দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
“এবার এলেই তোমাকে দেখিতে আসিবেন,” এই কথা বলিয়া নন্দা রমাকে আশ্বাস দিয়া আসিয়াছিল। সেই আশ্বাসে রমা কোন রকমে বাঁচিয়াছিল-কিন্তু আর বুঝি বাঁচে না। নন্দা তাহাকে যে আশ্বাসবাক্য দিয়া আসিয়াছে, নন্দাও তাহা জপমালা করিয়াছিল, কিন্তু রাজাকে ধরিতে পারিতেছিল না। যদি কখনও ধরে, তবে “আজ না–কাল” করিয়া রাজা প্রস্থান করিলেন। নন্দা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, কিছুতেই সে সীতারামের উপর রাগ করিবে না। ভাবিল, রাজাকে ত ডাকিনীতে পেয়েছে সত্য, কিন্তু তাই বলে আমায় যেন ভূতে না পায়। আমার ঘাড়ে রাগ ভূত চাপিলে–এ সংসার এখন আর রাখিবে কে? তাই নন্দা সীতারামের উপর রাগ করিল না–আপনার অনুষ্ঠেয় কর্ম প্রাণপাত করিয়া করিতে লাগিল। কিন্তু ডাকিনীটার উপর রাগ বড় বেশী। ডাকিনী যে শ্রী, তাহা নন্দা জানিত না; সীতারাম ভিন্ন কেহই জানিত না। নন্দা অনেকবার সন্ধান জানিবার জন্য লোক পাঠাইয়াছিল, কিন্তু সীতারামের আজ্ঞা ভিন্ন চিত্তবিশ্রামে মক্ষিকা প্রবেশ করিতে পারিত না, সুতরাং কিছুই হইল না। তবে জনপ্রবাদ এই যে, ডাকিনীটা দিবসে পরমসুন্দরী মানবী মূর্তি ধারণ করিয়া গৃহধর্ম করে, রাত্রিতে শৃগালীরূপ ধারণ করিয়া শ্মশানে শ্মশানে বিচরণপূর্বক নরমাংস ভক্ষণ করে। অতিশয় ভীতা হইয়া নন্দা, চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে সবিশেষ নিবেদন করিল। চন্দ্রচূড় উত্তম তন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণ সংগ্রহ করিয়া রাজার উদ্ধারার্থ তান্ত্রিক যজ্ঞ সকল সম্পাদন করাইলেন, কিন্তু কিছুতেই ডাকিনীর ধ্বংস হইল না। পরিশেষে একজন সুদক্ষ তান্তিক বলিলেন, মনুস্য হইতে ইহার কিছু উপায় হইবে না। ইনি সামান্যা নহেন। ইনি কৈলাসনিবাসিনী সাক্ষাৎ ভবানী সহচরী, ইঁহার নাম বিশালাক্ষী। ইনি রুদ্রের শাপে কিছুকালের জন্য মর্ত্যলোকে মনুষ্যসহবাসার্থ আসিয়াছেন। শাপান্ত হইলে আপনিই যাইবেন |” শুনিয়া চন্দ্রচূড় ও নন্দা নিরস্ত ও চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন। তবু নন্দা মনে মনে ভাবিত, “ভবানীর সহচরী হউক, আর যেই হউক, আমি একবার তাকে পাইলে নখে মাথা চিরি |”
তাই, নন্দার সীতারামের উপর কোন রাগ নাই। সীতারামও রাজধানীতে আসিলে নন্দার সঙ্গে কখন কখন সাক্ষাৎ করিতেন; এই সকল সময়ে, নন্দার রমার কথা সীতারামকে জানাইত, বলিত, “সে বড় ‘কাতর’-তুমি গিয়া একবার দেখিয়া
এসো |” সীতারাম যাচ্ছি যাব করিয়া, যান নাই। আজ নন্দা জোর করিয়া ধরিয়া বসিল-বলিল, “আজ দেখিতে যাও–নহিলে এ জন্মে আর দেখা হবে না |”
কাজেই সীতারাম রমাকে দেখিতে গেলেন। সীতারামকে দেখিয়া রমা বড় কাঁদিল। সীতারামকে কোন তিরস্কার করিল না। কিছুই বলিতে পারিল না। সীতারামের মনে কিছু অনুতাপ জন্মিল কি না, জানি না। সীতারাম স্নেহসূচক সম্বোধন করিয়া রোগমুক্তির ভরসা দিতে লাগিলেন। ক্রমে রমা প্রফুল্ল হইল, মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। কিন্তু কি হাসি! হাসি দেখিয়া সীতারামের শঙ্কা হইল যে, আর অধিক বিলম্ব নাই।
সীতারাম পালঙ্কের উপর উঠিয়া বসিয়াছিলেন। সেইখানে রমার পুত্র আসিল। আবার রমার চক্ষুতে জল আসিল-কিছুক্ষণ অবাধে জল শুষ্ক গণ্ড বহিয়া পড়িতে লাগিল। ছেলেও মর কান্না দেখিয়া কাঁদিতেছিল। রমা ইঙ্গিতে অস্ফুটস্বরে সীতারামকে বলিল, “ওকে একবার কোলে নাও |” সীতারাম অগত্যা পুত্রকে কোলে লইলেন। তখন রমা, সকাতরে ক্ষীণকণ্ঠে রুদ্ধশ্বাসে বলিতে লাগিল, “মার দোষে ছেলেকে ত্যাগ করিও না। এই তোমার কাছে আমার শেষ ভিক্ষা। বড় রাণীর হাতে ওকে সমর্পণ করিয়া যাব মনে করিয়াছিলাম—কিন্তু তা না করিয়া তোমারই হাতে সমর্পণ করিলাম। কথা রাখিবে কি?”
সীতারাম কলের পুতুলের মত স্বীকৃত হইলেন। রমা তখন সীতারামকে আরও নিকটে আসিয়া বসিতে ইঙ্গিত করিল। সীতারাম সরিয়া বসিলে, রমা তাঁর পায়ে হাত দিয়া, পায়ের ধূলা লইয়া আপনার মাথায় দিল। বলিল, “এ জন্মের মত বিদায় হইলাম। আশীর্বাদ করিও, জন্মান্তরে যেন তোমাকেই পাই |”
তার পর বাক্য বন্ধ হইল। শ্বাস বড় জোরে জোরে পড়িতে লাগিল। চক্ষুর জ্যোতি গেল। মুখের উপর কালো ছায়া আরও কালো হইতে লাগিল। শেষে সব অন্ধকার হইল। সব জ্বালা জুড়াইল। রমা চলিয়া গেল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
যে দিন রমা মরিল, সে দিন সীতারাম আর চিত্তবিশ্রামে গেলেন না। এখনও তত দূর হয় নাই। যখন সীতারাম রাজা না হইয়াছিলেন, তখন আবার শ্রীকে না দেখিয়াছিলেন, তখন সীতারাম রমাকে বড় ভালবাসিতেন–নন্দার অপেক্ষাও ভালবাসিতেন। সে ভালবাসা গিয়াছিল। কিসে গেল, সীতারাম তাহার চিন্তা কখনও করেন নাই। আজ একটু ভাবিলেন। ভাবিয়া দেখিলেন–রমার দোষ বড় বেশী নয়,–দোষ তাঁর নিজের। মনে মনে আপনার উপর বড় অসন্তুষ্ট হইলেন।
কাজেই মেজাজ খারাব হইয়া উঠিল। চিত্ত প্রফুল্ল করিবার জন্য শ্রীর কাছে যাইতে প্রবৃত্তি হইল না; কেন না, শ্রীর সঙ্গে এই আত্মগ্লানির বড় নিকট সম্বন্ধ; রমার প্রতি তাঁহার নিষ্ঠুরাচরণের কারণই শ্রী। শ্রীর কাছে গেলে আগুন আরও বাড়িবে। তাই শ্রীর কাছে না গিয়া রাজা নন্দার কাছে গেলেন। কিন্তু নন্দা সে দিন একটা ভুল করিল। নন্দা বড় চটিয়াছিল। ডাকিনীই হউক আর মানুষীই হউক, কোন পাপিষ্ঠার জন্য যে রাজা নন্দাকে অবহেলা করিতেন, নন্দা তাহাতে আপনার মনকে রাগিতে দেয় নাই। কিন্তু রমাকে এত অবহেলা করায়, রমা যে মরিল, তাহাতে রাজার উপর নন্দার রাগ হইল; কেন না, আপনার অপমানও তাহার সঙ্গে মিশিল। রাগটা এত বেশী হইল যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও নন্দা সকলটুকু লুকাইতে পারিল না।
রমার প্রসঙ্গ উঠইলে, নন্দা বলিল, “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |”
নন্দা এইটুকু মাত্র রাগ প্রকাশ করিল, আর কিছুই না। কিন্তু তাহাতেই আগুন জ্বলিল; কেন না, ইন্ধন প্রস্তুত। একে ত আত্মগ্লানিতে সীতারামের মেজাজ খারাব হইয়াছিল–কোন মতে আপনার নিকটে আপনার সাফাই করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাহার উপর নন্দার এই উচিত তিরস্কার শেলের মত বিঁধিল। “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |” শুনিয়া রাজা গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “ঠিক কথা। আমি তোমাদের মৃত্যুর কারণ। আমি প্রাণপাত করিয়া, আপনার রক্তে পৃথিবী ভাসাইয়া তোমাদিগকে রাজরাণী করিয়াছি–কাজেই এখন বলবেি বৈ কি, আমিই তোমাদের মৃত্যুর কারণ। যখন রমা গঙ্গারামকে ডাকিয়া আমার মৃত্যুর কারণ হইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কৈ তখন ত কেহ কিছু বল নাই?”
এই বলিয়া রাজা রাগ করিয়া বহির্বাটীতে গেলেন। সেখানে চন্দ্রচূড় ঠাকুর, রাজাকে রমার জন্য শোকাকুল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিবার জন্য নানা প্রকার আলাপ করিতে লাগিলেন। রাজার মেজাজ তপ্ত তেলের মত ফুটিতেছিল, রাজা তাঁহার কথার বড় উত্তর করিলেন না। চন্দ্রচূড় ঠাকুরও একটা ভুল করিলেন। তিনি মনে করিলেন, রমার মৃত্যুর জন্য রাজার অনুতাপ হইয়াছে, এই সময়ে চেষ্টা করিলে যদি ডাকিনী হইতে মন ফিরে, তবে সে চেষ্টা করা উচিত। তাই চন্দ্রচূড় ঠাকুর ভূমিকা করিবার অভিপ্রায়ে বলিলেন, “মহারাজ! আপনি যদি ছোট রাণীর প্রতি আর একটু মনোযোগী হইতেন, তা হইলে তিনি আরোগ্য লাভ করিতে পারিতেন |”
জ্বলন্ত আগুন এ ফুৎকারে আরও জ্বলিয়া উঠিল। রাজা বলিলেন, “আপনারও কি বিশ্বাস যে, আমিই ছোট রাণীর মৃত্যুর কারণ?”
চন্দ্রচূড়ের সেই বিশ্বাস বটে। তিনি মনে করিলেন, “এ কথা রাজাকে স্পষ্ট করিয়া বলাই উচিত। আপনার দোষ না দেখিলে, কাহারও চরিত্র শোধন হয় না। আমি ইঁহার গুরু ও মন্ত্রী, আমি যদি বলিতে সাহস না করিব, তবে কে বলিবে?” অতএব চন্দ্রচূড় বলিলেন, “তাহা এক রকম বলা যাইতে পারে |”
রাজা। পারে বটে। বলুন। কেবল বিবেচনা করুন, আমি যদি লোকের মৃত্যুকামনা করিতাম, তাহা হইলে এই রাজ্যে এক জনও এত দিন টিকিত না।
চন্দ্র। আমি বলিতেছি না যে, আপনি কাহারও মৃত্যুকামনা করেন। কিন্তু আপনি মৃত্যুকামনা না করিলেও, যে আপনার রক্ষণীয়, তাহাকে আপনি যত্ন ও রক্ষা না করিলে, কাজেই তাহার মৃত্যু উপস্থিত হইবে। কেবল ছোট রাণী কেন, আপনার তত্ত্বাবধানের অভাবে বুঝি সমস্ত রাজ্য যায়। কথাটা আপনাকে বলিবার জন্য কয় দিন হইতে আমি চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু আপনার অবসর অভাবে, তাহা বলিতে পারি নাই।
রাজা মনে মনে বলিলেন, “সকল বেটাই বলে–তত্ত্বাবধানের অভাব–বেটারা করে কি?” প্রকাশ্যে বলিলেন, “তত্ত্বাবধানের অভাব-আপনারা করেন কি?”
চন্দ্র। যা করিতে পারি–সব করি। তবে আমরা রাজা নহি। যেটা রাজার হুকুম নহিলে সিদ্ধ হয় না, সেইটুকু পারি না। আমার ভিক্ষা, কাল প্রাতে একবার দরবারে বসেন, আমি আপনাকে সবিশেষ অবগত করি, কাগজপত্র দেখাই; আপনি রাজাজ্ঞা প্রচার করিবেন।
রাজা মনে মনে বলিলেন, “তোমার গুরুগিরির কিছু বাড়াবাড়ি হইয়াছে–আমারও ইচ্ছা তোমায় কিছু শিখাই |” প্রকাশ্যে বলিলেন, “বিবেচনা করা যাইবে |”
চন্দ্রচূড়ের তিরস্কারে রাজার সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল, কেবল গুরু বলিয়া সীতারাম তাঁহাকে বেশী কিছু বলিতে পারেন নাই। কিন্তু রাগে সে রাত্রি নিদ্রা গেলেন না। চন্দ্রচূড়কে কিসে শিক্ষা দিবেন, সেই চিন্তা করিতে লাগিলেন। প্রভাতে উঠিয়াই প্রাতঃকৃত্য সমস্ত সমাপন করিয়া দরবারে বসিলেন। চন্দ্রচূড় খাতাপত্রের রাশি আনিয়া উপস্থিত করিলেন।