===========================
13 আধুনিক ভাষায় “Magnetized”.
===========================
নবম পরিচ্ছেদ
বন্দেআলি নামে ভূষণার একজন ছোট মুসলমান, একজন বড় মুসলমানের কবিলাকে বাহির করিয়া তাহাকে নেকা করিয়াছিল। খসম গিয়া বলপূর্বক অপহৃতা সীতার উদ্ধারের উদ্যোগী হইল; দোস্ত বিবি লইয়া মহম্মদপুর পলায়ন করিয়া তথায় বাস করিতে লাগিল। গঙ্গারামের নিকট সে পূর্ব হইতে পরিচিত ছিল। তাঁহার অনুগ্রহে সে সীতারামের নাগরিক সৈন্যমধ্যে সিপাহী হইল। গঙ্গারাম তাহাকে বড় বিশ্বাস করিতেন। তিনি এক্ষণে গোপনে তাহাকে তোরাব খাঁর নিকট পাঠাইলেন। বলিয়া পাঠাইলেন, “চন্দ্রচূড় ঠাকুর বঞ্চক। চন্দ্রচূড় যে বলিতেছেন যে, টাকা দিলে আমি মহম্মদপুর ফৌজদারের হস্তে দিব, সে কেবল প্রবঞ্চনাবাক্য। প্রবঞ্চনার দ্বারা কাল হরণ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য। যাহাতে সীতারাম আসিয়া পৌঁছে, তিনি তাহাই করিতেছেন। নগরও তাঁহার হাতে নয়। তিনি মনে করিলেও নগর ফৌজদারকে দিতে পারেন না। নগর আমার হাতে। আমি না দিলে নগর কেহ পাইবে না, সীতারামও না। আমি ফৌজদারকে নগর ছাড়িয়া দিতে পারি। কিন্তু তাহার কথাবার্তা আমি ফৌজদার সাহেবের সহিত স্বয়ং কহিতে ইচ্ছা করি-নহিলে হইবে না। কিন্তু আমি ত ফেরারী আসামী—প্রাণভয়ে যাইতে সাহস করি না। ফৌজদার সাহেব অভয় দিলে যাইতে পারি |”
গঙ্গারামের সৌভাগ্যক্রমে বন্দেআলির ভগিনী এক্ষণে তোরাব খাঁর একজন মতাহিয়া বেগম। সুতরাং ফৌজদারের সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ বন্দেআলির পক্ষে কঠিন হইল না। কথাবার্তা ঠিক হইল। গঙ্গারাম অভয় পাইলেন।
তোরাব স্বহস্তে গঙ্গারামকে এই পত্র লিখিলেন, “তোমার সকল কসুর মাফ করা গেল। কাল রাত্রিকালে হুজুরে হাজির হইবে |”
বন্দেআলি ভূষণা হইতে ফিরিল। যে নৌকায় সে পার হইল, সেই নৌকায় চাঁদশাহ ফকির-সেও পার হইতেছিল। ফকির বন্দেআলির সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইল। “কোথায় গিয়াছিলে?” জিজ্ঞাসা করায় বন্দেআলি বলিল, “ভূষণায় গিয়াছিলাম |” ফকির ভূষণার খবর জিজ্ঞাসা করিল। বন্দেআলি ফৌজদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আসিয়াছে, সুতরাং একটু উঁচু মেজাজে ছিল। ভূষণার খবর বলিতে একেবারে কোতোয়াল, বখশী, মুনশী, কারকুন, পেশকার, লাগায়েৎ খোদ ফৌজদারের খবর বলিয়া ফেলিল। ফকির বিস্মিত হইল। ফকির সীতারামের হিতাকাঙ্ক্ষী। সে মনে মনে স্থির করিল, “আমাকে একটু সন্ধানে থাকিতে হইবে |”
দশম পরিচ্ছেদ
গঙ্গারাম ফৌজদারের সঙ্গে নিভৃতে সাক্ষাৎ করিলেন। ফৌজদার তাঁহাকে কোন প্রকার ভয় দেখাইল না। কাজের কথা সব ঠিক হইল। ফৌজদারের সৈন্য মহম্মদপুরের দুর্গদ্বারে উপস্থিত হইলে, গঙ্গারাম দুর্গদ্বার খুলিয়া দিতে স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু ফৌজদার বলিলেন, “দুর্গদ্বারে পৌঁছিলে ত তুমি আমাদের দুর্গদ্বার খুলিয়া দিবে। এখন মৃণ্ময়ের তাঁবে অনেক সিপাহী আছে। পথিমধ্যে, বিশেষ পারের সময়ে, তাহারা যুদ্ধ করিবে, ইহাই সম্ভব। যুদ্ধে জয় পরাজয় আছে। যদি যুদ্ধে আমাদের জয় হয়, তবে তোমার সাহায্য ব্যতীতও আমরা দুর্গ অধিকার করিতে পারি। যদি পরাজয় হয়, তবে তোমার সাহায্যে আমাদের কোন উপকার হইবে না। তার কি পরামর্শ করিয়াছ?”
গ। ভূষণা হইতে মহম্মদপুর যাইবার দুই পথ আছে। এক উত্তর পথ, এক দক্ষিণ পথ। দক্ষিণ পথে, দূরে নদী পার হইতে হয়—উত্তর পথে কিল্লার সম্মুখেই পার হইতে হয়। আপনি মহম্মদপুর আক্রমণ করিতে দক্ষিণ পথে সেনা লইয়া যাইবেন। মৃণ্ময় তাহা বিশ্বাস করিবে; কেন না, কিল্লার সম্মুখে নদীপার কঠিন বা অসম্ভব। অতএব সেও সৈন্য লইয়া দক্ষিণ পথে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে যাইবে। আপনি সেই সময়ে উত্তর পথে সৈন্য লইয়া কিল্লার সম্মুখে নদী পার হইবেন। তখন দুর্গে সৈন্য থাকিবে না বা অল্পই থাকিবে। অতএব আপনি অনায়াসে নদী পার হইয়া খোলা পথে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিতে পারিবেন।
ফৌজদার। কিন্তু যদি মৃণ্ময় দক্ষিণ পথে যাইতে যাইতে শুনিতে পায় যে, আমরা উত্তর পথে সৈন্য লইয়া যাইতেছি, তবে সে পথ হইতে ফিরিতে পারে।
গঙ্গারাম। আপনি অর্ধেক সৈন্য দক্ষিণ পথে, অর্ধেক সৈন্য উত্তর পথে পাঠাইবেন। উত্তর পথে যে সৈন্য পাঠাইবেন, পূর্বে যেন কেহ তাহা না জানিতে পারে। ঐ সৈন্য রাত্রিতে রওয়ানা করিয়া নদীতীর হইতে কিছু দূরে বনজঙ্গল মধ্যে লুকাইয়া রাখিলে ভাল হয়। তার মৃণ্ময় ফৌজ লইয়া কিছু দূর গেলে পর নদী পার হইলেই নির্বিঘ্ন হইবেন। মৃণ্ময়ের সৈন্যও উত্তর দক্ষিণ দুই পথের সৈন্যের মাঝখানে পড়িয়া নষ্ট হইবে।
ফৌজদার পরামর্শ শুনিয়া সন্তুষ্ট ও সম্মত হইলেন। বলিলেন, “উত্তম। তুমি আমাদিগের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বটে। কোন পুরস্কারের লোভেতেই এরূপ করিতেছে সন্দেহ নাই। কি পুরস্কার তোমার বাঞ্ছিত?”
গঙ্গারাম অভীষ্ট পুরস্কার চাহিলেন-বলা বাহুল্য, সে পুরস্কার রমা।
সন্তুষ্ট হইয়া গঙ্গারাম বিদায় হইল। এবং সেই রাত্রিতেই মহম্মদপুর ফিরিয়া আসিল।
গঙ্গারাম জানিত না যে, চাঁদশাহ ফকির তাহার অনুবর্তী হইয়াছিল।
সীতারাম – ২য় খণ্ড – ১১-১৭
একাদশ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর গুপ্তচর আসিয়া চন্দ্রচূড়কে সংবাদ দিল যে, ফৌজদারী সৈন্য দক্ষিণ পথে মহম্মদপুর আক্রমণে আসিতেছে।
চন্দ্রচূড় তখন মৃণ্ময় ও গঙ্গারামকে ডাকাইয়া পরামর্শ করিতে লাগিলেন। পরামর্শ এই স্থির হইল যে, মৃণ্ময় সৈন্য লইয়া সেই রাত্রিতে দক্ষিণ পথে যাত্রা করিবেন—যাহাতে যবনসেনা নদী পার হইতে না পারে, এমন ব্যবস্থা করিবেন।
এ দিকে রণসজ্জার ধুম পড়িয়া গেল। মৃণ্ময় পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সৈন্য লইয়া রাত্রিতেই দক্ষিণ পথে যাত্রা করিলেন। গড় রক্ষার্থ অল্প মাত্র সিপাহী রাখিয়া গেলেন। তাহারা গঙ্গারামের আজ্ঞাধীনে রহিল।
এই সকল গোলমালের সময়ে পাঠকের কি গরিব রমাকে মনে পড়ে? সকলের কাছে মুসলমানের সৈন্যগমনবার্তা যেমন পৌঁছিল, রমার কাছেও সেইরূপ পৌঁছিল। মুরলা বলিল, “মহারাণী, এখন বাপের বাড়ী যাওয়ার উদ্যোগ কর |”
রমা বলিল, “মরিতে হয় এইখানেই মরিব। কলঙ্কের পথে যাইব না। কিন্তু তুমি একবার গঙ্গারামের কাছে যাও। আমি মরি, এইখানেই মরিব, কিন্তু আমার ছেলেকে রক্ষা করিতে তিনি স্বীকৃত আছেন, তাহা স্মরণ করিয়া দিও। সময়ে আসিয়া যেন রক্ষা করেন। আমার সঙ্গে কিছুতেই আর সাক্ষাৎ হইবে না, তাহাও বলিও |”
রমা মনস্থির করিবার জন্য নন্দার কাছে গিয়া বসিয়া রহিল। পুরীমধ্যে কেহই সে রাত্রিতে ঘুমাইল না।
মুরলা আজ্ঞা পাইয়া গঙ্গারামের কাছে চলিল। গঙ্গারাম নিশীথকালে গৃহমধ্যে একাকী গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। রত্ন আশায় সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে তিনি প্রবৃত্ত—সাঁতার দিয়া আবার কূল পাইবেন কি? গঙ্গারাম সাহসে ভর করিয়াও এ কথার কিছু মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। যে ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছু স্থির করিতে না পারে, তাহার শেষ ভরসা জগদীশ্বর। সে বলে, “জগদীশ্বর যা করেন |” কিন্তু গঙ্গারাম তাহাও বলিতে পারিতেছিলেন না-যে পাপকর্মে প্রবৃত্ত, সে জানে যে, জগদীশ্বর তার বিরুদ্ধ-জগতের বন্ধু তাহার শত্রু। অতএব গঙ্গারাম বড় বিষণ্ণ হইয়া চিন্তামগ্ন ছিলেন।
এমন সময়ে মুরলা আসিয়া দেখা দিল। রমার প্রেরিত সংবাদ তাঁহাকে বলিল।
গঙ্গারাম বলিল, “বলেন ত এখন গিয়া ছেলে নিয়া আসি |”
মু। তাহা হইবে না। যখন মুসলমান পুরীতে প্রবেশ করিবে, আপনি তখন গিয়া রক্ষা করিবেন, ইহাই রাণীর অভিপ্রায়।
গ। তখন কি হইবে, কে বলিতে পারে? যদি রক্ষার অভিপ্রায় থাকে তবে এই বেলা বালকটিকে আমাকে দিন।
মু। আমি তাহাকে লইয়া আসিব?
গ। না। আমার অনেক কথা আছে।
মু। আচ্ছা—পৌষ মাসে।
এই বলিয়া মুরলা হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। কিন্তু গঙ্গারামের গৃহ হইতে বাহির হইয়া রাজপথে উঠিতে না উঠিতে মুরলার সে হাসি হঠাৎ নিবিয়া গেল-ভয়ে মুখ কালি হইয়া উঠিল। দেখিল, সম্মুখে রাজপথে, প্রভাতশুক্রতারাবৎ সমুজ্জ্বলা ত্রিশূলধারিণী যুগলভৈরবীমূর্তি! মুরলা তাহাদিগকে শঙ্করীর অনুচারিণী ভাবিয়া ভূমিতে পড়িয়া প্রণাম করিয়া, জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল।
একজন ভৈরবী বলিল, “তুই কে?”
মুরলা কাতরস্বরে বলিল, “আমি মুরলা |”
ভৈ। মুরলা কে?
মু। আমি ছোট রাণীর দাসী।
ভৈ। নগরপালের ঘরে এত রাত্রিতে কি করিতে আসিয়াছিলি?
মু। মহারাণী পাঠাইয়াছিলেন।
ভৈ। সম্মুখে এই দেবমন্দির দেখিতেছিস্?
মু। আজ্ঞা হাঁ।
ভৈ। আমাদের সঙ্গে উহার উপরে আয়।
মু। যে আজ্ঞা।
তখন দুই জন, মুরলাকে ত্রিশূলাগ্রমধ্যবর্ত্তিনী করিয়া মন্দিরমধ্যে লইয়া গেলেন।