দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কারের সে রাত্রিতে নিদ্রা নাই। কিন্তু সমস্ত রাত্রি নগর পরিভ্রমণ করিয়া দেখিয়াছেন যে, নগর রক্ষার কোন উদ্যোগই নাই। গঙ্গারামকে সে কথা বলায়, গঙ্গারাম তাঁহাকে কড়া কড়া বলিয়া হাঁকাইয়া দিয়াছিল। তখন তিনি অতিশয় অনুতপ্তচিত্তে কুশাসনে বসিয়া সর্বরক্ষাকর্তা বিপত্তিভঞ্জন মধুসূদনকে চিন্তা করিতেছিলেন। এমন সময়ে চাঁদশাহ ফকির আসিয়া গঙ্গারামের ভূষণাগমন বৃত্তান্ত তাঁহাকে জানাইল। শুনিয়া চন্দ্রচূড় শিহরিয়া উঠিলেন। একবার মনে করিতেছিলেন যে, জনকত সিপাহী লইয়া গঙ্গারামকে ধরিয়া আবদ্ধ করিয়া, নগর রক্ষার ভার অন্য লোককে দিবেন, কিন্তু ইহাও ভাবিলেন যে, সিপাহীরা তাঁহার বাধ্য নহে, গঙ্গারামের বাধ্য। অতএব সে সকল উদ্যম সফল হইবে না। মৃণ্ময় থাকিলে কোন গোল উপস্থিত হইত না, সিপাহীরা মৃণ্ময়ের আজ্ঞাকারী। মৃণ্ময়কে বাহিরে পাঠাইয়া তিনি এই সর্বনাশ উপস্থিত করিয়াছেন। ইহা বুঝিতে পারিয়াই তিনি এত অনুতাপপীড়িত হইয়া নিশ্চেষ্টবৎ কেবল অসুরনিসূদন হরির চিন্তা করিতেছিলেন। তখন সহসা সম্মুখে প্রফুল্লকান্তি ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীকে দেখিলেন।
সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তুমি কে?”
ভৈরবী বলিল, “বাবা! শত্রু, নিকটে এ পুরীর রক্ষার কোন উদ্যোগ নাই কেন? তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি |”
মুরলার সঙ্গে কথা কহিয়াছিল ও চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে কথা কহিতেছে, জয়ন্তী।
প্রশ্ন শুনিয়া চন্দ্রচূড় বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তুমি কি এই নগরের রাজলক্ষ্মী?”
জ। আমি যে হই, আমার কথার উত্তর দাও। নহিলে মঙ্গল হইবে না।
চ। মা! আমার সাধ্য আর কিছু নাই। রাজা নগররক্ষকের উপর নগর রক্ষার ভার দিয়াছিলেন, নগররক্ষক নগর রক্ষা করিতেছে না। সৈন্য আমার বশ নহে। আমি কি করিব, আজ্ঞা করুন।
জ। নগররক্ষকের সংবাদ আপনি কিছু জানেন? কোন প্রকার অবিশ্বাসিতা শুনেন নাই?
চ। শুনিয়াছি। তিনি তোরাব খাঁর নিকট গিয়াছিলেন। বোধ হয় তাঁহাকে নগর সমর্পণ করিবেন। আমার দুর্বুদ্ধিবশতঃ আমি তাহার কোন উপায় করি নাই। মা! বোধ করিতেছি, আপনি এই নগরীর রাজলক্ষ্মী। দয়া করিয়া এ দাসকে ভৈরবীবেশে দর্শন দিয়াছেন। মা! আপনি অপরিম্লানতেজস্বিনী হইয়া আপনার পুরী রক্ষা করুন।
এই বলিয়া চন্দ্রচূড় কৃতাঞ্জলিপুটে ভক্তিভাবে জয়ন্তীকে প্রণাম করিলেন।
“তবে আমিই এই পুরী রক্ষা করিব |” এই বলিয়া জয়ন্তী প্রস্থান করিল। চন্দ্রচূড়ের মনে ভরসা হইল।
জয়ন্তীও আশার অতিরিক্ত ফললাভ হইয়াছিল। শ্রী বাহিরে ছিল। তাহাকে সঙ্গে লইয়া জয়ন্তী গঙ্গারামের গৃহাভিমুখে চলিল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মুরলা চলিয়া গেলে, গঙ্গারাম চারিদিকে আরও অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। যাহার জন্য তিনি বিপদ সাগরে ঝাঁপ দিতেছেন, সে ত তাঁহার অনুরাগিণী নয়। তিনি চক্ষু বুজিয়া সমুদ্রমধ্যে ঝাঁপ দিতেছেন, সমুদ্রতলে রত্ন মিলিবে কি? না, ডুবিয়া মরাই সার হইবে? আঁধার! চারিদিকে আঁধার! এখন কে তাঁকে উদ্ধার করিবে?
সহসা গঙ্গারামের শরীর রোমাঞ্চিত হইল। দেখিলেন, দ্বারদেশে প্রভাতনক্ষত্রোজ্জ্বলরূপিণী ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীমূর্তি। অঙ্গপ্রভায় গৃহস্থিত প্রদীপের জ্যোতি ম্লান হইয়া গেল। সাক্ষাৎ ভবানী ভূতলে অবতীর্ণা মনে করিয়া, গঙ্গারামও মুরলার ন্যায় প্রণত হইয়া জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “মা, দাসের প্রতি কি আজ্ঞা?”
জয়ন্তী বলিল, “বাছা! তোমার কাছে কিছু ভিক্ষার জন্য আসিয়াছি |”
ভৈরবীর কথা শুনিয়া গঙ্গারাম বলিল, “মা! আপনি যাহা চাহিবেন, তাহাই দিব। আজ্ঞা করুন |”
জ। আমাকে এক গাড়ি গোলা-বারুদ দাও। আর একজন ভাল গোলন্দাজ দাও।
গঙ্গারাম ইতস্ততঃ করিতে লাগিল—কে এ? জিজ্ঞাসা করিল, “মা! আপনি গোলা-বারুদ লইয়া কি করিবেন?”
জ। দেবতার কাজ।
গঙ্গারামের মনে সন্দেহ হইল। এ যদি কোন দেবী হইবে, তবে গোলা-বারুদ ইহার প্রয়োজন হইবে কেন? যদি মানুষী হয়, তবে ইহাকে গোলা-গুলি দিব কেন? কাহার চর তা কি জানি? এই ভাবিয়া গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “মা! তুমি কে?”
জ। আমি যে হই, রমা ও মুরলা ঘটিত সংবাদ আমি সব জানি। তা ছাড়া তোমার ভূষণাগমন-সংবাদ ও সেখানকার কথাবার্তার সংবাদ আমি জানি। আমি যাহা চাহিতেছি, তাহা এই মুহূর্তে আমাকে দাও, নচেৎ এই ত্রিশূলাঘাতে তোমাকে বধ করিব।
এই বলিয়া সেই তেজস্বিনী ভৈরবী উজ্জ্বল ত্রিশূল উত্থিত করিয়া আন্দোলিত করিল।
গঙ্গারাম একেবারে নিবিয়া গেল। “আসুন দিতেছি |” বলিয়া ভৈরবীকে সঙ্গে করিয়া অস্ত্রাগারে গেল। জয়ন্তী যাহা যাহা চাহিল, সকলই দিল, এবং পিয়ারীলাল নামে একজন গোলন্দাজকে সঙ্গে দিল। জয়ন্তীকে বিদায় দিয়া গঙ্গারাম দুর্গদ্বার বন্ধ রাখিতে আজ্ঞা দিলেন। যেন তাঁহার বিনানুমতিতে কেহ যাইতে আসিতে না পারে।
জয়ন্তী ও শ্রী গোলা—বারুদ লইয়া, গড়ের বাহির হইয়া যেখানে রাজবাড়ীর ঘাট সেইখানে উপস্থিত হইল। দেখিল, এক উন্নতবপু সুন্দরকান্তি পুরুষ তথা বসিয়া আছেন।
দুই জন ভৈরবীর মধ্য একজন ভৈরবী বারুদ, গোলার গাড়ি ও গোন্দাজকে সঙ্গে লইয়া কিছু দূরে গিয়া দাঁড়াইল, আর একজন সেই কান্তিমান পুরুষের নিকট গিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”
সে বলিল, “আমি যে হই না। তুমি কে?”
জয়ন্তী বলিল, “যদি তুমি বীরপুরুষ হও, এই গোলাগুলি আনিয়া দিতেছি—এই পুরী রক্ষা কর |”
সে পুরুষ বিস্মিত হইল, দেবতাক্রমে জয়ন্তীকে প্রণাম করিল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। বলিল, “তাতেই বা কি?”
জ। তুমি কি চাও?
পুরুষ। যা চাই, পুরী রক্ষা করিলে তা পাইব?
জ। পাইবে।
এই বলিয়া জয়ন্তী সহসা অদৃশ্য হইল।