==========================================
2- বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্থিত কতকগুলি পর্বতকে নীলগিরি বলে। তাহাই কোন কোন স্থানে বৈতরিণীতীর হইতে দেখা যায়। এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।
3- *বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্হিত কতকগুলি পর্বতকে বলে। তাহাই কোন কোন স্হানে বৈতরণীতীর্ইতে দেখা যায়। **এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।
4- পুরুষোত্তম যাইবার আধুনিক যে রাজপথ, এই সকল পর্বত, তাহার বামে থাকে। নিকট নহে।
==========================================
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতে উঠিয়া, খরস্রোতা5 জলে যথাবিধি স্নানাহ্নিক সমাপন করিয়া শ্রী ও সন্ন্যাসিনী, বিভূতি রুদ্রাক্ষাদি-শোভিতা হইয়া পুনরপি “সঞ্চারী দীপশিখা”দ্বয়ের ন্যায় শ্রীক্ষেত্রের পথ আলো করিয়া চলিল। তৎপ্রদেশবাসীরা নানাবিধ যাত্রীকে সেই পথে যাতায়াত করিতে দেখে, কোন প্রকার যাত্রী দেখিয়া বিস্মিত হয় না, কিন্তু আজ ইহাদিগকে দেখিয়া তাহারাও বিস্মিত হইল। কেহ বলিল, “কি পরি মাইকিনিয়া মানে যাউছন্তি পারা?” কেহ বলিল, “সে মানে দ্যাবতা হ্যাব |” কেহ আসিয়া প্রণাম করিল; কেহ ধন দৌলত বর মাঙিল। একজন পণ্ডিত তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া বলিল, “কিছু বলিও না; ইঁহারা বোধ হয় রুক্মিণী সত্যভামা স্বশরীরে স্বামিদর্শনে যাইতেছেন |” অপরে মনে করিল যে, রুক্মিণী সত্যভামা শ্রীক্ষেত্রেই আছেন, তাঁহাদিগের গমন সম্ভব নহে; অতএব নিশ্চয়ই ইঁহারা শ্রীরাধিকা এবং চন্দ্রাবলী, গোপকন্যা বলিয়া পদব্রজে যাইতেছেন। এই সিদ্ধান্ত স্থিরীকৃত হইলে, এক দুষ্টা স্ত্রী বলিল, “হউ হউ! যা! যা! সেঠিরে তা ভৌঁউড়ি।6 অচ্ছি, তুমানঙ্কো মারি পকাইব |”
এ দিকে শ্রীরাধিকা চন্দ্রাবলী আপন মনে কথোপকথন করিতে করিতে যাইতেছিল। সন্ন্যাসিনী বিরাগিণী প্রব্রজিতা, অনেকদিন হইতে তাহার সুহৃদ কেহ নাই; আজ একজন সমবয়স্কা প্রব্রজিতাকে পাইয়া তাহার চিত্ত একটু প্রফুল্ল হইয়াছিল। এখনও তার জীবনস্রোতঃ কিছুই শুকায় নাই।বরং শ্রীর শুকাইয়াছিল; কেন না, শ্রী দুঃখ কি, তাহা জানিয়াছিল সন্ন্যাসী বৈরাগীরদুঃখনাই। কথাবার্তা যাহা হইতেছিল, তাহার মধ্যে গোটা দুই কথা কেবল পাঠককে শুনান আবশ্যক।
সন্ন্যা। তুমি বলিতেছ, তোমার স্বামী আছেন। তিনি তোমাকে লইয়া ঘর—সংসার করিতেও ইচ্ছুক। তাতে তুমি গৃহত্যাগিনী হইয়াছ কেন, তাও তোমায় জিজ্ঞাসা করি না। কেন না, তোমার ঘরের কথা আমার জানিয়া কি হইবে? তবে এটা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি যে, কখনও ঘরে ফিরিয়া যাইবার তোমার ইচ্ছা আছে কি না?
শ্রী। তুমি হাত দেখিতে জান?
সন্ন্যা। না। হাত দেখিয়া কি তাহা জানিতে হইবে?
শ্রী। না। তাহা হইলে আমি তোমাকে হাত দেখাইয়া, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া, সে বিষয় স্থির করিতাম।
সন্ন্যা। আমি হাত দেখিতে জানি না। কিন্তু তোমাকে এমন লোকের কাছে লইয়া যাইতে পারি যে, তিনি এ বিদ্যায় ও আর সকল বিদ্যাতেই অভ্রান্ত।
শ্রী। কোথায় তিনি?
সন্ন্যা। ললিতগিরিতে হস্তিগুম্ফায় এক যোগী বাস করেন। আমি তাঁহার কথা বলিতেছি।
শ্রী। ললিতগিরি কোথায়?
সন্ন্যা। আমরা চেষ্টা করিলে আজ সন্ধ্যার পর পৌঁছিতে পারি।
শ্রী। তবে চল।
তখন দুই জনে দ্রুতগতি চলিতে লাগিল। জ্যোতির্বিদ দেখিলে বলিত, আজ বৃহস্পতি শুক্র উভয় গ্রহ যুক্ত হইয়া শীঘ্রগামী হইয়াছে।7
======================================
5- নদীর নাম।
6- সুভদ্রা।
7- হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে Accelerated Motionকে শীঘ্রগতি বলে। দুইটি গ্রহকে পৃথিবী হইতে যখন এক রাশিস্থিত দেখা যায়, তখন তাহাদিগকে যুক্ত বলা যায়।
======================================
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
এক পারে উদয়গিরি, অপর পারে ললিতগিরি, মধ্যে স্বচ্ছসলিলা কল্লোলিনী বিরূপা নদী, নীলবারিরাশি লইয়া সমুদ্রাভিমুখে চলিয়াছে।8 গিরিশিখরদ্বয়ে আরোহণ করিলে নিম্নে সহস্র সহস্র তালবৃক্ষ শোভিত, ধান্য হরিৎক্ষেত্রে চিত্রিত, পৃথ্বী অতিশয় মনোমোহিনী দেখা যায়—শিশু যেমন মার কোলে উঠিলে মাকে সর্বাঙ্গসুন্দরী দেখে, মনুষ্য পর্বতারোহণ করিয়া পৃথিবী দর্শন করিলে সেইরূপ দেখে। উদয়গিরি (বর্ত্তমান অল্ততিগিরি) বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ, কিন্তু ললিতগিরি (বর্ত্তমান নাল্ তিগিরি) বৃক্ষশূন্য প্রস্তরময়। এককালে ইহার শিখর ও সানুদেশ অট্টালিকা, স্তূপ এবং বৌদ্ধ মন্দিরাদিতে শোভিত ছিল। এখন শোভার মধ্যে শিখরদেশে চন্দনবৃক্ষ, আর মৃত্তিকাপ্রোথিত ভগ্নগৃহবিশিষ্ট প্রস্তর, ইষ্টক বা মনোমুগ্ধকর প্রস্তরগঠিত মূর্তিরাশি। তাহার দুই চারিটা কলিকাতার বড় বড় ইমারতের ভিতর থাকিলে কলিকাতার শোভা হইত। হায়! এখন কি না হিন্দুকে ইণ্ডষ্ট্রিয়াল স্কুলে পুতুল গড়া শিখিতে হয়! কুমারসম্ভব ছাড়িয়া সুইনবর্ণ পড়ি, গীতা ছাড়িয়া মিল পড়ি, আর উড়িষ্যার প্রস্তর-শিল্প ছাড়িয়া সাহেবদের চীনের পুতুল হাঁ করিয়া দেখি। আরও কি কপালে আছে বলিতে পারি না।
আমি যাহা দেখিয়াছি, তাহাই লিখিতেছি। সেই ললিতগিরি আমার চিরকাল মনে থাকিবে। চারি দিকে-যোজনের পর যোজন ব্যাপিয়া—হরিদ্বর্ণ ধান্যক্ষেত্র,-মাতা বসুমতীর অঙ্গে বহুযোজন—বিস্তৃতা পীতাম্বরী শাটী! তাহার পর মাতার অলঙ্কার স্বরূপ, তালবৃক্ষশ্রেণী-সহস্র সহস্র, তার পর সহস্র সহস্র তালবৃক্ষ; সরল সুপত্র, শোভাময়! মধ্যে নীলসলিলা বিরূপা, নীল পীত পুষ্পময় হরিৎক্ষেত্র মধ্য দিয়া বহিতেছে-সুকোমল গালিচার উপর কে নদী আঁকিয়া দিয়াছে। তা যাক—চারি পাশে মৃত মহাত্মাদের মহীয়সী কীর্তি। পাথর এমন করিয়া যে পালিশ করিয়াছিল, সে কি এই আমাদের মত হিন্দু? এমন করিয়া বিনা বন্ধনে যে গাঁথিয়াছিল, সে কি আমাদের মত হিন্দু?
আর এই প্রস্তরমূর্তিসকল যে খোদিয়াছিল- এই দিব্য পুষ্পমাল্যাভরণভূষিত বিকম্পিতচেলাচঞ্চল -প্রবৃদ্ধসৌন্দর্য্য, সর্বাঙ্গসুন্দরগঠন, পৌরুষের সহিত লাবণ্যের মূর্তিমান্ সম্মিলনস্বরূপ পুরুষমূর্তি যাহারা গড়িয়াছে, তাহারা কি হিন্দু?এই কোপপ্রেমগর্বসৌভাগ্যস্ফুরিতাধরা, চীনাম্বরা, তরলিরত্নহারা,পীবরযৌবনভারাবনতদেহা—
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পকবিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভি:–