন্ধুবর্গ বলপূর্ব্বক আমার বিবাহ দেন তাহা হইলে অনশনে, হুতাশনে অথবা উদ্বন্ধনে প্রাণ ত্যাগ করিব। গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও মহাদেবী মদিরা পরম্পরায় কন্যার এই প্রতিজ্ঞা শুনিয়া অতিশয় দুঃখিত হইয়াছেন। কিন্তু এক অপত্য, অত্যন্ত ভাল বাসেন, সুতরাং তাঁহার প্রতিজ্ঞার বিরুদ্ধে কোন কথা উত্থাপন করিতে পারেন নাই। যুক্তি করিয়া অদ্য প্রভাতে ক্ষীরোদনামা এক কঞ্চুকীকে আমার নিকট পাঠাইয়াছিলেন। তাহার দ্বারা আমাকে বলিয়া পাঠান, “বৎসে মহাশ্বেতে! তোমা ব্যতিরেকে কেহ কাদম্বরীকে সান্ত্বনা করিতে সমর্থ নয়। সে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছে; এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয় কর।” আমি গুরুজনের গৌরবে ও মিত্রতার অনুরোধে ক্ষীরোদের সহিত তরলিকাকে কাদম্বরীর নিকট পাঠাইয়াছি। বলিয়া দিয়াছি, সখি! একেই আমি মরিয়া আছি, আবার কেন যন্ত্রণা বাড়াও? তোমার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। আমার জীবিত থাকা যদি অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে, গুরুজনের অনুরোধ কদাচ উল্লঙ্ঘন করিও না। তরলিকাও তথায় গেল; আপনিও এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

মহাশ্বেতা এইরূপ পরিচয় দিতেছেন এমন সময়ে নিশানাথ গগনমণ্ডলে উদিত হইলেন। তারাগণ হীরকের ন্যায় উজ্জ্বল কিরণ বিস্তার করিল। বোধ হইল যেন, যামিনী গগনের অন্ধকার নিবারণের নিমিত্ত শত শত প্রদীপ প্রজ্বলিত করিলেন। মহাশ্বেতা শীতল শিলাতলে পল্লবের শয্যা পাতিয়া নিদ্রা গেলেন। চন্দ্রাপীড় মহাশ্বেতাকে নিদ্রিতা দেখিয়া আপনিও শয়ন করিলেন। এবং বৈশম্পায়ন কত চিন্তা করিতেছেন, পত্রলেখা কত ভাবিতেছে, অন্যান্য সমভিব্যাহারী লোক আমার অনাগমনে কত উদ্বিগ্ন হইয়াছে; এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিদ্রাগত হইলেন।

প্রভাত হইলে মহাশ্বেতা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সন্ধ্যোপাসনাদি সমুদায় প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া জপ করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড়ও প্রাভাতিক বিধি যথাবিধি সম্পাদন করিতেছেন এমন সময়ে পীনবাহু, বিশালবক্ষঃস্থল, করে তরবারিধারী, বলবান্, ষোড়শবর্ষবয়স্ক, কেয়ূরকনামা এক গন্ধর্ব্বদারকের সহিত তরলিকা তথায় উপস্থিত হইল। অপরিচিত চন্দ্রাপীড়ের অলৌকিক সৌন্দর্য্য দর্শনে বিস্মিত হইয়া, ইনি কে? কোথা হইতে আসিলেন? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে মহাশ্বেতার নিকটে গিয়া বসিল। কেয়ূরকও এক শিলাতলে উপবিষ্ট হইল। জপ সমাপ্ত হইলে মহাশ্বেতা তরলিকাকে জিজ্ঞাসিলেন, তরলিকে! প্রিয়সখী কাদম্বরীর কুশল? আমি যাহা বলিয়া দিয়াছিলাম তাহাতে ত সম্মত হইয়াছেন? কেমন, তাঁহার অভিপ্রায় কি বুঝিলে? তরলিকা কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! হাঁ কাদম্বরী কুশলে আছেন, আপনার উপদেশবাক্য শুনিয়া রোদন করিতে করিতে কত কথা কহিলেন। এই কেয়ূরকের মুখে সমুদায় শ্রবণ করুন।

কেয়ূরক বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, কাদম্বরী প্রণয় প্রদর্শন পূর্ব্বক সাদর সম্ভাষণে আপনাকে কহিলেন, “প্রিয়সখি! যাহা তরলিকার মুখে বলিয়া পাঠাইয়াছ উহা কি গুরুজনের অনুরোধক্রমে, অথবা আমার চিত্ত পরীক্ষার নিমিত্ত, কি অদ্যাপি গৃহে আছি বলিয়া তিরস্কার করিয়াছ? যদি মনের সহিত উহা বলিয়া থাক, তোমার অন্তঃকরণে কোন অভিসন্ধি আছে, সন্দেহ নাই। এই অধীনকে একবারে পরিত্যাগ করিবে ইহা এত দিন স্বপ্নেও জানি নাই। আমার হৃদয় তোমার প্রতি যেরূপ অনুরক্ত তাহা জানিয়াও এইরূপ নিষ্ঠুর বাক্য বলিতে তোমার কিছুমাত্র লজ্জা হইল না? আমি জানিতাম তুমি স্বভাবতঃ মধুরভাষিণী ও প্রিয়বাদিনী। এক্ষণে এরূপ পরুষ ও অপ্রিয় কথা কহিতে কোথায় শিখিলে? আপাততঃ মধুররূপে প্রতীয়মান, কিন্তু অবসানবিরস কর্ম্মে কোন্ ব্যক্তির সহসা প্রবৃত্তি জন্মে? আমি ত প্রিয়সখীর দুঃখে নিতান্ত দুঃখিনী হইয়াছি। এ সময়ে কি রূপে অকিঞ্চিৎকর বিবাহের আড়ম্বর করিয়া আমোদ প্রমোদ করিব? এ সময় আমোদের সময় নয় বলিয়াই সেইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। প্রিয়সখীর দুঃখে দুঃখিত অন্তঃকরণে সুখের আশা কি? সম্ভোগেরই বা স্পৃহা কি? মানুষের ত কথাই নাই, পশুপক্ষীরাও সহচরের দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিয়া থাকে। দিনকরের অস্তগমনে নলিনী মুকুলিত হইলে তৎসহবাসিনী চক্রবাকীও প্রিয়সমাগম পরিত্যাগ পূর্ব্বক সারা রাত্রি চীৎকার করিয়া দুঃখ প্রকাশ করে। যাহার প্রিয়সখী বনবাসিনী হইয়া দিনযামিনী সাতিশয় ক্লেশে কাল যাপন করিতেছে, সে, সুখের অভিলাষিণী হইলে লোকে কি বলিবে? আমি তোমার নিমিত্ত গুরুবচন অতিক্রম, লজ্জা ভয় পরিত্যাগ ও কুলকন্যাবিরুদ্ধ সাহস অবলম্বন পূর্ব্বক, দুস্তর প্রতিজ্ঞা অবলম্বন করিয়াছি; এক্ষণে যাহাতে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না হয় ও লোকের নিকট লজ্জা না পাই, এরূপ করিও।” এই বলিয়া কেয়ূরক ক্ষান্ত হইল।

কেয়ূরকের কথা শুনিয়া মহাশ্বেতা মনে মনে ক্ষণকাল অনুধ্যান করিয়া কহিলেন, কেয়ূরক! তুমি বিদায় হও, আমি স্বয়ং কাদম্বরীর নিকট যাইতেছি। কেয়ূরক প্রস্থান করিলে চন্দ্রাপীড়কে কহিলেন, রাজকুমার! হেমকূট অতি রমণীয় স্থান, চিত্ররথের রাজধানী অতি আশ্চর্য্য, কাদম্বরী অতি মহানুভবা। যদি দেখিতে কৌতুক হয় ও আর কোন কার্য্য না থাকে, আমার সঙ্গে চলুন। অদ্য তথায় বিশ্রাম করিয়া কল্য প্রত্যাগমন করিবেন। আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া অবধি আমার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় অনেক সুস্থ হইয়াছে। আপনার নিকট স্ববৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার শোকের অনেক হ্রাস হইয়াছে। আপনি অকারণমিত্র। আপনার সঙ্গ পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা হয় না। সাধুসমাগমে অতি দুঃখিত চিত্তও আহ্লাদিত হয়, এ কথা মিথ্যা নহে। আপনার গুণে ও সৌজন্যে অতিশয় বশীভূত হইয়াছি, যতক্ষণ দেখিতে পাই তাহাই ভাল। চন্দ্রাপীড় কহিলেন, ভগবতি! দর্শন অবধি আপনাকে শরীর প্রাণ সমর্পণ করিয়াছি। এক্ষণে যে দিকে লইয়া যাইবেন, সেই দিকে যাইব ও যাহা আদেশ করিবেন তাহাতেই সম্মত আছি। অনন্তর মহাশ্বেতা সমভিব্যাহারে গন্ধর্ব্বনগরে চলিলেন।

নগরে উত্তীর্ণ হইয়া রাজভবন অতিক্রম করিয়া ক্রমে কাদম্বরীর ভবনের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। প্রতিহারীরা পথ দেখাইয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। রাজকুমার অসংখ্য সুন্দরী-কুমারী-পরিবেষ্টিত অন্তঃপুরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। কুমারীগণের শরীরপ্রভায় অন্তঃপুর সর্ব্বদা চিত্রিতময় বোধ হয়। তাহারাও বিনা অলঙ্কারেও সর্ব্বদা অলঙ্কৃত। তাহাদিগের আকর্ণবিশ্রান্ত লোচনই কর্ণোৎপল, হসিতচ্ছবিই অঙ্গরাগ, নিশ্বাসই সুগন্ধি বিলেপন, অধরদ্যুতিই কুঙ্কুমলেপন, ভুজলতাই চম্পকমালা, করতলই লীলাকমল এবং অঙ্গুলিরাগই অলক্তকরস। রাজকুমার কুমারীগণের মনোহর শরীরকান্তি দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তাহাদিগের তানলয়বিশুদ্ধ বেণুবীণাঝঙ্কারমিলিত মধুর সঙ্গীত শ্রবণে তাঁহার অন্তঃকরণ আনন্দে পুলকিত হইল। ক্রমে কাদম্বরীর বাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া দেখিলেন, কন্যাজনেরা নানা বাদ্যযন্ত্র লইয়া চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া বসিয়াছে; মধ্যে সুচারু পর্য্যঙ্কে কাদম্বরী শয়ন করিয়া নিকটবর্ত্তী কেয়ূরককে মহাশ্বেতার বৃত্তান্ত ও মহাশ্বেতার আশ্রমে সমাগত অপরিচিত পুরুষের নাম, বয়স, বংশ ও তথায় আগমনহেতু সমুদায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন। চামরধারিণীরা অনবরত চামর বীজন করিতেছে।

শশিকলাদর্শনে জলনিধির জল যেরূপ উল্লাসিত হয়, কাদম্বরীদর্শনে চন্দ্রাপীড়ের হৃদয় সেইরূপ উল্লাসিত হইল। মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, আহা! আজি কি রমণীয় রত্ন দেখিলাম! এরূপ সুন্দরী কুমারী ত কখন নেত্রপথের অতিথি হয় নাই! আজি নয়নযুগল সফল ও চিত্ত চরিতার্থ হইল। জন্মান্তরে এই লোচনযুগল কত ধর্ম্ম ও পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছিল, সেই ফলে কাদম্বরীর মনোহর মুখারবিন্দ দেখিতে পাইল। বিধাতা আমার সকল ইন্দ্রিয় লোচনময় করেন নাই কেন? তাহা হইলে, সকল ইন্দ্রিয় দ্বারা এক বার অবলোকন করিয়া আশা পূর্ণ করিতাম। কি আশ্চর্য্য! যত বার দেখি তত আরও দেখিতে ইচ্ছা হয়। বিধাতা এরূপ রূপাতিশয় নির্ম্মাণের পরমাণু কোথায় পাইলেন। বোধ হয়, যে সকল পরমাণু দ্বারা ইহার রূপ লাবণ্য সৃষ্টি করিয়াছেন তাহারই অবশিষ্ট অংশ দ্বারা কমল, কুমুদ, কুবলয় প্রভৃতি কোমল বস্তুর সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। ক্রমে গন্ধর্ব্বকুমারীর ও রাজকুমারের চারি চক্ষু একত্র হইল। কাদম্বরী রাজকুমারকে দেখিয়া মনে মনে কহিলেন, কেয়ূরক যে অপরিচিত যুবা পুরুষের কথা কহিতেছিল, বোধ হয়, ইনিই সেই ব্যক্তি। আহা! এরূপ সুন্দর ত কখন দেখি নাই। গন্ধর্ব্বনগরেও এরূপ রূপাতিশয় দেখিতে পাওয়া যায় না। এইরূপে উভয়ের সৌন্দর্য্যে উভয়ের মন আকৃষ্ট হইল। কাদম্বরী নিমেষশূন্য লোচনে চন্দ্রাপীড়ের রূপ লাবণ্য বারংবার অবলোকন করিতে লাগিলেন; কিন্তু পরিতৃপ্ত হইলেন না। যতবার দেখেন মনে নব নব প্রীতি জন্মে।

বহু কালের পর প্রিয়সখী মহাশ্বেতাকে সমাগত দেখিয়া কাদম্বরী আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন ও সহসা গাত্রোত্থান করিয়া সস্নেহে গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন। মহাশ্বেতাও প্রত্যালিঙ্গন করিয়া কহিলেন, সখি! ইনি ভারতবর্ষের অধিপতি মহারাজ তারাপীড়ের পুত্র, নাম চন্দ্রাপীড়। দিগ্বিজয়বেশে আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়াছেন। দর্শনমাত্র আমার নয়ন ও মন হরণ করিয়াছেন; কিন্তু কি রূপে হরণ করিয়াছেন তাহা বুঝিতে পারি নাই। প্রজাপতির কি চমৎকার নির্ম্মাণকৌশল! এক স্থানে সমুদায় সৌন্দর্য্যের সুন্দররূপ সমাবেশ করিয়াছেন। ইনি বাস করেন বলিয়া মর্ত্ত্যলোক এক্ষণে সুরলোক হইতেও গৌরবান্বিত হইয়াছে। তুমি কখন সকল বিদ্যার ও সমুদয় গুণের এক স্থানে সমাগম দেখ নাই, এই নিমিত্ত অনুরোধবাক্যে বশীভূত করিয়া ইঁহাকে এখানে আনিয়াছি। তোমার কথাও ইঁহার সাক্ষাতে বিশেষ করিয়া বলিয়াছি। তুমি অদৃষ্টপূর্ব্ব এই লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া, অপরিচিত এই অবিশ্বাস দূর করিয়া, অজ্ঞাতকুলশীল এই শঙ্কা পরিহার করিয়া, অসঙ্কুচিত ও নিঃশঙ্ক চিত্তে সুহৃদের ন্যায় ইঁহার সহিত বিস্রম্ভ আলাপ কর। এই বলিয়া মহাশ্বেতা চন্দ্রাপীড়ের পরিচয় দিয়া দিলেন। মহাশ্বেতা ও কাদম্বরী এক পর্য্যঙ্কে উপবেশন করিলেন। রাজকুমার অন্য এক সিংহাসনে বসিলেন। কাদম্বরীর সঙ্কেত মাত্র বেণুরব, বীণাশব্দ ও সঙ্গীত নিবৃত্ত হইল। মহাশ্বেতা স্নেহসংবলিত মধুর বচনে কাদম্বরীর অনাময় জিজ্ঞাসা করিলেন। কাদম্বরী বলিলেন, সকল কুশল।

মনোভাবের কি অনির্ব্বচনীয় প্রভাব! প্রণয়পরাঙ্মুখ ব্যক্তির অন্তঃকরণও উহার প্রভাবের অধীন হইল। কাদম্বরীর নিরুৎসুক চিত্তেও অনুরাগ অজ্ঞাতসারে প্রবেশিল। তিনি মহাশ্বেতার সহিত কথা কহেন ও ছলক্রমে এক এক বার চন্দ্রাপীড়ের প্রতি কটাক্ষপাত করেন। মহাশ্বেতা উভয়ের ভাব ভঙ্গি দ্বারা উভয়ের মনোগত ভাব অনায়াসে বুঝিতে পারিলেন। কাদম্বরী তাম্বূল দিতে উদ্যত হইলে কহিলেন, সখি! চন্দ্রাপীড় আগন্তুক, আগন্তুকের সম্মান করা অগ্রে কর্ত্তব্য; চন্দ্রাপীড়ের হস্তে অগ্রে তাম্বূল প্রদান করিয়া অতিথিসৎকার কর, পরে আমরা ভক্ষণ করিব। কাদম্বরী ঈষৎ হাস্য করিয়া মুখ ফিরাইয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, প্রিয়সখি! অপরিচিত ব্যক্তির নিকট প্রগল্‌ভতা প্রকাশ করিতে আমার সাহস হয় না। লজ্জা যেন আমার হস্ত ধরিয়া তাম্বূল দিতে বারণ করিতেছে; অতএব আমার হইয়া তুমি রাজকুমারের করে তাম্বূল প্রদান কর। মহাশ্বেতা পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, আমি তোমার প্রতিনিধি হইতে পারিব না। আপনার কর্ত্তব্য কর্ম্ম আপনিই সম্পাদন কর। বারংবার অনুরোধ করাতে কাদম্বরী অগত্যা কি করেন, লজ্জায় মুকুলিতাক্ষী হইয়া তাম্বূল দিবার নিমিত্ত কর প্রসারণ করিলেন। চন্দ্রাপীড়ও হস্ত বাড়াইয়া তাম্বূল ধরিলেন।

এই অবসরে একটী শারিকা আসিয়া ক্রোধভরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! এই দুর্বিনীত বিহগাধমকে কেন নিবারণ করিতেছ না? যদি এ আমার গাত্র স্পর্শ করে, শপথ করিয়া বলিতেছি এ প্রাণ রাখিব না। কাদম্বরী শারিকার প্রণয়কোপের কথা শুনিয়া হাসিতে লাগিলেন। মহাশ্বেতা কিছু বুঝিতে না পারিয়া শারিকা কি বলিতেছে এই কথা মদলেখাকে জিজ্ঞাসিলেন। মদলেখা হাসিয়া বলিল, কাদম্বরী পরিহাস নামক শুকের সহিত কালিন্দীনাম্নী এই শারিকার বিবাহ দিয়াছেন। অদ্য প্রভাতে তমালিকার প্রতি পরিহাসকে পরিহাস করিতে দেখিয়া শারিকা ঈর্ষান্বিত হইয়া আর উহার সহিত কথা কহে না, উহাকে দেখিতে পারে না এবং স্পর্শও করে না। আমরা সান্ত্বনাবাক্যে অনেক বুঝাইয়াছি, কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না। চন্দ্রাপীড় হাসিয়া কহিলেন, হাঁ আমিও শুনিয়াছি পরিহাস তমালিকার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত। ইহা জানিয়া শুনিয়া শারিকাকে সেই বিহগাধমের হস্তে সমর্পণ করা অতি অন্যায় কর্ম্ম হইয়াছে। যাহা হউক, অন্ততঃ সেই দুর্বিনীত দাসীকে এক্ষণে এই দুষ্কর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত করা উচিত।

এইরূপ নানা হাস্য পরিহাস হইতেছে এমন সময়ে কঞ্চুকী আসিয়া বলিল, মহাশ্বেতে! গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও মহিষী মদিরা আপনাকে আহ্বান করিতেছেন। মহাশ্বেতা তথায় যাইবার সময় কাদম্বরীকে জিজ্ঞাসিলেন, সখি! চন্দ্রাপীড় এক্ষণে কোথায় থাকিবেন? কাদম্বরী কহিলেন, প্রিয়সখি! কি জন্য তুমি এরূপ জিজ্ঞাসা করিতেছ? দর্শন অবধি আমি চন্দ্রাপীড়কে মন, প্রাণ, গৃহ, পরিজন সমুদায় সমর্পণ করিয়াছি। ইনি সমুদায় বস্তুর অধিকারী হইয়াছেন। যেখানে রুচি হয় থাকুন! তোমার প্রাসাদের সমীপবর্ত্তী ঐ প্রমোদবনে ক্রীড়াপর্ব্বতের প্রস্থদেশস্থ মণিমন্দিরে গিয়া চন্দ্রাপীড় অবস্থিতি করুন, এই কথা বলিয়া মহাশ্বেতা চলিয়া গেলেন। বিনোদের নিমিত্ত কতিপয় বীণাবাদিকা গায়িকা সমভিব্যাহারে দিয়া কাদম্বরী চন্দ্রাপীড়কে তথায় যাইতে কহিলেন। কেয়ূরক পথ দেখাইয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। তাঁহার গমনের পর কাদম্বরী শয্যায় নিপতিত হইয়া জাগ্রদবস্থায় স্বপ্ন দেখিলেন, যেন লজ্জা আসিয়া কহিল, চপলে! তুমি কি কুকর্ম্ম করিয়াছ? আজি তোমার এরূপ চিত্তবিকার কেন হইল? কুলকুমারীদিগের এরূপ হওয়া কোন ক্রমেই উচিত নয়। লজ্জা কর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়া মনে মনে কহিলেন, আমি মোহান্ধ হইয়া কি চপলতা প্রকাশ করিয়াছি! এক জন উদাসীন অপরিচিত ব্যক্তির সমক্ষে নিঃশঙ্ক চিত্তে কতভাব প্রকাশ করিলাম। তাঁহার চিত্তবৃত্তি, অভিপ্রায়, স্বভাব কিছুই পরীক্ষা করিলাম না, তিনি কিরূপ লোক কিছু জানিলাম না। অথচ তাঁহার হস্তে মন, প্রাণ, সমুদায় সমর্পণ করিলাম। লোকে এই ব্যাপার শুনিলে আমাকে কি বলিবে? আমি সখীদিগের সমক্ষে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যাবৎ মহাশ্বেতা বৈধব্যদশায় ক্লেশভোগ করিবেন, তত দিন সাংসারিক সুখে বা অলীক আমোদে অনুরক্ত হইব না; আমার সেই প্রতিজ্ঞা আজি কোথায় রহিল। সকলেই আমাকে উপহাস করিবে, সন্দেহ নাই। পিতা এই ব্যাপার শুনিয়া কি মনে করিবেন? মাতা কি ভাবিবেন? প্রিয়সখী মহাশ্বেতার নিকট কি বলিয়া মুখ দেখাইব? যাহা হউক আমার অত্যন্ত লঘুহৃদয়তা ও চপলতা প্রকাশ হইয়াছে। বুঝি আমার চপলতা প্রকাশ করাইবার নিমিত্তই প্রজাপতি ও রতিপতি মন্ত্রণাপূর্ব্বক এই উদাসীন পুরুষকে এখানে পাঠাইয়া থাকিবেন। অন্তঃকরণে একবার অনুরাগ সঞ্চার হইলে তাহা ক্ষালিত করা দুঃসাধ্য। কাদম্বরী এইরূপ ভাবিতেছিলেন এমন সময়ে প্রণয় যেন সহসা তথায় আসিয়া কহিল, কাদম্বরী! কি ভাবিতেছ? তোমার অলীক অনুরাগে ও কপট মিত্রতায় বিরক্ত হইয়া চন্দ্রাপীড় এখান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইয়াছেন। গন্ধর্ব্বকুমারী তখন আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না। অমনি শয্যা হইতে ত্বরায় উঠিয়া গবাক্ষদ্বার উদ্ঘাটন পূর্ব্বক এক দৃষ্টে ক্রীড়াপর্ব্বতের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

২.০৯ চন্দ্রাপীড় মণিমন্দিরে প্রবেশিয়া

চন্দ্রাপীড় মণিমন্দিরে প্রবেশিয়া শিলাতলবিন্যস্ত শয্যায় শয়ন করিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, গন্ধর্ব্বরাজদুহিতা আমার সমক্ষে যেরূপ ভাব ভঙ্গি প্রকাশ করিলেন সে সকল কি তাঁহার স্বাভাবিক বিলাস, কি মকরকেতু আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া প্রকাশ করাইলেন? তাঁহার তৎকালীন বিলাসচেষ্টা স্মরণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ চঞ্চল হইতেছে। আমি যখন সেই সময়ে তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন মুখ অবনত করিয়াছিলেন। যখন অন্যাসক্তদৃষ্টি হই তখন আমার প্রতি কটাক্ষপাত পূর্ব্বক ছলক্রমে মন্দ মন্দ হাসিয়াছিলেন। অনঙ্গ উপদেশ না দিলে এ সকল বিলাস প্রকাশ হয় না। যাহা হউক, অলীক সংকল্পে প্রতারিত হওয়া বুদ্ধিমানের কর্ম্ম নহে। অগ্রে তাঁহার মন পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। এই স্থির করিয়া সমভিব্যাহারিণী বীণাবাদিনী ও গায়িকাদিগকে গান বাদ্য আরম্ভ করিতে আদেশ দিলেন। গানভঙ্গ হইলে উপবনের শোভা অবলোকন করিবার নিমিত্ত ক্রীড়াপর্ব্বতের শিখরদেশে উঠিলেন। কাদম্বরী গবাক্ষদ্বার দিয়া দেখিতে পাইয়া মহাশ্বেতার আগমন দর্শনচ্ছলে তথা হইতে প্রাসাদের উপরিভাগে আরোহণ করিয়া হৃদয়বল্লভের প্রতি অনুরাগসঞ্চারের চিহ্নস্বরূপ নানাবিধ অনঙ্গলীলা ও মনোহর বিলাস প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাহাতেই এরূপ অন্যমনস্ক হইলেন যে, যে ব্যপদেশে প্রাসাদের শিখরদেশে উঠিলেন তাহাতে কিছুমাত্র মনোযোগ রহিল না। মহাশ্বেতা আসিয়া প্রতিহারী দ্বারা সংবাদ দিলে সৌধশিখর হইতে অবতীর্ণ হইলেন ও স্নান ভোজন প্রভৃতি সমুদায় দিবসব্যাপার সম্পন্ন করিলেন।

চন্দ্রাপীড় মণিমন্দিরে স্নান ভোজন সমাপন করিয়া মরকতশিলাতলে বসিয়া আছেন এমন সময়ে তমালিকা, তরলিকা ও অন্যান্য পরিজন সমভিব্যাহারে কাদম্বরীর প্রধান পরিচারিকা মদলেখা আসিতেছে দেখিলেন। কাহারও হস্তে সুগন্ধি অঙ্গরাগ, কাহারও করে মালতীমালা, কাহারও বা পাণিতলে ধবল দুকূল এবং এক জনের করে এক ছড়া মুক্তার হার। ঐ হারের এরূপ উজ্জ্বল প্রভা যে চন্দ্রোদয়ে যেরূপ দিঙ্মণ্ডল জ্যোৎস্নাময় হয়, উহার প্রভায় সেইরূপ চতুর্দ্দিক্ আলোকময় হইয়াছে। মদলেখা সমীপবর্ত্তিনী হইলে চন্দ্রাপীড় যথোচিত সমাদর করিলেন। মদলেখা স্বহস্তে রাজকুমারের অঙ্গে অঙ্গরাগ লেপন করিয়া দিল, বস্ত্রযুগল প্রদান করিল এবং গলে মালতীমালা সমর্পণ করিয়া কহিল, রাজকুমার! আপনার আগমনে অনুগৃহীত, আপনার সরল স্বভাব ও প্রকৃতিমধুর ব্যবহারে বশীভূত এবং আপনার অহঙ্কারশূন্য সৌজন্যে সন্তুষ্ট হইয়া কাদম্বরী বয়স্যভাবে প্রণয়সঞ্চারের প্রমাণস্বরূপ এই হার প্রেরণ করিয়াছেন। তিনি আপনার ঐশ্বর্য্য বা সম্পত্তি দেখাইবার আশয়ে পাঠান নাই। ইহা কেবল শুদ্ধ সরলস্বভাবতার কার্য্য বিবেচনা করিয়া অনুগ্রহ পূর্ব্বক গ্রহণ করুন। রত্নাকর এই হার বরুণকে দিয়াছিলেন। বরুণ গন্ধর্ব্বরাজকে এবং গন্ধর্ব্বরাজ, কাদম্বরীকে দেন। অমৃতমন্থনসময়ে দেবগণ ও অসুরগণ সাগরের অভ্যন্তর হইতে সমস্ত রত্ন গ্রহণ করিয়াছিলেন, কেবল ইহাই শেষ ছিল; এই নিমিত্ত এই হারের নাম শেষ। গগনমণ্ডলেই চন্দ্রের উদয় শোভাকর হয় এই বিবেচনা করিয়া রাজকুমারের কণ্ঠে পরাইয়া দিবার নিমিত্ত এই হার পাঠাইয়াছেন। এই বলিয়া চন্দ্রাপীড়ের কণ্ঠদেশে হার পরাইয়া দিল। চন্দ্রাপীড় কাদম্বরীর সৌজন্য ও দাক্ষিণ্য এবং মদলেখার মধুর বচনে চমৎকৃত ও বিস্মিত হইয়া কহিলেন, তোমাদিগের গুণে অতিশয় বশীভূত হইয়াছি। কাদম্বরীর প্রদান বলিয়া হার গ্রহণ করিলাম। অনন্তর সন্তোষজনক নানা কথা বলিয়া ও কাদম্বরীসম্বদ্ধ নানা সংবাদ শুনিয়া মদলেখাকে বিদায় করিলেন।

কাদম্বরী চন্দ্রাপীড়ের অদর্শনে অধীর হইয়া পুনর্ব্বার প্রাসাদের শিখরদেশে আরোহণ করিলেন। দেখিলেন, তিনিও উজ্জ্বল মুক্তাময় হার কণ্ঠে ধারণ করিয়া ক্রীড়াপর্ব্বতের শিখর দেশে বিহার করিতেছেন। গন্ধর্ব্বনন্দিনী কুমুদিনীর ন্যায় চন্দ্রসদৃশ চন্দ্রাপীড়ের দর্শনে মুখবিকাস প্রভৃতি নানা বিলাস বিস্তার করিতে লাগিলেন। ক্রমে দিবাবসান হইল। সূর্য্যমণ্ডল ও দিঙ্মণ্ডল ও গগনমণ্ডল রক্তবর্ণ হইল। অন্ধকারের প্রাদুর্ভাব হওয়াতে দর্শনশক্তির হ্রাস হইয়া আসিল। কাদম্বরী সৌধশিখর হইতে ও চন্দ্রাপীড় ক্রীড়াপর্ব্বতের শিখরদেশ হইতে নামিলেন। ক্রমে সুধাংশু উদিত হইয়া সুধাময় দীধিতি দ্বারা পৃথিবীকে জ্যোৎস্নাময় করিলেন। চন্দ্রাপীড় মণিমন্দিরে শয়ন করিয়া আছেন এমন সময়ে কেয়ূরক আসিয়া কহিল, রাজকুমারী কাদম্বরী আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেছেন। তিনি সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সখীজন সমভিব্যাহারে সমাগত গন্ধর্ব্বরাজপুত্রীর যথোচিত সমাদর করিলেন। সকলে উপবিষ্ট হইলে বিনীতভাবে কহিলেন, দেবি! তোমার অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা দর্শনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও এরূপ প্রসাদ ও অনুগ্রহের উপযুক্ত কোন গুণ আমাতে দেখিতে পাই না। ফলতঃ এরূপ অনুগ্রহ প্রকাশ করা শুদ্ধ উদার স্বভাব ও সৌজন্যের কার্য্য, সন্দেহ নাই। কাদম্বরী তাঁহার বিনয়বাক্যে অতিশয় লজ্জিত হইয়া মুখ অবনত করিয়া রহিলেন। অনন্তর, ভারতবর্ষ, উজ্জয়িনী নগরী এবং চন্দ্রাপীড়ের বন্ধু বান্ধব, জনক জননী ও রাজ্যসংক্রান্ত নানাবিধ কথাপ্রসঙ্গে অনেক রাত্রি হইল। কেয়ূরককে চন্দ্রাপীড়ের নিকটে থাকিতে আদেশ করিয়া কাদম্বরী শয়নাগারে গমন পূর্ব্বক শয্যায় শয়ন করিলেন। চন্দ্রাপীড়ও সুশীতল শিলাতলে শয়ন করিয়া কাদম্বরীর নিরভিমান ব্যবহার, মহাশ্বেতার নিষ্কারণ স্নেহ, কাদম্বরীপরিজনের অকপট সৌজন্য. গন্ধর্ব্বনগরের রমণীয়তা ও সুখসমৃদ্ধি মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে যামিনী যাপন করিলেন।
তারাপতি সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া প্রভাতে নিভৃত প্রদেশে নিদ্রা যাইবার নিমিত্ত যেন, অস্তাচলের নির্জ্জন প্রদেশ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। প্রভাতসমীরণ মালতীকুসুমের পরিমল গ্রহণ করিয়া সুপ্তোত্থিত মানবগণের মনে আহ্লাদ বিতরণ পূর্ব্বক ইতস্ততঃ বহিতে লাগিল। প্রদীপের প্রভার আর প্রভাব রহিল না। পল্লবের অগ্র হইতে নিশার শিশির মুক্তার ন্যায় ভূতলে পড়িতে লাগিল। তেজস্বীর অনুচরও অনায়াসে শত্রুবিনাশে সমর্থ হয়, যে হেতু সূর্য্যসারথি অরুণ উদিত হইয়াই সমস্ত অন্ধকার নিরস্ত করিয়া দিলেন। শত্রুবিনাশে কৃতসংকল্প লোকেরা রমণীয় বস্তুকেও অরাতিপক্ষপাতী দেখিলে তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট করে, যে হেতু অরুণ তিমির বিনাশে উদ্যত হইয়া সুদৃশ্য তারাগণকেও অদৃশ্য করিয়া দিলেন; প্রভাতে কমল বিকসিত ও কুমুদ মুকুলিত হইতে আরম্ভ হইলে উভয় কুসুমেরই সমান শোভা হইল এবং মধুকর কলরব করিয়া উভয়তেই বসিতে লাগিল। অরুণোদয়ে তিমির নিরস্ত হইলে চক্রবাক প্রিয়তমার সন্নিধানে গমনের উদ্‌যোগ করিতেছে এমন সময়ে বিরহকাতরা চক্রবাকী প্রিয়তমের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। দিবাকরের উদয়ের সময় বোধ হইল যেন, দিগঙ্গনারা সাগরগর্ভ হইতে সুবর্ণের রজ্জু দ্বারা হেমকলস তুলিতেছে। দিবাকরের লোহিত কিরণ জলে প্রতিফলিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, বাড়বানল সলিলের অভ্যন্তর হইতে উত্থিত হইয়া দিগ্বলয় দাহ করিবার উদ্‌যোগ করিতেছে। চিরকাল কাহারও সমান অবস্থা থাকে না প্রভাতে কুমুদবন ভ্রষ্ট, কমলবন শোভাবিশিষ্ট, শশী অস্তগত, রবি উদিত, চক্রবাক প্রীত ও পেচক বিষণ্ণ হইয়া যেন ইহাই প্রকাশ করিতে লাগিল।

চন্দ্রাপীড় গাত্রোত্থানপূর্ব্বক মুখ ধৌত করিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিলেন। কাদম্বরী কোথায় আছেন জানিবার নিমিত্ত কেয়ূরককে পাঠাইলেন। কেয়ূরক প্রত্যাগত হইয়া কহিল, মন্দরপ্রাসাদের নিম্ন দেশে অঙ্গনসৌধবেদিকায় মহাশ্বেতা ও কাদম্বরী বসিয়া আছেন। চন্দ্রাপীড় তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, কেহ বা রক্তপটব্রতধারিণী কেহ বা পাশুপতব্রতধারিণী তাপসী; বুদ্ধ জিন কার্ত্তিকেয় প্রভৃতি নানা দেবতার স্তুতিপাঠ করিতেছেন। মহাশ্বেতা সাদর সম্ভাষণ ও আসন দান দ্বারা দর্শনাগত গন্ধর্ব্বপুরন্ধ্রীদিগের সম্মাননা করিতেছেন। কাদম্বরী মহাভারত শুনিতেছেন। তথায় আসনে উপবিষ্ট হইয়া মহাশ্বেতার প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। মহাশ্বেতা চন্দ্রাপীড়ের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া কাদম্বরীকে কহিলেন, সখি! সঙ্গিগণ রাজকুমারের বৃত্তান্ত কিছুই জানিতে না পারিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন আছেন, ইনিও তাহাদের নিকট যাইতে নিতান্ত উৎসুক। কিন্তু তোমার গুণে ও সৌজন্যে বশীভূত হইয়া যাইবার কথা উল্লেখ করিতে পারিতেছেন না। অতএব অনুমতি কর, ইনি তথায় গমন করুন। ভিন্নদেশবর্ত্তী হইলেও কমলিনী ও কমলবান্ধবের ন্যায় এবং কুমুদিনী ও কুমুদনাথের ন্যায় তোমাদিগের পরস্পর প্রীতি অবিচলিত ও চিরস্থায়িনী হউক।

সখি! আমি দর্শন অবধি রাজকুমারের অধীন হইয়াছি, অনুরোধের প্রয়োজন কি? রাজকুমার যাহা আদেশ করিবেন তাহাতেই সম্মত আছি। কাদম্বরী এই কথা কহিয়া গন্ধর্ব্বকুমারদিগকে ডাকাইয়া আদেশ করিলেন, তোমরা রাজকুমারকে আপন স্কন্ধাবারে রাখিয়া আইস। চন্দ্রাপীড় গাত্রোত্থানপূর্ব্বক বিনয় বাক্যে মহাশ্বেতার নিকট বিদায় লইলেন। অনন্তর কাদম্বরীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেবি! বহুভাষী লোকের কথায় কেহ বিশ্বাস করে না। অতএব অধিক কথায় প্রয়োজন নাই। পরিজনের কথা উপস্থিত হইলে আমাকেও এক জন পরিজন বলিয়া স্মরণ করিও। এই বলিয়া অন্তঃপুরের বহির্গত হইলেন। কাদম্বরী প্রেমস্নিগ্ধ চক্ষু দ্বারা এক দৃষ্টে দেখিতে লাগিলেন। পরিজনেরা বহিস্তোরণ পর্য্যন্ত অনুগমন করিল।

কন্যাজনেরা বহিস্তোরণের নিকট হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইল। চন্দ্রাপীড় কেয়ূরককর্ত্তৃক আনীত ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ করিয়া কাদম্বরীপ্রেরিত গন্ধর্ব্বকুমারগণ সমভিব্যাহারে হেমকূটের নিকট দিয়া গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। যাইতে যাইতে সেই পরমসুন্দরী গন্ধর্ব্বকুমারীকে কেবল অন্তঃকরণমধ্যে অবলোকন করিতেছিলেন এমন নহে, কিন্তু চতুর্দ্দিক তন্ময়ী দেখিলেন। তোমার বিরহবেদনা সহ্য করিতে পারিব না বলিয়া কাদম্বরী যেন পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছেন দেখিতে পাইলেন। কোথায় যাও যাইতে পাইবে না বলিয়া যেন, সম্মুখে পথ রোধ করিয়া দণ্ডায়মান আছেন দেখিলেন। ফলতঃ যে দিকে দৃষ্টিপাত করেন সেই দিকেই কাদম্বরীর রূপ লাবণ্য দেখিতে পান। ক্রমে অচ্ছোদসরোবরের তীরে সন্নিবিষ্ট মহাশ্বেতার আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে ইন্দ্রায়ুধের খুরচিহ্ন অনুসারে অনেক দূর যাইয়া আপন স্কন্ধাবার দেখিতে পাইলেন। গন্ধর্ব্বকুমারদিগকে সন্তোষজনক বাক্যে বিদায় করিয়া স্কন্ধাবারে প্রবেশিলেন। রাজকুমারকে সমাগত দেখিয়া সকলে অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। পত্রলেখা ও বৈশম্পায়নের সাক্ষাতে গন্ধর্ব্বলোকের সমুদায় সমৃদ্ধি বর্ণন করিলেন। মহাশ্বেতা অতি মহানুভাবা, কাদম্বরী পরমসুন্দরী, গন্ধর্ব্বলোকের ঐশ্বর্য্যের পরিসীমা নাই, এইরূপ নানা কথাপ্রসঙ্গে দিবাবসান হইল। কাদম্বরীর রূপ লাবণ্য চিন্তা করিয়া যামিনী যাপন করিলেন।

পর দিন প্রভাতকালে পটমণ্ডপে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কেয়ূরক আসিয়া প্রণাম করিল। রাজকুমার প্রথমতঃ অপাঙ্গবিস্তৃত নেত্রযুগল দ্বারা তদনন্তর প্রসারিত বাহুযুগ দ্বারা কেয়ূরককে আলিঙ্গন করিয়া মহাশ্বেতা, কাদম্বরী এবং কাদম্বরীর সখীজন ও পরিজনদিগের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসিলেন। কেয়ূরক কহিল, রাজকুমার এত আদর করিয়া যাহাদিগের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন তাহাদিগের কুশল, সন্দেহ কি! কাদম্বরী বদ্ধাঞ্জলি হইয়া অনুনয় পূর্ব্বক এই বিলেপন ও তাম্বূল গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়াছেন। মহাশ্বেতা বলিয়া পাঠাইয়াছেন, “রাজকুমার! যাহারা আপনাকে নেত্রপথের অতিথি করে নাই তাহারাই ধন্য ও সুখে কালযাপন করিতেছে। যে গন্ধর্ব্বনগর আপনি উৎসবময় ও আনন্দময় দেখিয়া গিয়াছেন তাহা এক্ষণে আপনার বিরহে দীন বেশ ধারণ করিয়াছে! আমি সমুদায় পরিত্যাগ করিয়াছি, রাজকুমারকে বিস্মৃত হইবার চেষ্টা পাইতেছি, কিন্তু আমার মন বারণ না মানিয়া সেই মুখচন্দ্র দেখিতে সর্ব্বদা উৎসুক। কাদম্বরী দিবসবিভাবরী আপনার প্রফুল্ল মুখকমল স্মরণ করিয়া অতিশয় অসুস্থ হইয়াছেন। অতএব আর এক বার গন্ধর্ব্বনগরে পদার্পণ করিলে সকলে চরিতার্থ হই।” শেষনামক হার শয্যায় বিস্মৃত হইয়া ফেলিয়া আসিয়াছিলেন তাহাও আপনাকে দিবার নিমিত্ত এই চামরধারিণীর করে পাঠাইয়াছেন। কেয়ূরকের মুখে কাদম্বরীর ও মহাশ্বেতার সন্দেশবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজকুমার অতিশয় আনন্দিত হইলেন। স্বহস্তে হার, বিলেপন ও তাম্বূল গ্রহণ করিলেন। অনন্তর কেয়ূরকের সহিত মন্দুরায় গমন করিলেন। যাইতে যাইতে পশ্চাতে কেহ আসিতেছে কি না মুখ ফিরাইয়া বারংবার দেখিতে লাগিলেন। প্রতীহারীরা তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিয়া পরিজনদিগকে সঙ্গে যাইতে নিষেধ করিল। আপনারাও সঙ্গে না গিয়া দূরে দণ্ডায়মান রহিল। চন্দ্রাপীড় কেবল কেয়ূরকের সহিত মন্দুরায় প্রবেশিয়া ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেয়ূরক! বল, আমি তথা হইতে বহির্গত হইলে গন্ধর্ব্বরাজকুমারী কিরূপে দিবস অতিবাহিত করিলেন? মহাশ্বেতা কি বলিলেন? পরিজনেরাই বা কে কি কহিল? আমার কোন কথা হইয়াছিল কি না?

কেয়ূরক কহিল, রাজকুমার! শ্রবণ করুন, আপনি গন্ধর্ব্বনগরের বহির্গত হইলে কাদম্বরী পরিজন সমভিব্যাহারে প্রাসাদশিখরে আরোহণ করিয়া আপনার গমনপথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আপনি নেত্রপথের অগোচর হইলেও অনেকক্ষণ সেই দিকে নেত্রপাত করিয়া রহিলেন। অনন্তর তথা হইতে নামিয়া যেখানে আপনি ক্ষণকাল অবস্থান করিয়াছিলেন সেই ক্রীড়াপর্ব্বতে গমন করিলেন। তথায় যাইয়া চন্দ্রাপীড় এই শিলাতলে বসিয়াছিলেন, এই স্থানে স্নান করিয়াছিলেন, এই স্থানে ভোজন করিয়াছিলেন, এই মরকতশিলায় শয়ন করিয়াছিলেন, এই সকল দেখিতে দেখিতে দিবস অতিবাহিত হইল। দিবাবসানে মহাশ্বেতার অনেক প্রযত্নে যৎকিঞ্চিৎ আহার করিলেন। রবি অস্তগত হইলেন। ক্রমে চন্দ্রোদয় হইল। চন্দ্রোদয়ে চন্দ্রকান্তমণির ন্যায় তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। নেত্র মুকুলিত করিয়া কপোলে কর প্রদান পূর্ব্বক বিষণ্ণ বদনে কতপ্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন। ভাবিতে ভাবিতে অতিকষ্টে শয়নাগারে প্রবেশিলেন। প্রবেশমাত্রে শয়নাগার কারাগার বোধ হইল। সুশীতল কোমল শয্যাও উত্তপ্ত বালুকার ন্যায় গাত্র দাহ করিতে লাগিল। প্রভাত হইতে না হইতেই আমাকে ডাকাইয়া আপনার নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

গন্ধর্ব্বকুমারীর পূর্ব্বরাগজনিত বিষম দশার আবির্ভাব শ্রবণে আহ্লাদিত ও কাতর হইয়া রাজকুমার আর চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে পারিলেন না। বৈশম্পায়নকে স্কন্ধাবারের রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়া পত্রলেখার সহিত ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক গন্ধর্ব্বনগরে চলিলেন। কাদম্বরীর বাটীর দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া ঘোটক হইতে নামিলেন। সম্মুখাগত এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসিলেন, গন্ধর্ব্বরাজকুমারী কাদম্বরী কোথায়? সে প্রণতি পূর্ব্বক কহিল, ক্রীড়াপর্ব্বতের নিকটে দীর্ঘিকাতীরস্থিত হিমগৃহে অধিষ্ঠান করিতেছেন। কেয়ূরক পথ দেখাইয়া চলিল। রাজকুমার প্রমোদবনের মধ্য দিয়া কিঞ্চিৎ দূর যাইয়া দেখিলেন, কদলীদল ও তরুপল্লবের শোভায় দিঙ্মণ্ডল হরিদ্বর্ণ হইয়াছে। তরুগণ বিকশিত কুসুমে আলোকময় ও সমীরণ কুসুমসৌরভে সুগন্ধময়। চতুর্দ্দিকে সরোবর, অভ্যন্তরে হিমগৃহ। বোধ হয় যেন, বরুণ জলক্রীড়া করিবার নিমিত্ত ঐ গৃহ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। তথায় প্রবেশ মাত্র বোধ হয় যেন তুষারে অবগাহন করিতেছি। ঐ গৃহে সুশীতলশিলাতলবিন্যস্ত শৈবাল ও নলিনীদলের শয্যায় শয়ন করিয়াও কাদম্বরীর গাত্রদাহ নিবারণ হইতেছে না, প্রবেশিয়া দেখিলেন। কাদম্বরী রাজকুমারকে দেখিবামাত্র অতিমাত্র সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া যথোচিত সমাদর করিলেন। মেঘাগমে চাতকীর যেরূপ আহ্লাদ হয়, চন্দ্রাপীড়ের আগমনে কাদম্বরী সেইরূপ আহ্লাদিত হইলেন। সকলে আসনে উপবিষ্ট হইলে, ইনি রাজকুমারের তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী ও পরমপ্রীতিপাত্র, ইঁহার নাম পত্রলেখা, এই বলিয়া কেয়ূরক পত্রলেখার পরিচয় দিল। পত্রলেখা বিনীত ভাবে মহাশ্বেতা ও কাদম্বরীকে প্রণাম করিল। তাঁহারা যথোচিত সমাদর ও সম্ভাষণ পূর্ব্বক হস্ত ধারণ করিয়া আপন সমীপদেশে বসাইলেন এবং সখীর ন্যায় জ্ঞান করিতে লাগিলেন।

চন্দ্রাপীড় চিত্ররথতনয়ার তদানীন্তন অবস্থা দেখিয়া মনে মনে কহিলেন, আমার হৃদয় কি দুর্ব্বিদগ্ধ! মনোরথ ফলোন্মুখ হইয়াছে তথাপি বিশ্বাস করিতেছে না। ভাল, কৌশল করিয়া দেখা যাউক এই স্থির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, দেবি! তোমার এরূপ অপরূপ ব্যাধি কোথা হইতে সমুত্থিত হইল? তোমাকে আজি এরূপ দেখিতেছি কেন? মুখকমল মলিন হইয়াছে, শরীর শীর্ণ হইয়াছে, হঠাৎ দেখিলে চিনিতে পারা যায় না। যদি আমা হইতে এ রোগের প্রতিকারের কোন সম্ভাবনা থাকে, এখনই বল। আমার দেহ দান বা প্রাণ দান করিলেও যদি সুস্থ হও আমি এখনি দিতে প্রস্তুত আছি। কাদম্বরী বালা ও স্বভাবমুগ্ধা হইয়াও অনঙ্গের উপদেশপ্রভাবে রাজকুমারের বচনচাতুরীর যথার্থ ভাবার্থ বুঝিলেন। কিন্তু লজ্জাপ্রযুক্ত বাক্য দ্বারা উত্তর দিতে অসমর্থ হইয়া ঈষৎমুহাস্য করিয়া সচিত উত্তর প্রদান করিলেন। মদলেখা তাহারই ভাবার্থ ব্যক্ত করিয়া কহিল, রাজকুমার! কি বলিব আমরা এরূপ অপরূপ ব্যাধি ও অদ্ভুত সন্তাপ কখন কাহারও দেখি নাই। সন্তাপিত ব্যক্তির নলিনীকিসলয় হুতাশনের ন্যায়, জ্যোৎস্না উত্তাপের ন্যায়, সমীরণ বিষের ন্যায় বোধ হয়, ইহা আমরা কখনও শ্রবণ করি নাই। জানি না এ রোগের কি ঔষধ আছে। প্রণয়োন্মুখ যুবজনের অন্তঃকরণ কি সন্দিগ্ধ! কাদম্বরীর সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া ও মদলেখার সেইরূপ উত্তর শুনিয়াও চন্দ্রাপীড়ের চিত্ত সন্দেহদোলা হইতে নিবৃত্ত হইল না। তিনি ভাবিলেন, যদি আমার প্রতি কাদম্বরীর যথার্থ অনুরাগ থাকিত, এ সময় স্পষ্ট করিয়া ব্যক্ত করিতেন। এই স্থির করিয়া মহাশ্বেতার সহিত মধুরালাপগর্ভ নানাবিধ কথাপ্রসঙ্গে ক্ষণ কাল ক্ষেপ করিয়া পুনর্ব্বার স্কন্ধাবারে চলিয়া গেলেন। কাদম্বরীর অনুরোধে কেবল পত্রলেখা তথায় থাকিল।

২.১০ চন্দ্রাপীড় স্কন্ধাবারে প্রবেশিয়া

চন্দ্রাপীড় স্কন্ধাবারে প্রবেশিয়া উজ্জয়িনী হইতে আগত এক বার্ত্তাবহকে দেখিতে পাইলেন। প্রীতিবিস্ফারিত লোচনে পিতা, মাতা, বন্ধু, বান্ধব, প্রজা, পরিজন প্রভৃতি সকলের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসিলেন। সে প্রণতিপূর্ব্বক দুই খানি লিখন তাঁহার হস্তে প্রদান করিল। যুবরাজ পিতৃপ্রেরিত পত্রিকা অগ্রে পাঠ করিয়া তদনন্তর শুকনাসপ্রেরিত পত্রের অর্থ অবগত হইলেন। এই লিখিত ছিল “বহু দিবস হইল তোমরা বাটী হইতে গমন করিয়াছ। অনেক কাল তোমাদিগকে না দেখিয়া আমরা অতিশয় উৎকণ্ঠিতচিত্ত হইয়াছি। পত্রপাঠ মাত্র উজ্জয়িনীতে না পঁহুছিলে, আমাদিগের উদ্বেগ বৃদ্ধি হইতে থাকিবে।” বৈশম্পায়নও যে দুইখানি পত্র পাইয়াছিলেন তাহাতেও এইরূপ লিখিত ছিল। যুবরাজ পত্র পাইয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন কি করি, এক দিকে গুরুজনের আজ্ঞা, আর দিকে প্রণয়প্রবৃত্তি। গন্ধর্ব্বরাজতনয়া কথা দ্বারা অনুরাগ প্রকাশ করেন নাই বটে, কিন্তু ভাবভঙ্গির দ্বারা বিলক্ষণ লক্ষিত হইয়াছে। ফলতঃ তিনি অনুরাগিণী না হইলে আমার অন্তঃকরণ কেন তাঁহার প্রতি এত অনুরক্ত হইবে? যাহা হউক, এক্ষণে পিতার আদেশ অতিক্রম করা হইতে পারে না। এই স্থির করিয়া সমীপস্থিত বলাহকের পুত্ত্র মেঘনাদকে কহিলেন, মেঘনাদ! পত্রলেখাকে সমভিব্যাহারে করিয়া কেয়ূরক এই স্থানে আসিবে। তুমি দুই এক দিন বিলম্ব কর, পত্রলেখা আসিলে তাহাকে সঙ্গে লইয়া বাটী যাইবে এবং কেয়ূরককে কহিবে যে, আমাকে ত্বরায় বাটী যাইতে হইল; এজন্য কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না। এক্ষণে বোধ হইতেছে তাঁহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় না হওয়াই ভাল ছিল। আলাপ পরিচয় হওয়াতে কেবল পরস্পর যাতনা সহ্য করা বই আর কিছুই লাভ দেখিতে পাই না। যাহা হউক, গুরুজনের আজ্ঞার অধীন হইয়া আমার শরীর উজ্জয়িনীতে চলিল, অন্তঃকরণ যে গন্ধর্ব্বনগরে রহিল ইহা বলা বাহুল্যমাত্র। অসজ্জনের নাম উল্লেখ করিবার সময়ে আমাকেও যেন এক এক বার স্মরণ করেন। মেঘনাদকে এই কথা বলিয়া বৈশম্পায়নকে কহিলেন আমি অগ্রসর হইলাম; তুমি রীতি পূর্ব্বক স্কন্ধাবার লইয়া আইস।

রাজকুমার পার্শ্ববর্ত্তী বার্ত্তাবহকে উজ্জয়িনীর বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতে করিতে চলিলেন। কতিপয় অশ্বারোহীও সঙ্গে সঙ্গে চলিল। ক্রমে প্রকাণ্ড পাদপ ও লতামণ্ডলীসমাকীর্ণ নিবিড় অটবীমধ্যে প্রবেশিলেন। কোন স্থানে গজভঙ্গ বৃক্ষশাখা পতিত হওয়াতে পথ বক্র ও দুর্গম হইয়াছে। কোন স্থানে বৃক্ষমণ্ডলীর শাখাসকল পরস্পর সংলগ্ন ও মূলদেশ পরস্পর মিলিত হওয়াতে দুষ্প্রবেশ দুর্গ সংস্থাপিত রহিয়াছে। স্থানে স্থানে এক একটা কূপ, উহার জল বিবর্ণ ও বিস্বাদ। উহার মুখ লতাজালে এরূপ আচ্ছন্ন যে, পথিকেরা জল তুলিবার নিমিত্ত লতা দ্বারা যে রজ্জুরচনা করিয়াছিল কেবল তাহা দ্বারাই অনুমিত হয়। মধ্যে মধ্যে গিরিনদী আছে; কিন্তু জল নাই। তৃষ্ণার্ত্ত পথিকেরা উহার শুষ্ক প্রদেশ খনন করাতে ছোট ছোট কূপ নির্ম্মিত হইয়াছে। এই ভয়ঙ্কর কান্তার অতিক্রম করিতে দিবাবসান হইল। দূর হইতে দেখিলেন সম্মুখে এক রক্তবর্ণ পতাকা সন্ধ্যাসমীরণে উড্ডীন হইতেছে।
রাজকুমার সেইদিক্ লক্ষ্য করিয়া কিঞ্চিৎ দূর গমন করিলেন। দেখিলেন চতুর্দ্দিকে খর্জ্জূরবৃক্ষের বনমধ্যে এক মন্দিরে ভগবতী চণ্ডিকার প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত আছে। রক্তচন্দনলিপ্ত রক্তোৎপল ও বিল্বদল সম্মুখে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। দ্রাবিড়দেশীয় এক ধার্ম্মিক তথায় উপবেশন করিয়া কখন বা যক্ষকন্যার মনে অনুরাগসঞ্চারের নিমিত্ত রুদ্রাক্ষমালা জপ, কখন বা দুর্গার স্তুতিপাঠ করিতেছেন। তিনি জরাজীর্ণ, কালগ্রাসে পতিত হইবার অধিক বিলম্ব নাই, তথাপি ভগবতী পার্ব্বতীর নিকট কখন বা দক্ষিণাপথের অধিরাজ্য কখন বা ভূমণ্ডলের আধিপত্য কামনা করিতেছেন। কখন বা প্রেয়সীবশীকরণতন্ত্রমন্ত্র শিখিতেছেন ও তীর্থদর্শনসমাগতা বৃদ্ধা পরিব্রাজিকাদিগের অঙ্গে বশীকরণচূর্ণ নিক্ষেপ করিতেছেন। কখন বা হস্ত বাজাইয়া মস্তক সঞ্চালন পূর্ব্বক মশকের ন্যায় গুন গুন শব্দে গান করিতেছেন। জগদীশ্বরের কি আশ্চর্য্য কৌশল! তিনি যেরূপ এক স্থানে সমুদায় সৌন্দর্য্যের সমাবেশ করিতে পারেন, সেইরূপ তাঁহার কৌশলের সমুদায় বৈরূপ্যও এক স্থানে সন্নিবিষ্ট হইয়া থাকে। দ্রাবিড়দেশীয় ধার্ম্মিকই তাহার প্রমাণস্বরূপ। তিনি কাণা, খঞ্জ, বধির ও রাত্র্যন্ধ; এরূপ লম্বোদর যে রাক্ষসের ন্যায় রাশি রাশি ভোজন করিয়াও উদর পূর্ণ হয় না। শুষ্কলতারচিত পুষ্পকরণ্ডক ও আঙ্কুশিক লইয়া বনে বনে ভ্রমণ ও বৃক্ষে বৃক্ষে আরোহণ করাতে বানরগণ কুপিত হইয়া তাঁহার নাসা কর্ণ ছিন্ন করিয়াছে এবং ভল্লূকের তীক্ষ্ণ নখে গাত্র ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে। রাজকুমারের লোকজন তথায় উপস্থিত হইবামাত্র তিনি তাহাদের সহিত কলহ আরম্ভ করিলেন।

চন্দ্রাপীড় মন্দিরের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গম হইতে অবতীর্ণ হইলেন। ভক্তিভাবে দেবীকে প্রদক্ষিণ করিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। কাদম্বরীর বিরহে তাঁহার অন্তঃকরণ অতিশয় উৎকণ্ঠিত ছিল, দ্রাবিড়দেশীয় ধার্ম্মিকের আমোদজনক ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। তিনি স্বয়ং তাঁহার জন্মভূমি, জাতি, বিদ্যা, পুত্ত্র, বিভব, বিষয় ও প্রব্রজ্যার কারণ সমুদায় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। ধার্ম্মিক আপনার শৌর্য্য, বীর্য্য, ঐশ্বর্য্য, রূপ, গুণ, বুদ্ধিমত্তার এ রূপে পরিচয় দিলেন যে তাহা শুনিয়া কেহ হাস্য নিবারণ করিয়া রাখিতে পারে না। অনন্তর রবি অস্তগত হইলে অগ্নি জ্বালিয়া ও ঘোটকের পর্য্যাণ বৃক্ষশাখায় রাখিয়া সকলে নিদ্রা গেলে রাজকুমার শয়ন করিয়া কেবল গন্ধর্ব্বনগর চিন্তা করিতে লাগিলেন। প্রভাতে চণ্ডিকার উপাসককে যথেষ্ট ধন দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। কতিপয় দিনে উজ্জয়িনীনগরে পঁহুছিলেন। রাজকুমারের আগমনে নগর আনন্দময় হইল। তারাপীড় চন্দ্রাপীড়ের আগমনবার্ত্তা শ্রবণে সাতিশয় আনন্দিত হইয়া সভাস্থ রাজমণ্ডলী সমভিব্যাহারে স্বয়ং প্রত্যুদ্গমন করিলেন। প্রণত পুত্ত্রকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া তাঁহার শরীর শীতল হইল। যুবরাজ তথা হইতে অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া প্রথমতঃ জননীকে, অনন্তর অবরোধকামিনীদিগকে, একে একে প্রণাম করিলেন। পরে অমাত্যের ভবনে গমন করিয়া শুকনাস ও মনোরমার চরণ বন্দনা পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন পশ্চাৎ আসিতেছেন সংবাদ দিয়া তাঁহাদিগকে আহ্লাদিত করিলেন। বাটী আসিয়া জননীর নিকট আহারাদি সমাপন করিয়া, অপরাহ্ণে শ্রীমণ্ডপে আসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। তথায় জীবিতেশ্বরী গন্ধর্ব্বরাজকুমারীর মোহিনী মূর্ত্তি স্মৃতিপথারূঢ় হইল। পত্রলেখা আসিলে প্রিয়তমার সংবাদ পাইব এইমাত্র আশা অবলম্বন করিয়া কথঞ্চিৎ কাল যাপন করিতে লাগিলেন।

কিছু দিন পরে মেঘনাদ ও পত্রলেখা আসিয়া উপস্থিত হইল। যুবরাজ সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া পত্রলেখাকে মহাশ্বেতা ও কাদম্বরীর কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিলেন। পত্রলেখা কহিলেন, সকলেই কুশলে আছেন। প্রিয়তমার সংক্ষেপ সংবাদ শ্রবণে যুবরাজের মন পরিতৃপ্ত হইল না। তিনি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, পত্রলেখে! আমি তথা হইতে আগমন করিলে তুমি তথায় কত দিন ছিলে? গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রী কিরূপ তোমার আদর করিয়াছিলেন? কি কি কথা হইয়াছিল? সমুদায় বিশেষ রূপে বর্ণন কর। পত্রলেখা কহিল, শ্রবণ করুন। আপনি আগমন করিলে আমি তথায় যে কয়েক দিন ছিলাম, গন্ধর্ব্বকুমারীর নব নব প্রসাদ অনুভব করিতাম। আমোদ আহ্লাদে পরম সুখে দিবস অতিবাহিত করিয়াছি। তিনি আমা ব্যতিরেকে এক দণ্ডও থাকিতেন না। যেখানে যাইতেন, আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেন। সর্ব্বদা আমার চক্ষুর উপর তাঁহার নয়নোৎপল ও আমার করে তাঁহার পাণিপল্লব থাকিত। একদা প্রমোদবনবেদিকায় আরোহণ পূর্ব্বক কিছু বলিতে অভিলাষ করিয়া বিষণ্ণ বদনে আমার মুখপানে অনেক ক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। তৎকালে তাঁহার মনে কোন অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হওয়াতে তাঁহার কম্পিত ও রোমাঞ্চিত কলেবর হইতে বিন্দু বিন্দু স্বেদজল নিঃসৃত হইতে লাগিল। কিন্তু কিছুই বলিতে পারিলেন না। আমি তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, দেবি! কি বলিতেছেন বলুন। কিন্তু তাঁহার কথা স্ফূর্ত্তি হইল না; কেবল নয়নযুগল হইতে জলধারা পড়িতে লাগিল। এ কি! অকস্মাৎ এরূপ দুঃখের কারণ কি? এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে বসনাঞ্চলে নেত্রজল মোচন করিয়া বলিলেন, পত্রলেখে! দর্শন অবধি তুমি আমার প্রিয়পাত্র হইয়াছ। আমার হৃদয় কাহাকেও বিশ্বাস করিতে সম্মত নহে; কিন্তু তোমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করিয়াছে। তোমাকে মনের কথা না বলিয়া আর কাহাকে বলিব। প্রিয়সখীকে আত্মদুঃখে দুঃখিত না করিয়া আর কাহাকে আত্মদুঃখে দুঃখিত করিব? কুমার চন্দ্রাপীড় লোকের নিকটে আমাকে নিন্দনীয় করিলেন ও যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিলেন। কুমারীজনের কুসুমসুকুমার অন্তঃকরণ যুবজনেরা বলপূর্ব্বক আক্রমণ করে, কিছুমাত্র দয়া করে না। এক্ষণে গুরুজনের অননুমোদিত পথে পদার্পণ করিয়া কিরূপে নিষ্কলঙ্ক কুলে জলাঞ্জলি প্রদান করি। কুলক্রমাগত লজ্জা ও বিনয়ই বা কিরূপে পরিত্যাগ করি। যাহা হউক, জগদীশ্বরের নিকটে এই প্রার্থনা, জন্মান্তরে যেন তোমাকে প্রিয়সখীরূপে প্রাপ্ত হই। আমি প্রাণত্যাগ দ্বারা কুলের কলঙ্ক নিবারণ করিব, অভিলাষ করিয়াছি।

আমি তাঁহার দুরবগাহ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিতে না পারিয়া বিষণ্ণ বদনে বিজ্ঞাপন করিলাম, দেবি! যুবরাজ কি অপরাধ করিয়াছেন, আপনি তাঁহাকে এত তিরস্কার করিতেছেন কেন? এই কথা শুনিয়া রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, ধূর্ত্ত প্রতিদিন স্বপ্নাবস্থায় আমার নিকট উপস্থিত হইয়া আমাকে কত কুপ্রবৃত্তি দেয়, তাহা ব্যক্ত করা যায় না। কখন সঙ্কেতস্থান নির্দ্দেশ পূর্ব্বক মদনলেখন প্রেরণ করে; কখন বা দূতীমুখে নানা অসৎপ্রবৃত্তি দেয়। আমি ক্রোধান্ধ হইয়া অমনি জাগরিত হই ও চক্ষু উন্মীলন করি, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাই না। কাহাকে তিরস্কার করি, কাহাকেই বা নিষেধ করি কিছুই বুঝিতে পারি না। এই কথা দ্বারা অনায়াসে কাদম্বরীর সংকল্প ব্যক্ত হইল। তখন আমি হাসিতে হাসিতে কহিলাম, দেবি! একজনের অপরাধে অন্যের প্রতি দোষারোপ করা উচিত নয়। আপনি দুরাত্মা কুসুমচাপের চাপল্যে প্রতারিত হইয়াছেন, চন্দ্রাপীড়ের কিছুমাত্র অপরাধ নাই।

কুসুমচাপই হউক, আর যে হউক, তাহার রূপ, গুণ, স্বভাব কি প্রকার বর্ণনা কর তাহা হইলে বুঝিতে পারি কে আমাকে এত যাতনা দিতেছে। তিনি এই কথা কহিলে বলিলাম, সে দুরাত্মা অনঙ্গ, তাহার রূপ কোথায়? সে জ্বালাবতী ও ধূমপটল বিস্তার না করিয়াও সন্তাপপ্রদান ও অশ্রুপাতন করে। ত্রিভুবনে প্রায় এরূপ লোক নাই, যাহাকে তাহার শরের শরব্য হইতে না হয়। কুসুমচাপের যেরূপ স্বরূপ বর্ণনা করিলে, বোধ হয়, আমি তাহার বাণপাতের পথবর্ত্তী হইয়া থাকিব। এক্ষণে কি কর্ত্তব্য উপদেশ দাও। এই কথা শুনিয়া আমি প্রবোধবাক্যে বলিলাম, দেবি! কত শত বিখ্যাত অবলাগণ ইচ্ছা পূর্ব্বক স্বয়ংবরবিধানে প্রবৃত্ত হইয়া আপন অভিলাষ সম্পাদন করিয়া থাকেন, অথচ লোকসমাজে নিন্দনীয় হয়েন না। আপনিও স্বয়ংবরবিধানের আয়োজন করুন ও এক খানি পত্রিকা লিখিয়া দেন। সেই পত্রিকা দেখাইয়া আমি রাজকুমারকে আনিয়া আপনার মনোরথ পূর্ণ করিতেছি। এই কথায় অতিশয় হৃষ্ট হইয়া প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে ক্ষণকাল অনুধ্যান করিয়া কহিলেন, তাহারা অতিশয় সাহসকারিণী, যাহারা স্বয়ংবরে প্রবৃত্ত হয় ও মনোগত কথা প্রিয়তমের নিকট বলিয়া পাঠায়। কুমারীজনের এতাদৃশ প্রাগল্‌ভ্য ও সাহস কোথা হইতে হইবে? কি কথাই বা বলিয়া পাঠাইব? তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় এ কথা বলা পৌনরুক্ত। আমি তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত, বেশবনিতারাই ইহা কথা দ্বারা ব্যক্ত করিয়া থাকে। তোমা ব্যতিরেকে জীবিত থাকিতে পারি না এ কথা অনুভববিরুদ্ধ ও অবিশ্বাস্য। যদি তুমি না আইস, আমি স্বয়ং তোমার নিকট যাইব, এ কথায় চাপল্য প্রকাশ হয়। প্রাণপরিত্যাগ দ্বারা প্রণয়প্রকাশ করিতেছি, এ কথা আপাততঃ অসম্ভব বোধ হয়। অবশ্য একবার আসিবে, এ কথা বলিলে গর্ব্ব প্রকাশ হয়। তিনি এখানে আসিলেই বা কি হইবে, যখন হিমগৃহে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তিনি কত কথা কহিলেন; আমি তাঁহার সমক্ষে একটি মনের কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। আমার সেই মুখ, সেই অন্তঃকরণ, কিছুই পরিবর্ত্ত হয় নাই। পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ হইলেই যে মনোগত অনুরাগ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে প্রণয়পাশে বদ্ধ করিতে পারিব, তাহারই বা প্রমাণ কি? যাহা হউক, এক্ষণে সখীজনের যাহা কর্ত্তব্য, কর। এই বলিয়া আমাকে পাঠাইয়া দিলেন। ফলতঃ গন্ধর্ব্বরাজকুমারীর সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া তৎকালে তথা হইতে আপনার প্রত্যাগমন করায় নিতান্ত নিঃস্নেহতা প্রকাশ হইয়াছে; এটি যুবরাজের উপযুক্ত কর্ম্ম হয় নাই। এই কথা বলিয়া পত্রলেখা ক্ষান্ত হইল।

২.১১ চন্দ্রাপীড় স্বভাবতঃ ধীরপ্রকৃতি

চন্দ্রাপীড় স্বভাবতঃ ধীরপ্রকৃতি হইয়াও কাদম্বরীর আদ্যোপান্ত বিরহবৃত্তান্ত শ্রবণে সাতিশয় অধীর হইলেন; এমন সময়ে প্রতীহারী আসিয়া কহিল, যুবরাজ! পত্রলেখা আসিয়াছে, এই সংবাদ শুনিয়া মহিষী পত্রলেখার সহিত আপনাকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে আদেশ করিলেন। অনেক ক্ষণ আপনাকে না দেখিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছেন। চন্দ্রাপীড় মনে মনে কহিলেন, কি বিষম সঙ্কট উপস্থিত। এক দিকে গুরু জনের স্নেহ, আর দিকে প্রিয়তমের অনুরাগ। মাতা না দেখিয়া এক দণ্ড থাকিতে পারেন না, কিন্তু পত্রলেখার মুখে প্রাণেশ্বরীর যে সংবাদ শুনিলাম, ইহাতে আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। কি করি, কাহার অনুরোধ রাখি। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে অন্তঃপুরে প্রবেশিলেন। গন্ধর্ব্বনগরে কিরূপে যাইবেন দিন যামিনী এই ভাবনায় অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন। কতিপয় বাসর অতীত হইলে একদা বিনোদের নিমিত্ত শিপ্রানদীর তীরে ভ্রমণ করিতেছেন এমন সময়ে দেখিলেন, অতি দূরে কতকগুলি অশ্বারোহী আসিতেছে। তাহারা নিকটবর্ত্তী হইলে দেখিলেন অগ্রে কেয়ূরক, পশ্চাতে কতিপয় গন্ধর্ব্বদারক। রাজকুমার কেয়ূরককে অবলোকন করিয়া পরম পুলকিত হইলেন এবং প্রসারিত ভুজযুগল দ্বারা আলিঙ্গন করিয়া সাদর সম্ভাষণে কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসিলেন। অনন্তর তথা হইতে বাটী আসিয়া নির্জ্জনে গন্ধর্ব্বকুমারীর সন্দেশবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করাতে কহিল, আমাকে তিনি কিছুই বলিয়া দেন নাই। আমি মেঘনাদের নিকট পত্রলেখাকে রাখিয়া ফিরিয়া গেলাম এবং রাজকুমার উজ্জয়িনী গমন করিয়াছেন এই সংবাদ দিলাম। মহাশ্বেতা শুনিয়া ঊর্দ্ধে দৃষ্টিপাত ও দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক কেবল এইমাত্র কহিলেন, হাঁ উপযুক্ত কর্ম্ম হইয়াছে। এবং তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান করিয়া আপন আশ্রমে চলিয়া গেলেন। কাদম্বরী শুনিবামাত্র নিমীলিতনেত্র ও সংজ্ঞাশূন্য হইলেন। অনেক ক্ষণের পর নয়ন উন্মীলন করিয়া মদলেখাকে কহিলেন, মদলেখে! চন্দ্রাপীড় যে কর্ম্ম করিয়াছেন আর কেহ কি এরূপ করিতে পারে! এইমাত্র বলিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। তদবধি কাহারও সহিত কোন কথা কহেন নাই। পর দিন প্রভাত কালে আমি তথায় গিয়া দেখিলাম, কাদম্বরী সংজ্ঞাশূন্য, কেহ কোন কথা কহিলে উত্তর দিতেছেন না। কেবল নয়নযুগল হইতে অনবরত অশ্রুধারা পতিত হইতেছে। আমি তাঁহার সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া অতিশয় চিন্তিত হইলাম এবং তাঁহাকে না বলিয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।

গন্ধর্ব্বকুমারীর বিরহবৃত্তান্ত শুনিতেছেন এমন সময়ে মূর্চ্ছা রাজকুমারের চেতন হরণ করিল। সকলে সসম্ভ্রমে তালবৃন্ত ব্যজন ও শীতল চন্দনজল সেচন করাতে অনেক ক্ষণের পর চেতন হইলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক কহিলেন, কাদম্বরীর মন আমার প্রতি এরূপ অনুরক্ত তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতে পারি নাই। এক্ষণে কি করি, কি উপায়ে প্রিয়তমার প্রাণ রক্ষা হয়! বুঝি, দুরাত্মা বিধি বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটাইয়া আমাকে মহাপাপে লিপ্ত ও কলঙ্কিত করিবার মানস করিয়াছে। এ সকল দৈববিড়ম্বনা সন্দেহ নাই। নতুবা নিরর্থক কিন্নরমিথুনের অনুসরণে কেন প্রবৃত্তি হইবে? অচ্ছোদসরোবরেই বা কেন যাইব? মহাশ্বেতার সঙ্গেই বা কেন সাক্ষাৎ হইবে? গন্ধর্ব্বনগরেই বা কি জন্য গমন করিব? আমার প্রতি কাদম্বরীর অনুরাগসঞ্চারই বা কেন হইবে? এ সকল বিধাতার চাতুরী সন্দেহ নাই। নতুবা, অসম্ভাবিত ও স্বপ্নকল্পিত ব্যাপার সকল কি রূপে সংঘটিত হইল? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে দিবাবসান হইল। নিশি উপস্থিত হইলে জিজ্ঞাসিলেন, কেয়ূরক! তোমার কি বোধ হয় আমাদিগের গমন পর্য্যন্ত কাদম্বরী জীবিত থাকিবেন? তাঁহার সেই পরম সুন্দর মুখচন্দ্র আর কি দেখিতে পাইব? কেয়ূরক কহিল, রাজকুমার! এই সংসারে আশাই জীবনের মূল। আশা আশ্বাস প্রদান না করিলে কেহ জীবিত থাকিতে পারে না। লোকেরা আশালতা অবলম্বন করিয়া দুঃখসাগরে নিতান্ত নিমগ্ন হয় না। আপনি নিতান্ত কাতর হইবেন না, ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক গমনের উপায় দেখুন। আপনি তথায় যাইবেন এই আশা অবলম্বন করিয়া গন্ধর্ব্বকুমারী কালক্ষেপ করিতেছেন, সন্দেহ নাই। অনন্তর রাজকুমার কেয়ূরককে বিশ্রাম করিতে আদেশ দিয়া কিরূপে গন্ধর্ব্বপুরে যাইবেন তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। ভাবিলেন যদি পিতা মাতাকে না বলিয়া তাঁহাদিগের অজ্ঞাতসারে গমন করি, তাহা হইলে কোথায় সুখ কোথায় বা শ্রেয়ঃ? পিতা যে রাজ্য-ভার দিয়াছেন সে কেবল দুঃখভার, প্রতিদিন পর্য্যবেক্ষণ না করিলে বিষমসঙ্কটের হেতুভূত হয়। সুতরাং তাঁহাকে না বলিয়া কি রূপে যাওয়া যাইতে পারে? বলিয়া যাওয়া উচিত; কিন্তু কি বলিব? গন্ধর্ব্বরাজকুমারী আমাকে দেখিয়া প্রণয়পাশে বদ্ধ হইয়াছেন, আমি সেই প্রাণেশ্বরী ব্যতিরেকে প্রাণ ধারণ করিতে পারি না, কেয়ূরক আমাকে লইতে আসিয়াছে, আমি চলিলাম, নিতান্ত নির্লজ্জ ও অসারের ন্যায় এ কথাই বা কি রূপে বলিব? বহুকালের পর বাটী আসিয়াছি; কি ব্যপদেশেই বা আবার শীঘ্র বিদেশে যাইব? পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি এরূপ একটী লোক নাই। প্রিয়সখা বৈশম্পায়নও নিকটে নাই। এরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে রাত্রি প্রভাত হইল।

প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক বহির্গত হইয়া শুনিলেন, স্কন্ধাবার দশপুরী পর্য্যন্ত আসিয়াছে। শত শত সাম্রাজ্যলাভেও যেরূপ সন্তোষ না হয়, এই সংবাদ শুনিয়া তাদৃশ আহ্লাদ জন্মিল। হর্ষোৎফুল্ল নয়নে কেয়ূরককে কহিলেন, কেয়ূরক! আমার পরম মিত্র বৈশম্পায়ন আসিতেছেন, আর চিন্তা নাই। কেয়ূরক সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া কহিল, রাজকুমার! মেঘোদয়ে যেরূপ বৃষ্টির অনুমান হয়, পূর্ব্বদিকে আলোক দেখিলে যেরূপ রবির উদয় জানা যায়, মলয়ানিল বহিলে যেরূপ বসন্ত কালের সমাগম বোধ হয়, কাশকুসুম বিকসিত হইলে যেরূপ শরদারম্ভ সূচিত হয়, সেইরূপ এই শুভ ঘটনা অচিরাৎ আপনার গন্ধর্ব্বনগরে গমনের সূচনা করিতেছে। গন্ধর্ব্বরাজকুমারী কাদম্বরীর সহিতও আপনার সমাগম সম্পন্ন হইবেক, সন্দেহ করিবেন না। কেহ কখন কি চন্দ্রমাকে জ্যোৎস্নারহিত হইতে দেখিয়াছে? লতাশূন্য উদ্যান কি কখন কাহারও দৃষ্টিপথে পতিত হইয়াছে? কিন্তু বৈশম্পায়ন আসিতে ও তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া আপনার গন্ধর্ব্বনগরে যাত্রা করিতে বিলম্ব হইবে বোধ হয়। কাদম্বরীর যেরূপ শরীরের অবস্থা তাহা রাজকুমারকে পূর্ব্বেই নিবেদন করিয়াছি, অতএব আমি অগ্রসর হইয়া আপনার আগমনবার্ত্তা দ্বারা তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিতে অভিলাষ করি।

কেয়ূরকের ন্যায়ানুগত মধুর বাক্য শুনিয়া চন্দ্রাপীড় পরম পরিতুষ্ট হইলেন। কহিলেন, কেয়ূরক! ভাল যুক্তিযুক্ত কথা বলিয়াছ। এতাদৃশী দেশকালজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তা কাহারও দেখিতে পাওয়া যায় না। তুমি শীঘ্র গমন কর এবং আমাদিগের কুশল সংবাদ ও আগমনবার্ত্তা দ্বারা প্রিয়তমার প্রাণ রক্ষা কর। প্রত্যয়ের নিমিত্ত পত্রলেখাকেও তোমার সহিত পাঠাইয়া দিতেছি। পরে মেঘনাদকে ডাকাইয়া কহিলেন, মেঘনাদ! পূর্ব্বে তোমাকে যে স্থানে রাখিয়া আসিয়াছিলাম, পত্রলেখা ও কেয়ূরককে সমভিব্যাহারে লইয়া পুনর্ব্বার তথায় যাও। শুনিলাম বৈশম্পায়ন আসিতেছেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমিও তথায় যাইতেছি! মেঘনাদ যে আজ্ঞা বলিয়া গমনের উদ্যোগ করিতে গেল। রাজকুমার কেয়ূরককে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া বহুমূল্যের কর্ণাভরণ পারিতোষিক দিলেন। বাষ্পাকুল লোচনে কহিলেন, কেয়ূরক! তুমি প্রিয়তমার কোন সন্দেশবাক্য আনিতে পার নাই, সুতরাং প্রতিসন্দেশ তোমাকে কি বলিয়া দিব। পত্রলেখা যাইতেছে ইহার মুখে প্রিয়তমার যাহা শুনিতে ইচ্ছা হয় শুনিবেন। পত্রলেখাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, পত্রলেখে! তুমি সাবধানে যাইবে। গন্ধর্ব্বনগরে পঁহুছিয়া আমার নাম করিয়া কাদম্বরীকে কহিবে যে, আমি বাটী আসিবার কালে তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারি নাই তজ্জন্য অত্যন্ত অপরাধী আছি। তোমরা আমার সহিত যেরূপ সরল ব্যবহার করিয়াছিলে আমার তদনুরূপ কর্ম্ম করা হয় নাই। এক্ষণে স্বীয় ঔদার্য্যগুণে ক্ষমা করিলে অনুগৃহীত হইব।

পত্রলেখা, মেঘনাদ ও কেয়ূরক বিদায় হইলে রাজকুমার বৈশম্পায়নের সহিত সাক্ষাৎ করিতে অতিশয় উৎসুক হইলেন। তাঁহার আগমন পর্য্যন্ত প্রতীক্ষা করিতে পারিলেন না। আপনিই স্কন্ধাবারে যাইবেন স্থির করিয়া মহারাজের আদেশ লইতে গেলেন। রাজা প্রণত পুত্ত্রকে সস্নেহে আলিঙ্গন করিয়া গাত্রে হস্তস্পর্শ পূর্ব্বক শুকনাসকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, অমাত্য! চন্দ্রাপীড়ের শ্মশ্রুরাজি উদ্ভিন্ন হইয়াছে। এক্ষণে পুত্ত্রবধূ-মুখাবলোকন দ্বারা আত্মাকে পরিতৃপ্ত করিতে বাঞ্ছা হয়। মহিষীর সহিত পরামর্শ করিয়া সম্ভ্রান্তকুলজাত উপযুক্ত কন্যা অন্বেষণ কর। মন্ত্রী কহিলেন, মহারাজ! উত্তম কল্প বটে! রাজকুমার সমুদায় বিদ্যা শিখিয়াছেন, উত্তম রূপে রাজ্য শাসন ও প্রজা পালন করিতেছেন। এক্ষণে নববধূর পাণিগ্রহণ করেন ইহা সকলের বাঞ্ছা। চন্দ্রাপীড় মনে মনে কহিলেন, কি সৌভাগ্য! গন্ধর্ব্বকুমারীর সহিত সমাগমের উপায়চিন্তাসমকালেই পিতার বিবাহ দিবার অভিলাষ হইয়াছে। এই সময় বৈশম্পায়ন আসিলে প্রিয়তমার প্রাপ্তিবিষয়ে আর কোন বাধা থাকে না। অনন্তর স্কন্ধাবারের প্রত্যুদ্গমনের নিমিত্ত পিতার আদেশ প্রার্থনা করিলেন। রাজাও সম্মত হইলেন। বৈশম্পায়নকে দেখিবার নিমিত্ত এরূপ উৎসুক হইয়াছিলেন যে, সে রাত্রি নিদ্রা হইল না। নিশীথ সময়েই প্রস্থানসূচক শঙ্খধ্বনি করিতে আদেশ দিলেন। শঙ্খধ্বনি হইবামাত্র সকলে সুসজ্জ হইয়া রাজপথে বহির্গত হইল। পৃথিবী জ্যোৎস্নাময়, চতুর্দ্দিক্ আলোকময়। সে সময় পথ চলার কোন ক্লেশ হয় না। চন্দ্রাপীড় দ্রুত বেগে অগ্রে অগ্রে চলিলেন। রাত্রি প্রভাত না হইতেই অনেক দূর চলিয়া গেলেন। স্কন্ধাবার যে স্থানে সন্নিবেশিত ছিল, প্রভাতে ঐ স্থান দেখিতে পাইলেন। গাঢ় অন্ধকারে আলোক দেখিলে যেরূপ আহ্লাদ জন্মে, দূর হইতে স্কন্ধাবার নেত্রগোচর করিয়া রাজকুমার সেইরূপ আনন্দিত হইলেন। মনে মনে কল্পনা করিলেন, অতর্কিত রূপে সহসা উপস্থিত হইয়া বন্ধুর মনে বিস্ময় জন্মাইয়া দিব।

ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইয়া স্কন্ধাবারে প্রবেশিলেন। দেখিলেন কতকগুলি স্ত্রীলোক এক স্থানে বসিয়া কথা বার্ত্তা কহিতেছে। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৈশম্পায়ন কোথায়? তাহারা রাজকুমারকে চিনিত না; সুতরাং সমাদর বা সম্ভ্রম প্রদর্শন না করিয়াই উত্তর করিল কি জিজ্ঞাসা করিতেছ, বৈশম্পায়ন এখানে কোথায়? আঃ কি প্রলাপ করিতেছিস্ রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক এই কথা বলিয়া রাজকুমার তাহাদিগের যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। কিন্তু তাঁহার অন্তঃকরণ নিতান্ত ব্যাকুল ও চঞ্চল হইয়া উঠিল। অনন্তর কতিপয় প্রধান সৈনিক পুরুষ নিকটে আসিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিল। চন্দ্রাপীড় জিজ্ঞাসা করিলেন, বৈশম্পায়ন কোথায়? তাহারা বিনয়বচনে কহিল, যুবরাজ! এই তরুতলে শীতল ছায়ায় উপবেশন করুন, আমরা সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি। তাহাদিগের কথায় আরও উৎকণ্ঠিত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, আমি স্কন্ধাবার হইতে বাটী গমন করিলে কি কোন সংগ্রাম উপস্থিত হইয়াছিল? কি কোন অসাধ্য ব্যাধি বন্ধুকে কবলিত করিয়াছে? কি অত্যহিত ঘটিয়াছে? শীঘ্র বল। তাহারা সসম্ভ্রমে কর্ণে করক্ষেপ করিয়া কহিল না, না, অত্যহিত বা অমঙ্গলের আশঙ্কা করিবেন না। রাজকুমার প্রথমে ভাবিয়াছিলেন বন্ধু জীবদ্দশায় নাই; এক্ষণে সে ভাবনা দূর হইল ও শোকাশ্রু আনন্দাশ্রু রূপে পরিগণিত হইল। তখন গদ্গদ বচনে কহিলেন, তবে বৈশম্পায়ন কোথায় আছেন, কি নিমিত্ত আসিলেন না? তাহারা কহিল, রাজকুমার! শ্রবণ করুন।

২.১২ আপনি বৈশম্পায়নকে স্কন্ধাবার লইয়া

আপনি বৈশম্পায়নকে স্কন্ধাবার লইয়া আসিবার ভার দিয়া প্রস্থান করিলে তিনি কহিলেন, পুরাণে শুনিয়াছি অচ্ছোদসরোবর অতি পবিত্র তীর্থ। অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়াও লোকে তীর্থ দর্শন করিতে যায়। আমরা সেই তীর্থের নিকটে আসিয়াছি, অতএব একবার না দেখিয়া এখান হইতে যাওয়া উচিত নয়। অচ্ছোদসরোবরে স্নান করিয়া এবং তত্তীরস্থিত ভগবান্ শশাঙ্কশেখরকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া যাত্রা করা যাইবে। এই বলিয়া সেই সরোবর দেখিতে গেলেন। তথায় বিকসিতকুসুম, নির্ম্মল জল, রমণীয় তীরভূমি, শ্রেণীবদ্ধ তরু, কুসুমিত লতাকুঞ্জ দেখিয়া বোধ হইল যেন, বসন্ত সপরিবারে ও সবান্ধবে তথায় বাস করিতেছেন। ফলতঃ তাদৃশ রমণীয় প্রদেশ ভূমণ্ডলে অতি বিরল। বৈশম্পায়ন তথায় ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক এক মনোহর লতামণ্ডপ দেখিলেন। ঐ লতামণ্ডপের অভ্যন্তরে এক শিলা পতিত ছিল। পরমপ্রীতিপাত্র মিত্রকে বহু কালের পর দেখিলে অন্তঃকরণে যেরূপ ভাবোদয় হয়, লতামণ্ডপ দেখিয়া বৈশম্পায়নের মনে সেইরূপ অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হইল। তিনি নিমেষশূন্য নয়নে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। ক্রমে নিতান্ত উন্মনা হইতে লাগিলেন। পরিশেষে ভূতলে উপবিষ্ট হইয়া বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক নানাপ্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন বিস্মৃত বস্তুর স্মরণ করিতেছেন। তাঁহাকে সেইরূপ উন্মনা দেখিয়া আমরা মনে করিলাম, বুঝি রমণীয় লতামণ্ডপ ও মনোহর সরোবর ইঁহার চিত্তকে বিকৃত করিয়া থাকিবেক। যৌবনকাল কি বিষম কাল! এই কালে উত্তীর্ণ হইলে আর লজ্জা, ধৈর্য্য, কিছুই থাকে না। যাহা হউক, অধিক ক্ষণ এখানে আর থাকা হইবে না। শাস্ত্রকারেরা কহেন, বিকারের সামগ্রী শীঘ্র পরিহার করাই বিধেয়। এই স্থির করিয়া কহিলাম, মহাশয়! সরোবর দর্শন হইল এক্ষণে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অবগাহন করুন। বেলা অধিক হইয়াছে। স্কন্ধাবার সুসজ্জ হইয়া আপনার প্রতীক্ষা করিতেছে। আর বিলম্ব করিবেন না।

তিনি আমাদিগের কথায় কিছুই প্রত্যুত্তর দিলেন না, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় অনিমিষ নয়নে সেই লতামণ্ডপ দেখিতে লাগিলেন। পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করাতে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, আমি এখান হইতে যাইব না। তোমরা স্কন্ধাবার লইয়া চলিয়া যাও। তাঁহার এই কথার ভাবার্থ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নানা অনুনয় করিলাম ও কহিলাম, দেব চন্দ্রাপীড় আপনাকে স্কন্ধাবার লইয়া যাইবার ভার দিয়া বাটী গমন করিয়াছেন; অতএব আপনার এখানে বিলম্ব করা অবিধেয়। আপনি বৈরাগ্যের কথা কহিতেছেন কেন? এই জনশূন্য অরণ্যে আপনাকে একাকী পরিত্যাগ করিয়া গেলে যুবরাজ আমাদিগকে কি বলিবেন? আজি আপনার এরূপ চিত্তবিভ্রম দেখিতেছি কেন? যদি আমাদিগের কোন অপরাধ হইয়া থাকে, ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। এক্ষণে স্নান করুন। তিনি কহিলেন, তোমরা কি নিমিত্ত আমাকে এত প্রবোধ দিতেছ। আমি চন্দ্রাপীড়কে না দেখিয়া এক দণ্ড থাকিতে পারি না, ইহা অপেক্ষা আর আমার শীঘ্র গমনের কারণ কি আছে? কিন্তু এই স্থানে আসিয়া ও এই লতামণ্ডপ দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইয়াছে ও ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া আসিতেছে যাইবার আর সামর্থ্য নাই। যদি তোমরা বলপূর্ব্বক লইয়া যাও, বোধ হয় এখান হইতে না যাইতে যাইতেই আমার প্রাণ দেহ হইতে বহির্গত হইবেক। আমাকে লইয়া যাইবার আর আগ্রহ করিও না। তোমরা স্কন্ধাবার সমভিব্যাহারে বাটী গমন কর ও চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া সুখী হও। আমার আর সে মুখারবিন্দ দেখিবার সম্ভাবনা নাই। এরূপ কি পুণ্যকর্ম্ম করিয়াছি যে, চিরকাল সুখে কাল ক্ষেপ করিব!

অকস্মাৎ আপনার এ আবার কি ব্যামোহ উপস্থিত হইল? এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে কহিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি ইহার কারণ কিছু জানি না। তোমাদিগের সঙ্গেই এই প্রদেশে আসিয়াছি। তোমাদিগের সমক্ষেই এই লতামণ্ডপ দর্শন করিতেছি। জানি না, কি নিমিত্ত আমার মন এরূপ চঞ্চল হইল। এই কথা বলিয়া তথা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক যেরূপ লোক অনন্যদৃষ্টি হইয়া নষ্ট বস্তুর অন্বেষণ করে, সেইরূপ লতাগৃহে, তরুতলে, তীরে ও মন্দিরে ভ্রমণ করিয়া যেন, অপহৃত অভীষ্ট সামগ্রীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। আমরা আহার করিতে অনুরোধ করিলে কহিলেন, আমার প্রাণ আপন প্রাণ অপেক্ষাও চন্দ্রাপীড়ের প্রিয়তর। সুতরাং সুহৃদের সন্তোষের নিমিত্ত অবশ্য রক্ষা করিতে হইবেক। এই কথা বলিয়া সরোবরে স্নান করিয়া যৎকিঞ্চিৎ ফলমূল ভক্ষণ করিলেন। এইরূপে তিন দিন অতিবাহিত হইল। আমরা প্রতিদিন নানাপ্রকার বুঝাইতে লাগিলাম। কিছুতেই চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে পারিলেন না। পরিশেষে তাঁহার আগমন ও আনয়ন বিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়া কতিপয় সৈন্য তাঁহার নিকটে রাখিয়া, আমরা স্কন্ধাবার লইয়া আসিতেছি। রাজকুমারের অতিশয় ক্লেশ হইবে বলিয়া পূর্ব্বে এ সংবাদ পাঠান যায় নাই।

অসম্ভবনীয় ও অচিন্তনীয় বৈশম্পায়নবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া চন্দ্রাপীড় বিস্মিত ও উদ্বিগ্নচিত্ত হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, প্রিয়সখার অকস্মাৎ এরূপ বৈরাগ্যের কারণ কি? আমি ত কখন কোন অপরাধ করি নাই। কখন অপ্রিয় কথা কহি নাই। অন্যে অপরাধ করিবে ইহাও সম্ভব নহে। তৃতীয় আশ্রমেরও এ সময় নয়। তিনি অদ্যাপি গৃহস্থাশ্রমে প্রবিষ্ট হন নাই। দেব পিতৃ ঋষি ঋণ হইতে অদ্যাপি মুক্ত হন নাই। এরূপ অবিবেকী নহেন যে, কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া মূর্খের ন্যায় উন্মার্গগামী হইবেন। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে এক পটগৃহে প্রবেশিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। ভাবিলেন যদি বাটীতে না গিয়া এইখান হইতে প্রিয়সুহৃদের অন্বেষণে যাই, তাহা হইলে পিতা, মাতা, শুকনাস ও মনোরমা এই বৃত্তান্ত শুনিয়া ক্ষিপ্তপ্রায় হইবেন। তাঁহাদিগের অনুজ্ঞা লইয়া এবং শুকনাস ও মনোরমাকে প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিয়া বাটী হইতে বন্ধুর অন্বেষণে যাওয়াই কর্ত্তব্য। যাহা হউক, বন্ধু অন্যায় কর্ম্ম করিয়াও আমার পরম উপকার করিলেন, আমার মনোরথ সম্পাদনের বিলক্ষণ সুযোগ হইল। এই অবসরে প্রিয়তমাকে দেখিতে পাইব। এই রূপে প্রিয়সুহৃদের বিরহবেদনাকেও পরিণামে শুভ ও সুখের হেতু জ্ঞান করিয়া দুঃখে নিতান্ত নিমগ্ন হইলেন না। স্বয়ং যাইলেই প্রিয়সুহৃৎকে আনিতে পারিবেন এই বিশ্বাস থাকাতে নিতান্ত কাতরও হইলেন না।

অনন্তর আহারাদি সমাপন করিয়া পটগৃহের বহির্গত হইলেন। দেখিলেন সূর্য্যদেব অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় কিরণ বিস্তার করিতেছেন। গগনে দৃষ্টিপাত করা কাহার সাধ্য। একে নিদাঘকাল, তাহাতে বেলা ঠিক্ দুই প্রহর, চতুর্দ্দিকে মাঠ ধূ ধূ করিতেছে। দিঙ্মণ্ডল যেন জ্বলিতেছে, বোধ হয়। পক্ষিগণ নিস্তব্ধ হইয়া নীড়ে অবস্থিতি করিতেছে। কিছুই শুনা যায় না, কেবল চাতকের কাতর স্বর এক এক বার শ্রবণগোচর হয়। মহিষকুল পঙ্কশেষ পল্বলে পড়িয়া আছে। পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হরিণ ও হরিণীগণ সূর্য্যকিরণে জলভ্রম হওয়াতে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে, কুক্কুরগণ বারংবার জিহ্বা বহির্গত করিতেছে। গ্রীষ্মের প্রভাবে বায়ু উত্তপ্ত হইয়া অনলের ন্যায় গাত্রে লাগিতেছে। গাত্র হইতে অনবরত ঘর্ম্মবারি বিনির্গত হইতেছে। রাজকুমার জলসেচন দ্বারা আপনার বাসগৃহ শীতল করিয়া তথায় বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। গ্রীষ্মকালে দিবসের শেষভাগ অতি রমণীয়। সূর্য্যের উত্তাপ থাকে না। মন্দ মন্দ সন্ধ্যাসমীরণ অমৃতবৃষ্টির ন্যায় শরীরে সুখস্পর্শ বোধ হয়। এই সময় সকলে গৃহের বহির্গত হইয়া সুশীতল সমীরণ সেবন করে, প্রফুল্ল অন্তঃকরণে তরুগণের শ্যামল শোভা দেখিয়া এবং দিঙ্মণ্ডলের শোভা দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হয়। রাজকুমার সন্ধ্যাকালে পটগৃহের বহির্গত হইলেন এবং আকাশমণ্ডলের চমৎকার শোভা দেখিতে লাগিলেন। নিশীথসময়ে চন্দ্রোদয়ে পৃথিবী জ্যোৎস্নাময় হইলে প্রয়াণ-সূচক শঙ্খধ্বনি হইল। স্কন্ধাবারস্থিত সেনাগণ উজ্জয়িনীদর্শনে সাতিশয় উৎসুক ছিল। শঙ্খধ্বনি শুনিবামাত্র অমনি সুসজ্জ হইয়া গমন করিতে আরম্ভ করিল। যামিনী প্রভাত হইবার সময় স্কন্ধাবার উজ্জয়িনীতে আসিয়া পঁহুছিল। বৈশম্পায়নের বৃত্তান্ত নগরে পূর্ব্বেই প্রচারিত হইয়াছিল। পৌরজনেরা রাজকুমারকে দেখিয়া, হতোঽস্মি! বলিয়া রোদন করিতে লাগিল। রাজকুমার ভাবিলেন, পৌরজনেরা যখন এরূপ বিলাপ করিতেছে, না জানি পুত্ত্রশোকে মনোরমা ও শুকনাসের কত দুঃখ ক্লেশ হইয়া থাকিবেক।

ক্রমে রাজবাটীর দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। রাজা বাটীতে নাই, মহিষীর সহিত শুকনাসের ভবনে গিয়াছেন, এই কথা শুনিয়া তথা হইতে মন্ত্রীর ভবনে গমন করিলেন। দেখিলেন, সকলেই বিষণ্ণ। “হা বৎস! নির্ম্মানুষ, ব্যালসঙ্কুল, ভীষণ গহনে কি রূপে আছ! ক্ষুধার সময় কাহার নিকট খাদ্য দ্রব্য প্রার্থনা করিতেছ! তৃষ্ণার সময় কে জলদান করিতেছে! যদি তোমার নির্জ্জন বনে বাস করিবার অভিলাষ ছিল, কেন আমারে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও নাই? বাল্যাবধি কখন তোমার মুখ কুপিত দেখি নাই, অকস্মাৎ ক্রোধোদয় কেন হইল? এরূপ বৈরাগ্যের কারণ কি? তোমার সেই প্রফুল্ল মুখকমল না দেখিয়া আমি আর জীবন ধারণ করিতে সমর্থ নহি।” মনোরমা কাতরস্বরে অন্তঃপুরে এইরূপ নানা প্রকার বিলাপ করিতেছেন, শুনিতে পাইলেন। অনন্তর বিষণ্ণ বদনে মহারাজ ও শুকনাসকে প্রণাম করিয়া আসনে বসিলেন।

রাজা কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! তোমার সহিত বৈশম্পায়নের যে প্রণয় তাহা বিলক্ষণ অবগত আছি। কিন্তু তাঁহার এই অনুচিত কর্ম্ম দেখিয়া আমার অন্তঃকরণ তোমার দোষ সম্ভাবনা করিতেছে। রাজার কথা সমাপ্ত না হইতে শুকনাস কহিলেন, দেব! যদি শশধরে উষ্ণতা, অমৃতে উগ্রতা ও হিমে দাহ্যশক্তি জন্মে, তথাপি নির্দ্দোষস্বভাব চন্দ্রাপীড়ের দোষশঙ্কা হইতে পারে না। একের অপরাধে অন্যকে দোষী জ্ঞান করা অতি অন্যায় কর্ম্ম। মাতৃদ্রোহী, পিতৃঘাতী, কৃতঘ্ন, দুরাচার, দুষ্কর্ম্মান্বিতের দোষে সুশীল চন্দ্রাপীড়ের দোষ সম্ভাবনা করা উচিত নয়। যে পিতা মাতার অপেক্ষা করিল না, রাজাকে গ্রাহ্য করিল না, মিত্রতার অনুরোধ রাখিল না, চন্দ্রাপীড় তাহার কি করিবেন? তাহার কি একবারও ইহা মনে হইল না যে, আমি পিতা মাতার একমাত্র জীবননিবন্ধন, আমাকে না দেখিয়া কি রূপে তাঁহারা জীবন ধারণ করিবেন। এক্ষণে বুঝিলাম কেবল আমাদিগকে দুঃখ দিবার নিমিত্তই সে ভূতলে জন্ম গ্রহণ করিয়ছিল। বলিতে বলিতে শোকে শুকনাসের অধর স্ফুরিত ও গণ্ডস্থল অশ্রু জলে পরিপ্লুত হইল। রাজা তাঁহার সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া কহিলেন, অমাত্য! যেরূপ খদ্যোতের আলোক দ্বারা অনলপ্রকাশ, অনল দ্বারা রবির প্রকাশ, অস্মদ্বিধ ব্যক্তি কর্ত্তৃক তোমার পরিবোধনও সেইরূপ। কিন্তু বর্ষাকালীন জলাশয়ের ন্যায় তোমার মন কলুষিত হইয়াছে। কলুষিত মনে বিবেকশক্তি স্পষ্ট রূপে প্রকাশিত হয় না। সে সময়ে অদূরদর্শীও দীর্ঘদর্শীকে অনায়াসে উপদেশ দিতে পারে। অতএব আমার কথা শুন। এই ভূমণ্ডলে এমন লোক অতি বিরল, যাহার যৌবনকাল নির্ব্বিকার ও নির্দ্দোষে অতিক্রান্ত হয়। যৌবনকাল অতি বিষম কাল। এই কালে উত্তীর্ণ হইলে শৈশবের সহিত গুরুজনের প্রতি স্নেহ বিগলিত হয়। বক্ষঃস্থলের সহিত বাঞ্ছা বিস্তীর্ণ বাহুযুগলের সহিত বুদ্ধি স্থূল হয়। মধ্যভাগের সহিত বিনয় ক্ষীণ হয়। এবং অকারণেই বিকারের আবির্ভাব হয়। বৈশম্পায়নের কোন দোষ নাই, ইহা কালের দোষ। কি জন্য তাহার বৈরাগ্যোদয় হইল, তাহা বিশেষ রূপে না জানিয়া দোষার্পণ করাও বিধেয় নয়। অগ্রে তাহাকে আনয়ন করা যাউক। তাহার মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া যাহা কর্ত্তব্য, পরে করা যাইবেক। শুকনাস কহিলেন, মহারাজ! বাৎসল্য প্রযুক্ত এরূপ কহিতেছেন। নতুবা, যাহার সহিত একত্র বাস, একত্র বিদ্যাভ্যাস ও পরম সৌহার্দ্দে কালযাপন হইয়াছে, পরম প্রীতিপাত্র সেই মিত্রের কথা অগ্রাহ্য করা অপেক্ষা আর কি অধিক অপরাধ হইতে পারে?

চন্দ্রাপীড় নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বিনয় বচনে কহিলেন, তাত! এ সকল আমারই দোষ, সন্দেহ নাই। এক্ষণে অনুমতি করুন, আমি স্বীয় পাপের প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্ত, অচ্ছোদসরোবরে গমন করি এবং বৈশম্পায়নকে নিবৃত্ত করিয়া আনি। অনন্তর পিতা মাতা, শুকনাস ও মনোরমার নিকট বিদায় লইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক বন্ধুর অন্বেষণে চলিলেন। শিপ্রানদীর তীরে সে দিন অবস্থিতি করিয়া রজনী প্রভাত না হইতেই সমভিব্যাহারী লোকদিগকে গমনের আদেশ দিলেন; আপনি অগ্রে অগ্রে চলিলেন। যাইতে যাইতে মনে মনে কত মনোরথ করিতে লাগিলেন। সুহৃদের অজ্ঞাতসারে তথায় উপস্থিত হইয়া সহসা কণ্ঠধারণ পূর্ব্বক কোথায় পলায়ন করিতেছ বলিয়া প্রিয়সখার লজ্জা ভঞ্জন করিয়া দিব। তদনন্তর মহাশ্বেতার আশ্রমে উপস্থিত হইব। তিনি আমাকে দেখিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইবেন, সন্দেহ নাই। মহাশ্বেতার আশ্রমে সৈন্য সামন্ত রাখিয়া হেমকূটে গমন করিব। তথায় প্রিয়তমার প্রফুল্ল মুখকমল দর্শনে নয়নযুগল চরিতার্থ করিব ও মহাসমারোহে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়া জীবন সফল ও আত্মাকে পরিতৃপ্ত করিব। অনন্তর প্রিয়তমার অনুমতি লইয়া মদলেখার সহিত পরিণয় সম্পাদন দ্বারা বন্ধুর সংসারবৈরাগ্য নিবারণ করিয়া দিব। এইরূপ মনোরথ করিতে করিতে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, পথশ্রম ও জাগরণ জন্য ক্লেশকে ক্লেশবোধ না করিয়া দিন যামিনী গমন করিতে লাগিলেন।

পথে বর্ষাকাল উপস্থিত। নীলবর্ণ মেঘমালায় গগনমণ্ডল আচ্ছাদিত হইল। দিনকর আর দৃষ্টিগোচর হয় না। চতুর্দ্দিকে মেঘ, দশ দিক্ অন্ধকার। দিবা রাত্রির কিছুই বিশেষ রহিল না। ঘনঘটার ঘোরতর গভীর গর্জ্জন ও ক্ষণপ্রভার দুঃসহ প্রভা ভয়ানক হইয়া উঠিল। মধ্যে মধ্যে বজ্রাঘাত ও শিলাবৃষ্টি। অনবরত মূষলধারে বৃষ্টি হওয়াতে, নদী সকল বর্দ্ধিত হইয়া উভয় কূল ভগ্ন করিয়া ভীষণ বেগে প্রবাহিত হইল। সরোবর, পুষ্করিণী, নদ, নদী পরিপূর্ণ হইয়া গেল। চতুর্দ্দিক জলময় ও পথ পঙ্কময়। ময়ূর ও ময়ূরীগণ আহ্লাদে পুলকিত হইয়া নৃত্য আরম্ভ করিল। কদম্ব, মালতী, কেতকী, কুটজ প্রভৃতি নানাবিধ তরু ও লতার বিকসিত কুসুম আন্দোলিত করিয়া নবসলিলসিক্ত বসুন্ধরার মৃদগন্ধ বিস্তার পূর্ব্বক ঝাঞ্ঝাবায়ু উৎকলাপ শিখিকুলের শিখাকলাপে আঘাত করিতে লাগিল। কোন দিকে কেকারব, কোন দিকে ভেকরব, গগনে চাতকের কলরব, চতুর্দ্দিকে ঝঞ্ঝাবায়ু ও বৃষ্টিধারার গভীর শব্দ এবং স্থানে স্থানে গিরিনির্ঝরের পতনশব্দ। গগনমণ্ডলে আর চন্দ্রমা দৃষ্টিগোচর হয় না। নক্ষত্রগণ আর দেখিতে পাওয়া যায় না। এইরূপে বর্ষাকাল উপস্থিত হইয়া কালসর্পের ন্যায় চন্দ্রাপীড়ের পথরোধ করিল। ইন্দ্রচাপে তড়িদ্ গুণ সংযোগ করিয়া গভীর গর্জ্জন পূর্ব্বক বারিরূপ শর বৃষ্টি করিতে লাগিল। তড়িৎ যেন তর্জ্জন করিয়া উঠিল। বর্ষাকাল সমাগত দেখিয়া, চন্দ্রাপীড় সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। ভাবিলেন, এ আবার কি উৎপাত; আমি প্রিয় সুহৃৎ ও প্রিয়তমার সমাগমে সমুৎসুক হইয়া, প্রাণপণে ত্বরা করিয়া যাইতেছি। কোথা হইতে জলদকাল দশ দিক্ অন্ধকার করিয়া বৈরনির্যাতনের আশয়ে উপস্থিত হইল? অথবা, বিদ্যুতের আলোকে পথ আলোকময় করিয়া, মেঘরূপ চন্দ্রাতপ দ্বারা রৌদ্র নিবারণ করিয়া, আমার সেবার নিমিত্তই বুঝি, জলদকাল সমাগত হইয়াছে। এই সময় পথ চলিবার সময়। এই স্থির করিয়া গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।

যাইতে যাইতে পথিমধ্যে, মেঘনাদ আসিতেছে দেখিতে পাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, মেঘনাদ! তুমি অচ্ছোদসরোবরে বৈশম্পায়নকে দেখিয়াছ? তিনি তথায় কি নিমিত্ত আছেন, জিজ্ঞাসা করিয়াছ? তোমার জিজ্ঞাসার কি উত্তর দিলেন? তাঁহার কিরূপ অভিপ্রায় বুঝিলে, বাটীতে ফিরিয়া আসিবেন কি না? আমি গন্ধর্ব্বনগরে যাইব শুনিয়া কি বলিলেন? তোমার কি বোধ হয়, আমাদের গমন পর্য্যন্ত তথায় থাকিবেন ত? মেঘনাদ বিনীত বচনে কহিল, “দেব! বৈশম্পায়ন বাটী আসিলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমি অবিলম্বে গন্ধর্ব্বনগরে গমন করিতেছি; তুমি পত্রলেখা ও কেয়ূরকের সহিত অগ্রসর হও,” আপনি এই আদেশ দিয়া আমাকে বিদায় করিলেন। আমি আসিবার সময়, বৈশম্পায়ন বাটী যান নাই, অচ্ছোদসরোবরের তীরে অবস্থিতি করিতেছেন, ইহা কাহারও মুখে শুনি নাই। তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎও হয় নাই। আমি অচ্ছোদসরোবর পর্য্যন্ত যাই নাই। পথিমধ্যে পত্রলেখা ও কেয়ূরক কহিলেন, মেঘনাদ! বর্ষাকাল উপস্থিত! তুমি এই স্থান হইতেই প্রস্থান কর। এই ভীষণকালে একাকী এখানে কদাচ থাকিও না। এই কথা বলিয়া আমাকে বিদায় দিলেন।

রাজকুমার মেঘনাদকেও সঙ্গে করিয়া লইলেন। কিছু দিন পরে অচ্ছোদসরোবরের তীরে উপস্থিত হইলেন। পূর্ব্বে যে স্থানে নির্ম্মল জল, বিকসিত কুসুম, মনোহর তীর ও বিচিত্র লতাকুঞ্জ দেখিয়া প্রীত ও প্রফুল্লচিত্ত হইয়াছিলেন, এক্ষণে বিষণ্ণ চিত্তে তথায় উপস্থিত হইয়া প্রিয়সখার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। সমভিব্যাহারী লোকদিগকে সতর্ক হইয়া অনুসন্ধান করিতে কহিলেন। আপনিও তরুগহন, তীরভূমি ও লতামণ্ডপ তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিলেন। যখন তাঁহার অবস্থানের কোন চিহ্ন পাইলেন না, তখন ভগ্নোৎসাহ চিত্তে চিন্তা করিলেন, পত্রলেখার মুখে আমার আগমন সংবাদ শুনিয়া বন্ধু বুঝি এখান হইতে প্রস্থান করিয়া থাকিবেন। এখানে থাকিলে অবশ্য অবস্থানচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যাইত। বোধ হয়, তিনি নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। এক্ষণে কোথায় যাই কোথায় গেলে বন্ধুর দেখা পাই। যে আশা অবলম্বন করিয়া এত দিন জীবন ধারণ করিয়াছিলাম, তাহার মূলোচ্ছেদ হইল। শরীর অবশ হইতেছে, চরণ আর চলে না। এক বারে ভগ্নোৎসাহ হইয়াছি, অন্তঃকরণ বিষাদসাগরে মগ্ন হইতেছে! সকলই অন্ধকার দেখিতেছি।

আশার কি অপরিসীম মহিমা! চন্দ্রাপীড় সরসীতীরে বন্ধুকে দেখিতে না পাইয়া ভাবিলেন, এক বার মহাশ্বেতার আশ্রম দেখিয়া আসি। বোধ হয়, মহাশ্বেতা সন্ধান বলিতে পারেন। এই স্থির করিয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক তথায় চলিলেন। কতিপয় পরিচারকও সঙ্গে সঙ্গে গেল। আসিবার সময় মনোরথ করিয়াছিলেন মহাশ্বেতা আমার গমনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইবেন এবং আমিও আহ্লাদিত চিত্তে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব। কিন্তু বিধাতার কি চাতুরী! ভবিতব্যতার কি প্রভাব! মনুষ্যেরা কি অন্ধ এবং তাহাদিগের মনোরথ কি অলীক! চন্দ্রাপীড় বন্ধুর বিয়োগে দুঃখিত হইয়া অনুসন্ধানের নিমিত্ত যাঁহার নিকট গমন করিলেন, দূর হইতে দেখিলেন, তিনি শিলাতলে উপবিষ্ট হইয়া অধোমুখে রোদন করিতেছেন। তরলিকা বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিত মনে তাঁহাকে ধরিয়া আছে। মহাশ্বেতার তাদৃশ অবস্থা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইলেন। ভাবিলেন, বুঝি কাদম্বরীর কোন অত্যহিত ঘটিয়া থাকিবেক। নতুবা পত্রলেখার মুখে আমার আগমনবার্ত্তা শুনিয়াছেন, এসময় অবশ্য হৃষ্টচিত্ত থাকিতেন। চন্দ্রাপীড় বৈশম্পায়নের অনুসন্ধান না পাওয়াতে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাহাতে আবার প্রিয়তমার অমঙ্গলচিন্তা মনোমধ্যে প্রবেশ করাতে নিতান্ত কাতর হইলেন। শূন্য হৃদয়ে মহাশ্বেতার নিকটবর্ত্তী হইয়া শিলাতলের এক পার্শ্বে বসিলেন ও তরলিকাকে মহাশ্বেতার শোকের হেতু জিজ্ঞাসিলেন। তরলিকা প্রস্থান করিয়া থাকিবেন। এখানে থাকিলে অবশ্য অবস্থানচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যাইত। বোধ হয়, তিনি নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। এক্ষণে কোথায় যাই কোথায় গেলে বন্ধুর দেখা পাই। যে আশা অবলম্বন করিয়া এত দিন জীবন ধারণ করিয়াছিলাম, তাহার মূলোচ্ছেদ হইল। শরীর অবশ হইতেছে, চরণ আর চলে না। এক বারে ভগ্নোৎসাহ হইয়াছি, অন্তঃকরণ বিষাদসাগরে মগ্ন হইতেছে! সকলই অন্ধকার দেখিতেছি।

আশার কি অপরিসীম মহিমা! চন্দ্রাপীড় সরসীতীরে বন্ধুকে দেখিতে না পাইয়া ভাবিলেন, এক বার মহাশ্বেতার আশ্রম দেখিয়া আসি। বোধ হয়, মহাশ্বেতা সন্ধান বলিতে পারেন। এই স্থির করিয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক তথায় চলিলেন। কতিপয় পরিচারকও সঙ্গে সঙ্গে গেল। আসিবার সময় মনোরথ করিয়াছিলেন মহাশ্বেতা আমার গমনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইবেন এবং আমিও আহ্লাদিত চিত্তে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব। কিন্তু বিধাতার কি চাতুরী! ভবিতব্যতার কি প্রভাব! মনুষ্যেরা কি অন্ধ এবং তাহাদিগের মনোরথ কি অলীক! চন্দ্রাপীড় বন্ধুর বিয়োগে দুঃখিত হইয়া অনুসন্ধানের নিমিত্ত যাঁহার নিকট গমন করিলেন, দূর হইতে দেখিলেন, তিনি শিলাতলে উপবিষ্ট হইয়া অধোমুখে রোদন করিতেছেন। তরলিকা বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিত মনে তাঁহাকে ধরিয়া আছে। মহাশ্বেতার তাদৃশ অবস্থা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইলেন। ভাবিলেন, বুঝি কাদম্বরীর কোন অত্যহিত ঘটিয়া থাকিবেক। নতুবা পত্রলেখার মুখে আমার আগমনবার্ত্তা শুনিয়াছেন, এসময় অবশ্য হৃষ্টচিত্ত থাকিতেন। চন্দ্রাপীড় বৈশম্পায়নের অনুসন্ধান না পাওয়াতে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাহাতে আবার প্রিয়তমার অমঙ্গলচিন্তা মনোমধ্যে প্রবেশ করাতে নিতান্ত কাতর হইলেন। শূন্য হৃদয়ে মহাশ্বেতার নিকটবর্ত্তী হইয়া শিলাতলের এক পার্শ্বে বসিলেন ও তরলিকাকে মহাশ্বেতার শোকের হেতু জিজ্ঞাসিলেন। তরলিকা কিছু বলিতে পারিল না, কেবল দীন নয়নে মহাশ্বেতার মুখ পানে চাহিয়া রহিল।

মহাশ্বেতা বসনাঞ্চলে নেত্রজল মোচন করিয়া কাতর স্বরে কহিলেন, মহাভাগ! যে নিষ্করুণা ও নির্লজ্জা পূর্ব্বে আপনাকে দারুণ শোকবৃত্তান্ত শ্রবণ করাইয়াছিল, সেই পাপীয়সী এক্ষণেও এক অপূর্ব্ব ঘটনা শ্রবণ করাইতে প্রস্তুত আছে। কেয়ূরকের মুখে আপনার উজ্জয়িনীগমনের সংবাদ শুনিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলাম। চিত্ররথের মনোরথ, মদিরার বাঞ্ছা ও আপনার অভীষ্টসিদ্ধি না হওয়াতে সমধিক বৈরাগ্যোদয় হইল এবং কাদম্বরীর স্নেহপাশ ভেদ করিয়া তৎক্ষণাৎ আপন আশ্রমে আগমন করিলাম। একদা আশ্রমে বসিয়া আছি এমন সময়ে, রাজকুমারের সমবয়স্ক ও সদৃশাকৃতি সুকুমার এক ব্রাহ্মণকুমারকে দূর হইতে দেখিলাম। তিনি এরূপ অন্যমনস্ক যে তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন প্রণষ্ট বস্তুর অন্বেষণ করিতে করিতে এইদিকে আসিতেছেন। ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইয়া পরিচিতের ন্যায় আমাকে জ্ঞান করিয়া, নিমেষশূন্য নয়নে অনেক ক্ষণ আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। অনন্তর মৃদু স্বরে বলিলেন, সুন্দরি! এই ভূমণ্ডলে বয়স ও আকৃতির অবিসংবাদী কর্ম্ম করিয়া কেহ নিন্দাস্পদ হয় না। কিন্তু তুমি তাহার বিপরীত কর্ম্ম করিতেছ। তোমার নবীন বয়স, কোমল শরীর ও শিরীষকুসুমের ন্যায় সুকুমার অবয়ব। এ সময় তোমার তপস্যার সময় নয়। মৃণালিনীর তুহিনপাত যেরূপ সাংঘাতিক, তোমার পক্ষে তপস্যার আড়ম্বর সেইরূপ। তোমার মত নবযুবতীরা যদি ইন্দ্রিয়সুখে জলাঞ্জলি দিয়া তপস্যায় অনুরক্ত হয়, তাহা হইলে, মকরকেতুর মোহন শর কি কার্য্যকর হইল? শশধরের উদয়, কোকিলের কলরব, বসন্তকালের সমাগম ও বর্ষা ঋতুর আড়ম্বরের কি ফলোদয় হইল? বিকসিত কমল, কুসুমিত উপবন ও মলয়ানিল কি কর্ম্মে লাগিল?

দেব পুণ্ডরীকের সেই দারুণ ঘটনাবধি আমি সকল বিষয়েই নিরুৎসুক ছিলাম। ব্রাহ্মণকুমারের কথা অগ্নিশিখার ন্যায় আমার গাত্র দাহ করিতে লাগিল। তাহার কথা সমাপ্তি না হইতেই বিরক্ত হইয়া তথা হইতে উঠিয়া গেলাম। দেবতাদিগের অর্চ্চনার নিমিত্ত কুসুম তুলিতে লাগিলাম। তথা হইতে তরলিকাকে ডাকিয়া কহিলাম, ঐ দুর্ব্বৃত্ত ব্রাহ্মণকুমারের অসঙ্গত কথা ও কুৎসিত ভাবভঙ্গী দ্বারা বোধ হইতেছে, উহার অভিপ্রায় ভাল নয়। উহাকে বারণ কর, যেন আর এখানে না আইসে। যদি আইসে ভাল হইবে না। তরলিকা ভয়প্রদর্শন ও তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক বারণ করিয়া কহিল, তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও, পুনর্ব্বার আর আসিও না। সেই হতভাগ্য সে দিন ফিরিয়া গেল বটে, কিন্তু আপন সঙ্কল্প এক বারে পরিত্যাগ করিল না। একদা নিশীথসময়ে চন্দ্রোদয়ে দিগ্বলয় জ্যোৎস্নাময় হইলে তরলিকা শিলাতলে শয়ন করিয়া নিদ্রায় অচেতন হইল। গ্রীষ্মের নিমিত্ত গুহার অভ্যন্তরে নিদ্রা না হওয়াতে আমি বহিঃস্থিত এক শিলাতলে অঙ্গ নিক্ষেপ করিয়া গগনোদিত সুধাংশুর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলাম। মন্দ মন্দ সমীরণ গাত্রে সুধাবৃষ্টির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। সেই সময়ে দেব পুণ্ডরীকের বিস্ময়কর ব্যাপার স্মৃতিপথারূঢ় হইল। তাঁহার গুণ স্মরণ হওয়াতে খেদ করিয়া মনে মনে কহিলাম আমি কি হতভাগিনী! আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ বুঝি দেববাক্যও মিথ্যা হইল! কই! প্রিয়তমের সহিত সমাগমের কোন উপায় দেখিতেছি না। কপিঞ্জল সেই গমন করিয়াছেন, অদ্যাপি প্রত্যাগত হইলেন না। এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছি এমন সময়ে দূর হইতে পদসঞ্চারের শব্দ শুনিতে পাইলাম। যে দিকে শব্দ হইতেছিল, সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া জ্যোৎস্নার আলোকে দূর হইতে দেখিলাম, সেই ব্রাহ্মণকুমার উন্মত্তের ন্যায় দুই বাহু প্রসারিত করিয়া দৌড়িয়া আসিতেছে। তাহার সেইরূপ ভয়ঙ্কর আকার দেখিয়া সাতিশয় শঙ্কা জন্মিল। ভাবিলাম, কি পাপ! উন্মত্তটা আসিয়া সহসা যদি গাত্র স্পর্শ করে, তৎক্ষণাৎ এই অপবিত্র কলেবর পরিত্যাগ করিব। এত দিনে প্রাণেশ্বরের পুনর্দ্দর্শন প্রত্যাশার মূলোচ্ছেদ হইল। এত কাল বৃথা কষ্ট ভোগ করিলাম।

এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে নিকটে আসিয়া কহিল, চন্দ্রমুখি! ঐ দেখ কুসুমশরের প্রধান সহায় চন্দ্রমা আমাকে বধ করিতে আসিতেছে। এক্ষণে তোমার শরণাপন্ন হইলাম, যাহাতে রক্ষা পাই কর। তাহার সেই ঘৃণাকর কথা শুনিয়া আমার রোষানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। ক্রোধে কলেবর কাঁপিতে লাগিল। নিশ্বাসবায়ুর সহিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইতে লাগিল। ক্রোধে তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক ভর্ৎসনা করিয়া কহিলাম, রে দুরাত্মন্! এখনও তোর মস্তকে বজ্রাঘাত হইল না, এখনও তোর জিহ্বা ছিন্ন হইয়া পতিত হইল না, এখনও তোর শরীর শত শত খণ্ডে বিভক্ত হইয়া গেল না? বোধ হয় শুভাশুভ কর্ম্মের সাক্ষীভূত পঞ্চ মহাভূত দ্বারা তোর এই অপবিত্র অস্পৃশ্য দেহ নির্ম্মিত হয় নাই। তাহা হইলে, এত ক্ষণে তোর শরীর অনলে ভস্মীভূত, জলে আপ্লাবিত, রসাতলে নীত, বায়ুবেগে শতধা বিভক্ত ও গগনের সহিত মিলিত হইয়া যাইত। মনুষ্যদেহ আশ্রয় করিয়াছিস, কিন্তু তোকে তির্য্যগ্‌জাতির ন্যায় যথেচ্ছাচারী দেখিতেছি। তোর হিতাহিত জ্ঞান ও কার্য্যাকার্য্যবিবেক কিছুই নাই। তুই একান্ত তির্য্যগ্ধর্ম্মাক্রান্ত। তির্য্যগ্​জাতিতেই তোর পতন হওয়া উচিত। অনন্তর সর্ব্বসাক্ষীভূত ভগবান্ চন্দ্রমার প্রতি নেত্রপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলাম, ভগবন্! সর্ব্বসাক্ষিন্! দেব পুণ্ডরীকের দর্শনাবধি যদি অন্য পুরুষের চিন্তা না করিয়া থাকি, যদি কায়মনোবাক্যে তাঁহার প্রতি ভক্তি থাকে, যদি আমার অন্তঃকরণ পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক হয়, তাহা হইলে, আমার বচন সত্য হউক অর্থাৎ তির্য্যগ্​জাতিতে এই পাপিষ্ঠের পতন হউক। আমার কথার অবসানে, জানি না, কি মদনজ্বরের প্রভাবে, কি আত্মদুষ্কর্ম্মের দুর্ব্বিপাকবশতঃ, কি আমার পাপের সামর্থ্যে, সেই ব্রাহ্মণকুমার অচেতন হইয়া ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলে পতিত হইল। তাহার সঙ্গিগণ কাতর স্বরে হা হতোঽস্মি! বলিয়া শব্দ করিয়া উঠিল। তাহাদের মুখে শুনিলাম তিনি আপনার মিত্র। এই বলিয়া লজ্জায় অধোমুখী হইয়া মহাশ্বেতা রোদন করিতে লাগিলেন।

» ২.১৩ চন্দ্রাপীড় নয়ননিমীলন পূর্ব্বক

চন্দ্রাপীড় নয়ননিমীলন পূর্ব্বক মহাশ্বেতার কথা শুনিতেছিলেন; কথা সমাপ্ত হইলে কহিলেন, ভগবতি! এ জন্মে কাদম্বরীসমাগম ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। জন্মান্তরে যাহাতে সেই প্রফুল্ল মুখারবিন্দ দেখিতে পাই এরূপ যত্ন করিও। বলিতে বলিতে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। যেমন শিলাতল হইতে ভূতলে পড়িতেছিলেন, অমনি তরলিকা মহাশ্বেতাকে ছাড়িয়া শশব্যস্তে হস্ত বাড়াইয়া ধরিল এবং কাতর স্বরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! দেখ দেখ কি সর্ব্বনাশ উপস্থিত! চন্দ্রাপীড় চৈতন্যশূন্য হইয়াছেন। মৃত দেহের ন্যায় গ্রীবা ভগ্ন হইয়া পড়িতেছে। নেত্র নিমীলিত হইয়াছে। নিশ্বাস বহিতেছে না। জীবনের কোন লক্ষণ নাই। একি দুর্দ্দৈব!—একি সর্ব্বনাশ!—হা দেব, কাদম্বরীপ্রাণবল্লভ! কাদম্বরীর কি দশা ঘটিল। এই বলিয়া তরলিকা মুক্ত কণ্ঠে রোদন করিয়া উঠিল। মহাশ্বেতা সসম্ভ্রমে চন্দ্রাপীড়ের প্রতি চক্ষু নিক্ষেপ করিলেন এবং সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া হতবুদ্ধি ও চিত্রিতের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন। আঃ—পাপীয়সি, দুষ্টতাপসি! কি করিলি, জগতের চন্দ্র হরণ করিলি, মহারাজ তারাপীড়ের সর্ব্বস্ব অপহৃত হইল, মহিষী বিলাসবতীর সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল, পৃথিবী অনাথা হইল। হায় এত দিনের পর উজ্জয়িনী শূন্য হইল! এক্ষণে প্রজারা কাহার মুখ নিরীক্ষণ করিবে, আমরা কাহার শরণাপন্ন হইব? এ কি বিনা মেঘে বজ্রাঘাত? চন্দ্রাপীড় কোথায়? মহারাজ এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে আমরা কি উত্তর দিব। পরিচারকেরা হা হতোঽস্মি! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে এই রূপে বিলাপ করিয়া উঠিল। ইন্দ্রায়ুধ চন্দ্রাপীড়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। তাহার নয়নযুগল হইতে অজস্র অশ্রুবারি বিনির্গত হইতে লাগিল।

এ দিকে পত্রলেখার মুখে চন্দ্রাপীড়ের আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া কাদম্বরীর আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। প্রাণেশ্বরের সমাগমে এরূপ সমুৎসুক হইলেন যে, তাঁহার আগমন পর্য্যন্ত প্রতীক্ষা করিতে পারিলেন না। প্রিয়তমের প্রত্যুদ্গমন করিবার মানসে উজ্জ্বল বেশ ধারণ করিলেন। মণিময় অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া গাত্রে অঙ্গরাগ লেপন পূর্ব্বক কণ্ঠে কুসুমমালা পরিলেন। সুসজ্জিত হইয়া কতিপয় পরিজনের সহিত বাটীর বহির্গত হইলেন। যাইতে যাইতে মদলেখাকে জিজ্ঞাসিলেন, মদলেখে! পত্রলেখার কথা কি সত্য, চন্দ্রাপীড় কি আসিয়াছেন? আমার ত বিশ্বাস হয় না। তাঁহার তৎকালীন নির্দ্দয় আচরণ স্মরণ করিলে তাঁহার আর কোন কথায় শ্রদ্ধা হয় না। আমার হৃদয় কম্পিত হইতেছে। পাছে তাঁহার আগমন বিষয়ে হতাশ হইয়া বিষণ্ণ চিত্তে ফিরিয়া আসিতে হয়। বলিতে বলিতে দক্ষিণ চক্ষু স্পন্দ হইল। ভাবিলেন এ আবার কি! বিধাতা কি এখনও পরিতৃপ্ত হন নাই? আবারও দুঃখে নিক্ষিপ্ত করিবেন? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে মহাশ্বেতার আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সকলেই বিষণ্ণ সকলের মুখেই দুঃখের চিহ্ন প্রকাশ পাইতেছে। অনন্তর ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া পুষ্পশূন্য উদ্যানের ন্যায়, পল্লবশূন্য তরুর ন্যায়, বারিশূন্য সরোবরের ন্যায়, প্রাণশূন্য চন্দ্রাপীড়ের দেহ পতিত রহিয়াছে, দেখিতে পাইলেন। দেখিবামাত্র মূর্চ্ছাপন্ন হইয়া ভূতলে পড়িলেন, অমনি মদলেখা ধরিল। পত্রলেখা অচেতন হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতে লাগিল। কাদম্বরী অনেক ক্ষণের পর চেতন হইয়া সস্পৃহ লোচনে চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র দেখিলেন এবং ছিন্নমূলা লতার ন্যায় ভূতলে পতিত হইয়া শিরে করাঘাত করিতে লাগিলেন।

মদলেখা কাদম্বরীর চরণে পতিত হইয়া আর্ত্তস্বরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আহা তোমা বই মদিরা ও চিত্ররথের কেহ নাই! তোমার হৃদয় বিদীর্ণ হইল, বোধ হইতেছে। প্রসন্ন হও, ধৈর্য্য, অবলম্বন কর। মদলেখার কথায় হাস্য করিয়া কহিলেন, অয়ি উন্মত্তে! ভয় কি? আমার হৃদয় পাষাণে নির্ম্মিত তাহা কি তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই? ইহা বজ্র অপেক্ষাও কঠিন তাহা কি তুমি জানিতে পার নাই? যখন এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখিবামাত্র বিদীর্ণ হয় নাই, তখন আর বিদীর্ণ হইবার আশঙ্কা কি? হা এখনও জীবিত আছি! মরিবার এমন সময় আর কবে পাইব? সমুদায় দুঃখ ও সকল সন্তাপ শান্তি হইবার শুভ দিন উপস্থিত হইয়াছে। আহা আমার কি সৌভাগ্য! মরিবার সময় প্রাণেশ্বরের মুখকমল দেখিতে পাইলাম। জীবিতেশ্বরকে পুনর্ব্বার দেখিতে পাইব, এরূপ প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু বিধাতা অনুকূল হইয়া তাহাও ঘটাইয়া দিলেন। তবে আর বিলম্ব কেন? জীবিত ব্যক্তিরাই পিতা, মাতা, বন্ধু, বান্ধব, পরিজন ও সখীগণের অপেক্ষা করে। এখন আর তাঁহাদিগের অনুরোধ কি? এত দিনে সকল ক্লেশ দূর হইল, সকল যাতনা শান্তি হইল, সকল সন্তাপ নির্ব্বাণ হইল। যাহার নিমিত্ত লজ্জা, ধৈর্য্য, কুলমর্য্যাদা পরিত্যাগ করিয়াছি; বিনয়ে জলাঞ্জলি দিয়াছি; গুরুজনের অপেক্ষা পরিহার করিয়াছি; সখীদিগকে যৎপরোনাস্তি যাতনা দিয়াছি; প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়াছি; সে জীবন-সর্ব্বস্ব প্রাণেশ্বর প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন, আমি এখনও জীবিত আছি! সখি! তুমি আবার সেই ঘৃণাকর, লজ্জাকর প্রাণ রাখিতে অনুরোধ করিতেছ! এ সময় সুখে মরিবার সময়, তুমি বাধা দিও না।

যদি আমার প্রতি প্রিয়সখীর স্নেহ থাকে ও আমার প্রিয়কার্য্য করিতে ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে শোকে পিতা মাতার যাহাতে দেহ অবসান না হয়, বাসভবন শূন্য দেখিয়া সখীজন ও পরিজনেরা যাহাতে দিগ্দিগন্তে প্রস্থান না করে, এরূপ করিও। অঙ্গনমধ্যবর্ত্তী সহকারপোতকের সহিত তৎপার্শ্ববর্ত্তিনী মাধবীলতার বিবাহ দিও। সাবধান, যেন মদারোপিত অশোকতরুর বাল পল্লব কেহ খণ্ডন না করে। শয়নের শিরোভাগে কামদেবের যে চিত্রপট আছে, তাহা গতমাত্র পাটিত করিও। কালিন্দী শারিকা ও পরিহাস শুককে বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া দিও। আমার প্রীতিপাত্র হরিণটীকে কোন তপোবনে রাখিয়া আসিও। নকুলীকে আপন অঙ্কে সর্ব্বদা রাখিও। ক্রীড়াপর্ব্বতে যে জীবঞ্জীবকমিথুন এবং আমার পাদসহচরী যে হংসশাবক আছে, তাহারা যাহাতে বিপন্ন না হয়, এরূপ তত্ত্বাবধান করিও। বনমানুষী কখন গৃহে বাস করে না, অতএব তাহাকে বনে ছাড়িয়া দিও। কোন তপস্বীকে ক্রীড়াপর্ব্বত প্রদান করিও। আমার এই অঙ্গের ভূষণ গ্রহণ কর, ইহা কোন দীন ব্রাহ্মণকে সমর্পণ করিও। বীণা ও অন্য সামগ্রী যাহা তোমার রুচি হয় আপনি রাখিও। আমি এক্ষণে বিদায় হইলাম, আইস, একবার জন্মের শোধ আলিঙ্গন ও কণ্ঠগ্রহণ করিয়া শরীর শীতল করি। চন্দ্রকিরণে, চন্দনরসে, শীতল জলে, সুশীতল শিলাতলে, কমলিনীপত্রে, কুমুদ কুবলয় ও শৈবালের শয্যায় আমার গাত্র দগ্ধ ও জর্জ্জরিত হইয়াছে। এক্ষণে প্রাণেশ্বরের কণ্ঠ গ্রহণ পূর্ব্বক উজ্জ্বলিত চিতানলে শরীর নির্ব্বাপিত করি। মদলেখাকে এই কথা বলিয়া মহাশ্বেতার কণ্ঠ ধারণ পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়সখি! তুমি আশারূপ মৃগতৃষ্ণিকায় মোহিত হইয়া ক্ষণে ক্ষণে মরণাধিক যন্ত্রণা অনুভব করিয়া সুখে জীবন ধারণ করিতেছ। এই অভাগিনীর আবার সে আশাও নাই। এক্ষণে জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা, যেন জন্মান্তরে প্রিয়সখীর দেখা পাই। এই বলিয়া চন্দ্রাপীড়ের চরণদ্বয় অঙ্কে ধারণ করিলেন। স্পর্শমাত্রে চন্দ্রাপীড়ের দেহ হইতে উজ্জ্বল জ্যোতিঃ উদ্গত হইল। জ্যোতির উজ্জ্বল আলোকে ক্ষণকাল সেই প্রদেশ কৌমুদীময় বোধ হইল।

অনন্তর অন্তরীক্ষে এই বাণী বিনির্গত হইল, “বৎসে মহাশ্বেতে! আমার কথার আশ্বাসে তুমি জীবন ধারণ করিতেছ। অবশ্য প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ হইবে, সন্দেহ করিও না। পুণ্ডরীকের শরীর আমার তেজঃস্পর্শে অবিনাশি ও অবিকৃত হইয়া মদীয় লোকে আছে। চন্দ্রাপীড়ের এই শরীরও মত্তেজোময় অবিনাশি। বিশেষতঃ কাদম্বরীর করস্পর্শ হওয়াতে ইহার আর ক্ষয় নাই। শাপদোষে এই দেহ জীবনশূন্য হইয়াছে, যোগিশরীরের ন্যায় পুনর্ব্বার জীবাত্মা সংযুক্ত হইবে। তোমাদের প্রত্যয়ের নিমিত্ত ইহা এই স্থানেই থাকিল, অগ্নিসংস্কার বা পরিত্যাগ করিও না। যত দিন পুনর্জীবিত না হয়, প্রযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করিও।”

আকাশবাণী শ্রবণান্তর সকলে বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়া চিত্রিতের ন্যায় নিমেষশূন্য লোচনে গগনে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। চন্দ্রাপীড়ের শরীরোদ্ভূতজ্যোতিঃস্পর্শে পত্রলেখার মূর্চ্ছাপনয় ও চৈতন্যোদয় হইল। তখন সে উন্মত্তের ন্যায় সহসা গাত্রোত্থান করিয়া, ইন্দ্রায়ুধের নিকটে অতি বেগে গমন করিয়া কহিল, রাজকুমার প্রস্থান করিলেন, তোমার আর একাকী থাকা উচিত নয়। এই বলিয়া রক্ষকের হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক বল্​গা গ্রহণ করিয়া তাহার সহিত অচ্ছোদসরোবরে ঝম্প প্রদান করিল। ক্ষণকালের মধ্যে জলে নিমগ্ন হইয়া গেল। অনন্তর জটাধারী এক তাপসকুমার সহসা জলমধ্য হইতে সমুত্থিত হইলেন। তাঁহার মস্তকে শৈবাল লাগাতে ও গাত্র হইতে বিন্দু বিন্দু বারি পতিত হওয়াতে প্রথমে বোধ হইল যেন, জলমানুষ। মহাশ্বেতা সেই তাপসকুমারকে পরিচিতপূর্ব্ব ও দৃষ্টপূর্ব্ব বোধ করিয়া এক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন। তিনিও নিকটে আসিয়া মৃদু স্বরে কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! আমাকে চিনিতে পার? মহাশ্বেতা শোক, বিস্ময় ও আনন্দের মধ্যবর্ত্তিনী হইয়া, সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। গদ্গদ বচনে কহিলেন, ভগবন্ কপিঞ্জল! এই হতভাগিনীকে সেইরূপ বিষম সঙ্কটে রাখিয়া আপনি কোথায় গিয়াছিলেন? এত কাল কোথায় ছিলেন? আপনার প্রিয় সখাকে কোথায় রাখিয়া আসিতেছেন?

মহাশ্বেতা এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে কাদম্বরী, কাদম্বরীর পরিজন ও চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গিগণ সকলে, বিস্ময়াপন্ন হইয়া তাপসকুমারের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। তিনি প্রতিবচন প্রদান করিতে আরম্ভ করিয়া কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। তুমি সেইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছিলে, তোমাকে একাকিনী রাখিয়া, “রে দুরাত্মন্! বন্ধুকে লইয়া কোথায় যাইতেছিস্” এই কথা বলিতে বলিতে অপহরণকারী সেই পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। তিনি আমার কথায় কিছুই উত্তর না দিয়া স্বর্গমার্গে উপস্থিত হইলেন। বৈমানিকেরা বিস্ময়োৎফুল্ল নয়নে দেখিতে লাগিল। দিব্যাঙ্গনারা ভয়ে পথ ছাড়িয়া দিল। আমি ক্রমাগত পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। তিনি চন্দ্রলোকে উপস্থিত হইলেন। তথায় মহোদয়নাম্নী সভার মধ্যে চন্দ্রকান্তমণিনির্ম্মিত পর্য্যঙ্কে প্রিয় সখার শরীর সংস্থাপিত করিয়া কহিলেন, কপিঞ্জল! আমি চন্দ্রমা, জগতের হিতের নিমিত্ত গগনমণ্ডলে উদিত হইয়া স্বকার্য্য সম্পাদন করিতেছিলাম। তোমার এই প্রিয় বয়স্য বিরহবেদনায় প্রাণত্যাগ করিবার সময় বিনাপরাধে আমাকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “রে দুরাত্মন্! যেহেতু তুই কর দ্বারা সন্তাপিত করিয়া বল্লভার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত এই ব্যক্তির প্রাণ বিনাশ করিলি, এই অপরাধে তোকে ভূতলে বারংবার জন্ম গ্রহণ করিতে হইবেক এবং আমার ন্যায় অনুরাগপরবশ হইয়া প্রিয়বিয়োগে দুঃসহ যন্ত্রণা অনুভব করিতে হইবেক।” বিনাপরাধে শাপ দেওয়াতে আমি ক্রোধান্ধ হইলাম, এবং বৈরনির্য্যাতনের নিমিত্ত এই বলিয়া প্রতিশাপ প্রদান করিলাম, “রে মূঢ়! তুই এবার যেরূপ যাতনা ভোগ করিলি, বারংবার তোকে এইরূপ যাতনা ভোগ করিতে হইবেক।” ক্রোধ শান্তি হইলে ধ্যান করিয়া দেখিলাম, আমার কিরণ হইতে অপ্সরাদিগের যে কুল উৎপন্ন হয়, সেই কুলে গৌরীনাম্নী গন্ধর্ব্বকুমারী জন্ম গ্রহণ করেন; তাঁহার দুহিতা মহাশ্বেতা এই মুনিকুমারকে পতি রূপে বরণ করিয়াছে। তখন সাতিশয় অনুতাপ হইল। কিন্তু শাপ দিয়াছি আর উপায় কি? এক্ষণে উভয়ের পাপে উভয়কেই মর্ত্ত্যলোকে দুই বার জন্ম গ্রহণ করিতে হইবেক, সন্দেহ নাই। যাবৎ পাপের অবসান না হয়, তাবৎ তোমার বন্ধুর মৃত দেহ এই স্থানে থাকিবেক। আমার সুধাময় করস্পর্শে ইহা বিকৃত হইবেক না। শাপাবসানে এই শরীরেই পুনর্ব্বার প্রাণসঞ্চার হইবেক, এই নিমিত্ত ইহা এখানে আনিয়াছি। মহাশ্বেতাকেও আশ্বাস প্রদান করিয়া আসিয়াছি। তুমি এখানে মহর্ষি শ্বেতকেতুর নিকটে গিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিশেষ করিয়া তাঁহার সমক্ষে বর্ণন কর। তিনি মহাপ্রভাব, অবশ্য কোন প্রতিকার করিতে পারিবেন।

চন্দ্রমার আদেশানুসারে আমি দেবমার্গ গিয়া শ্বেতকেতুর নিকট যাইতেছিলাম। পথিমধ্যে অতি কোপনস্বভাব এক বিমানচারীর উল্লঙ্ঘন করাতে তিনি ভ্রূকুটীভঙ্গী দ্বারা রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক আমার প্রতি নেত্রপাত করিলেন। তাঁহার আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, রোষানলে আমাকে দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন! অনন্তর “দুরাত্মন্! তুই মিথ্যা তপোবলে গর্ব্বিত হইয়াছিস, তুরঙ্গমের ন্যায় লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক আমায় উল্লঙ্ঘন করিলি। অতএব তুরঙ্গম হইয়া ভূতলে জন্মগ্রহণ কর!” তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক এই বলিয়া শাপ প্রদান করিলেন। আমি বাষ্পাকুল নয়নে কৃতাঞ্জলিপুটে নানা অনুনয় করিয়া কহিলাম, ভগবন্! বয়স্যের বিরহ শোকে অন্ধ হইয়া এই দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি, অবজ্ঞা প্রযুক্ত করি নাই। এক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। প্রসন্ন হইয়া, শাপ সংহার করুন। তিনি কহিলেন, আমার শাপ অন্যথা হইবার নহে। তুমি ভূতলে তুরঙ্গম রূপে অবতীর্ণ হইয়া যাহার বাহন হইবে, তাহার মরণান্তে স্নান করিয়া আপনার স্বরূপ প্রাপ্ত হইবে। আমি বিনয় পূর্ব্বক পুনর্ব্বার কহিলাম, ভগবন্! শাপদোষে চন্দ্রমা মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিবেন। আমি যেন তাঁহারই বাহন হই। তিনি ধ্যান প্রভাবে সমুদায় অবগত হইয়া কহিলেন, “হাঁ, উজ্জয়িনী নগরে তারাপীড় রাজা অপত্যপ্রাপ্তির আশয়ে ধর্ম্ম কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছেন। চন্দ্রমা তাঁহারই অপত্য হইয়া ভূতলে অবতীর্ণ হইবেন। তোমার প্রিয় বয়স্য পুণ্ডরীক ঋষিও রাজমন্ত্রী শুকনাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন। তুমিও রাজকুমার রূপে অবতীর্ণ চন্দ্রের বাহন হইবে।” তাঁহার কথার অবসানে আমি সমুদ্রের প্রবাহে নিপতিত হইলাম ও তুরঙ্গরূপ ধারণ করিয়া তীরে উঠিলাম। তুরঙ্গম হইলাম বটে, কিন্তু আমার জন্মান্তরীণ সংস্কার বিনষ্ট হইল না। আমিই চন্দ্রাপীড়কে কিন্নরমিথুনের অনুগামী করিয়া এই স্থানে আনিয়াছিলাম। চন্দ্রাপীড় চন্দ্রের অবতার। যিনি জন্মান্তরীণ অনুরাগের পরতন্ত্র হইয়া তোমার প্রণয়াভিলাষে এই প্রদেশে আসিয়াছিলেন ও তোমার শাপে বিনষ্ট হইয়াছেন, তিনি আমার প্রিয় বয়স্য পুণ্ডরীকের অবতার।

মহাশ্বেতা কপিঞ্জলের কথা শুনিয়া, হা দেব! জন্মান্তরেও তুমি আমার প্রণয়ানুরাগ বিস্মৃত হইতে পার নাই। আমারই অন্বেষণ করিতে করিতে এই স্থানে আগমন করিয়াছিলে; আমি নৃশংসা রাক্ষসী বারংবার তোমার বিনাশের হেতুভূত হইলাম। দগ্ধবিধি আমাকে আপন প্রয়োজন সম্পাদনের সাধন করিবে বলিয়াই কি এত দীর্ঘ পরমায়ু প্রদান পূর্ব্বক আমার নির্ম্মাণ করিয়াছিল! কপিঞ্জল প্রবোধবাক্যে কহিলেন, গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রি! শাপদোষে সেই সেই ঘটনা হইয়াছে, তোমার দোষ কি? এক্ষণে যাহাতে পরিণামে শ্রেয়ঃ হয়, তাহার চেষ্টা পাও। যে ব্রত অঙ্গীকার করিয়াছ, তাহাতেই একান্ত অনুরক্ত হও। তপস্যার অসাধ্য কিছুই নাই। পার্ব্বতী যেরূপ তপস্যার প্রভাবে পশুপতির প্রণয়িনী হইয়াছেন, তুমিও সেইরূপ পুণ্ডরীকের সহধর্ম্মিণী হইবে, সন্দেহ করিও না। কপিঞ্জলের সান্ত্ত্বনাবাক্যে মহাশ্বেতা ক্ষান্ত হইলেন। কাদম্বরী বিষণ্ণ বদনে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্! পত্রলেখাও ইন্দ্রায়ুধের সহিত জলপ্রবেশ করিয়াছিল। শাপগ্রস্ত ইন্দ্রায়ুধরূপ পরিত্যাগ করিয়া আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু পত্রলেখা কোথায় গেল, শুনিতে অতিশয় কৌতুক জন্মিয়াছে, অনুগ্রহ করিয়া ব্যক্ত করুন। কপিঞ্জল কহিলেন, জলপ্রবেশানন্তর যে যে ঘটনা হইয়াছে তাহা আমি অবগত নহি। চন্দ্রের অবতার চন্দ্রাপীড় ও পুণ্ডরীকের অবতার বৈশম্পায়ন কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং পত্রলেখা কোথা গিয়াছে, জানিবার নিমিত্ত কালত্রয়দর্শী ভগবান্ শ্বেতকেতুর নিকট গমন করি। এই বলিয়া কপিঞ্জল গগনমার্গে উঠিলেন।

তিনি প্রস্থান করিলে রাজপরিজনেরা বিস্ময়ে শোক সন্তাপ বিস্মৃত হইল। চন্দ্রাপীড়ের ও বৈশম্পায়নের পুনরুজ্জীবন পর্য্যন্ত এই স্থানে থাকিতে হইবেক স্থির করিয়া বাসস্থান নিরূপণ করিল ও তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিল। কাদম্বরী মহাশ্বেতাকে কহিলেন, প্রিয়সখি! বিধাতা এই হতভাগিনীদিগকে দুঃখের সমান অংশভাগিনী করিয়া পরস্পর দৃঢ়তর সখ্যবন্ধন করিয়া দিলেন। আজি তোমাকে প্রিয়সখী বলিয়া সম্বোধন করিতে লজ্জা বোধ হইতেছে না। ফলতঃ এত দিনের পর আজি আমি তোমার যথার্থ প্রিয়সখী হইলাম। এক্ষণে কর্ত্তব্য কি উপদেশ দাও। কি করিলে শ্রেয়ঃ হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। মহাশ্বেতা উত্তর করিলেন, প্রিয়সখি! কি উপদেশ দিব! আশাকে কেহ অতিক্রম করিতে পারে না। আশা লোকদিগকে যে পথে লইয়া যায়, লোকেরা সেই পথে যায়। আমি কেবল কথামাত্রের আশ্বাসে প্রাণত্যাগ করিতে পারি নাই। তুমি ত কপিঞ্জলের মুখে সমুদায় বৃত্তান্ত বিশেষ রূপে অবগত হইলে। যাবৎ চন্দ্রাপীড়ের শরীর অবিকৃত থাকে, তাবৎ ইহার রক্ষণাবেক্ষণ কর। শুভ ফল প্রাপ্তির আশয়ে লোকে অপ্রত্যক্ষ দেবতার কাষ্ঠময়, মৃন্ময়, প্রস্তরময় প্রতিমাও পূজা করিয়া থাকে। তুমি ত প্রত্যক্ষ দেবতা চন্দ্রমার সাক্ষাৎ মূর্ত্তি লাভ করিয়াছ। তোমার ভাগ্যের পরিসীমা নাই এক্ষণে যত্ন পূর্ব্বক রক্ষা ও ভক্তিভাবে পরিচর্য্যা কর।

মদলেখা ও তরলিকা ধরাধরি করিয়া শীত, বাত, আতপ ও বৃষ্টির জল না লাগে এমন স্থানে, এক শিলার উপরে চন্দ্রাপীড়ের মৃত দেহ আনিয়া রাখিল। যিনি নানা বেশভূষায় ভূষিত হইয়া হর্ষোৎফুল্ল লোচনে প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে এক্ষণে দীন বেশে ও দুঃখিত চিত্তে তপস্বিনীর আকার অঙ্গীকার করিতে হইল! বিকসিত কুসুম, সুগন্ধি চন্দন, সুরভি ধূপ, যাহা উপভোগের প্রধান সামগ্রী ছিল, তাহা এক্ষণে দেবার্চ্চনায় নিযুক্ত হইল। এক্ষণে নির্ঝরবারি দর্পণ, গিরিগুহা গৃহ, লতা সখী, বৃক্ষগণ রক্ষক, তরুশাখা চন্দ্রাতপ ও কেকারব তন্ত্রীঝঙ্কার হইল। দূর হইতে আগমন করাতে ও সহসা সেই দুঃসহ শোকানলে পতিত হওয়াতে কাদম্বরীর কণ্ঠ শুষ্ক হইয়াছিল; তথাপি পান ভোজন কিছুই করিলেন না। সরোবরে স্নান করিয়া পবিত্র দুকূল পরিধান করিলেন এবং প্রিয়তমের পাদদ্বয় অঙ্কে ধারণ করিয়া দিবস অতিবাহিত করিলেন। রজনী সমাগত হইল। একে বর্ষাকাল, তাহাতে অন্ধকারাবৃত রজনী। চতুর্দ্দিকে মেঘ, মূষলধারে বৃষ্টি, ক্ষণে ক্ষণে বজ্রের নির্ঘাত ও মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের দুঃসহ আলোক। খদ্যোতমালা অন্ধকারাচ্ছন্ন তরুমণ্ডলীকে আবৃত করিয়া আরও ভয়ঙ্কর করিল। গিরিনির্ঝরের পতনশব্দ, ভেকের কোলাহল ও ময়ূরের কেকারবে বন আকুল হইল। কিছুই দেখা যায় না। কিছুই কর্ণগোচর হয় না। কি ভয়ানক সময়! এ সময়ে জনপদবাসী সাহসী পুরুষের মনেও ভয়সঞ্চার হয়; কিন্ত কাদম্বরী সেই অরণ্যে প্রিয়তমের মৃতদেহ সম্মুখে রাখিয়া সেই ভয়ঙ্করী বর্ষাবিভাবরী যাপিত করিলেন।

প্রভাতে অরুণ উদিত হইলে প্রিয়তমের শরীরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিছুমাত্র বিশ্রী হয় নাই; বরং অধিক উজ্জ্বল বোধ হইতেছে। তখন আহ্লাদিত চিত্তে মদলেখাকে কহিলেন, মদলেখে! দেখ, দেখ! প্রাণেশ্বরের শরীর যেন সজীব বোধ হইতেছে। মদলেখা নিমেষশূন্য নয়নে অনেক ক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! জীবনবিরহে এই দেহ কেবল চেষ্টাশূন্য; নতুবা সেই রূপ, সেই লাবণ্য, কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই। কপিঞ্জল যে শাপবিবরণ বর্ণন করিয়া গেলেন এবং আকাশবাণী দ্বারা যাহা ব্যক্ত হইয়াছে, তাহা সত্য, সংশয় নাই। কাদম্বরী আনন্দিত মনে মহাশ্বেতাকে, তদনন্তর চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গিগণকে সেই শরীর দেখাইলেন। সঙ্গিগণ বিস্ময়বিকসিত নয়নে যুবরাজের শরীরশোভা দেখিতে লাগিল। কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, দেবি! মৃত দেহ অবিকৃত থাকে, ইহা আমরা কখন দেখি নাই, শ্রবণও করি নাই। ইহা অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার সন্দেহ নাই। এক্ষণে আপনার প্রভাববলে ও তপস্যার ফলে যুবরাজ পুনর্জীবিত হইলে সকলে চরিতার্থ হই। পর দিনও সেইরূপ উজ্জ্বল শরীরসৌষ্ঠব দেখিয়া আকাশবাণীর কোন অংশে আর সংশয় রহিল না। তখন কাদম্বরী কহিলেন, মদলেখে! আশার শেষ পর্য্যন্ত এই স্থানে অবস্থিতি করিতে হইবেক। অতএব তুমি বাটী যাও ও এই বিস্ময়াবহ ব্যাপার পিতা মাতার কর্ণগোচর কর। তাঁহারা যাহাতে বিরূপ না ভাবেন, দুঃখিত না হন এবং এখানে না আইসেন, এরূপ করিও। এখানে আসিলে তাঁহাদিগকে দেখিয়া শোকাবেগ ধারণ করিতে পারিব না। সেই বিষম সময়ে অমঙ্গলভয়ে আমার নেত্রযুগল হইতে অশ্রুজল বহির্গত হয় নাই। এক্ষণে জীবিতনাথের পুনঃপ্রাপ্তিবিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধচিত্ত হইয়াও কেন বৃথা রোদন দ্বারা প্রিয়তমের অমঙ্গল ঘটাইব? এই বলিয়া মদলেখাকে বিদায় করিলেন।

মদলেখা গন্ধর্ব্বনগর হইতে প্রত্যাগত হইয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! তোমার অভীষ্টসিদ্ধি হইয়াছে। মহারাজ ও মহিষী আদ্যোপান্ত সমুদায় শ্রবণ করিয়া সস্নেহে কহিলেন, “বৎসে কাদম্বরি! চন্দ্রসমীপবর্ত্তিনী রোহিণীর ন্যায় তোমাকে জামাতার পার্শ্ববর্ত্তিনী দেখিব ইহা মনে প্রত্যাশা ছিল না। স্বাভিলষিত ভর্ত্তাকে স্বয়ং বরণ করিয়াছ, তিনি আবার চন্দ্রমার অবতার শুনিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলাম। শাপাবসানে জামাতা জীবিত হইলে, তাঁহার সহচারিণী তোমাকে দেখিয়া জীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিব। এক্ষণে আকাশবাণীর অনুসারে ধর্ম্ম কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। যাহাতে পরিণামে শ্রেয়ঃ হয় তাহার উপায় দেখ।” মদলেখার মুখে পিতা মাতার স্নেহ সংবলিত মধুর বাক্য শুনিয়া কাদম্বরীর উদ্বেগ দূর হইল।

ক্রমে বর্ষাকাল গত ও শরৎকাল আগত হইল। মেঘের অপগমে দিঙ্মণ্ডল যেন প্রসারিত হইল। মার্তণ্ড প্রচণ্ড কিরণদ্বারা পঙ্কময় পথ শুষ্ক করিয়া দিলেন। নদ, নদী, সরোবর ও পুষ্করিণীর কলুষিত সলিল নির্ম্মল হইল। মরালকুল নদীর সিকতাময় পুলিনে সুমধুর কলরব করিয়া কেলি করিতে লাগিল। গ্রামসীমায় পিঙ্গল কলমঞ্জরী ফলভরে অবনত হইল। শুকসারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণ ধান্যশীষ মুখে করিয়া শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গগনের উপরিভাগে অপূর্ব্ব শোভা বিস্তার করিল। কাশকুসুম বিকসিত হইল। ইন্দীবর, কহ্লার শেফালিকা প্রভৃতি নানা কুসুমের গন্ধযুক্ত বিশদবারিশীকরসম্পৃক্ত সমীরণ মন্দ মন্দ সঞ্চারিত হইয়া জীবগণের মনে আহ্লাদ জন্মিয়া দিল। সকল অপেক্ষা শশধরের প্রভা ও কমলবনের শোভা উজ্জ্বল হইল। এই কাল কি রমণীয়! লোকের গতায়াতের কোন ক্লেশ থাকে না। যে দিকে নেত্রপাত করা যায়, ধান্যমঞ্জরীর শোভা নয়ন ও মনকে পরিতৃপ্ত করে। জল দেখিলে আহ্লাদ জন্মে! চন্দ্রোদয়ে রজনীর সাতিশয় শোভা হয়। নভোমণ্ডল সর্ব্বদা নির্ম্মল থাকে। ভীষণ বর্ষাকালের অপগমে শরৎকালের মনোহর শোভা দেখিয়া কাদম্বরীর দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তও অনেক সুস্থ হইল।

একদা মেঘনাদ আসিয়া কহিল, দেবি! যুবরাজের বিলম্ব হওয়াতে মহারাজ, মহিষী ও মন্ত্রী অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া অনেক দূত পাঠাইয়াছেন। আমরা তাহাদিগকে সমুদায় বৃত্তান্ত শ্রবণ করাইয়া বাটী যাইতে অনুরোধ করাতে কহিল, আমরা এক বার যুবরাজের অবিকৃত আকৃতি দেখিতে অভিলাষ করি। এতদূর আসিয়া যদি তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে দেখিয়া না যাই, মহারাজ কি বলিবেন, মহিষীকে কি বলিয়া বুঝাইব? এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন। উপস্থিত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলে শ্বশুরকুলে শোক তাপের পরিসীমা থাকিবে না। এই চিন্তা করিয়া কাদম্বরী অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলেন। বাস্পালকু [sic: বাস্পাকুল] লোচনে গদ্গদ বচনে কহিলেন, হাঁ, তাহারা অযুক্ত কথা কহে নাই। যে অদ্ভুত, অলৌকিক ব্যাপার উপস্থিত, ইহা স্বচক্ষে দেখিলেও প্রত্যয় হয় না। না দেখিয়া মহারাজের নিকটে গিয়া তাহারা কি বলিবে? কি বলিয়াই বা মহিষীকে বুঝাইবে? যাঁহাকে ক্ষণমাত্র অবলোকন করিলে আর বিস্মৃত হইতে পারা যায় না, ভৃত্যেরা তাঁহার চিরকালীন স্নেহ কি রূপে বিস্মৃত হইবে? শীঘ্র তাহাদিগকে আনয়ন কর। যুবরাজের অবিকৃত শরীরশোভা দেখিয়া তাহাদিগের আগমনশ্রম সফল হউক। অনন্তর দূতগণ আশ্রমে প্রবেশিয়া কাদম্বরীকে প্রণাম করিল। সজল নয়নে রাজকুমারের অঙ্গসৌষ্ঠব দেখিতে লাগিল। কাদম্বরী কহিলেন, তোমরা স্নেহসুলভ শোকাবেগ পরিত্যাগ কর। নিরবধি দুঃখকেই দুঃখ বলিয়া গণনা করা উচিত; কিন্তু ইহা সেরূপ নয়, ইহাতে পরিণামে মঙ্গলের প্রত্যাশা আছে। এই বিস্ময়কর ব্যাপারে শোকের অবসর নাই। এরূপ ঘটনা কেহ কখন দেখে নাই, শ্রবণও করে নাই। প্রাণবায়ু প্রয়াণ করিলে শরীর অবিকৃত থাকে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয়। এক্ষণে তোমরা প্রতিগমন কর। এবং উৎকণ্ঠিতচেতা মহারাজকে এইমাত্র বলিও যে, আমরা অচ্ছোদসরোবরে যুবরাজকে দেখিয়া আসিতেছি। উপস্থিত ঘটনা প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই। প্রকাশ করিলে মহারাজের কখন বিশ্বাস হইবে না, প্রত্যুত শোকে তাঁহার প্রাণ বিগমের সম্ভাবনা।

দূতেরা কহিল, দেবি! হয় আমরা না যাই, অথবা গিয়া না বলি, ইহা হইলে এই ব্যাপার অপ্রকাশিত থাকিতে পারে; কিন্তু দুই অসম্ভব। বৈশম্পায়নের অন্বেষণ করিতে আসিয়া যুবরাজের বিলম্ব হওয়াতে মহারাজ অতিশয় ব্যাকুল হইয়া আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন। আমরা না যাইলে বিষম অনর্থ ঘটিবার সম্ভাবনা। গিয়া তনয়বার্ত্তাশ্রবণলালস মহারাজ, মহিষী ও শুকনাসের উৎকণ্ঠিত বদন অবলোকন করিলে নির্ব্বিকার চিত্তে স্থির হইয়া থাকিতে পারিব, ইহাও অসম্ভব। কাদম্বরী কহিলেন, হাঁ অলীক কথায় প্রভুকে প্রতারণা করাও পরিচিত ব্যক্তির উচিত নয়, তাহা বুঝিয়াছি। কিন্তু গুরুজনের মনঃপীড়া পরিহারের আশয়ে ঐরূপ বলিয়াছিলাম। যাহা হউক মেঘনাদ! দূতদিগের সমভিব্যাহারে এরূপ একটী বিশ্বস্ত লোক পাঠাইয়া দেও, যে সমুদায় ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং বিশেষরূপে সমুদায় বিবরণ বলিতে পারিবে। মেঘনাদ কহিল, দেবি! আমরা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, যত দিন যুবরাজ পুনর্জ্জীবিত না হইবেন তাবৎ বন্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া বনে বাস করিব; কদাচ পরিত্যাগ করিয়া যাইব না। সেই ভৃত্যেই ভৃত্য, যে সম্পৎকালের ন্যায় বিপৎকালেও প্রভুর সহবাসী হয়। কিন্তু আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করাও আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম। এই বলিয়া ত্বরিতকনামা এক বিশ্বস্ত সেবককে ডাকাইয়া দূতগণের সমভিব্যাহারে রাজধানী পাঠাইয়া দিল।

এ দিকে মহিষী বহুদিবস চন্দ্রাপীড়ের সংবাদ না পাইয়া অতিশয় উদ্বিগ্ন ছিলেন। একদা উপযাচিতক করিতে দেবমন্দিরে সমাগত হইয়াছেন এমন সময়ে, পরিজনেরা আসিয়া কহিল, দেবি! দেবতারা বুঝি এতদিনে প্রসন্ন হইলেন; যুবরাজের সংবাদ আসিয়াছে। পরিজনের মুখে এই কথা শুনিয়া মহিষীর নয়ন আনন্দবাস্পে পরিপ্লুত হইল। শাবকভ্রষ্ট হরিণীর ন্যায় চতুর্দ্দিকে চঞ্চল চক্ষু নিক্ষেপ করিয়া গদ্গদ বচনে কহিলেন, কই কে আসিয়াছে? এরূপ শুভ সংবাদ কে শুনাইল? বৎস চন্দ্রাপীড় ত কুশলে আছেন? মনের ঔৎসুক্য প্রযুক্ত এই কথা বারংবার বলিতে বলিতে স্বয়ং বার্ত্তাবহদিগের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন। সজল নয়নে কহিলেন, বৎস! শীঘ্র চন্দ্রাপীড়ের কুশল সংবাদ বল। আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে। চন্দ্রাপীড়কে তোমরা কোথায় দেখিলে? তিনি কেমন আছেন শীঘ্র বল। তাহারা মহিষীর কাতরতা দেখিয়া অত্যন্ত শোকাকুল হইল এবং প্রণামব্যপদেশে নেত্রজল মোচন করিয়া কহিল, আমরা আচ্ছোদসরোবরতীরে যুবরাজকে দেখিয়াছি। অন্যান্য সংবাদ এই ত্বরিতক নিবেদন করিতেছে, শ্রবণ করুন।

মহিষী তাহাদিগের বিষণ্ণ আকার দেখিয়াই অমঙ্গল সম্ভাবনা করিতেছিলেন, তাহাতে আবার, ত্বরিতক আর আর সংবাদ নিবেদন করিতেছে, এই কথা শুনিয়া বিষণ্ণ হইয়া ভূতলে পড়িলেন। শিরে করাঘাত পূর্ব্বক হা হতাস্মি বলিয়া বিলাপ করিয়া কহিলেন, ত্বরিতক আর কি বলিবে? তোমাদিগের বিষণ্ণ বদন, কাতর বচন ও হর্ষশূন্য আগমনেই সকল ব্যক্ত হইয়াছে। হা বৎস! জগদেকচন্দ্র! চন্দ্রানন! তোমার কি ঘটিয়াছে? কেন তুমি বাটী আসিলে না? শীঘ্র আসিব বলিয়া গেলে কই তোমার সে কথা কোথায় রহিল? কখন আমার নিকট মিথ্যা বল নাই এবারে কেন প্রতারণা করিলে? তোমার যাত্রার সময় আমার অন্তঃকরণে শঙ্কা হইয়াছিল, বুঝি সেই শঙ্কা সত্য হইল। তোমার সেই প্রফুল্ল মুখ আর দেখিতে পাইব না! তুমি কি এক বারে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছ? বস এক বার আসিয়া আমার অঙ্কের ভূষণ হও এবং মধুর স্বরে মা বলিয়া ডাকিয়া কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ কর। এই হতভাগিনীকে মা বলিয়া সম্বোধন করে, এমন আর নাই। তুমি কখন আমার কথা উল্লঙ্ঘন কর নাই, এক্ষণে আমার কথা শুনিতেছ না কেন? কি জন্য উত্তর দিতেছ না? তুমি এমন বিবেচনা করিও না যে, বিলাসবতী চন্দ্রাপীড়ের অস্তগমনেও জীবন ধারণ করিবে। ত্বরিতকের মুখে তোমার সংবাদ শুনিতে ভয় হইতেছে। উহা যেন শুনিতে না হয়। এই বলিয়া মহিষী মোহ প্রাপ্ত হইলেন।

বিলাসবতী দেবমন্দিরে মোহ প্রাপ্ত হইয়া পড়িয়া আছেন, শুনিয়া মহারাজ অতিশয় চঞ্চল ও ব্যাকুল হইলেন। শুকনাসের সহিত তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, কেহ কদলীদল দ্বারা বীজন, কেহ জলসেচন, কেহ বা শীতল পাণিতল দ্বারা মহিষীর গাত্রস্পর্শ করিতেছে। ক্রমে মহিষীর চৈতন্যোদয় হইল এবং মুক্ত কণ্ঠে হা হতাস্মি বলিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজা প্রবোধবাক্যে কহিলেন, দেবি! যদি চন্দ্রাপীড়ের অত্যহিত ঘটিয়া থাকে, রোদন দ্বারা তাহার কি প্রতিকার হইবে? বিশেষতঃ সমুদায় বৃত্তান্ত শ্রবণ করা হয় নাই। অগ্রে বিশেষ রূপে সমুদায় শ্রবণ করা যাউক, পরে যাহা কর্ত্তব্য, করা যাইবেক। এই বলিয়া ত্বরিতককে ডাকাইলেন। জিজ্ঞাসিলেন, ত্বরিতক! চন্দ্রাপীড় কোথায় কিরূপ আছেন? বাটী আসিবার নিমিত্ত পত্র লিখিয়াছিলাম, আসিলেন না কেন? কি উত্তর দিয়াছেন? ত্বরিতক, যুবরাজের বাটী হইতে গমন অবধি হৃদয়বিদারণ পর্য্যন্ত সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিল। রাজা আর শুনিতে না পারিয়া আর্ত্তস্বরে বারণ করিয়া কহিলেন, ক্ষান্ত হও — ক্ষান্ত হও! আর বলিতে হইবে না। যাহা শুনিবার শুনিলাম। হা বৎস! হৃদয়বিদারণের ক্লেশ তুমিই অনুভব করিলে। বন্ধুর প্রতি যেরূপ প্রণয় প্রকাশ করিতে হয়, তাহার দৃষ্টান্ত পথে দণ্ডায়মান হইয়া পৃথিবীর প্রশংসাপাত্র হইলে। স্নেহ প্রকাশের নবীন পথ উদ্ভাবিত করিলে। তুমিই সার্থকজন্মা মহাপুরুষ। আমরা পাপিষ্ঠ, নির্দ্দয়, নরাধম। যেন কৌতুকাবহ উপন্যাসের ন্যায় এই দুর্ব্বিষহ দারুণ বৃত্তান্ত অবলীলাক্রমে শুনিলাম, কই কিছুই হইল না। অরে ভীরু প্রাণ! ব্যাকুল হইতেছিস্ কেন? যদি স্বয়ং বহির্গত না হইস্ এবার বলপূর্ব্বক তোকে বহির্গত করিব। দেবি! প্রস্তুত হও, এ সময় কালক্ষেপের সময় নয়। চন্দ্রাপীড় একাকী যাইতেছেন, শীঘ্র তাঁহার সঙ্গী হইতে হইবে। আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। আঃ হতভাগ্য শুকনাস! এখনও বিলম্ব করিতেছ? প্রাণপরিত্যাগের এরূপ সময় আর কবে পাইবে? এই বেলা চিতা প্রস্তুত কর। প্রজ্জ্বলিত অনলশিখা আলিঙ্গন করিয়া তাপিত অঙ্গ শীতল করা যাউক। ত্বরিতক সভয়ে বিনীত বচনে নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি যেরূপ সম্ভাবনা ও শঙ্কা করিতেছেন সেরূপ নয়। যুবরাজের শরীর প্রাণবিযুক্ত হইয়াছে; কিন্তু অনির্ব্বচনীয় ঘটনাবশতঃ অবিকৃত আছে। এই বলিয়া আকাশবাণীর সমুদায় বিবরণ, ইন্দ্রায়ুধের কপিঞ্জলরূপ ধারণ ও শাপবৃত্তান্ত অবিকল বর্ণন করিল। উহা শ্রবণ করিয়া রাজার শোক বিস্ময়রসে পরিণত হইল। তখন বিস্মিত নয়নে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

স্বয়ং শোকার্ণবে নিমগ্ন হইয়াও শুকনাস ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক সাক্ষাৎ জ্ঞানরাশির ন্যায় রাজাকে বুঝাইতে লাগিলেন। কহিলেন, মহারাজ! বিচিত্র এই সংসারে প্রকৃতির পরিণাম, জগদীশ্বরের ইচ্ছা, শুভাশুভ কর্ম্মের পরিপাক অথবা স্বভাববশতঃ নানাপ্রকার কার্য্যের উৎপত্তি হয় ও নানাবিধ ঘটনা উপস্থিত হইয়া থাকে। শাস্ত্রকারেরা এরূপ অনেক ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন, যাহা যুক্তি ও তর্কশক্তিতে আপাততঃ অলীক রূপে প্রতীয়মান হয়; কিন্তু বস্তুতঃ তাহা মিথ্যা নহে। ভুজঙ্গদষ্ট ও বিষবেগে অভিভূত ব্যক্তি মন্ত্রপ্রভাবে জাগরিত ও বিষমুক্ত হয়। যোগপ্রভাবে যোগীরা সকল ভূমণ্ডল করতলস্থিত বস্তুর ন্যায় দেখিতে পান। ধ্যানপ্রভাবে লোক অনেক কাল জীবিত থাকে। ইহার প্রমাণ আগম, রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি সমুদায় পুরাণে অনেকপ্রকার শাপবৃত্তান্তও বর্ণিত আছে। নহুষ রাজর্ষি অগস্ত্য ঋষির শাপে অজগর হইয়াছিলেন। বশিষ্ঠমুনির পুত্রের শাপে সৌদাস রাক্ষস হয়েন। শুক্রাচার্য্যের শাপে যযাতির যৌবনাবস্থায় জরা উপস্থিত হয়। পিতৃশাপে ত্রিশঙ্কু চণ্ডালকুলে জন্মপরিগ্রহ করেন। অধিক কি, জন্মমরণরহিত ভগবান্ নারায়ণও কখন জমদগ্নির আত্মজ, কখন বা রঘুবংশে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কখন বা মানবের ঔরসে জন্মপরিগ্রহ করিয়া লীলা প্রচার করিয়া থাকেন। অতএব মনুষ্যলোকে দেবতাদিগের উৎপত্তি অলীক বা অসম্ভব নয়। আপনি পূর্ব্বকালীন নৃপগণ অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহেন। চন্দ্রমাও চক্রপাণি অপেক্ষা সমধিক ক্ষমতাবান্ নহেন। তিনি শাপদোষে মহারাজের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন, ইহা নিতান্ত আশ্চর্য্য নয়। বিশেষতঃ স্বপ্নবৃত্তান্ত বিবেচনা করিয়া দেখিলে আর কিছুই সন্দেহ থাকে না। মহিষীর গর্ভে পূর্ণ শশধর প্রবেশ করিতেছে আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন। আমিও স্বপ্নে পুণ্ডরীক দেখিয়াছিলাম। অমৃতদীধিতির অমৃতের প্রভাব ভিন্ন বিনষ্ট দেহের অবিকার কিরূপে সম্ভবে? এক্ষণে ধৈর্য্য অবলম্বন করুন। শাপও পরিণামে আমাদিগের বর হইবে। আমাদের সৌভাগ্যের পরিসীমা নাই। শাপাবসানে বধূসমেত চন্দ্রাপীড়রূপধারী ভগবান্ চন্দ্রমার মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন সার্থক হইবে। এ সময় অভ্যুদয়ের সময় শোকতাপের সময় নয় এক্ষণে পুণ্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান করুন, শীঘ্র শ্রেয়ঃ হইবে। কর্ম্মের অসাধ্য কিছুই নাই।

শুকনাস এত বুঝাইলেন, কিন্তু রাজার শোকাচ্ছন্ন মনে প্রবোধের উদয় হইল না। তিনি কহিলেন, শুকনাস! তুমি যাহা বলিলে যুক্তিসিদ্ধ বটে, আমার মন প্রবোধ মানিতেছে না। আমিই যখন ধৈর্য্য অবলম্বন করিতে সমর্থ নহি, মহিষী স্ত্রীলোক হইয়া কি রূপে শোকাবেগ পরিত্যাগ করিবেন। চল, আমরা তথায় যাই, স্বচক্ষে চন্দ্রাপীড়ের অবিকৃত অঙ্গশোভা অবলোকন করি। তাহা হইলে শোকের কিছু শৈথিল্য হইতে পারে। মহিষী কহিলেন, তবে আর বিলম্ব করা নয়। শীঘ্র যাইবার উদ্যোগ করা যাউক। এমন সময়ে এক জন বৃদ্ধ আসিয়া কহিল, দেবি! চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়নের নিকট হইতে লোক আসিয়াছে, সংবাদ কি জানিবার নিমিত্ত মনোরমা এই মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে দণ্ডায়মান আছেন। মনোরমার আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া নরপতি অতিশয় শোকাকুল হইলেন। বাস্পাকুল নয়নে কহিলেন, দেবি! তুমি স্বয়ং গিয়া সমুদায় বৃত্তান্ত তাঁহার কর্ণগোচর কর এবং প্রবোধবাক্যে বুঝাইয়া কহ যে, তিনি আমাদিগের সমভিব্যাহারে তথায় যাইবেন। গমনের সমুদায় আয়োজন হইল। রাজা, মহিষী, মন্ত্রী, মন্ত্রিপত্নী, সকলে চলিলেন। নগরবাসী লোকেরা কেহ বা নরপতির প্রতি অনুরাগবশতঃ কেহ বা চন্দ্রাপীড়ের প্রতি স্নেহযুক্ত, কেহ বা আশ্চর্য্য দেখিবার নিমিত্ত সুসজ্জ হইয়া অনুগমন করিতে প্রস্তুত হইল। রাজা তাহাদিগকে নানাপ্রকার বুঝাইয়া ক্ষান্ত করিলেন। কেবল পরিচারকেরা সঙ্গে চলিল।

কিয়ৎদিন পরে অচ্ছোদ সরোবরের তীরে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার নিকট অগ্রে সংবাদ পাঠাইয়া পরে আপনারা আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। গুরুজনের আগমনে লজ্জিত হইয়া মহাশ্বেতা মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশিলেন। কাদম্বরী শোকে বিহ্বল হইয়া মূর্চ্ছাপন্ন হইলেন। নব কিসলয়ের ন্যায় কোমল শয্যায় শয়ন করিয়াও পূর্ব্বে যাঁহার নিদ্রা হইত না, তিনি এক্ষণে এক প্রস্তরের উপর পতিত হইয়া মহানিদ্রায় অভিভূত হইয়াছেন দেখিয়া, মহিষীর শোকের আর পরিসীমা রহিল না। বারংবার আলিঙ্গন, মুখচুম্বন ও মস্তক আঘ্রাণ করিয়া, হা হতাস্মি বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, দেবি! জন্মান্তরীণ পুণ্যফলে চন্দ্রাপীড়কে পুত্ত্ররূপে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম বটে; কিন্তু ইনি দেবমূর্ত্তি, এ সময়ে স্পর্শ করা উচিত নয়। পুত্ত্র কলত্রাদির বিরহই যাতনাবহ। আমরা স্বচক্ষে চন্দ্রাপীড়ের আনন্দজনক মুখচন্দ্র দেখিতে পাইলাম, আর দুঃখ সন্তাপ কি? যাঁহার প্রভাবে বৎস পুনর্জীবিত হইবেন, যাঁহার প্রভাবে পরিণামে শ্রেয়ঃ হইবে, এক্ষণে একমাত্র অবলম্বন, তোমার বধূ সেই গন্ধর্ব্বরাজপুত্ত্রী শোকে জ্ঞানশূন্যা হইয়াছেন দেখিতেছ না? যাহাতে ইঁহার চৈতন্যোদয় হয় তাহার চেষ্টা পাও! কই! বধূ কোথায়? বলিয়া রাণী সসম্ভ্রমে কাদম্বরীর নিকটে গেলেন এবং ধরিয়া তুলিয়া ক্রোড়ে বসাইলেন। বধূর মুখশশী মহিষী যত বার দেখেন ততই নয়নযুগল হইতে অশ্রুজল নির্গত হয়। তখন বিলাপ করিয়া কহিলেন, আহা! মনে করিয়াছিলাম চন্দ্রাপীড়ের বিবাহ দিয়া পুত্ত্রবধূ লইয়া পরম সুখে কালক্ষেপ করিব, কিন্তু জগদীশ্বরের কি বিড়ম্বনা, পরমপ্রীতিপাত্র সেই বধূর বৈধব্যদশা ও তপস্বিবেশ দেখিতে হইল। হায়! যাহাকে রাজভবনের অধিকারিণী করিব ভাবিয়াছিলাম, তাহাকে বনবাসিনী ও নিতান্ত দুঃখিনী দেখিতে হইল। এই বলিয়া বারংবার বধূর মুখ চুম্বন করিতে লাগিলেন। রাণীর অশ্রুজল ও পাণিতল স্পর্শে কাদম্বরীর চৈতন্যোদয় হইল। তখন নয়ন উন্মীলন পূর্ব্বক লজ্জায় অবনতমুখী হইয়া একে একে গুরুজনদিগকে প্রণাম করিলেন। বৈধব্যদশা শীঘ্র দূর হউক বলিয়া সকলে আশীর্ব্বাদ করিলেন। রাজা মদলেখাকে ডাকিয়া কহিলেন, বৎসে! তুমি বধূর নিকটে গিয়া কহ যে, আমরা কেবল দেখিবার পাত্র আসিয়া দেখিলাম। কিন্তু যেরূপ আচার করিতে হয় এবং এত দিন যেরূপ নিয়মে ছিলেন আমাদিগের আগমনে লজ্জার অনুরোধে যেন তাহার অন্যথা না হয়। বধূ যেন সর্ব্বদা বৎসের নিকটবর্ত্তিনী থাকেন। এই বলিয়া সঙ্গিগণ সমভিব্যাহারে আশ্রমের বহির্গত হইলেন।

আশ্রমের অনতিদূরে এক লতামণ্ডপে বাসস্থান নিরূপণ করিয়া সমুদায় নৃপতিগণকে ডাকাইয়া কহিলেন, ভ্রাতঃ! পূর্ব্বে স্থির করিয়াছিলাম, চন্দ্রাপীড়ের বিবাহ দিয়া তাঁহাকে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া, তৃতীয় আশ্রমে প্রবেশ করিব। এবং জগদীশ্বরের আরাধনায় শেষদশা অতিবাহিত হইবেক। আমার মনোরথ সফল হইল না বটে কিন্তু পুনর্ব্বার সংসারে প্রবেশ করিতে আস্থা নাই। তোমরা সহোদরতুল্য ও পরম সুহৃদ্। নগরে প্রতিগমন করিয়া সুশৃঙ্খল রূপে রাজ্য শাসন ও প্রজা পালন কর। আমি পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার উপায় চিন্তা করি। যাহারা পুত্ত্র কিংবা ভ্রাতার প্রতি সংসারভার সমর্পণ করিয়া চরমে পরমেশ্বরের আরাধনা করিতে পারে তাহারাই ধন্য ও সার্থকজন্মা। এই অকিঞ্চিৎকর মাংসপিণ্ডময় শরীর দ্বারা যৎকিঞ্চিৎ ধর্ম্ম উপার্জ্জন হইলেও পরম লাভ বলিতে হইবেক। ধর্ম্মসঞ্চয় ব্যতিরেকে পরলোকে পরিত্রাণের উপায়ান্তর নাই। তোমরা এক্ষণে বিদায় হও এবং আপন আপন আলয়ে গমন করিয়া সুখে রাজ্যভোগ কর। আমি এই স্থানেই জীবনক্ষেপ করিব, মানস করিয়াছি। এই বলিয়া সকলকে বিদায় করিলেন এবং তদবধি তপস্বিবেশে জগদীশ্বরের আরাধনায় অনুরক্ত হইলেন। তরুমূলে হর্ম্ম্যবুদ্ধি, হরিণশাবকে সুতস্নেহ সংস্থাপন পূর্ব্বক সস্ত্রীক শুকনাস সহিত প্রতি দিন চন্দ্রাপীড়ের মুখচন্দ্র দর্শন করিয়া সুখে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

মহর্ষি জাবালি এই রূপে কথা সমাপ্ত করিয়া হাস্য পূর্ব্বক মুনিকুমারদিগকে কহিলেন, দেখ! আমি অন্যমনস্ক হইয়া তোমাদিগের অভিপ্রেত উপাখ্যান অপেক্ষাও অধিক বলিলাম। যাহা হউক, যে মুনিতনয় মদনবাণে আহত হইয়া আত্মকৃত অবিনয় জন্য মর্ত্ত্যলোকে শুকনাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তদনন্তর মহাশ্বেতার শাপে তির্য্যগ্‌জাতিতে পতিত হন, তিনি এই। এই কথা বলিয়া অঙ্গুলি দ্বারা আমাকে নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন।

তাঁহার কথাবসানে জন্মান্তরীণ সমুদায় কর্ম্ম আমার স্মৃতিপথারূঢ় এবং পূর্ব্বজন্মশিক্ষিত সমুদায় বিদ্যা আমার জিহ্বাগ্রবর্ত্তিনী হইল। তদবধি মনুষ্যের ন্যায় সুস্পষ্ট কথা কহিতে লাগিলাম। বোধ হইল যেন, এত দিন নিদ্রিত ছিলাম, এক্ষণে জাগরিত হইলাম। কেবল মনুষ্যদেহ হইল না নতুবা চন্দ্রাপীড়ের প্রতি সেইরূপ স্নেহ, মহাশ্বেতার প্রতি সেইরূপ অনুরাগ এবং তাঁহার প্রাপ্তিবিষয়েও সেইরূপ ঔৎসুক্য জন্মিল। পক্ষোদ্ভেদ না হওয়াতে কেবল কায়িক চেষ্টা হইল না। পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মের সমুদায় বৃত্তান্ত স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে পিতা, মাতা, মহারাজ তারাপীড়, মহিষী বিলাসবতী, বয়স্য চন্দ্রাপীড় এবং প্রথম সুহৃদ্ কপিঞ্জল সকলেই এককালে আমার সমুৎসুক চিত্তে পদ প্রাপ্ত হইলেন। তখন আমার অন্তঃকরণ কিরূপ হইল কিছু বলিতে পারি না। অনেক ক্ষণ চিন্তা করিলাম, মনে কত ভাবোদয় হইতে লাগিল। মহর্ষি আমার অবিনয়ের পরিচয় দেওয়াতে তাঁহার নিকট লজ্জিত হইলাম। লজ্জায় অধোবদন হইয়া বিনয়বচনে জিজ্ঞাসিলাম, ভগবন্! আপনার অনুকম্পায় পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত আমার স্মৃতিপথবর্ত্তী হইয়াছে ও সমুদায় সুহৃদ্গণকে মনে পড়িয়াছে। কিন্তু উহা স্মরণ না হওয়াই ভাল ছিল। এক্ষণে বিরহবেদনায় প্রাণ যায়। বিশেষতঃ আমার মরণসংবাদ শুনিয়া যাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছিল, সেই চন্দ্রাপীড়ের অদর্শনে আর প্রাণ ধারণ করিতে পারি না। তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলিয়া দেন। আমি তির্য্যগ্‌জাতি হইয়াছি, তথাপি তাঁহার সহিত একত্র বাস করিলে আমার কোন ক্লেশ থাকিবে না। মহর্ষি আমার প্রতি নেত্রপাত পূর্ব্বক স্নেহ ও কোপগর্ভ বচনে কহিলেন, দুরাত্মন্! যে পথে পদার্পণ করিয়া তোর এত দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে, আবার সেই পথ অবলম্বন করিবার চেষ্টা পাইতেছিস্? অদ্যাপি পক্ষোদ্ভেদ হয় নাই, অগ্রে গমন করিবার সামর্থ হউক পরে তাহার জন্ম স্থান বলিয়া দিব।

তাত! প্রাণধারণ করিতে পারা না যায় এরূপ বিকার মুনিকুমারের মনে কেন সহসা সঞ্চারিত হইল? পরম পবিত্র দিব্য লোকে জন্মগ্রহণ করিয়া অত্যল্প পরমায়ুঃ কেন হইল? আমাদিগের অতিশয় বিস্ময় জন্মিয়াছে অনুগ্রহ পূর্ব্বক ইহার কারণ নির্দ্দেশ করিলে চরিতার্থ হই। হারীতের এই কথা শুনিয়া মহর্ষি কহিলেন, অপত্যোৎপাদন কালে মাতার যেরূপ মনোবৃত্তি থাকে, সন্তানও সেইরূপ মনোবৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়। পুণ্ডরীকের জন্মকালে লক্ষ্মী রিপুপরতন্ত্র হইয়াছিলেন; সুতরাং পুণ্ডরীক যে, রিপু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন ইহা আশ্চর্য্য নহে। শাস্ত্রকারেরা কহেন, কারণের গুণ কার্য্যে সংক্রামিত হয়। কিন্তু শাপাবসানে ইহার দীর্ঘ পরমায়ু হইবেক। আমি পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, ভগবন্! কিরূপে আমি দীর্ঘ পরমায়ুঃ প্রাপ্ত হই তাহার উপায় বলিয়া দেন। তিনি কহিলেন, ইহার পর ক্রমে ক্রমে সমুদায় জানিতে পারিবে।

৩.১ উপসংহার : কথায় কথায় নিশাবসান

কথায় কথায় নিশাবসান ও পূর্ব্বদিক্ ধূসরবর্ণ হইল। পম্পাসরোবরে কলহংসগণ কলরব করিয়া উঠিল। প্রভাতসমীরণ তপোবনের তরুপল্লব কম্পিত করিয়া মন্দ মন্দ বহিতে লাগিল। শশধরের আর প্রভা রহিল না। দূর্ব্বাদলের উপর নিশির শিশির মুক্তাকলাপের ন্যায় প্রভা পাইতে লাগিল। মহর্ষি হোমবেলা উপস্থিত দেখিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। মুনিকুমারেরা এরূপ একাগ্রচিত্ত হইয়া কথা শুনিতেছিলেন এবং শুনিয়া এরূপ বিস্ময়াপন্ন হইলেন যে, মহর্ষিকে প্রণাম না করিয়াই প্রভাতকৃত্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। হারীত আমাকে লইয়া আপন পর্ণশালায় রাখিয়া নির্গত হইলেন। তিনি বহির্গত হইলে আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, এক্ষণে কি কর্ত্তব্য, যে দেহ প্রাপ্ত হইয়াছি, ইহা অতি অকিঞ্চিৎকর, কোন কর্ম্মের যোগ্য নয়। অনেক সুকৃত না থাকিলে মনুষ্যদেহ হয় না। তাহাতে আবার সর্ব্ববর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলে জন্ম লাভ করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া তপস্বিবেশে জগদীশ্বরের আরাধনা ও অপবর্গের উপায় চিন্তা করা প্রায় কাহারও ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে না। দিব্যলোকে নিবাসের ত কথাই নাই। আমি এই সমুদায় প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, কেবল আপন দোষে হারাইয়াছি। কোন কালে যে উদ্ধার পাইব তাহারও উপায় দেখিতেছি না। জন্মান্তরীণ বান্ধবগণের সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। এ দেহে কোন প্রয়োজন নাই। এ প্রাণ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ। আমাকে এক দুঃখ হইতে দুঃখান্তরে নিক্ষিপ্ত করাই বিধাতার সম্পূর্ণ মানস। ভাল, বিধাতার মানসই সফল হউক।

এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম এমন সময়ে, হারীত সহাস্য বদনে আমার নিকটে আসিয়া মধুর বচনে কহিলেন, ভ্রাতঃ! ভগবান শ্বেতকেতুর নিকট হইতে তোমার পূর্ব্বসুহৃৎ কপিঞ্জল তোমার অন্বেষণে আসিয়াছেন। বাহিরে পিতার সহিত কথা কহিতেছেন। আমি আহ্লাদে পুলকিত হইয়া কহিলাম কই, তিনি কোথায়? আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া চল। বলিতে বলিতে কপিঞ্জল আমার নিকটে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমার দুই চক্ষু দিয়া আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বলিলাম, সখে কপিঞ্জল! বহু কাল তোমার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। ইচ্ছা হইতেছে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া তাপিত হৃদয় শীতল করি। বলিবামাত্র তিনি আপন বক্ষঃস্থলে আমাকে তুলিয়া লইলেন। আমার দুর্দ্দশা দেখিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। আমি প্রবোধবাক্যে কহিলাম, সখে! তুমি আমার ন্যায় অজ্ঞান নহ। তোমার গম্ভীর প্রকৃতি কখন বিচলিত হয় নাই। তোমার মন কখন চঞ্চল দেখি নাই। এক্ষণে চঞ্চল হইতেছে কেন? ধৈর্য্য অবলম্বন কর। আসনপরিগ্রহণ দ্বারা শ্রান্তি পরিহার পূর্ব্বক পিতার কুশল বার্ত্তা বল। তিনি কখন এই হতভাগ্যকে কি স্মরণ করিয়া থাকেন? আমার দারুণ দৈবদুর্ব্বিপাকের কথা শুনিয়া কি বলিলেন? বোধ হয় অতিশয় কুপিত হইয়া থাকিবেন।

কপিঞ্জল আসনে উপবেশন ও মুখ প্রক্ষালন পূর্ব্বক শ্রান্তি দূর করিয়া কহিলেন, ভগবান কুশলে আছেন এবং দিব্যচক্ষু দ্বারা আমাদিগের সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া প্রতীকারের নিমিত্ত এক ক্রিয়া আরম্ভ করিয়াছেন। ক্রিয়ার প্রভাবে আমি ঘোটক রূপ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়াছিলাম। আমাকে বিষণ্ণ ও ভীত দেখিয়া কহিলেন, বৎস কপিঞ্জল! যে ঘটনা উপস্থিত তাহাতে তোমাদিগের কোন দোষ নাই। আমি উহা অগ্রে জানিতে পারিয়াও প্রতীকারের কোন চেষ্টা করি নাই; অতএব আমারই দোষ বলিতে হইবেক। এই দেখ, বৎস পুণ্ডরীকের আয়ুষ্কর কর্ম্ম আরম্ভ করিয়াছি, ইহা সিদ্ধপ্রায়; যত দিন সমাপ্ত না হয় তুমি এই স্থানে অবস্থিতি কর, বলিয়া আমার ভয় ভঞ্জন করিয়া দিলেন। আমি তখন নির্ভয় চিত্তে নিবেদন করিলাম, তাত! পুণ্ডরীক যে স্থানে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমাকে তথায় যাইতে অনুমতি করুন। তিনি বলিলেন, বৎস! তোমার সখা শুকজাতিতে পতিত হইয়াছেন; এক্ষণে তুমি তাঁহাকে চিনিতে পারিবে না। তাঁহারও তোমাকে দেখিয়া মিত্র বলিয়া প্রত্যভিজ্ঞা হইবে না। অদ্য প্রাতঃকালে আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, বৎস! তোমার সখা মহর্ষি জাবালির আশ্রমে আছেন। পূর্ব্বজন্মের সমুদায় বৃত্তান্ত তাঁহার স্মৃতিপথবর্ত্তী হইয়াছে; এক্ষণে তোমাকে দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। অতএব তুমি তাঁহার নিকটে যাও। যত দিন আরব্ধ কর্ম্ম সমাপ্ত না হয়, তাবৎ তাঁহাকে জাবালির আশ্রমে থাকিতে কহিও। তোমার মাতা লক্ষ্মী দেবীও সেই কর্ম্মে ব্যাপৃত আছেন। তিনিও আশীর্ব্বাদ প্রয়োগ পূর্ব্বক উহাই বলিয়া দিলেন। কপিঞ্জল এই কথা বলিয়া দুঃখিত চিত্তে আমার গাত্র স্পর্শ করিতে লাগিলেন। আমিও তাঁহার ঘোটকরূপ ধারণের সময় যে যে ক্লেশ হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলাম। মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইলে আহারাদি করিয়া, সখে! যাবৎ সেই কর্ম্ম সমাপ্ত না হয় তাবৎ এই স্থানে থাক। আমিও সেই কর্ম্মে ব্যাপৃত আছি, শীঘ্র তথায় যাইতে হইবেক, চলিলাম বলিয়া বিদায় হইলেন। দেখিতে দেখিতে অন্তরীক্ষে উঠিলেন ও ক্রমে অদৃ্শ্য হইলেন।

হারীত যত্ন পূর্ব্বক আমার লালন পালন করিতে লাগিলেন। ক্রমে বলাধান হইল এবং পক্ষোদ্ভেদ হওয়াতে গমন করিবার শক্তি জন্মিল। একদা মনে মনে চিন্তা করিলাম, এক্ষণে উড়িবার সামর্থ্য হইয়াছে, এক বার মহাশ্বেতার আশ্রমে যাই। এই স্থির করিয়া উত্তর দিকে গমন করিতে লাগিলাম। গমন করা অভ্যাস ছিল না, সুতরাং কিঞ্চিৎ দূর যাইয়াই অতিশয় শ্রান্তি বোধ ও পিপাসায় কণ্ঠশোষ হইল। এক সরোবরের সমীপবর্ত্তী জম্বুনিকুঞ্জে উপবেশন করিয়া শ্রান্তি দূর করিলাম। সুস্বাদু ফল ভক্ষণ ও সুশীতল জল পান করিয়া ক্ষুৎপিপাসা শান্তি হইলে নিদ্রাকর্ষণ হইতে লাগিল। পক্ষপুটের অন্তরালে চঞ্চুপুট নিবেশিত করিয়া সুখে নিদ্রা গেলাম। জাগরিত হইয়া দেখি জালে বদ্ধ হইয়াছি। সম্মুখে এক বিকটাকার ব্যাধ দণ্ডায়মান। তাহার ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া কলেবর কম্পিত হইল এবং জীবনে নিরাশ হইয়া ব্যাধকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ভদ্র! তুমি কে, কি নিমিত্ত আমাকে জালবদ্ধ করিলে? যদি আমিষলোভে বদ্ধ করিয়া থাক নিদ্রাবস্থায় কেন প্রাণ বিনাশ কর নাই? যদি কৌতুকের নিমিত্ত ধরিয়া থাক, কৌতুক নিবৃত্ত হইল এক্ষণে জালমোচন করিয়া দেও। নিরপরাধে কেন আর যন্ত্রণা দিতেছ? আমার চিত্ত প্রিয়জন দর্শনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত, আর বিলম্ব সহেনা। তুমিও প্রাণী বট, বল্লভ জনের অদর্শনে মন কিরূপ চঞ্চল হয়, জানিতে পার।

কিরাত কহিল, আমি চণ্ডাল বটি, কিন্তু আমিষলোভে তোমাকে জালবদ্ধ করি নাই। আমাদিগের স্বামী পক্কণদেশের অধিপতি। তাঁহার কন্যা শুনিয়াছিলেন, জাবালি মুনির আশ্রমে এক আশ্চর্য্য শুকপক্ষী আছে। সে মনুষ্যের মত কথা কহিতে পারে। শুনিয়া অধিক কৌতুকাক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং অনেক ব্যক্তিকে ধরিবার আদেশ দিয়াছিলেন। অনেক দিন অনুসন্ধানে ছিলাম। আজি সুযোগক্রমে জালবদ্ধ করিয়াছি। এক্ষণে লইয়া গিয়া তাঁহাকে প্রদান করিব। তিনিই তোমার বন্ধু অথবা মোচনের প্রভু। কিরাতের কথায় সাতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। ভাবিলাম, আমি কি হতভাগ্য! প্রথমে ছিলাম দিব্যলোকবাসী ঋষি; তাহার পর সামান্য মানব হইলাম; অবশেষে শুকজাতিতে পতিত হইয়া জালবদ্ধ হইলাম ও চণ্ডালের গৃহে যাইতে হইল। তথায় চণ্ডাল-বালকের ক্রীড়াসামগ্রী হইব এবং ম্লেচ্ছ জাতির অপবিত্র অন্নে এই দেহ পোষিত হইবেক। হা মাতঃ! কেন আমি গর্ভেই বিলীন হই নাই! হা পিতঃ! আর ক্লেশ সহ্য করিতে পারি না। হা বিধাতঃ! তোমার মনে এই ছিল! এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিলাম। পুনর্ব্বার বিনয়বচনে কিরাতকে কহিলাম, ভ্রাতঃ! আমি জাতিস্মর মুনিকুমার, কেন চণ্ডালের আলয়ে লইয়া গিয়া আমার দেহ অপবিত্র কর? ছাড়িয়া দাও, তোমার যথেষ্ট পুণ্যলাভ হইবেক। পুনঃ পুনঃ পাদপতনপুরঃসর অনেক অনুনয় করিলাম; কিছুতেই তাহার পাষাণময় অন্তঃকরণে দয়া জন্মিল না। কহিল, রে মোহান্ধ! পরাধীন ব্যক্তিরা কি স্বামীর আদেশ অবহেলন করিতে পারে? এই বলিয়া পক্কণাভিমুখে আমাকে লইয়া চলিল।

কতক দূর গিয়া দেখি, কেহ মৃগবন্ধনের বাগুরা প্রস্তুত করিতেছে; কেহ ধনুর্ব্বাণ নির্ম্মাণ করিতেছে; কেহ বা কূটজাল রচনা করিতে শিখিতেছে; কাহার হস্তে কোদণ্ড কাহার হস্তে লৌহদণ্ড। সকলেরই আকার ভয়ঙ্কর। সুরাপানে সকলের চক্ষু জবাবর্ণ। কোন স্থানে মৃত হরিণশাবক পতিত রহিয়াছে। কেহ বা তীক্ষ্ণধার ছুরিকা দ্বারা মৃগমাংস খণ্ড খণ্ড করিতেছে। পিঞ্জরবদ্ধ পক্ষিগণ ক্ষুৎপিপাসায় ব্যাকুল হইয়া চীৎকার করিতেছে। কেহ এক বিন্দু বারি দান করিতেছে না। এই সকল দেখিয়া অনায়াসে বুঝিলাম, উহা চণ্ডালরাজের আধিপত্য। উহার আলয় যেন যমালয় বোধ হইল। ফলতঃ তথায় এরূপ একটীও লোক দেখিতে পাইলাম না, যাহার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র করুণা আছে। কিরাত চণ্ডালকন্যার হস্তে আমাকে সমর্পণ করিল। কন্যা অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া কাষ্ঠের পিঞ্জরে আমাকে বদ্ধ করিয়া রাখিল। পিঞ্জরবদ্ধ হইয়া ভাবিলাম, যদি বিনয় পূর্ব্বক কন্যার নিকট আত্মমোচনের প্রার্থনা করি, তাহা হইলে, যে নিমিত্ত আমাকে ধরিয়াছে তাহারই পরিচয় দেওয়া হয়; অর্থাৎ মনুষ্যের ন্যায় সুস্পষ্ট কথা কহিতে পারি বলিয়া ধরিয়াছে তাহাই সপ্রমাণ করা হয়। যদি কথা না কহি, তাহা হইলে শঠতা করিয়া কথা কহিতেছে না ভাবিয়া অধিক যন্ত্রণা দিতে পারে। যাহা হউক, বিষম সঙ্কটে পড়িলাম। কথা কহিলে কখন মোচন করিবে না, বরং না কহিলে অবজ্ঞা করিয়া ছাড়িয়া দিলেও দিতে পারে। এই স্থির করিয়া মৌনাবলম্বন করিলাম। কথা কহাইবার জন্য সকলে চেষ্টা পাইল, আমি কিছুতেই মৌনভঞ্জন করিলাম না। যখন কেহ আঘাত করে কেবল উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠি। চণ্ডালকন্যা ফল মূল প্রভৃতি খাদ্য দ্রব্য আমার সম্মুখে দিল, আমি খাইলাম না। পর দিনও ঐরূপ আহার সামগ্রী আনিয়া দিল। আমি ভক্ষণ না করাতে কহিল, পক্ষী ও পশুজাতি ক্ষুধা লাগিলে খায় না, ইহা অতি অসম্ভব বোধ হয়, তুমি জাতিস্মর, ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিবেচনা করিতেছ। অর্থাৎ চণ্ডালস্পর্শে খাদ্য দ্রব্য অপবিত্র হইয়াছে বলিয়া আহার করিতেছ না। তুমি পূর্ব্বজন্মে যে থাক, এক্ষণে পক্ষিজাতি হইয়াছ। চণ্ডালস্পৃষ্ট বস্তু ভক্ষণ করিলে পক্ষিজাতির দুরদৃষ্ট জন্মে না। বিশেষতঃ আমি বিশুদ্ধ ফল মূল আনয়ন করিয়াছি, উচ্ছিষ্ট সামগ্রী আনি নাই। নীচজাতিস্পৃষ্ট ফল মূল ভক্ষণ করা কাহারও পক্ষে নিষিদ্ধ নহে। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, পানীয় কিছুতেই অপবিত্র হয় না। অতএব তোমার পান ভোজনে বাধা কি?

চণ্ডালকুমারীর ন্যায়ানুগত বাক্য শুনিয়া বিস্মিত হইলাম এবং ফলভক্ষণ ও জলপান দ্বারা ক্ষুৎপিপাসা শান্তি করিলাম; কিন্তু কথা কহিলাম না। ক্রমে যৌবন প্রাপ্ত হইলাম। একদা পিঞ্জরের অভ্যন্তরে নিদ্রিত আছি, জাগরিত হইয়া দেখি, পিঞ্জর সুবর্ণময় ও পক্কণপুর অমরপুর হইয়াছে। চণ্ডালদারিকাকে মহারাজ যেরূপ রূপলাবণ্যসম্পন্ন দেখিতেছেন ঐরূপ আমিও দেখিলাম। দেখিয়া অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। সমুদায় বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব ভাবিয়াছিলাম। ইতিমধ্যে মহারাজের নিকট আনীত হইয়াছি। ঐ কন্যা কে, কি নিমিত্ত চণ্ডালকন্যা বলিয়া পরিচয় দেয়, আমাকেই বা কি নিমিত্ত ধরিয়াছে মহারাজের নিকটই বা কি জন্য আনয়ন করিয়াছে কিছুমাত্র অবগত নহি।

রাজা শূদ্রক, শুকের এই দীর্ঘ উপাখ্যান শ্রবণ করিয়া শেষ বৃত্তান্ত শুনিবার নিমিত্ত অতিশয় কৌতুকাক্রান্ত হইলেন। প্রতীহারীকে আজ্ঞা দিলেন, শীঘ্র সেই চণ্ডালকন্যাকে লইয়া আইস। প্রতীহারী যে আজ্ঞা বলিয়া কন্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল। কন্যা শয়নাগারে প্রবেশিয়া প্রগল্‌ভ বচনে কহিল, ভুবনভূষণ রোহিণীপতে, কাদম্বরীলোচনানন্দ, চন্দ্র! শুকের ও আপনার পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত অবগত হইলেন, পক্ষী অনুরাগান্ধ হইয়া পিতার আদেশ উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক মহাশ্বেতার নিকট যাইতেছিল তাহাও শুনিলেন। আমি ঐ দুরাত্মার জননী লক্ষ্মী, মহর্ষি কালত্রয়দর্শী দিব্য চক্ষু দ্বারা উহাকে পুনর্ব্বার অপথে পদার্পণ করিতে দেখিয়া আমাকে কহিলেন, তুমি ভূতলে গমন কর এবং যাবৎ আরব্ধ কর্ম্ম সমাপ্ত না হয় তাবৎ তোমার পুত্ত্রকে তথায় বদ্ধ করিয়া রাখ এবং যাহাতে অনুতাপ হয় এরূপ শিক্ষা দিও! কি জানি, যদি কর্ম্মদোষে আবার তির্য্যগ্‌জাতি অপেক্ষাও অন্য কোন নীচ জাতিতে পতিত হয়। দুষ্কর্ম্মের অসাধ্য কিছুই নাই। আমি মহর্ষির বচনানুসারে উহাকে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। অদ্য কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়াছে এই নিমিত্ত তোমাদিগের পরস্পর মিলন করিয়া দিলাম; এক্ষণে জরামরণাদিদুঃখসঙ্কুল এই দেহ পরিত্যাগ করিয়া আপন আপন অভীষ্ট বস্তু লাভ কর, এই বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন।

৩.২ উপসংহার : লক্ষ্মীর বাক্য শুনিবামাত্র

লক্ষ্মীর বাক্য শুনিবামাত্র রাজার জন্মান্তর বৃত্তান্ত সমুদায় স্মরণ হইল। তখন মকরকেতু কাদম্বরীকে তাঁহার স্মৃতিপথে উপস্থিত করিয়া শরাসনে শর সন্ধান করিলেন। তখন গন্ধর্ব্বকুমারী কাদম্বরীর বিরহবেদনা রাজার হৃদয়ে অতিশয় যন্ত্রণা দিতে লাগিল। এ দিকে বসন্তকাল উপস্থিত। সহকারের মুকুলমঞ্জরী সঞ্চালিত করিয়া মলয়ানিল মন্দ মন্দ বহিতে লাগিল কোকিলের কুহুরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। অশোক, কিংশুক, কুরুবক, চম্পক প্রভৃতি তরুগণ বিকসিত কুসুম দ্বারা দিঙ্মণ্ডল আলোকময় করিল। অলিকুল বকুলপুষ্পের গন্ধে অন্ধ হইয়া ঝঙ্কার পূর্ব্বক তাহার চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিল। তরুগণ পল্লবিত ও ফলভরে অবনত হইল। কমলবন বিকসিত হইয়া সরোবরের শোভা বৃদ্ধি করিল। ক্রমে মদনমহোৎসবের সময় সমাগত হইলে, একদা কাদম্বরী সায়াহ্নে সরোবরে স্নান করিয়া ভক্তিভাবে অনঙ্গদেবের অর্চ্চনা করিলেন। চন্দ্রাপীড়ের শরীর ধৌত ও মার্জ্জিত করিয়া গাত্রে হরিচন্দন লেপন করিয়া দিলেন এবং কণ্ঠদেশে কুসুমমালা ও কর্ণে অশোকস্তবক পরাইয়া দিলেন। উত্তম বেশ ভূষায় ভূষিত করিয়া সস্পৃহ লোচনে বারংবার নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। একে বসন্ত কাল তাহাতে নির্জ্জন প্রদেশ। রতিপতিও সময় বুঝিয়া অমনি শর নিক্ষেপ করিলেন। কাদম্বরী উন্মত্ত ও বিকৃতচিত্ত হইয়া জীবিতভ্রমে যেমন চন্দ্রাপীড়ের মৃত দেহ গাঢ় আলিঙ্গন করিবার উপক্রম করিতেছেন, অমনি চন্দ্রাপীড় পুনর্জীবিত হইয়া উঠিলেন। কাদম্বরী ভয়ে কাঁপিতেছেন, চন্দ্রাপীড় সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ভীরু! ভয় কি? এই দেখ, আমি পুনর্জীবিত হইয়াছি। আজি শাপাবসান হইয়াছে। এত দিন বিদিশা নগরীতে শূদ্রক নামে নরপতি ছিলাম, অদ্য সে শরীর পরিত্যাগ করিয়াছি। তোমার প্রিয়সখী মহাশ্বেতার মনোরথও আজি সফল হইবেক। আজি পুণ্ডরীকও বিগতশাপ হইয়াছেন। বলিতে বলিতে চন্দ্রলোক হইতে পুণ্ডরীক নভোমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেন। তাঁহার গলে সেই একাবলী মালা ও বামপার্শ্বে কপিঞ্জল। কাদম্বরী প্রিয়সখীকে প্রিয় সংবাদ শুনাইতে গেলেন, এমন সময়ে পুণ্ডরীক চন্দ্রাপীড়ের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চন্দ্রাপীড় সমাদরে হস্ত ধারণ ও কণ্ঠগ্রহণ পূর্ব্বক মৃদু মধুর বচনে বলিলেন, সখে! তোমার সৌহার্দ্দ কখন বিস্মৃত হইতে পারিব না। আমি তোমাকে বৈশম্পায়ন বলিয়াই জ্ঞান করিব। তোমাকে আমার সহিত মিত্রতা ব্যবহার করিতে হইবেক।

গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও হংসকে এই শুভ সংবাদ শুনাইবার নিমিত্ত কেয়ূরক হেমকূটে গমন করিল। মদলেখা আহ্লাদিত হইয়া তারাপীড় ও বিলাসবতীর নিকটে গিয়া কহিল, আপনাদের সৌভাগ্যবলে, যুবরাজ আজি পুনর্জ্জীবিত হইয়াছেন। রাজা, রাণী, শুকনাস ও মনোরমা এই বিস্ময়কর শুভসমাচার শ্রবণে পরম পুলকিত হইয়া শীঘ্র আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। চন্দ্রাপীড় জনক জননীকে সমাগত দেখিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিবার নিমিত্ত মস্তক অবনত করিতেছিলেন, রাজা অমনি ভুজযুগল প্রসারিত করিয়া ধরিলেন। কহিলেন, বৎস! জন্মান্তরীণ পুণ্যফলে তোমাকে পুত্ত্ররূপে প্রাপ্ত হইয়াছি বটে; কিন্তু তুমি সাক্ষাৎ ভগবান্ চন্দ্রমার মূর্ত্তি! তুমিই সকলের নমস্য; তোমাকে দেখিয়া আজি দেবগণ অপেক্ষাও সৌভাগ্যশালী হইলাম। আজি জীবন সার্থক ও ধর্ম্ম কর্ম্ম সফল হইল। বিলাসবতী পুনঃ পুনঃ মুখচুম্বন ও শিরোঘ্রাণ করিয়া সস্নেহে পুত্ত্রকে ক্রোড়ে করিলেন। তাঁহার কপোলযুগল হইতে আনন্দাশ্রু বহিতে লাগিল। অনন্তর শুকনাস ও মনোরমাকে প্রণাম করিলেন। তাঁহারাও যথোচিত স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক যথাবিহিত আশীর্ব্বাদ করিলেন। ইনিই বৈশম্পায়নরূপে আপনাদিগের পুত্ত্র হইয়াছিলেন বলিয়া চন্দ্রাপীড় পুণ্ডরীকের পরিচয় দিলেন। পুণ্ডরীক জনক জননীকে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন। কপিঞ্জল কহিলেন, শুকনাস! মহর্ষি শ্বেতকেতু আপনাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “আমি পুণ্ডরীকের লালন পালন করিয়াছি বটে, কিন্তু ইনি তোমার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত। অতএব তোমার নিকটেই পাঠাইতেছি! ইঁহাকে বৈশম্পায়ন বলিয়া জ্ঞান করিও, কদাচ ভিন্ন ভাবিও না”। শুকনাস কহিলেন, মহর্ষির আদেশ গ্রহণ করিলাম, তিনি যাহা আজ্ঞা করিয়াছেন তাহার অন্যথা হইবেক না। বৈশম্পায়ন বলিয়াই আমার জ্ঞান হইতেছে। এইরূপ নানা কথায় রজনী প্রভাত হইল। প্রাতঃকালে চিত্ররথ ও হংস, মদিরা ও গৌরীর সহিত তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সমুদায় গন্ধর্ব্বলোক আহ্লাদে পুলকিত হইয়া আগমন করিল।

আহা! কি শুভদিন! কি আনন্দের সময়! সকলের শোক দুঃখ দূর হইল। আপন আপন মনোরথ সম্পন্ন হওয়াতে সকলেই আহ্লাদের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। গন্ধর্ব্বপতির সহিত নরপতির এবং হংসের সহিত শুকনাসের বৈবাহিক সম্বন্ধ নির্দ্ধারিত হওয়াতে তাঁহারা নব নব উৎসব ও আমোদ অনুভব করিতে লাগিলেন। কাদম্বরী ও মহাশ্বেতা চিরপ্রার্থিত মনোরথ লাভ করিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। আপন আপন প্রিয়সখীর অভিলষিত সিদ্ধি হওয়াতে মদলেখা ও তরলিকার সমুদায় ক্লেশ শান্তি হইল।

চিত্ররথ সাদর সম্ভাষণে কহিলেন, মহারাজ সকল মনোরথ সফল হইল। এক্ষণে এই অধীনের সদনে পদার্পণ করিলে চন্দ্রাপীড়কে কাদম্বরী প্রদান ও রাজ্য দান করিয়া চরিতার্থ হই। তারাপীড় উত্তর করিলেন, গন্ধর্ব্বরাজ! যেখানে সুখ, সেই গৃহ। আমি এই আশ্রমকেই সুখের ধাম ও আপন আলয় বলিয়া স্থির করিয়াছি। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি এই স্থানেই জীবন যাপিত করিব। তুমি বধূসহিত চন্দ্রাপীড়কে আপন আলয়ে লইয়া যাও, বিবাহমহোৎসব নির্ব্বাহ কর। আমি এই আশ্রমেই থাকিলাম। চিত্ররথ ও হংস জামাতা ও কন্যাকে আপন আপন আলয়ে লইয়া গেলেন ও মহাসমারোহে মহোৎসব আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে উভয়েই জামাতার প্রতি আপন আপন রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।

এই রূপে চন্দ্রাপীড় ও পুণ্ডরীক প্রিয়তমাসমাগমে পরম সুখী হইয়া রাজ্যভোগ করেন। একদা কাদম্বরী বিষণ্ণমুখী হইয়া চন্দ্রাপীড়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, নাথ! সকলেই মরিয়া পুনর্জ্জীবিত হইল; কিন্তু সেই পত্রলেখা কোথায় গেল জানিতে বাসনা হয়। চন্দ্রাপীড় কহিলেন, প্রিয়ে! আমি শাপগ্রস্ত হইয়া মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিলে, রোহিণী আমার পরিচর্য্যার নিমিত্ত পত্রলেখারূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তাঁহাকে পুনর্ব্বার চন্দ্রলোকে দেখিতে পাইবে এই বলিয়া তাঁহার কৌতুক ভঞ্জন করিয়া দিলেন। হেমকূটে কিছু কাল বাস করিয়া আপন রাজধানী উজ্জয়িনী নগরে গমন করিলেন। তথায় পুণ্ডরীকের প্রতি রাজ্যশাসনের ভার দিয়া কখন গন্ধর্ব্বলোকে, কখন চন্দ্রলোকে, কখন পিতার আশ্রমে, কখন বা পরমরমণীয় সেই সেই প্রদেশে বাস করিয়া সুখ সম্ভোগ করিতে লাগিলেন।

সম্পূর্ণ।

 

Exit mobile version