চতুর্বিশতিতম পরিচ্ছেদ
শ্রী সন্ধ্যার পর জয়ন্তীকে নিভৃতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “জয়ন্তী! সেই গোলন্দাজ কে?”
জ। যাহাকে মহারাজ কাটিয়া ফেলিয়াছেন?
শ্রী। হাঁ, তুমি মহারাজকে কাটিতে নিষেধ করিয়াছিলে কেন?
জ। সন্ন্যাসিনীর জানিয়া কি হইবে?
শ্রী। না হয় একটু চোখের জল পড়িবে! তাহাতে সন্ন্যাসধর্ম ভ্রষ্ট হয় না।
জ। চোখের জলই বা কেন পড়িবে?
শ্রী। জীবন্তে আমি চিনিতে পারি নাই। কিন্তু তোমার নিষেধবাক্য শুনিয়া আমি মরা মুখখানা একটু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়াছিলাম। আমার একটা সন্দেহ হইতেছে। সে ব্যক্তি যেই হউক, আমিই তার মৃত্যুর কারণ। আমি তোপের মুখে বুক না দিলে সে অবশ্য তোপ দাগিত। তাহা হইলে মহারাজা নিশ্চিত বিনষ্ট হইতেন, গোলন্দাজকে তখন আর কে মারিত?
জ। সে মরিয়াছে, মহারাজা বাঁচিয়াছেন, সে তোমার উপযুক্ত কাজই হইয়াছে-তবে আর কথায় কাজ কি?
শ্রী। তবু মনের সন্দেহটা ভাঙ্গিয়া রাখিতে হইবে।
জ। সন্ন্যাসিনীর এ উৎকণ্ঠা কেন?
শ্রী। সন্ন্যাসিনীই হউক, যেই হউক, মানুষ মানুষই চিরকাল থাকিবে। আমি তোমাকে দেবী বলিয়াই জানি, কিন্তু যখন তুমিও লোকালয়ের লৌকিক লজ্জায় অভিভূত হইয়াছিলে, তখন আমার সন্ন্যাসবিভ্রংশের কথা কেন বল?
জ। তবে চল, সন্দেহ মিটিয়া আসি। আমি সে স্থানে একটা চিহ্ন রাখিয়া আসিয়াছি- রাত্রেও সে স্থানের ঠিক পাইব। কিন্তু আলো লইয়া যাইতে হইবে।
এই বলিয়া দুই জনে খড়ের মশাল তৈয়ার করিয়া তাহা জ্বালিয়া রণক্ষেত্র দেখিতে চলিল। চিহ্ন ধরিয়া জয়ন্তী অভীপ্সিত স্থানে পৌঁছিল। সেখানে মশালের আলো ধরিয়া তল্লাশ করিতে করিতে সেই গোলন্দাজের মৃতদেহ পাওয়া গেল। দেখিয়া শ্রীর সন্দেহ ভাঙ্গিল না। তখন জয়ন্তী সেই শবের রাশীকৃত পাকা চুল ধরিয়া টানিল—পরচুলা খসিয়া আসিল; শ্বেত শ্মশ্রু ধরিয়া টানিল-পরচুলা খসিয়া আসিল। তখন আর শ্রীর সন্দেহ রহিল না-গঙ্গারাম বটে।
শ্রীর চক্ষু দিয়া অবিরল জলধারা পড়িতে লাগিল। জয়ন্তী বলিল, “বহিন, যদি এ শোকে কাতর হইবে, তবে কেন সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলে?”
শ্রী বলিল, “মহারাজ আমাকে বৃথা ভর্ৎসনা করিয়াছেন। আমি তাঁহার প্রাণহন্ত্রী হই নাই—আপনার সহোদরেরই প্রাণঘাতিনী হইয়াছি। বিধিলিপি এত দিনে ফলিল |”
জ। বিধাতা কাহার দ্বারা কাহার দণ্ড করেন, তাহার বলা যায় না। তোমা হইতেই গঙ্গারাম দুই বার জীবন লাভ করিয়াছিল, আবার তোমা হইতেই ইহার বিনাশ হইল। যাই হউক, গঙ্গারাম পাপ করিয়াছিল, আবার পাপ করিতে আসিয়াছিল। বোধ হয়, রমার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা জানে না, ছদ্মবেশে ছলনা দ্বারা তাহাকে লাভ করিবার জন্যই মুসলমান সেনার গোলন্দাজ হইয়া আসিয়াছিল। কেন না, রমা তাহাকে চিনিতে পারিলে কখনই তাহার সঙ্গে যাইবে না মনে করিয়া থাকিবে। বোধ হয়, শিবিকাতে, রমা ছিল মনে করিয়া, তোপ লইয়া পথ রোধ করিয়াছিল। যাই হৌক, উহার জন্য বৃথা রোদন না করিয়া, উহার দাহ করা যাক আইস।
তখন দুই জনে ধরাধরি করিয়া গঙ্গারামের শব উপযুক্ত স্থানে লইয়া গিয়া দাহ করিল।
জয়ন্তী ও শ্রী আর সীতারামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিল না। সেই রাত্রিতে তাহারা কোথায় অন্ধকারে মিশিয়া গেল, কেহ জানিল না।
পরিশিষ্ট
আমাদের পূর্বপরিচিত বন্ধুদ্বয় রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ ইতিপূর্বেই পলাইয়া নলডাঙ্গায় বাস করিতেছিলেন। সেখানে একখানি আটচালায় বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন।
রা। কেমন হে ভায়া! মহম্মদপুরের খবরটা শুনেছ?
শ্যা। আজ্ঞে হাঁ-সে ত জানাই ছিল। গড়—টড় সব মুসলমানে দখল করে লুঠপাট করে নিয়েছে।
রা। রাজা-রাণীর কি হ’লো, কিছু ঠিক খবর রাখ?
শ্যা। শোনা যাচ্ছে, তাঁদের না কি বেঁধে মুরশিদাবাদ চালান দিয়েছে। সেখানে না কি তাঁদের শূলে দিয়েছে।
রা। আমিও শুনেছি তাই বটে, তবে কি না শুনতে পাই যে, তাঁরা পথে বিষ খেয়ে মরেছেন। তার পর মড়া দুটো নিয়ে গিয়ে বেটারা শূলে চড়িয়ে দিয়েছে।
শ্যা। কত লোকেই কত রকম বলে! আবার কেউ কেউ বলে, রাজা রাণী না কি ধরা পড়ে নাই—সেই দেবতা এসে তাঁদের বার ক’রে নিয়ে গিয়েছেন। তার পর নেড়ে বেটারা জাল রাজা রাণী সাজিয়ে মুরশিদাবাদে নিয়ে শূলে দিয়েছে।
রা। তুমিও যেমন! ও সব হিন্দুদের রচা কথা, উপন্যাস মাত্র।
শ্যা। তা এটা উপন্যাস, না ওটা উপন্যাস, তার ঠিক কি? ওটা না হয় মুসলমানের রচা। তা যাক গিয়ে—আমরা আদার ব্যাপারী-জাহাজের খবরে কাজ কি? আপনার আপনার প্রাণ নিয়ে যে বেঁচে এয়েছি, এই ঢের। এখন তামাকটা ঢেলে সাজ দেখি।
রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ তামাক ঢালিয়া সাজিয়া খাইতে থাকুক। আমরা ততক্ষণ গ্রন্থ সমাপন করি।