পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কামানের বন্দুকের হুড়মুপড় দুড়মুড়ি শুনিয়া গঙ্গারাম মনে ভাবিল—এ আবার কি? লড়াই কে করে? সেই ডাকিনী নয় ত? তিনি কি দেবতা? গঙ্গারাম এক জন জমাদ্দারকে দেখিতে পাঠাইলেন। জমাদ্দার নিষ্ক্রান্ত হইল। সে দিন, সেই প্রথম ফটক খোলা হইল।
জমাদ্দার ফিরিয়া গিয়া নিবেদন করিল, “মুসলমান লড়াই করিতেছে |”
গঙ্গারাম বিরক্ত হইয়া বলিল, “তা ত জানি। কার সঙ্গে মুসলমান লড়াই করিতেছে?”
জমাদ্দার বলিল, “কারও সঙ্গে নহে |”
গঙ্গারাম হাসিল, “তাও কি হয় মূর্খ! তোপ কার?”
জ। হুজুর, তোপ কারও না।
গঙ্গারাম বড় রাগ করিল। বলিল, “তোপের আওয়াজ শুনিতেছিস না?”
জ। তা শুনিতেছি।
গ। তবে? সে তোপ কে দাগিতেছে?
জ। তাহা দেখিতে পাই নাই।
গ। চোখ কোথা ছিল?
জ। সঙ্গে।
গ। তবে তোপ দেখিতে পাও নাই কেন?
জ। বটে! কে আওয়াজ করিতেছে?
জ। গাছের ডাল।
গ। তুই কি ক্ষেপিয়াছিস? গাছের ডালে তোপ দাগে?
জ। সেখানে আর কাহাকে দেখিতে পাইলাম না-কেবল কতকগুলা গাছের ডাল তোপ ঢাকিয়া নুঙিয়া পড়িয়া আছে দেখিলাম।
গ। তবে কেহ ডাল নোঙাইয়া বাঁধিয়া তাহার আশ্রয়ে তোপ দাগিতেছে। সে বুদ্ধিমান সন্দেহ নাই। সিপাহীরা তাহাকে লক্ষ্য করিতে পারিবে না, কিন্তু সে পাতার আড়াল হইতে তাহাদের লক্ষ্য করিবে। ডালের ভিতর কে আছে, তা দেখে এলি না কেন?
জমা। সেখানে কি যাওয়া যায়?
গ। কেন?
জ। সেখানে বৃষ্টির ধারার মত গুলি পড়িতেছে।
গ। গুলিতে এত ভয় ত এ কাজে এসেছিলি কেন?
তখন গঙ্গারাম অনুচরকে হুকুম দিল যে, জমাদ্দারের পাগড়ি পোষাক কাপড় সব কাড়িয়া লয়। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখিয়া মৃণ্ময় বাছা বাছা জনকত হিন্দুস্থানীকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এবং দুর্গরক্ষার জন্য তাহাদের রাখিয়া গিয়াছিলেন। গঙ্গারাম তাহাদিগের মধ্যে চারি জনকে আদেশ করিল, “যেখানে ঘাটের উপর তোপ আছে, সেইখানে যাও। যে কামান ছাড়িতেছে, তাহাকে ধরিয়া আন |”
সেই চারি জন সিপাহী যখন তোপের কাছে আসিল, তখন যুদ্ধ শেষ হইয়াছে, হতাবশিষ্ট মুসলমানেরা বাহিয়া পলাইয়া যাইতেছে। সিপাহীরা গাছের ডালের ভিতর গিয়া দেখিল-তোপের কাছে এক জন মানুষ মরিয়া পড়িয়া আছে-আর এক জন জীবিত, পলিতা হাতে করিয়া বসিয়া আছে। সে খুব জোওয়ান, ধুতি মালকোঁচা মারা, মাথায় মুখে গালচাল্লা বাঁধা; সর্বাঙ্গে বারুদে আর ছাইয়ে কালো হইয়া আছে। চারি জন আসিয়া তাহাকে ধরিল। বলিল, “তোম কোন হো রে?”
সে বলিল, “কেন বাপু!”
“তোম্ কাহে হিঁয়া বৈঠ বৈঠকের তোপ ছোড়তে হো?”
“কেন বাপু, তাতে কি দোষ হয়েছে? মুসলমানের সঙ্গে তোমরা মিলেছ?”
“আরে মুসলমান আনেসে হমলোক আভি হাঁকায় দেতে-তোম কাহেকো দিক কিয়ে হো? চল হুজুরমে যানে হোগা |”
“কার কাছে যাব?”
“কোতোয়াল সাহেবকি হুকুমসে তোমকো উনকাল পাশ লে যাঙ্গে |”
“আচ্ছা যাই। আগে নেড়েরা বিদায় হোক। যতক্ষণ ওদের মধ্যে এক জনকে ও পারে দেখা যাইবে, ততক্ষণ তোরা কি, তোদের কোতোয়াল এলে উঠিব না। ততক্ষণ দেখ দেখি, যে মানুষটা মরিয়া আছে, ও কে চিনিতে পারিস কি না?”
সিপাহীরা দেখিয়া বলিল, “হাঁ, হামলোক ত ইস্কো পহচান্ তে হেঁ। য়ে ত হামারা গোলন্দাজ পিয়ারীলাল হৈঁ—য়ে কাঁহাসে আয়া?”
“তবে আগে ওকে গড়ের ভিতর নিয়ে যা-আমি যাচ্ছি |”
সিপাহীরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, “য়ে আদমি ত আচ্ছা বোলতা হৈ। যো তোপকাদ পাশ রহেগা, ওসিকো লে যানেগো হুকুম হৈ। এই মুরদার তোপকাআ পাশ হৈ-উসকো আলবৎ লে যানে হোগা |”
কিন্তু মড়া—হিন্দু সিপাহীরা ছুঁইবে না। তখন পরামর্শ করিয়া একজন সিপাহী ডোম ডাকিতে লাগিল-আর তিন জন তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।
এ দিকে কালি বারুদ মাখা পুরুষ, ক্রমে ক্রমে দেখিলেন যে, মুসলমান সিপাহীরা সব তীরে গিয়া উঠিল। তখন তিনি সিপাহীদিগকে বলিলেন, “চল বাবা, তোমাদের কোতোয়াল সাহেবকে সেলাম করি গিয়া চল |” সিপাহীরা সে ব্যক্তিকে ধরিয়া লইয়া চলিল।
সেই সমবেত সজ্জিত দুর্গরক্ষক সৈন্যমণ্ডলীমধ্যে যেখানে ভীত নাগরিকগণ পিপীলিকাশ্রেণীবৎ সারি দিয়া দাঁড়াইয়া আছে-সেইখানে সিপাহীরা সেই কালিমাখা বারুদমাখা পুরুষকে আনিয়া খাড়া করিল।
তখন সহসা জয়ধ্বনিতে আকাশ পুরিয়া উঠিল। সেই সমবেত সৈনিক ও নাগরিকমণ্ডলী, একেবারে সহস্র কণ্ঠে গর্জন করিল, “জয় মহারাজের জয় |”
“জয় মহারাজাধিরাজকি জয় |”
“জয় শ্রীসীতারামরায় রাজা বাহাদুরকি জয় |”
“জয় লক্ষ্মীনারায়ণজীকি জয় |”
চন্দ্রচূড় দ্রুত আসিয়া বারুদমাখা মহাপুরুষকে আলিঙ্গন করিলেন; বারুদমাখা পুরুষও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “সমর দেখিয়া আমি জানিয়াছি, তুমি আসিয়াছ। মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন এ অব্যর্থ সন্ধান আর কাহারও নাই। এখন অন্য কথার আগে গঙ্গারামকে বাঁধিয়া আনিতে আজ্ঞা দাও |”
সীতারাম সেই আজ্ঞা দিলেন। গঙ্গারাম সীতারামকে দেখিয়া সরিয়া পড়িতেছিল, কিন্তু শীঘ্র ধৃত হইয়া সীতারামের আজ্ঞাক্রমে কারাবদ্ধ হইল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সীতারাম, তখন সিপাহীদিগকে দুর্গপ্রাকারস্থিত তোপ সকলের নিকট, এবং অন্যান্য উপযুক্ত স্থানে অবস্থিত করিয়া এবং মৃণ্ময়ের সম্বন্ধে সংবাদ আনিবার জন্য লোক পাঠাইয়া স্বয়ং স্নানাহ্নিকে গমন করিলেন। স্নানাহ্নিকের পর, চন্দ্রচূড় ঠাকুরের সঙ্গে নিভৃতে কথোপকথন করিতে লাগিলেন। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “মহারাজ! আপনি কখন আসিয়াছেন, আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই। একাই বা কেন আসিলেন? আপনার অনুচরবর্গই বা কোথায়? পথে কোন বিপদ ঘটে নাই ত?”
সী। সঙ্গীদিগকে পথে রাখিয়া আমি একা আগে আসিয়াছি। আমার অবর্তমানে নগরের কিরূপ অবস্থা, তাহা জানিবার জন্য ছদ্মবেশে একা রাত্রিকালে আসিয়াছিলাম। দেখিলাম, নগর সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত। কেন, তাহা এখন কতক কতক বুঝিয়াছি। পরে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখিলাম, ফটক বন্ধ। দুর্গে প্রবেশ না করিয়া, প্রভাত নিকট দেখিয়া নদীতীরে গিয়া দেখিলাম, মুসলমান সেনা নৌকায় পার হইতেছে। দুর্গরক্ষকেরা রক্ষার কোন উদ্যোগই করিতেছে না দেখিয়া, আপনার যাহা সাধ্য, তাহা করিলাম।
চন্দ্র। যাহা করিয়াছেন, তাহা আপনারই সাধ্য, অপরের নহে। এত গোলা বারুদ পাইলেন কোথা?
সী। এক দেবী সহায় হইয়া আমাকে গোলাবারুদ এবং গোলন্দাজ আনিয়া দিয়াছিলেন।
চ। দেবী? আমিও তাঁহার দর্শন পাইয়াছিলাম। তিনি এই পুরীর রাজলক্ষ্মী। তিনি কোথায় গেলেন?
সী। তিনি আমাকে গোলা-বারুদ এবং গোলন্দাজ দিয়া অন্তর্দ্ধান হইয়াছেন।
শেষে বলিলেন, “এক্ষণে এ কয় মাসের সংবাদ আমাকে বলুন।
তখন চন্দ্রচূড় সকল বৃত্তান্ত,ল যতদূর তিনি জানিতেন আনুপূর্বিক বিবৃত করিলেন।
শেষে বলিলেন এখানে যে জন্য দিল্লী গিয়াছিলেন, তাহার সুসিদ্ধির সংবাদ বলুন |”
সী। কার্যসিদ্ধি হইয়াছে। বাদশাহের আমি কোন উপকার করিতে পারিয়াছিলাম। তাহাতে তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট হইয়া দ্বাদশ ভৌমিকের উপর আধিপত্য প্রদান করিয়া মহারাজাধিরাজ নাম দিয়া সনন্দ দিয়াছেন। এক্ষণে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ফৌজদারের সঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হইযাছে। কেন না, ফৌজদার সুবাদারের অধীন, এবং সুবাদার বাদশাহের অধীন। অতএব ফৌজদারের সঙ্গে বিরোধ করিলে, বাদশাহের সঙ্গেই বিরোধ করা হইল। যিনি আমাকে এতদূর অনুগৃহীত করিয়াছেন, তাঁহার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা নিতান্ত কৃতঘ্নের কাজ। আত্মরক্ষা সকলেরই কর্তব্য। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য ভিন্ন ফৌজদারের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার অকর্তব্য। অতএব এ বিরোধ আমার বড় দুরদৃষ্ট বিবেচনা করি।
চ। ইহা আমাদিগের শুভাদৃষ্ট-হিন্দু মাত্রেরই শুভাদৃষ্ট; কেন না, আপনি মুসলমানের প্রতি সম্প্রীত হইলে, মুসলমান হইতে হিন্দুকে রক্ষা করিবে কে? হিন্দুধর্ম আর দাঁড়াইবে কোথায়? ইহা আপনারও শুভাদৃষ্ট; কেন না, যে হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার করিবে, সেই মনুষ্যমধ্যে কৃতী ও সৌভাগ্যশালী।
সী। মৃণ্ময়ের সংবাদ না পাইলে, কি কর্তব্য, কিছুই বলা যায় না।
সন্ধ্যার পর মৃণ্ময়ের সংবাদ আসিল। পীর বক্স্ক খাঁ নামে ফৌজদারী সেনাপতি অর্ধেক ফৌজদারী সৈন্য লইয়া আসিতেছিলেন, অর্ধেক পথে মৃণ্ময়ের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ ও যুদ্ধ হয়। মৃণ্ময়ের অসাধারণ সাহস ও কৌশলে তিনি সসৈন্যে পরাজিত ও নিহত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শয়ন করেন। বিজয়ী মৃণ্ময় সসৈন্যে ফিরিয়া আসিতেছেন।
শুনিয়া চন্দ্রচূড় সীতারামকে বলিলেন, “মহারাজ! আর দেখেন কি? এই সময়ে বিজয়ী সেনা লইয়া নদী পার হইয়া গিয়া ভূষণা দখল করুন |”