- বইয়ের নামঃ রাধারাণী
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ সুচয়নী পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
রাধারাণী – ০১
প্রথম পরিচ্ছেদ
রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল। বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই। তাহাদিগের অবস্থা পূর্বে ভাল ছিল–বড়মানুষের মেয়ে। কিন্তু তাহার পিতা নাই; তাহার মাতার সঙ্গে একজন জ্ঞাতির একটি মোকদ্দমা হয়; সর্বস্ব লইয়া মোকদ্দমা; মোকদ্দমাটি বিধবা হাইকোর্টে হারিল। সে হারিবামাত্র, ডিক্রীদের জ্ঞাতি ডিক্রী জারি করিয়া ভদ্রাসন হইতে উহাদিগকে বাহির করিয়া দিল। প্রায় দশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি; ডিক্রীদার সকলই লইল। খরচা ও ওয়াশিলাত দিতে নগদ যাহা ছিল, তাহাও গেল; রাধারাণীর মাতা, অলঙ্কারাদি বিক্রয় করিয়া, প্রিবি কৌন্সিলে একটি আপীল করিল। কিন্তু আর আহারের সংস্থান রহিল না। বিধবা একটি কুটীরে আশ্রয় লইয়া কোন প্রকারে শারীরিক পরিশ্রম করিয়া দিনপাত করিতে লাগিল। রাধারাণীর বিবাহ দিতে পারিল না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রথের পূর্বে রাধারাণীর মা ঘোরতর পীড়িতা হইল–যে কায়িক পরিশ্রমে দিনপাত হইত, তাহা বন্ধ হইল। সুতরাং আর আহার চলে না। মাতা রুগ্না, এ জন্য কাজে কাজেই তাহার উপবাস; রাধারাণীর জুটিল না বলিয়া উপবাস। রথের দিন তাহার মা একটু বিশেষ হইল, পথ্যের প্রয়োজন হইল, কিন্তু পথ্য কোথা? কি দিবে?
রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে কতকগুলি বনফুল তুলিয়া তাহার মালা গাঁথিল। মনে করিল যে, এই মালা রথের হাটে বিক্রয় করিয়া দুই একটি পয়সা পাইব, তাহাতেই মার পথ্য হইবে।
কিন্তু রথের টান অর্ধেক হইতে না হইতেই বড় বৃষ্টি আরম্ভ হইল। বৃষ্টি দেখিয়া লোকসকল ভাঙ্গিয়া গেল। মালা কেহ কিনিল না। রাধারাণী মনে করিল যে, আমি একটু না হয় ভিজিলাম–বৃষ্টি থামিলেই আবার লোক জমিবে। কিন্তু আর বৃষ্টি থামিল না। লোক আর জমিল না। সন্ধ্যা হইল–রাত্রি হইল–বড় অন্ধকার হইল–অগত্যা রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিল।
অন্ধকার–পথ কর্দমময়, পিচ্ছিল–কিছুই দেখা যায় না। তাহাতে মুষলধারে শ্রাবণের ধারা বর্ষিতেছিল। মাতার অন্নাভাব মনে করিয়া তদপেক্ষাও রাধারাণীর চক্ষু: বারি বর্ষণ করিতেছিল। রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল–কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিতেছিল। আবার কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল। দুই গণ্ডবিলম্বী ঘন কৃষ্ণ অলকাবলী বহিয়া, কবরী বহিয়া, বৃষ্টির জল পড়িয়া ভাসিয়া যাইতেছিল। তথাপি রাধারাণী সেই এক পয়সার বনফুলের মালা বুকে করিয়া রাখিয়াছিল–ফেলে নাই।
এমত সময়, অন্ধকারে, অকস্মাৎ কে আসিয়া রাধারাণীর ঘাড়ের উপর পড়িল। রাধারাণী এতক্ষণ উচ্চৈস্বরে ডাকিয়া কাঁদে নাই–এক্ষণে উচ্চৈ:স্বরে কাঁদিল।
যে ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছিল, সে বলিল, “কে গা তুমি কাঁদ?”
পুরুষ মানুষের গলা–কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনিয়া রাধারাণীর রোদন বন্ধ হইল। রাধারাণীর চেনা লোক নহে কিন্তু বড় দয়ালু লোকের কথা–রাধারাণীর ক্ষুদ্র বুদ্ধিটুকুতে ইহা বুঝিতে পারিল। রাধারাণী রোদন বন্ধ করিয়া বলিল, “আমি দু:খিলোকের মেয়ে। আমার কেহ নাই–কেবল মা আছে |”
সে পুরুষ বলিল, “তুমি কোথা গিয়াছিলে?”
রা। আমি রথ দেখিতে গিয়াছিলাম। বাড়ী যাইব। অন্ধকারে বৃষ্টিতে পথ পাইতেছি না।
পুরুষ বলিল, “তোমার বাড়ী কোথায়?”
রাধারাণী বলিল, “শ্রীরামপুর |”
সে ব্যক্তি বলিল, “আমার সঙ্গে আইস–আমিও শ্রীরামপুর যাইব। চল, কোন্ পাড়ায় তোমার বাড়ী–তাহা আমাকে বলিয়া দিও–আমি তোমাকে বাড়ী রাখিয়া আসিতেছি। বড় পিছল, তুমি আমার হাত ধর, নহিলে পড়িয়া যাইবে !”
এইরূপে সে ব্যক্তি রাধারাণীকে লইয়া চলিল। অন্ধকারে সে রাধারাণীর বয়স অনুমান করিতে পারে নাই, কিন্তু কথার স্বরে বুঝিয়াছিল যে, রাধারাণী বড় বালিকা। এখন রাধারাণী তাহার হাত ধরায় হস্তস্পর্শে জানিল, রাধারাণী বড় বালিকা। তখন সে জিজ্ঞাসা করিল যে, “তোমার বয়স কত?”
রা। দশ এগার বছর–
“তোমার নাম কি?
রা। রাধারাণী।
“হাঁ রাধারাণী! তুমি ছেলেমানুষ, একেলা রথ দেখিতে গিয়াছিলে কেন?”
তখন সে কথায় কথায়, মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি বলিয়া, সেই এক পয়সার বনফুলের মালার সকল কথাই বাহির করিয়া লইল। শুনিল যে, মাতার পথ্যের জন্য বালিকা এই মালা গাঁথিয়া রথহাটে বেচিতে গিয়াছিল–রথ দেখিতে যায় নাই–সে মালাও বিক্রয় হয় নাই–এক্ষণেও বালিকার হৃদয়মধ্যে লুক্কায়িত আছে। তখন সে বলিল, “আমি একছড়া মালা খুঁজিতেছিলাম। আমাদের বাড়ীতে ঠাকুর আছেন, তাঁহাকে পরাইব। রথের হাট শীঘ্র ভাঙ্গিয়া গেল–আমি তাই মালা কিনিতে পারি নাই। তুমি মালা বেচ ত আমি কিনি |”
রাধারাণীর আনন্দ হইল, কিন্তু মনে ভাবিল যে, আমাকে যে এত যত্ন করিয়া হাত ধরিয়া, এ অন্ধকারে বাড়ী লইয়া যাইতেছে, তাহার কাছে দাম লইব কি প্রকারে? তা নহিলে, আমার মা খেতে পাবে না। তা নিই।
এই ভাবিয়া রাধারাণী, মালা সমভিব্যাহারীকে দিল। সমভিব্যাহারী বলিল, “ইহার দাম চারি পয়সা–এই লও!” সমভিব্যাহারী এই বলিয়া মূল্য দিল। রাধারাণী বলিল, “এ কি পয়সা? এ যে বড় বড় ঠেকচে |”
“ডবল পয়সা–দেখিতেছ না দুইটা বই দিই নাই |”
রা। তা এ যে অন্ধকারেও চকচক করচে। তুমি ভুলে টাকা দাও নাই ত?
“না। নূতন কলের পয়সা, তাই চকচক করচে।”
রা। তা, আচ্ছা, ঘরে গিয়ে প্রদীপ জ্বেলে যদি দেখি যে, পয়সা নয়, তখন ফিরাইয়া দিব। তোমাকে সেখানে একটু দাঁড়াইতে হইবে।
কিছু পরে তাহারা রাধারাণীর মার কুটীরদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া, রাধারাণী বলিল, “তুমি ঘরে আসিয়া দাঁড়াও, আমরা আলো জ্বালিয়া দেখি, টাকা না পয়সা |”
সঙ্গী বলিল, “আমি বাহিরে দাঁড়াইয়া আছি। তুমি আগে ভিজা কাপড় ছাড়–তার পর প্রদীপ জ্বালিও |”
রাধারাণী বলিল, “আমার আর কাপড় নাই–একখানি ছিল, তাহা কাচিতে দিয়াছি। তা, আমি ভিজা কাপড়ে সর্বদা থাকি, আমার ব্যামো হয় না। আঁচলটা নিঙড়ে পরিব এখন। তুমি দাঁড়াও, আমি আলো জ্বালি |”
“আচ্ছা |”
ঘরে তৈল ছিল না, সুতরাং চালের খড় পাড়িয়া চকমকি ঠুকিয়া, আগুল জ্বালিতে হইল। আগুন জ্বালিতে কাজে কাজেই একটু বিলম্ব হইল। আলো জ্বালিয়া রাধারাণী দেখিল, টাকা বটে, পয়সা নহে।
তখন রাধারাণী বাহিরে আসিয়া আলো ধরিয়া দেখিল যে, যে টাকা দিয়াছে, সে নাই–চলিয়া গিয়াছে।
রাধারাণী তখন বিষণ্ণবদনে সকল কথা তাহার মাকে বলিয়া, মুখপানে চাহিয়া রহিল–সকাতরে বলিল–“মা! এখন কি হবে?”
মা বলিল, “কি হবে বাছা! সে কি আর না জেনে টাকা দিয়েছে? সে দাতা, আমাদের দু:খ শুনিয়া দান করিয়াছে–আমরাও ভিখারী হইয়াছি, দান গ্রহণ করিয়া খরচ করি |”
তাহারা এইরূপ কথাবার্তা কহিতেছিল, এমত সময়ে কে আসিয়া তাহাদের কুটীরের আগড় ঠেলিয়া বড় সোরগোল উপস্থিত করিল। রাধারাণী দ্বার খুলিয়া দিল–মনে করিয়াছিল যে, সেই তিনিই বুঝি আবার ফিরিয়া আসিয়াছেন। পোড়া কপাল! তিনি কেন? পোড়ারমুখো, কাপুড়ে মিন্সে
রাধারাণীর মার কুটীর বাজারের অনতিদূরে। তাহাদের কুটীরের নিকটেই পদ্মলোচন শাহার কাপড়ের দোকান। পদ্মলোচন খোদ,-পোড়ারমুখো কাপুড়ে মিন্ সে–একজোড়া নূতন কুঞ্জদার শান্তিপুরে কাপড় হাতে করিয়া আনিয়াছিল, এখন দ্বার খোলা পাইয়া তাহা রাধারাণীকে দিল। বলিল, “রাধারাণীর এই কাপড় |”
রাধারাণী বলিল, “ওমা! আমার কিসের কাপড়!” পদ্মলোচন–সে বাস্তবিক পোড়ারমুখো কিনা, তাহা আমরা সবিশেষ জানি না–রাধারাণীর কথা শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইল; বলিল, “কেন, এই যে এক বাবু এখনই আমাকে নগদ দাম দিয়া বলিয়া গেল যে, এই কাপড় এখনই ঐ রাধারাণীকে দিয়া এস |”
রাধারাণী তখন বলিল, “ওমা সেই গো! সেই। তিনিই কাপড় কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হাঁ গা পদ্মলোচন?”–
রাধারাণীর পিতার সময় হইতে পদ্মলোচন ইঁহাদের কাছে সুপরিচিত–অনেকবারই ইহাদিগের নিকট যখন সুদিন ছিল, তখন চারি টাকার কাপড়ে শপথ করিয়া আট টাকা সাড়ে বারো আনা, আর দুই আনা মুনফা লইতেন।
“হাঁ পদ্মলোচন–বলি সে বাবুটিকে চেন?”
পদ্মলোচন বলিল, “তোমরা চেন না?”
রা। না।
প। আমি বলি তোমাদের কুটুম্ব। আমি চিনি না।
যাহা হৌক, পদ্মলোচন চারি টাকার কাপড় আবার মায় মুনফা আট টাকা সাড়ে চৌদ্দ আনায় বিক্রয় করিয়াছিলেন, আর অধিক কথা কহিবার প্রয়োজন নাই বিবেচনা করিয়া, প্রসন্নমনে দোকানে ফিরিয়া গেলেন।
এ দিকে রাধারাণী, প্রাপ্ত টাকা ভাঙ্গাইয়া মার পথ্যের উদ্যোগের জন্য বাজারে গেল। বাজার করিয়া, তৈল আনিয়া প্রদীপ জ্বালিল। মার জন্য যৎকিঞ্চিৎ রন্ধন করিল। স্থান পরিষ্কার করিয়া মাকে অন্ন দিবে, এই অভিপ্রায়ে ঘর ঝাঁটাইতে লাগিল। ঝাঁটাইতে একখানা কাগজ কুড়াইয়া পাইল–হাতে করিয়া তুলিল–“এ কি মা!”
মা দেখিয়া বলিল “একখানা নোট!”
রাধারাণী বলিল, “তবে তিনি ফেলিয়া গিয়াছেন |”
মা বলিলেন, “হাঁ! তোমাকে দিয়া গিয়াছেন। দেখ, তোমার নাম লেখা আছে |”
রাধারাণী বড়ঘরের মেয়ে, একটু অক্ষরপরিচয় ছিল। সে পড়িয়া দেখিল, তাই বটে। লেখা আছে।
রাধারাণী বলিল, “হাঁ মা, এমন লোক কে মা!”
মা বলিলেন, “তাহার নামও নোটে লেখা আছে। পাছে কেহ চোরা নোট বলে, এই জন্য নাম লিখিয়া দিয়া গিয়াছেন। তাঁহার নাম রুক্মিণীকুমার রায় |”
পরদিন মাতায় কন্যায়, রুক্মিণীকুমার রায়ের অনেক সন্ধান করিল। কিন্তু শ্রীরামপুরে বা নিকটবর্তী কোন স্থানে রুক্মিণীকুমার রায় কেহ আছে, এমত কোন সন্ধান পাইল না। নোটখানি তাহারা ভাঙ্গাইল না–তুলিয়া রাখিল–তাহারা দরিদ্র, কিন্তু লোভী নহে।
রাধারাণী – ০২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাধারাণীর মাতা পথ্য করিলেন বটে, কিন্তু সে রোগ হইতে মুক্তি পাইয়া, তাঁহার অদৃষ্টে ছিল না। তিনি অতিশয় ধনী ছিলেন, এখন অতি দু:খিনী হইয়াছিলেন, এই শারীরিক এবং মানসিক দ্বিবিধ কষ্ট, তাঁহার সহ্য হইল না। রোগ ক্রমে বৃদ্ধি পাইয়া, তাঁহার শেষ কাল উপস্থিত হইল।
এমত সময়ে বিলাত হইতে সংবাদ আসিল যে, প্রিবি কৌন্সিলের আপীল তাঁহার পক্ষে নিষ্পত্তি পাইয়াছে; তিনি আপন সম্পত্তি পুন:প্রাপ্ত হইবেন, ওয়াশিলাতের টাকা ফেরত পাইবেন এবং তিনি আদালতের খরচা পাইবেন। কামাখ্যানাথ বাবু তাঁহার পক্ষে হাইকোর্টের উকীল ছিলেন, তিনি স্বয়ং এই সংবাদ লইয়া রাধারাণীর মাতার কুটীরে উপস্থিত হইলেন। সুসংবাদ শুনিয়া, রুগ্নার অবিরল নয়নাশ্রু পড়িতে লাগিল।
তিনি নয়নাশ্রু সংবরণ করিয়া কামাখ্যা বাবুকে বলিলেন, “যে প্রদীপ নিবিয়াছে, তাহাতে তেল দিলে কি হইবে? আপনার এ সুসংবাদেও আমার আর প্রাণরক্ষা হইবে না। আমার আয়ু:শেষ হইয়াছে। তবে আমার এই সুখ যে, রাধারাণী আর অনাহারে প্রাণত্যাগ করিবে না। তাই বা কে জানে? সে বালিকা, তাহার এ সম্পত্তি কে রক্ষা করিবে? কেবল আপনিই ভরসা। আপনি আমার এই অন্তিম কালে আমারে একটি ভিক্ষা দিউন–নহিলে আর কাহার কাছে চাহিব |”
কামাখ্যা বাবু অতি ভদ্রলোক এবং তিনি রাধারাণীর পিতার বন্ধু ছিলেন। রাধারাণীর মাতা দুর্দশাগ্রস্ত হইলে, তিনি রাধারাণীর মাতাকে বলিয়াছিলেন যে, যতদিন না আপীল নিষ্পত্তি পায়, অন্তত: ততদিন তোমরা আসিয়া আমার গৃহে অবস্থান কর, আমি আপনার মাতার মত তোমাকে রাখিব। রাধারাণীর মাতা তাহাতে অস্বীকৃতা হইয়াছিলেন। পরিশেষে কামাখ্যা বাবু কিছু কিছু মাসিক সাহায্য করিতে চাহিলেন। “আমার এখনও কিছু হাতে আছে–আবশ্যক হইলে চাহিয়া লইব |” এইরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া রাধারাণীর মাতা সে সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতা হইয়াছিলেন। রুক্মিণীকুমারের দান গ্রহণ তাঁহাদিগের প্রথম ও শেষ দান গ্রহণ।
কামাখ্যা বাবু এতদিন বুঝিতে পারেন নাই যে, তাঁহারা এরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইয়াছেন। দশা দেখিয়া কামাখ্যা বাবু অত্যন্ত কাতর হইলেন। আবার রাধারাণীর মাতা, যুক্তকরে তাঁহার কাছে ভিক্ষা চাহিতেছেন, দেখিয়া আরও কাতর হইলেন; বলিলেন, “আপনি আজ্ঞা করুন, আমি কি করিব? আপনার যাহা প্রয়োজনীয়, আমি তাহাই করিব |”
রাধারাণীর মাতা বলিলেন, “আমি চলিলাম, কিন্তু রাধারাণী রহিল। এক্ষণে আদালত হইতে আমার শ্বশুরের যথার্থ উইল সিদ্ধ হইয়াছে; অতএব রাধারাণী একা সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হইবে। আপনি তাহাকে দেখিবেন, আপনার কন্যার ন্যায় তাহাকে রক্ষা করিবেন, এই আমার ভিক্ষা। আপনি এই কথা স্বীকার করিলেই আমি সুখে মরিতে পারি |”
কামাখ্যা বাবু বলিলেন, “আমি আপনার নিকট শপথ করিতেছি, আমি রাধারাণীকে আপন কন্যার অধিক যত্ন করিব। আমি কায়মনোবাক্যে এ কথা কহিলাম; আপনি বিশ্বাস করুন |”
যিনি মুমূর্ষু, তিনি কামাখ্যা বাবুর চক্ষে জল দেখিয়া, তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন। তাঁহার সেই শীর্ণ শুষ্ক অধরে একটু আহ্লাদের হাসি দেখা দিল। হাসি দেখিয়া কামাখ্যা বাবু বুঝিলেন, ইনি আর বাঁচিবেন না।
কামাখ্যা বাবু তাঁহাকে বিশেষ করিয়া অনুরোধ করিলেন যে, এক্ষণে আমার গৃহে চলুন–পরে ভদ্রাসন দখল হইলে আসিবেন। রাধারাণীর মাতার যে অহঙ্কার, সে দারিদ্র্যজনিত–এজন্য দারিদ্র্যাবস্থায় তাঁহার গৃহে যাইতে চাহেন নাই। এক্ষণে আর দারিদ্র্য নাই, সুতরাং আর সে অহঙ্কারও নাই। এক্ষণে তিনি যাইতে সম্মত হইলেন। কামাখ্যা বাবু, রাধারাণী ও তাহার মাতাকে সযত্নে নিজালয়ে লইয়া গেলেন।
তিনি রীতিমত পীড়িতার চিকিৎসা করাইলেন। কিন্তু তাঁহার জীবন রক্ষা হইল না, অল্পদিনেই তাঁহার মৃত্যু হইল।
উপযুক্ত সময়ে কামাখ্যা বাবু রাধারাণীকে তাহার সম্পত্তিতে দখল দেওয়াইলেন। কিন্তু রাধারাণী বালিকা বলিয়া তাহাকে নিজ বাটীতে একা থাকিতে দিলেন না, আপন গৃহেই রাখিলেন।
কালেক্টর সাহেব, রাধারাণীর সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে আনিবার জন্য যত্ন পাইলেন, কিন্তু কামাখ্যা বাবু বিবেচনা করিলেন, আমি রাধারাণীর জন্য যতদূর করিব, সরকারি কর্মচারিগণ ততদূর করিবে না। কামাখ্যা বাবুর কৌশলে কালেক্টের সাহেব নিরস্ত হইলেন। কামাখ্যা বাবু স্বয়ং রাধারাণীর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন।
বাকি রাধারাণীর বিবাহ। কিন্তু কামাখ্যা বাবু নব্যতন্ত্রের লোক–বাল্যবিবাহে তাঁহার দ্বেষ ছিল। তিনি বিবেচনা করিলেন যে, রাধারাণীর বিবাহ তাড়াতাড়ি না দিলে, জাতি গেল মনে করে, এমত কেহ তাহার নাই। অতএব যবে রাধারাণী, স্বয়ং বিবেচনা করিয়া বিবাহে ইচ্ছুক হইবে, তবে তাহার বিবাহ দিব। এখন সে লেখাপড়া শিখুক।
এই ভাবিয়া কামাখ্যা বাবু রাধারাণীর বিবাহের কোন উদ্যোগ না করিয়া, তাহাকে উত্তমরূপে সুশিক্ষিত করাইলেন।
রাধারাণী – ০৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পাঁচ বৎসর গেল–রাধারাণী পরম সুন্দরী ষোড়শবর্ষীয়া কুমারী। কিন্তু সে অন্ত:পুরমধ্যে বাস করে, তাহার সে রূপরাশি কেহ দেখিতে পায় না। এক্ষণে রাধারাণীর সম্বন্ধ করিবার সময় উপস্থিত হইল। কামাখ্যা বাবুর ইচ্ছা, রাধারাণীর মনের কথা বুঝিয়া তাহার সম্বন্ধ করেন। তত্ত্ব জানিবার জন্য আপনার কন্যা বসন্তকুমারীকে ডাকিলেন।
বসন্তের সঙ্গে রাধারাণীর সখিত্ব। উভয়ে সমবয়স্কা। এবং উভয়ে অত্যন্ত প্রণয়। কামাখ্যা বাবু বসন্তকে আপনার মনোগত কথা বুঝাইয়া বলিলেন।
বসন্ত সলজ্জভাবে, অথচ অল্প হাসিতে হাসিতে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “রুক্মিণীকুমার রায় কেহ আছে?”
কামাখ্যা বাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “না। তা ত জানি না। কেন?”
বসন্ত বলিল, “রাধারাণী রুক্মিণীকুমার ভিন্ন আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না |”
কা। সে কি? রাধারাণীর সঙ্গে অন্য ব্যক্তির পরিচয় কি প্রকারে হইল?
বসন্ত অবনতমুখে অল্প হাসিল। সে রথের রাত্রির বিবরণ সবিস্তারে রাধারাণীর কাছে শুনিয়াছিল, পিতার সাক্ষাতে সকল বিবৃত করিল। শুনিয়া কামাখ্যা বাবু রুক্মিণীকুমারের প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “রাধারাণীকে বুঝাইয়া বলিও, রাধারাণী একটি মহাভ্রমে পড়িয়াছে। বিবাহ কৃতজ্ঞতা অনুসারে কর্তব্য নহে। রুক্মিণীকুমারের নিকট রাধারাণীর কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত; যদি সময় ঘটে, তবে অবশ্য প্রত্যুপকার করিতে হইবে। কিন্তু বিবাহে রুক্মিণীকুমারের কোন দাবি দাওয়া নাই। তাতে আবার সে কি জাতি, কি বয়স, তাহা কেহ জানে না। তাহার পরিবার সন্তানাদি থাকিবারই সম্ভাবনা; রুক্মিণীকুমারের বিবাহ করিবারই বা সম্ভাবনা কি?
বসন্ত বলিল, “সম্ভাবনা কিছুই নাই, তাহাও রাধারাণী বিলক্ষণ বুঝিয়াছে। কিন্তু সেই রাত্রি অবধি, রুক্মিণীকুমারের একটি মানসিক প্রতিমা গড়িয়া আপনার মনে তাহা স্থাপিত করিয়াছে। যেমন দেবতাকে লোকে পূজা করে, রাধারাণী সেই প্রতিমা তেমন করিয়া, প্রত্যহ মনে মনে পূজা করে। এই পাঁচ বৎসর রাধারাণী আমাদিগের বাড়ী আসিয়াছে, এই পাঁচ বৎসরে এমন দিন প্রায় যায় নাই, যেদিন রাধারাণী রুক্মিণীকুমারের কথা আমার সাক্ষাতে একবারও বলে নাই। আর কেহ রাধারাণীকে বিবাহ করিলে, তাহার স্বামী সুখী হইবে না |”
কামাখ্যা বাবু মনে মনে বলিলেন, “বাতিক। ইহার একটু চিকিৎসা আবশ্যক। কিন্তু প্রথম চিকিৎসা বোধ হয়, রুক্মিণীকুমারের সন্ধান করা |”
কামাখ্যা বাবু রুক্মিণীকুমারের সন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। স্বয়ং কলিকাতায় তাঁহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। বন্ধুবর্গকেও সেই সন্ধানে নিযুক্ত করিলেন। দেশে দেশে আপনার মোয়াক্কেলগণকে পত্র লিখিলেন। প্রতি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন। সে বিজ্ঞাপন এইরূপ–
“বাবু রুক্মিণীকুমার রায়, নিম্ন স্বাক্ষরকারী ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবেন–বিশেষ প্রয়োজন আছে। ইহাতে রুক্মিণী বাবুর সন্তোষের ব্যতীত অসন্তোষের কারণ উপস্থিত হইবে না।
শ্রী ইত্যাদি__”
কিন্তু কিছুতেই রুক্মিণীকুমারের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। দিন গেল, মাস গেল, বৎসর গেল, তথাপি কৈ, রুক্মিণীকুমার ত আসিল না।
ইহার পর রাধারাণীর আর একটি ঘোরতর বিপদ উপস্থিত হইল–কামাখ্যা বাবুর লোকান্তরগতি হইল। রাধারাণী ইহাতে অত্যন্ত শোকাতুরা হইলেন, দ্বিতীয় বার পিতৃহীনা হইলেন মনে করিলেন। কামাখ্যা বাবুর শ্রাদ্ধাদির পর রাধারাণী আপন বাটীতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন এবং নিজ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান স্বয়ং করিতে লাগিলেন। কামাখ্যা বাবুর বিচক্ষণতা হেতু রাধারাণীর সম্পত্তি বিস্তর বাড়িয়াছিল।
বিষয় হস্তে লইয়াই রাধারাণী প্রথমেই দুই লক্ষ মুদ্রা গবর্ণমেণ্টে প্রেরণ করিলেন। তৎসঙ্গে এই প্রার্থনা করিলেন যে, এই অর্থে তাঁহার নিজ গ্রামে একটি অনাথনিবাস স্থাপিত হউক। তাহার নাম হউক–রুক্মিণীকুমারের প্রাসাদ |”
গবর্ণমেণ্টের কর্মচারিগণ প্রস্তাবিত নাম শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন, কিন্তু তাহাতে কে কথা কহিবে? অনাথনিবাস সংস্থাপিত হইল। রাধারাণীর মত দরিদ্রাবস্থায় নিজ গ্রাম ত্যাগ করিয়া শ্রীরামপুরে কুটীর নির্মাণ করিয়াছিলেন; কেন না, যে গ্রামে যে ধনী ছিল, সে সহসা দরিদ্র হইলে, সে গ্রামে তাহার বাস করা কষ্টকর হয়। তাঁহাদিগের নিজ গ্রাম শ্রীরামপুর হইতে কিঞ্চিৎ দূর–আমরা সে গ্রামকে রাজপুর বলিব। এক্ষণে রাধারাণী রাজপুরেই বাস করিতেন। অনাথনিবাসও রাধারাণীর বাড়ীর সম্মুখে, রাজপুরে সংস্থাপিত হইল। নানা দেশ হইতে দীন দু:খী অনাথ আসিয়া তথায় বাস করিতে লাগিল।
রাধারাণী – ০৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
দুই এক বৎসর পরে একজন ভদ্রলোক সেই অনাথনিবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার বয়স ৩৫/৩৬ বৎসর। অবস্থা দেখিয়া, অতি ধীর, গম্ভীর এবং অর্থশালী লোক বোধ হয়। তিনি সেই “রুক্মিণীকুমারের প্রাসাদের” দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রক্ষকগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কাহার বাড়ী?”
তাহারা বলিল, “এ কাহারও বাড়ী নহে, এখানে দু:খী অনাথ লোক থাকে। ইহাকে ‘রুক্মিণীকুমারের প্রাসাদ’ বলে |”
আগন্তুক বলিলেন, “আমি ইহার ভিতরে গিয়া দেখিতে পারি?”
রক্ষকগণ বলিল, “দীন দু:খী লোকেও ইহার ভিতর অনায়াসে যাইতেছে–আপনাকে নিষেধ কি?”
দর্শক ভিতরে গিয়া সব দেখিয়া প্রত্যাবর্তন করিলেন। বলিলেন, “বন্দোবস্ত দেখিয়া আমার বড় আহ্লাদ হইয়াছে। কে এই অন্নসত্র দিয়াছে? রুক্মিণীকুমার কি তাঁহার নাম?”
রক্ষকেরা বলিল, “একজন স্ত্রীলোক এই অন্নসত্র দিয়াছেন |”
দর্শক জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে ইহাকে রুক্মিণীকুমারের প্রাসাদ বলে কেন?”
রক্ষকেরা বলিল, “তাহা আমরা কেহ জানি না |”
“রুক্মিণীকুমার কার নাম?”
“কাহারও নয় |”
“যিনি অন্নসত্র দিয়াছেন, তাঁহার নিবাস কোথায়?”
রক্ষকেরা সম্মুখে অতি বৃহৎ অট্টালিকা দেখাইয়া দিল।
আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “তোমরা যাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিলে, তিনি পুরুষ মানুষের সাক্ষাতে বাহির হইয়া থাকেন? রাগ করিও না, এখন অনেক বড় মানুষের মেয়ে মেম লোকের মত বাহিরে বাহির হইয়া থাকে, এই জন্যই জিজ্ঞাসা করিতেছি |”
রক্ষকেরা উত্তর করিল–“ইনি সেরূপ চরিত্রের নন। পুরুষের সমক্ষে বাহির হন না |”
প্রশ্নকর্তা ধীরে ধীরে রাধারাণীর অট্টালিকার অভিমুখে গিয়া, তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
রাধারাণী – ০৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যিনি আসিয়াছিলেন, তাঁহার পরিচ্ছদ সচরাচর বাঙ্গালী ভদ্রলোকের মত; বিশেষ পারিপাট্য, অথবা পারিপাট্যের বিশেষ অভাবও কিছু ছিল না, কিন্তু তাঁহার অঙ্গুলিতে একটি হীরকাঙ্গুরীয় ছিল; তাহা দেখিয়া রাধারাণীর কর্মকারগণ অবাক হইয়া তৎপ্রতি চাহিয়া রহিল, এত বড় হীরা তাহারা কখন অঙ্গুরীয়ে দেখে নাই। তাঁহার সঙ্গে কেহ লোক ছিল না, এজন্য তাহারা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না যে, কে ইনি? মনে করিল, বাবু স্বয়ং পরিচয় দিবেন। কিন্তু বাবু কোন পরিচয় দিলেন না। তিনি রাধারাণীর দেওয়ানজির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিলেন। বলিলেন, “এই পত্র আপনার মুনিবের কাছে পাঠাইয়া দিয়া, আমাকে উত্তর আনিয়া দিন |”
দেওয়ানজি বলিলেন, “আমার মুনিব স্ত্রীলোক, আবার অল্পবয়স্কা। এজন্য তিনি নিয়ম করিয়াছেন যে, কোন অপরিচিত লোকে পত্র আনিলে আমরা তাহা না পড়িয়া তাঁহার কাছে পাঠাইব না |”
আগন্তুক বলিল, “আপনি পড়ুন |”
দেওয়ানজি পত্র পড়িলেন–
“প্রিয় ভগিনি!
এ ব্যক্তি পুরুষ হইলেও ইঁহার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিও–ভয় করিও না। যেমত যেমত ঘটে, আমাকে লিখিও।
শ্রীমতী বসন্তকুমারী |”
কামাখ্যা বাবুর কন্যার স্বাক্ষর দেখিয়া, কেহ আর কিছু বলিল না। পত্র অন্ত:পুরে গেল।
অন্ত:পুর হইতে পরিচারিকা, পত্রবাহক বাবুকে লইতে আসিল। আর কেহ সঙ্গে যাইতে পারিল না–হুকুম নাই।
পরিচারিকা বাবুকে লইয়া এক সুসজ্জিত গৃহে বসাইলেন। রাধারাণীর অন্ত:পুরে সেই প্রথম পুরুষ মানুষ প্রবেশ করিল। দেখিয়া একজন পরিচারিকা রাধারাণীকে ডাকিতে গেল, আর একজন অন্তরালে থাকিয়া আগন্তুককে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। দেখিল যে, তাঁহার বর্ণটুকু গৌর, স্ফুটিত মল্লিকারাশির মত গৌর; তাঁহার শরীর দীর্ঘ, ঈষৎ স্থূল, কপাল দীর্ঘ, অতি সূক্ষ্ম পরিষ্কার ঘনকৃষ্ণ সুরঞ্জিত কেশজালে মণ্ডিত; চক্ষু বৃহৎ, কটাক্ষ স্থির, ভ্রূযুগ সূক্ষ্ম, ঘন দূরায়ত এবং নিবিড় কৃষ্ণ; নাসিকা দীর্ঘ এবং উন্নত; ওষ্ঠাধর রক্তবর্ণ, ক্ষুদ্র এবং কোমল; গ্রীবা দীর্ঘ, অথচ মাংসল; অন্যান্য অঙ্গ বস্ত্রে আচ্ছাদিত; কেবল অঙ্গুলিগুলি দেখা যাইতেছে, সেগুলি শুভ্র, সুগঠিত, এবং একটি বৃহদাকার হীরকে রঞ্জিত।
রাধারাণী সেই স্থানে আসিয়া পরিচারিকাকে বিদায় করিয়া দিলেন। রাধারাণী আসিবামাত্র দর্শকের বোধ হইল যে, সেই কক্ষমধ্যে এক অভিনব সূর্যোদয় হইল–রূপের আলোকে তাঁহার মস্তকের কেশ পর্যন্ত যেন প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।
আগন্তুকের উচিত, প্রথম কথা কহা–কেন না, তিনি পুরুষ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ–কিন্তু তিনি সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হইয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রাধারাণী একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “আপনি এরূপ গোপনে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিলাষ করিয়াছেন কেন? আমি স্ত্রীলোক, কেবল বসন্তের অনুরোধেই আমি ইহা স্বীকার করিয়াছি |”
আগন্তুক বলিল, “আমি আপনার সহিত এরূপ সাক্ষাতের অভিলাষী হইয়াছি, ঠিক তা নহে |”
রাধারাণী অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “তা নয় বটে। তবে বসন্ত কি জন্য এরূপ অনুরোধ করিয়াছেন, তাহা কিছু লেখেন নাই। বোধ হয়, আপনি জানেন |”
আগন্তুক একখানি অতি পুরাতন সংবাদপত্র বাহির করিয়া তাহা রাধারাণীকে দেখাইলেন। রাধারাণী পড়িলেন; কামাখ্যা বাবুর স্বাক্ষরিত রুক্মিণীকুমার সম্বন্ধে সেই বিজ্ঞাপন। রাধারাণী দাঁড়াইয়াছিলেন–দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া নারিকেলপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন। আগন্তুকের দেবতুল্য গঠন দেখিয়া, মনে ভাবিলেন, ইনিই আমার সেই রুক্মিণীকুমার। আর থাকিতে পারিলেন না–জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন, “আপনার নাম কি রুক্মিণীকুমার বাবু?”
আগন্তুক বলিলেন, “না |” “না” শব্দ শুনিয়াই রাধারাণী ধীরে ধীরে আসন গ্রহণ করিলেন। আর দাঁড়াইতে পারিলেন না–তাঁহার বুক যেন ভাঙ্গিয়া গেল। আগন্তুক বলিলেন, “না। আমি যদি রুক্মিণীকুমার হইতাম, তাহা হইলে, কামাখ্যা বাবু এ বিজ্ঞাপন দিতেন না। কেন না, তাঁহার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কিন্তু যখন এই বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তখনি আমি ইহা দেখিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিলাম |”
রাধারাণী বলিল, “যদি আপনার সঙ্গে এই বিজ্ঞাপনের কোন সম্বন্ধ নাই তবে আপনি ইহা তুলিয়া রাখিয়াছিলেন কেন?”
উত্তরকারী বলিলেন, “একটি কৌতুকের জন্য। আজি আট দশ বৎসর হইল, আমি যেখানে সেখানে বেড়াইতাম –কিন্তু লোকলজ্জাভয়ে আপনার নামটা গোপন করিয়া কাল্পনিক নাম ব্যবহার করিতাম। কাল্পনিক নাম রুক্মিণীকুমার। আপনি অত বিমনা হইতেছেন কেন?”
রাধারাণী একটু স্থির হইলেন-আগন্তুক বলিতে লাগিলেন-“যথার্থ রুক্মিণীকুমার নাম ধরে, এমন কাহাকেও চিনি না। যদি কেহ আমারই তল্লাস করিয়া থাকে-তাহা সম্ভব নহে-তথাপি কি জানি-সাত পাঁচ ভাবিয়া বিজ্ঞাপনটি তুলিয়া রাখিলাম-কিন্তু কামাখ্যা বাবুর কাছে আসিতে সাহস হইল না।”
“পরে?”
“পরে কামাখ্যা বাবুর শ্রাদ্ধে তাঁহার পুত্রগণ আমাকে নিমন্ত্রণ করিল, কিন্তু আমি কার্যগতিকে আসিতে পারি নাই। সম্প্রতি সেই ত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য তাঁহার পুত্রদিগের নিকট আসিলাম। কৌতুকবশত: বিজ্ঞাপন সঙ্গে আনিয়াছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে উহার কথা উত্থাপন করিয়া কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠপুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, এ বিজ্ঞাপন কেন দেওয়া হইয়াছিল? কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বলিলেন, যে রাধারাণীর অনুরোধে। আমিও এক রাধারাণীকে চিনিতাম–এক বালিকা–আমি একদিন দেখিয়া তাহাকে আর ভুলিতে পারিলাম না। সে মাতার পথ্যের জন্য, আপনি অনাহারে থাকিয়া বনফুলের মালা গাঁথিয়া–সেই অন্ধকার বৃষ্টিতে___” বক্তা আর কথা কহিতে পারিলেন না–তাঁহার চক্ষু: জলে পূরিয়া গেল। রাধারাণীরও চক্ষু: জলে ভাসিতে লাগিল। চক্ষু: মুছিয়া রাধারাণী বলিল, “ইতর লোকের কথায় এখন প্রয়োজন কি? আপনার কথা বলুন |”
আগন্তুক উত্তর করিলেন, “রাধারাণী ইতর লোক নহে। যদি সংসারে কেহ দেবকন্যা থাকে, তবে সেই রাধারাণী। যদি কাহাকে পবিত্র, সরলচিত্ত, এ সংসারে আমি দেখিয়া থাকি, তবে সেই রাধারাণী–যদি কাহারও কথায় অমৃত থাকে, তবে সেই রাধারাণী–যথার্থ অমৃত! বর্ণে বর্ণে অপ্সরার বীণা বাজে, যেন কথা কহিতে বাধ বাধ করে অথচ সকল কথা পরিষ্কার, সুমধুর,-অতি সরল! আমি এমন কণ্ঠ কখন শুনি নাই–এমন কথা কখনও শুনি নাই!”
রুক্মিণীকুমার–এক্ষণে ইহাকে রুক্মিণীকুমারই বলা যাউক–ঐ সঙ্গে মনে মনে বলিলেন, “আবার আজ বুঝি তেমনি কথা শুনিতেছি!”
রুক্মিণীকুমার মনে মনে ভাবিতেছিলেন, আজি এত দিন হইল, সেই বালিকার কণ্ঠস্বর শুনিয়াছিলাম, ঠিক আজিও সে কণ্ঠ আমার মনের ভিতর জাগিতেছে! যেন কাল শুনিয়াছি। অথচ আজি এই সুন্দরীর কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমার সেই রাধারাণীকেই বা মনে পড়ে কেন? এই কি সেই? আমি মূর্খ! কোথায় সেই দীনদু:খিনী, কুটীরবাসিনী ভিখারিণী–আর কোথায় এই উচ্চপ্রাসাদবিহারিণী ইন্দ্রাণী! আমি সে রাধারাণীকে অন্ধকারে ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই, সুতরাং জানি না যে, সে সুন্দরী, কি কুৎসিতা, কিন্তু এই শচীনিন্দিতা রূপসীর শতাংশের একাংশ রূপও যদি তাহার থাকে, তাহা হইলে সেও লোকমনোমোহিনী বটে!
এ দিকে রাধারাণী, অতৃপ্তশ্রবণে রুক্মিণীকুমারের মধুর বচনগুলি শুনিতেছিলেন–মনে মনে ভাবিতেছিলেন, তুমি যাহা পাপিষ্ঠা রাধারাণীকে বলিতেছ, কেবল তোমাকেই সেই কথাগুলি বলা যায়! তুমি আজ আট বৎসরের পর রাধারাণীকে ছলিবার জন্য কোন্ নন্দনকানন ছাড়িয়া পৃথিবীতে নামিলে? এত দিনে কি আমার হৃদয়ের পূজায় প্রীত হইয়াছ? তুমি কি অন্তর্যামী? নহিলে আমি লুকাইয়া লুকাইয়া, হৃদয়ের ভিতরে লুকাইয়া তোমাকে যে পূজা করি, তাহা তুমি কি প্রকারে জানিলে?
এই প্রথম, দুইজনে স্পষ্ট দিবসালোকে, পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। দুইজনে, দুইজনের মুখপানে চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন, আর এমন আছে কি? এই সসাগরা, নদনদীচিত্রিতা, জীবসঙ্কুলা পৃথিবীতলে এমন তেজোময়, এমন মধুর, এমন সুখময়, এমন চঞ্চল অথচ স্থির, এমন সহাস্য অথচ গম্ভীর, এমন প্রফুল্ল অথচ ব্রীড়াময়, এমন আর আছে কি? চিরপরিচিত অথচ অত্যন্ত অভিনব, মুহূর্তে মুহূর্তে অভিনব মধুরিমাময়, আত্মীয় অথচ অত্যন্ত পর, চিরস্মৃত অথচ অদৃষ্টপূর্ব–কখন দেখি নাই, আর এমন দেখিব না, এমন আর আছে কি?
রাধারাণী বলিল.-বড় কষ্টে বলিতে হইল, কেন না, চক্ষের জল থামে না, আবার সেই চক্ষের জলের উপর কোথা হইতে পোড়া হাসি আসিয়া পড়ে–রাধারাণী বলিল, “তা, আপনি এতক্ষণ কেবল সেই ভিখারিণীর কথাই বলিলেন, আমাকে যে কেন দর্শন দিয়াছেন, তা ত এখনও বলেন নাই |”
হাঁ গা, এমন করিয়া কি কথা কহা যায় গা? যাহার গলা ধরিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছে, প্রাণেশ্বর! দু:খিনীর সর্বস্ব! চিরবাঞ্ছিত! বলিয়া যাহাকে ডাকিতে ইচ্ছা করিতেছে; আবার যাকে সেই সঙ্গে হাঁ গা, সেই রাধারাণী পোড়ারমুখী তোমার কে হয় গা” বলিয়া তামাসা করিতে ইচ্ছা করিতেছে–তার সঙ্গে আপনি, মশাই, দর্শন দিয়াছেন, এই সকল কথা নিয়ে কি কথা কহা যায় গা? তোমরা পাঁচজন রসিকা, প্রেমিকা, বাক্চরতুরা, বয়োধিকা ইত্যাদি ইত্যাদি আছ, তোমরা পাঁচজনে বল দেখি, ছেলেমানুষ রাধারাণী কেমন করে এমন করে কথা কয় গা?
রাধারাণী মনে মনে একটু পরিতাপ করিল; কেন না, কথাটা একটু ভর্ৎসনার মত হইল। রুক্মিণীকুমার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন,-“তাই বলিতেছিলাম। আমি সেই রাধারাণীকে চিনিতাম–রাধারাণীকে মনে পড়িল, একটু–এতটুকু–অন্ধকার রাত্রে জোনাকির ন্যায়–একটু আশা হইল যে, যদি এই রাধারাণী আমার সেই রাধারাণী হয়!”
“তোমার রাধারাণী |” রাধারাণী ছল ধরিয়া চুপি চুপি এই কথাটি বলিয়া, মুখ নত করিয়া ঈষৎ হাসিল। হাঁ গা, না হেসে কি থাকা যায় গা? তোমরা আমার রাধারাণীর নিন্দা করিও না।
রুক্মিণীকুমারও মনে মনে ছল ধরিল–এ তুমি বলে কেন? কে এ? প্রকাশ্যে বলিল, “আমারই রাধারাণী। আমি একরাত্রি মাত্র তাহাকে দেখিয়া–দেখিয়াছিই বা কেমন করিয়া বলি–এই আট বৎসরেও তাহাকে ভুলি নাই। আমারই রাধারাণী |”
রাধারাণী বলিল, “হোক আপনারই রাধারাণী |”
রুক্মিণী বলিতে লাগিলেন, “সেই ক্ষুদ্র আশায় আমি কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম, রাধারাণী কে? কামাখ্যা বাবুর পুত্র সবিস্তারে পরিচয় দিতে বোধ হয় অনিচ্ছুক ছিলেন; কেবল বলিলেন, ‘আমাদিগের কোন আত্মীয়ার কন্যা |’ যেখানে তাঁহাকে অনিচ্ছুক দেখিলাম, সেখানে আর অধিক পীড়াপীড়ি করিলাম না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলাম, রাধারাণী কেন রুক্মিণীকুমারের সন্ধান করিয়াছিলেন, শুনিতে পাই কি? যদি প্রয়োজন হয় ত বোধ করি, আমি কিছু সন্ধান দিতে পারি। আমি এই কথা বলিলে, তিনি বলিলেন, ‘কেন রাধারাণী রুক্মিণীকুমারকে খুঁজিয়াছিলেন, তাহা আমি সবিশেষ জানি না; আমার পিতৃঠাকুর জানিতেন; বোধ করি, আমার ভগিনীও জানিতে পারেন। যেখানে আপনি সন্ধান দিতে পারেন বলিতেছেন, সেখানে আমার ভগিনীকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে হইতেছে |’ এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। প্রত্যাগমন করিয়া তিনি আমাকে যে পত্র দিলেন, সে পত্র আপনাকে দিয়াছি। তিনি আমাকে সেই পত্র দিয়া বলিলেন, আমার ভগিনী সবিশেষ কিছু ভাঙ্গিয়া চুরিয়া বলিলেন না, কেবল এই পত্র দিলেন, আর বলিলেন যে, এই পত্র লইয়া তাঁহাকে স্বয়ং রাজপুরে যাইতে বলুন। রাজপুরে যিনি অন্নসত্র দিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বলিবেন। আমি সেই পত্র লইয়া আপনার কাছে আসিয়াছি। কোন অপরাধ করিয়াছি কি?”
রাধারাণী বলিলেন, “জানি না। বোধ হয় যে, আপনি মহাভ্রমে পতিত হইয়াই এখানে আসিয়াছেন। আপনার রাধারাণী কে, তাহা আমি চিনি কিনা, বলিতে পারিতেছি না। সে রাধারাণীর কথা কি, শুনিলে বলিতে পারি, আমা হইতে তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যাইবে কি
না |”
রুক্মিণী সেই রথের কথা সবিস্তারে বলিলেন, কেবল নিজদত্ত অর্থ বস্ত্রের কথা কিছু বলিলেন না। রাধারাণী বলিলেন–“স্পষ্ট কথা মার্জনা করিবেন। আপনাকে রাধারাণীর কোন কথা বলিতে সাহস হয় না; কেন না, আপনাকে দয়ালু লোক বোধ হইতেছে না। যদি আপনি সেরূপ দয়ার্দ্রচিত্ত হইতেন, তাহা হইলে আপনি যে ভিখারী বালিকার কথা বলিলেন, তাহাকে অমন দুর্দশাপন্না দেখিয়া অবশ্য তার কিছু আনুকূল্য করিতেন। কই, আনুকূল্য করার কথা ত কিছু আপনি বলিলেন না?”
রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আনুকূল্য বিশেষ কিছুই করিতে পারি নাই। আমি সেদিন নৌকাপথে রথ দেখিতে আসিয়াছিলাম–পাছে কেহ জানিতে পারে, এই জন্য ছদ্মবেশে রুক্মিণীকুমার রায় পরিচয়ে লুকাইয়া আসিয়াছিলাম–অপরাহ্নে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় বোটে থাকিতে সাহস না করিয়া একা তটে উঠিয়া আসিয়াছিলাম। সঙ্গে যাহা অল্প ছিল, তাহা রাধারাণীকেই দিয়াছিলাম; কিন্তু সে অতি সামান্য। পরদিন প্রাতে আসিয়া উহাদিগের বিশেষ সংবাদ লইব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রে আমার পিতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া তখনই আমাকে কাশী যাইতে হইল। পিতা অনেক দিন রুগ্ন হইয়া রহিলেন, কাশী হইতে প্রত্যাগমন করিতে আমার বৎসরাধিক বিলম্ব হইল। বৎসর পরে আমি ফিরিয়া আসিয়া আবার সেই কুটীরের সন্ধান করিলাম–কিন্তু তাহাদিগকে আর সেখানে দেখিলাম না |”
রা। একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিতেছে। বোধ হয়, সে রথের দিন নিরাশ্রয়ে, বৃষ্টি বাদলে, আপনাকে সেই কুটীরেই আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। আপনি কতক্ষণ সেখানে অবস্থিতি করিলেন?
রু। অধিকক্ষণ নহে। আমি যাহা রাধারাণীর হাতে দিয়াছিলাম, তাহা দেখিবার জন্য রাধারাণী আলো জ্বলিতে গেল–আমি সেই অবসরে তাহার বস্ত্র কিনিতে চলিয়া আসিলাম।
রা। আর কি দিয়া আসিলেন?
রু। আর কি দিব? একখানি ক্ষুদ্র নোট ছিল, তাহা কুটীরে রাখিয়া আসিলাম।
রা। নোটখানি ওরূপে দেওয়া বিবেচনাসিদ্ধ হয় নাই–তাহারা মনে করিতে পারে, আপনি নোটখানি হারাইয়া গিয়াছেন।
রু। না, আমি পেন্চসিলে লিখিয়া দিয়াছিলাম, “রাধারাণীর জন্য |” তাহাতে নাম স্বাক্ষর করিয়াছিলাম, “রুক্মিণীকুমার রায় |” যদি সেই রুক্মিণীকুমারকে সেই রাধারাণী অন্বেষণ করিয়া থাকে, এই ভরসায় বিজ্ঞাপনটি তুলিয়া রাখিয়াছিলাম।
রা। তাই বলিতেছিলাম, আপনাকে দয়ার্দ্রচিত্ত বলিয়া বোধ হয় না। যে রাধারাণী আপনার শ্রীচরণ দর্শন জন্য–এইটুকু বলিতেই–আ ছি ছি রাধারাণী! ফুলের কুঁড়ির ভিতর যেমন বৃষ্টির জল ভরা থাকে, ফুলটি নীচু করিলেই ঝরঝর করিয়া পড়িয়া যায়, রাধারাণী মুখ নত করিয়া এইটুকু বলিতেই, তাহার চোখের জল ঝরঝর করিয়া পড়িতে লাগিল। অমনই যেদিকে রুক্মিণীকুমার ছিলেন, সেই দিকের মাথার কাপড়টা বেশী করিয়া টানিয়া দিয়া সে ঘর হইতে রাধারাণী বাহির হইয়া গেল। রুক্মিণীকুমার বোধ হয়, চক্ষের জলটুকু দেখিতে পান নাই, কি পাইয়াই থাকিবেন, বলা যায় না।
রাধারাণী – ০৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বাহিরে আসিয়া, মুখে চক্ষে জল দিয়া অশ্রচিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া, রাধরাণী ভাবিতে লাগিল। ভাবিল, ইনিই ত রুক্মিণীকুমার। আমিও সেই রাধারাণী। দুইজনে দুইজনের জন্য মন তুলিয়া রাখিয়াছি। এখন উপায়? আমি যে রাধারাণী, তা উহাকে বিশ্বাস করাইতে পারি–তার পর? উনি কি জাতি, তা কে জানে। জাতিটা এখনই জানিতে পারা যায়। কিন্তু উনি যদি আমার জাতি না হন! তবে ধর্মবন্ধন ঘটিবে না, চিরন্তনের যে বন্ধন, তাহা ঘটিবে না, প্রাণের বন্ধন ঘটিবে না। তবে আর উঁহার সঙ্গে কথায় কাজ কি? না হয় এ জন্মটা রুক্মিণীকুমার নাম জপ করিয়া কাটাইব। এতদিন সেই জপ করিয়া কাটাইয়াছি, জোয়ারের প্রথম বেগটা কাটিয়া গিয়াছে–বাকি কাল কাটিবে না কি?”
এই ভাবিতে ভাবিতে রাধারাণীর আবার নাকের পাটা ফাঁপিয়া উঠিল, ঠোঁট দুখানা ফুলিয়া উঠিল–আবার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। আবার সে জল দিয়া মুখ চোখ ধুইয়া টৌয়ালিয়া দিয়া মুছিয়া ঠিক হইয়া আসিল। রাধারাণী আবার ভাবিতে লাগিল,–“আচ্ছা! যদি আমার জাতিই হন, তা হলেই বা ভরসা কি? উনি ত দেখিতেছি–বয়:প্রাপ্ত–কুমার, এমন সম্ভাবনা কি? তা হলেনই বা বিবাহিত? না! না! তা হইবে না। নাম জপ করিয়া মরি, সে অনেক ভাল–সতীন সহিতে পারিব না।
“তবে এখন কর্তব্য কি? জাতির কথাটা জিজ্ঞাসা করিয়াই কি হইবে? তবে রাধারাণীর পরিচয়টা দিই। আর উনি কে, তাহা জানিয়া লই; কেন না, রুক্মিণীকুমার ত ওঁর নাম নয়–তা ত শুনিলাম। যে নাম জপ করিয়া মরিতে হইবে, তা শুনিয়া লই। তার পর বিদায় দিয়া কাঁদিতে বসি। আ পোড়ারমুখী বসন্ত! না বুঝিয়া, না জানিয়া এ সামগ্রী কেন পাঠাইলি? জানিস না কি, এ জীবনসমুদ্র অমন করিয়া মন্থন করিতে গেলে, কাহারও কপালে অমৃত, কাহারও কপালে গরল উঠে!
“আচ্ছা! পরিচয়টা ত দিই |” এই ভাবিয়া রাধারাণী, যাহা প্রাণের অধিক যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা বাহির করিয়া আনিল। সে সেই নোটখানি; বলিয়াছি, রাধারাণী তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল। রাধারাণী তাহা আঁচলে বাঁধিল। বাঁধিতে বাঁধিতে ভাবিতে লাগিল–
“আচ্ছা, যদি মনের বাসনা পূরিবার মতনই হয়? তবে শেষ কথাটা কে বলিবে?” এই ভাবিয়া রাধারাণী আপনাআপনি হাসিয়া কুটপাট হইল। “আ, ছি–ছি–ছি! তা ত পারিব না। বসন্তকে যদি আনাইতাম! ভাল, উঁহাকে এখন দুদিন বসাইয়া রাখিয়া বসন্তকে আনাইতে পারিব না? উনি না হয় সে দুই দিন আমার লাইব্রেরি হইতে বহি পড়ুন না! পড়া শুনা করেন না কি? ওঁরই জন্য ত লাইব্রেরি করিয়া রাখিয়াছি। তা যদি দুই দিন থাকিতে রাজি না হন? উঁহার যদি কাজ থাকে? তবে কি হবে? ওঁতে আমাতেই সে কথাটা কি হবে? ক্ষতি কি, ইংরেজের মেয়ের কি হয়? আমাদের দেশে তাতে নিন্দা আছে, তা আমি দেশের লোকের নিন্দার ভয়ে কোন্ কাজটাই করি? এই যে ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিয়ে করলেম না, এতে কে না কি বলে? আমি ত বুড়া বয়স পর্যন্ত কুমারী;-তা এ কাজটা না হয় ইংরেজের মেয়ের মত হইল |”
তার পর রাধারাণী বিষণ্ণ মনে ভাবিল, তা যেন হলো; তাতেও বড় গোল! মোমবাতিতে গড়া মেয়েদের মাঝখানে প্রথাটা এই যে, পুরুষ মানুষেই কথাটা পাড়িবে। ইনি যদি কথাটা না পাড়েন? না পাড়েন, তবে–তবে হে ভগবান! বলিয়া দাও, কি করিব! লজ্জাও তুমি গড়িয়াছ–যে আগুনে আমি পুড়িতেছি, তাহাও তুমি গড়িয়াছ! এ আগুনে সে লজ্জা কি পুড়িবে না? তুমি এই সহায়হীনা, অনাথাকে দয়া করিয়া, পবিত্রতার আবরণে আমাকে আবৃত করিয়া লজ্জার আবরণ কাড়িয়া লও। তোমার কৃপায় যেন আমি এক দণ্ডের জন্য মুখরা হই!”
রাধারাণী – ০৭
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভগবান বুঝি, সে কথাও শুনিলেন। বিশুদ্ধচিত্তে যাহা বলিবে, তাহাই বুঝি তিনি শুনেন। রাধারাণী মৃদু হাসি হাসিতে হাসিতে, গজেন্দ্রমনে রুক্মিণীকুমারের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
রুক্মিণীকুমার তখন বলিলেন, “আপনি আমাকে বিদায় দিয়াও যান নাই, আমি যে কথা জানিবার জন্য আসিয়াছি, তাহাও জানিতে পারি নাই। তাই এখনও যাই নাই |”
রা। আপনি রাধারাণীর জন্য আসিয়াছেন, আমারও মনে আছে। এ বাড়ীতে একজন রাধারাণী আছে, সত্য বটে। সে আপনার নিকট পরিচিত হইবে কি না, সেই কথাটা ঠিক করিতে গিয়াছিলাম। রু। তার পর?
রাধারাণী তখন অল্প একটু হাসিয়া, একবার আপনার পা-র দিকে চাহিয়া, আপনার হাতের অলঙ্কার খুঁটিয়া; সেই ঘরে বসান একটা প্রস্তরনির্মিত Niobe প্রতিকৃতি পানে চাহিয়া, রুক্মিণীকুমারের পানে চাহিয়া বলিল–“আপনি বলিয়াছেন, রুক্মিণীকুমার আপনার যথার্থ নাম নহে। রাধারাণীর যে আরাধ্য দেবতা, তাহার নাম পর্যন্ত এখনও সে শুনিতে পায় নাই |”
রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আরাধ্য দেবতা! কে বলিল?”
রাধারাণী কথাটা অনবধানে বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, এখন সামলাইতে গিয়া বলিয়া ফেলিলেন, “নাম ঐরূপে জিজ্ঞাসা করিতে হয় |”
কি বোকা মেয়ে।
রুক্মিণীকুমার বলিলেন, “আমার নাম দেবেন্দ্রনারায়ণ রায় |”
রাধারাণী গুপ্তভাবে দুই হাত যুক্ত করিয়া মনে মনে ডাকিল, “জয় জগদীশ্বর! তোমার কৃপা অনন্ত!” প্রকাশ্যে বলিল, “রাজা দেবেন্দ্রনারায়ণের নাম শুনিয়াছি |”
দেবেন্দ্রনারায়ণ বলিলেন, “অমনই সকলেই রাজা কবলায়। আমাকে যে কুমার বলে, সে যথেষ্ট সম্মান করে|”
রা। এক্ষণে আমার সাহস বাড়িল। জানিলাম যে, আপনি আমার স্বজাতি। এখন স্পর্ধা হইতেছে, আজি আপনাকে আমার আতিথ্য স্বীকার করাই।
দে। সে কথা পরে হবে। রাধারাণী কৈ?
রা। ভোজনের পর সে কথা বলিব।
দে। মনে দু:খ থাকিলে ভোজনে তৃপ্তি হয় না।
রা। রাধারাণীর জন্য এত দু:খ? কেন?
দে। তা জানি না, বড় দু:খ-আট বৎসরের দু:খ, তাই জানি!
রা। হঠাৎ রাধারাণীর পরিচয় দিতে আমার কিছু সঙ্কোচ হইতেছে। আপনি রাধারাণীকে পাইলে কি করিবেন?
দে। কি আর করিব? একবার দেখিব।
রা। একবার দেখিবার জন্য এই আট বৎসর এত কাতর?
দে। রকম রকমের মানুষ থাকে।
রা। আচ্ছা, আমি ভোজনের পরে আপনাকে আপনার রাধারাণী দেখাইব। ঐ বড় আয়না দেখিতেছেন; উহার ভিতর দেখাইব। চাক্ষুষ দেখিতে পাইবেন না।
দে। চাক্ষুষ সাক্ষাতেই বা কি আপত্তি? আমি যে আট বৎসর কাতর!
ভিতরে ভিতরে দুইজনে দুইজনকে বুঝিতেছেন কিনা জানি না, কিন্তু কথাবার্তা এইরূপ হইতে লাগিল। রাধারাণী বলিতে লাগিল, “সে কথাটায় তত বিশ্বাস হয় না। আপনি আট বৎসর পূর্বে তাহাকে দেখিয়াছিলেন, তখন তাহার বয়স কত?
দে। এগার হইবে।
রা। এগার বৎসরের বালিকার উপর এত অনুরাগ?
দে। হয় না কি?
রা। কখনও শুনি নাই।
দে। তবে মনে করুন কৌতূহল!
রা। সে আবার কি?
দে। শুধুই দেখিবার ইচ্ছা।
রা। তা, দেখাইব, ঐ বড় আয়নার ভিতর। আপনি বাহিরে থাকিবেন।
দে। কেন, সম্মুখ সাক্ষাতে আপত্তি কি?
রা। সে কুলের কুলবতী।
দে। আপনিও ত তাই।
রা। আমার কিছু বিষয় আছে। নিজে তাহার তত্ত্বাবধান করি। সুতরাং সকলের সমুখেই আমাকে বাহির হইতে হয়। আমি কাহারও অধীন নই। সে তাহার স্বামীর অধীন, স্বামীর অনুমতি ব্যতীত–
দে। স্বামী!
রা। হাঁ! আশ্চর্য হইলেন যে?
দে। বিবাহিতা!
রা। হিন্দুর মেয়ে–ঊনিশ বৎসর বয়স–বিবাহিতা নহে?
দেবেন্দ্রনারায়ণ অনেক্ষণ মাথায় হাত দিয়া রহিলেন। রাধারাণী বলিলেন, “কেন, আপনি কি তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন?”
দে। মানুষ কি না ইচ্ছা করে?
রা। এরূপ ইচ্ছা রাণীজি জানিতে পারিয়াছেন কি?
দে। রাণীজি কেহ ইহার ভিতর নাই। রাধারাণী-সাক্ষাতের অনেক পূর্বেই আমার পত্নী- বিয়োগ হইয়াছে।
রাধারাণী আবার যুক্তকরে ডাকিল, “জয় জগদীশ্বর! আর ক্ষণকাল যেন আমার এমনই সাহস থাকে |” প্রকাশ্যে বলিল, “তা শুনিলেন ত, রাধারাণী পরস্ত্রী। এখনও কি তাহর দর্শন করিতে অভিলাষ করেন?”
দে। করি বৈ কি।
রা। সে কথাটা কি আপনার যোগ্য?
দে। রাধারাণী আমার সন্ধান করিয়াছিল কেন, তাহা এখনও আমার জানা হয় নাই।
রা। আপনি রাধারাণীকে যাহা দিয়াছিলেন, তাহা পরিশোধ করিবে বলিয়া। আপনি শোধ লইবেন কি?
দেবেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “যা দিয়াছি, তাহা পাইলে লইতে পারি |”
রা। কি কি দিয়াছেন?
দে। একখানা নোট।
রা। এই নিন।
বলিয়া রাধারাণী আঁচল হইতে সেই নোটখানি খুলিয়া দেবেন্দ্রনারায়ণের হাতে দিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ দেখিলেন, তাঁহার হাতে লেখা রাধারাণীর নাম সে নোটে আছে। দেখিয়া বলিলেন, “এ নোট কি রাধারাণীর স্বামী কখনও দেখিয়াছেন?”
রা। রাধারাণী কুমারী। স্বামীর কথাটা আপনাকে মিথ্যা বলিয়াছিলাম।
দে। তা, সব ত শোধ হইল না।
রা। আর কি বাকি?
দে। দুইটা টাকা, আর কাপড়।
রা। সব ঋণ যদি এখন পরিশোধ হয়, তবে আপনি আহার না করিয়া চলিয়া যাইবেন। পাওনা বুঝিয়া পাইলে কোন্ মহাজন বসে? ঋণের সে অংশ ভোজনের পর রাধারাণী পরিশোধ করিবে।
দে। আমার যে এখনও অনেক পাওনা বাকি?
রা। আবার কি?
দে। রাধারাণীকে মন:প্রাণ দিয়াছি–তা ত পাই নাই।
রা। অনেকদিন পাইয়াছেন। রাধারাণীর মন:প্রাণ আপনি অনেকদিন লইয়াছেন–তা সে দেনাটা শোধ-বোধ গিয়াছে।
দে। সুদ কিছু পাই না?
রা। পাইবেন বৈ কি।
দে। কি পাইব?
রা। শুভ লগ্নে সুতহিবুক যোগে কি অধম নারীদেহ আপনাকে দিয়া, রাধারাণী ঋণ হইতে মুক্ত হইবে।
এই বলিয়া রাধারাণী ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
রাধারাণী – ০৮ (শেষ)
অষ্টম পরিচ্ছেদ
রাধারাণীর আজ্ঞা পাইয়া, দেওয়ানজি আসিয়া রাজা দেবেন্দ্রনারায়ণকে বহির্বাটিতে লইয়া গিয়া যথেষ্ট সমাদর করিলেন। যথাবিহিত সময়ে রাজা দেবেন্দ্রনারায়ণ ভোজন করিলেন। রাধারাণী স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া তাঁহাকে ভোজন করাইলেন। ভোজনান্তে রাধারাণী বলিলেন, “আপনার নগদ দুইটাকা ও কাপড় এখনও ধারি। কাপড় পরিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি; টাকা খরচ করিয়াছি। তাহা আর ফেরত দিবার যো নাই। তাহার বদলে যাহা আপনার জন্য রাখিয়াছি, তাহা গ্রহণ করুন |”
এই বলিয়া রাধারাণী বহুমূল্য হীরকহার বাহির করিয়া দেবেন্দ্রের গলায় পরাইয়া দিতে গেলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিষেধ করিয়া বলিলেন, “যদি ঐরূপে দেনা পরিশোধ করিবে, তবে তোমার গলায় যে ছড়া আছে, তাহাই লইব |”
রাধারাণী হাসিতে হাসিতে আপনার গলার হার খুলিয়া দেবেন্দ্রনারায়ণের গলায় পরাইল। তখন দেবেন্দ্রনারায়ণ বলিলেন, “সব শোধ হইল– কিন্তু আমি একটু ঋণী হইলাম |”
রা। কিসে?
দে। সেই দুই পয়সার ফুলের মালার মূল্য ফেরত পাইলাম। তবে এখন মালা ফেরত দিতে আমি বাধ্য।
রাধারাণী হাসিল।
দেবেন্দ্রনারায়ণ ইচ্ছাপূর্বক মুক্তাহার পরিয়া আসিয়াছিলেন, তাহা রাধারাণীর কণ্ঠে পরাইয়া দিয়া বলিলেন, “এই ফেরত দিলাম |”
এমন সময়ে পোঁ করিয়া শাঁক বাজিল।
রাধারাণী হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “শাঁক বাজাইল কে?”
তাঁহার একজন দাসী, চিত্রা, উত্তর করিল, “আজ্ঞে, আমি |”
রাধারাণী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বাজাইলি?”
চিত্রা বলিল, “কিছু পাইব বলিয়া |”
বলা বাহুল্য যে, চিত্রা পুরস্কৃত হইল। কিন্তু তাহার কথাটা মিথ্যা। রাধারাণী তাহাকে শিখাইয়া পড়াইয়া দ্বারের নিকট বসাইয়া আসিয়াছিল।
তার পরে দুই জনে বিরলে বসিয়া মনের কথা হইল। রাধারাণী দেবেন্দ্রনারায়ণের বিস্ময় দূর করিবার জন্য, সেই রথের দিনের সাক্ষাতের পর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহার পিতামহের বিষয়সম্পত্তির কথা, পিতামহের উইল লইয়া মোকদ্দমার কথা, তজ্জন্য রাধারাণীর মার দৈন্যের কথা, মার মৃত্যুর কথা, কামাখ্যা বাবুর আশ্রয়ের কথা, প্রিবি কৌন্সিলের ডিক্রীর কথা, কামাখ্যা বাবুর মৃত্যুর কথা, সব বলিল। বসন্তের কথা বলিল, আপনার বিজ্ঞাপনের কথা বলিল। কাঁদিতে কাঁদিতে, হাসিতে হাসিতে, বৃষ্টি বিদ্যুতে, চাতকী চিরসঞ্চিত প্রণয়সম্ভাষণপিপাসা পরিতৃপ্ত করিল। নিদাঘসন্তপ্ত পর্বত যেমন বর্ষার বারিধারা পাইয়া শীতল হয়, দেবেন্দ্রনারায়ণও তেমনি শীতল হইলেন।
তিনি রাধারাণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার ত কেহ নাই। কিন্তু এ বাড়ী বড় জনাকীর্ণ দেখিতেছি |”
রাধারাণী বলিল, “দু:খের দিনে আমার কেহ ছিল না। এখন আমার অনেক আত্মীয়-কুটুম্ব জুটিয়াছে। আমি এ অল্প বয়সে একা থাকিতে পারি না, এজন্য যত্ন করিয়া তাহাদিগকে স্থান দিয়া রাখিয়াছি |”
দে। তাঁহাদের মধ্যে এমন সম্বন্ধবিশিষ্ট কেহ আছে যে, তোমাকে এই দীনদরিদ্রকে দান করিতে পারে?
রা। তাও আছে।
দে। তবে তিনি কেন সেই শুভলগ্নযুক্ত সুতহিবুক যোগটা খুঁজুন না?
রা। বোধ করি, এতক্ষণ সে কাজটা হইয়া গেল। তোমার সঙ্গে রাধারাণীর এরূপ সাক্ষাৎ অন্য কোন কারণে হইতে পারে না, এ পুরীতে সকলেই জানে। সংবাদ লইব কি?
দে। বিলম্বে কাজ কি?
রাধারাণী ডাকিল, “চিত্রে!” চিত্রা আসিল। রাধারাণী জিজ্ঞাসা করিল, “দিনটিন কিছু হইল কি?”
চিত্রা বলিল, “হাঁ, দেওয়ানজি মহাশয় পুরোহিত মহাশয়কে ডাকাইয়াছিলেন। পুরোহিত পরদিন বিবাহের উত্তম দিন বলিয়া গিয়াছেন। দেওয়ানজি মহাশয় সমস্ত উদ্যোগ করিতেছেন |”
তখন বসন্ত আসিল, কামাখ্যা বাবুর পুত্রেরা এবং পরিবারবর্গ সকলেই আসিল, আর যত বসন্তের কোকিল, সময়ের বন্ধু, যে যেখানে ছিল, সকলেই আসিল। দেবেন্দ্রনারায়ণের বন্ধু ও অনুচরবর্গ সকলেই আসিল।
বসন্ত আসিলে রাধারাণী বলিল, “তোমার কি আক্কেল ভাই বসন্ত?” বসন্ত বলিল, “কি আক্কেল ভাই রাধারাণী?”
রা। যাকে তাকে তুমি পত্র দিয়া পাঠাইয়া দাও কেন?
ব। কেন, লোকটা কি করেছে বল দেখি?
রাধারাণী তখন সকল কথা বলিল। বসন্ত বলিল, “রাগের কথা ত বটে। সুদ সুদ্ধ দেনা-পাওনা বুঝিয়া নেয়, এমন মহাজনকে যে বাড়ী চিনাইয়া দেয়, তার উপর রাগের কথাটা বটে |”
রাধারাণী বলিল, “তাই আজ আমি তোর গলায় দড়ি দিব!”
এই বলিয়া রাধারাণী যে হীরকহার রুক্মিণীকুমারকে পরাইতে গিয়াছিলেন, তাহা আনিয়া বসন্তের গলায় পরাইয়া দিলেন।
তার পর শুভ লগ্নে শুভবিবাহ হইয়া গেল।
===========
[সমাপ্ত]