তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এ দিকে তোরাব খাঁ সংবাদ পাইলেন যে, সীতারাম মহম্মদপুরে নাই, দিল্লী যাত্রা করিয়াছেন। তিনি ভাবিলেন, এই শুভ সময়, এই সময় মহম্মদপুর পোড়াইয়া ছারখার করাই ভাল। তখন তিনি সসৈন্যে মহম্মদপুর যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সে সংবাদও মহম্মদপুরে পৌঁছিল। নগরে একটা ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল। গৃহস্থেরা যে যেখানে পাইল, পলাইতে লাগিল। কেহ মাসীর বাড়ী, কেহ পিসীর বাড়ী, কেহ খুড়ার বাড়ী, কেহ শ্বশুরবাড়ী, কেহ জামাইবাড়ী, কেহ বেহাইবাড়ী, বোনাইবাড়ী, সপরিবার, ঘটি-বাটি, সিন্দুক, পেটারা, তক্তপোষ সমেত গিয়া দাখিল হইল। দোকানদার দোকান লইয়া পলাইতে লাগিল, মহাজন গোলা বেচিয়া পলাইতে লাগিল, আড়তদার আড়ত বেচিয়া পলাইল, শিল্পকর যন্ত্র-তন্ত্র মাথায় করিয়া পলাইল। বড় হুলস্থূল পড়িয়া গেল।
নগররক্ষক গঙ্গারাম দাস, চন্দ্রচূড়ের নিকট মন্ত্রণার জন্য আসিলেন। বলিলেন, “এখন ঠাকুর কি করিতে বলেন? সহর ত ভাঙ্গিয়া যায় |”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “স্ত্রীলোক বালক বৃদ্ধ যে পলায় পলাক, নিষেধ করিও না। বরং তাহাতে প্রয়োজন আছে। ঈশ্বর না করুন, কিন্তু তোরাব খাঁ আসিয়া যদি গড় ঘেরাও করে, তবে গড়ে যত খাইবার লোক কম থাকে, ততই ভাল, তা হলে দুই মাস ছয় মাস চালাইতে পারিব। কিন্তু যাহারা যুদ্ধ শিখিয়াছে, তাহাদের এক জনকেও যাইতে দিবে না, যে যাইবে, তাহাকে গুলি করিবার হুকুম দিবে। অস্ত্র-শস্ত্র একখানিও সহরের বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না। আর খাবার সামগ্রী এক মুঠাও বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না |”
সেনাপতি মৃণ্ময় রায় আসিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করিলেন। বলিলেন, “এখানে পড়িয়া মার খাইব কেন? যদি তোরাব খাঁ আসিতেছে, তবে সৈন্য লইয়া অর্দ্ধেক পথ গিয়া তাহাকে মারিয়া আসি না কেন?”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এই প্রবলা নদীর সাহায্য কেন ছাড়িবে? যদি অর্ধপথে তুমি হার, তবে আর আমাদের দাঁড়াইবার উপায় থাকিবে না; কিন্তু তুমি যদি এই নদীর এ পারে কামান সাজাইয়া দাঁড়াও, কার সাধ্য এ নদী পার হয়? এ হাঁটিয়া পার হইবার নদী নয়। সংবাদ রাখ, কোথায় নদী পার হইবে। সেইখানে সৈন্য লইয়া যাও, তাহা হইলে মুসলমান এ পারে আসিতে পারিবে না। সব প্রস্তুত রাখ, কিন্তু আমায় না বলিয়া যাত্রা করিও না |”
চন্দ্রচূড় গুপ্তচরের প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। গুপ্তচর ফিরিলেই তিনি সংবাদ পাইবেন, কখন কোন পথে তোরাব খাঁর সৈন্য যাত্রা করিবে; তখন ব্যবস্থা করিবেন।
এ দিকে অন্তঃপুরে সংবাদ পৌঁছিল যে, তোরাব খাঁ সসৈন্য মহম্মদপুর লুঠিতে আসিতেছে। বহির্বাটীর অপেক্ষা অন্তঃপুরে সংবাদটা কিছু বাড়িয়া যাওয়াই রীতি। বাহিরে, “আসিতেছে” অর্থে বুঝিল, আসিবার উদ্যোগ করিতেছে। ভিতর মহলে, “আসিতেছে” অর্থে বুঝিল, “প্রায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে”। তখন সে অন্তঃপুরমধ্যে কাঁদাকাটার ভারি ধুম পড়িয়া গেল। নন্দার বড় কাজ বাড়িয়া গেল- কয়জনকে একা বুঝাইবে, কয়জনকে থামাইবে! বিশেষ রমাকে লইয়াই নন্দাকে বড় ব্যস্ত হইতে হইল-কেন না, রমা ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাইতে লাগিল। নন্দা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “সতীন মরিয়া গেলেই বাঁচি- কিন্তু প্রভু যখন আমাকে অন্তঃপুরের ভার দিয়া গিয়াছেন, তখন আমাকে আপনার প্রাণ দিয়াও সতীনকে বাঁচাইতে হইবে |” তাই নন্দা সকল কাজ ফেলিয়া রমার সেবা করিতে লাগিল।
এ দিকে পৌরস্ত্রীগণ নন্দাকে পরামর্শ দিতে লাগিল-“মা! তুমি এক কাজ কর-সকলের প্রাণ বাঁচাও। এই পুরী মুসলমানকে বিনা যুদ্ধে সমর্পণ কর-সকলের প্রাণ ভিক্ষা মাঙ্গিয়া লও। আমরা বাঙ্গালী মানুষ, আমাদের লড়াই ঝগড়া কাজ কি মা! প্রাণ বাঁচিলে আবার সব হবে। সকলের প্রাণ তোমার হাতে-মা, তোমার মঙ্গল হোক-আমদের কথা শোন |”
নন্দা তাহাদিগকে বুঝাইলেন। বলিলেন, “ভয় কি মা! পুরুষ মানুষের চেয়ে তোমরা কি বেশী বুঝ? তাঁরা যখন বলিতেছেন ভয় নাই, তখন ভয় কেন? তাঁদের কি আপনার প্রাণে দরদ নাই-না আমাদের প্রাণে দরদ নাই?”
এই সকল কথার পর রমা বড় মূর্ছা গেল না। উঠিয়া বসিল। কি কথা ভাবিয়া মনে সাহস পাইয়াছিল, তাহা পরে বলিতেছি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গঙ্গারাম নগররক্ষক। এ সময়ে রাত্রিতে নগর পরিভ্রমণে তিনি বিশেষ মনোযোগী। যে দিনের কথা বলিলাম, সেই রাত্রিতে, তিনি নগরের অবস্থা জানিবার জন্য, পদব্রজে, সামান্য বেশে, গোপনে, একা নগর পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। রাত্রি তৃতীয় প্রহরে, ক্লান্ত হইয়া তিনি গৃহে প্রত্যাগমন করিবার বাসনায় গৃহাভিমুখী হইতেছিলেন, এমন সময়ে কে আসিয়া পশ্চাৎ হইতে তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিল।
গঙ্গারাম পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, একজন স্ত্রীলোক। রাত্রি অন্ধকার, রাজপথে আর কেহ নাই-কেবল একাকিনী সেই স্ত্রীলোক। অন্ধকারে স্ত্রীলোকের আকার, স্ত্রীলোকের বেশ, ইহা জানা গেল-কিন্তু আর কিছুই বুঝা গেল না। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
স্ত্রীলোক বলিল, “আমি যে হই, তাতে আপনার কিছু প্রয়োজন নাই। আমাকে বরং জিজ্ঞাসা করুন যে, আমি কি চাই |”
কথার স্বরে বোধ হইল যে, এই স্ত্রীলোকের বয়স বড় বেশী নয়। তবে কথাগুলা জোর জোর বটে। গঙ্গরাম বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে। আগে বল দেখি, তুমি স্ত্রীলোক, এত রাত্রে একাকিনী রাজপথে কেন বেড়াইতেছ? আজকাল কিরূপ সময় পড়িয়াছে, তাহা কি জান না?”
স্ত্রীলোক বলিল, “এত রাত্রে একাকিনী আমি এই রাজপথে আর কিছু করিতেছি না-কেবল আপনারই সন্ধান করিতেছি |”
গ। মিছা কথা। প্রথমতঃ তুমি চেনই না যে, আমি কে?
স্ত্রী। আমি চিনি যে, আপনি দাস মহাশয়, নগররক্ষক।
গ। ভাল, চেন দেখিতেছি। কিন্তু আমাকে এখানে পাইবার সম্ভাবনা, ইহা তোমার জানিবার সম্ভাবনা নাই; কেন না, আমিই জানিতাম না যে, আমি এখন এ পথে আসিব।
স্ত্রী। আমি অনেক্ষণ ধরিয়া আপনাকে গলিতে গলিতে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। আপনার বাড়ীতেও সন্ধান লইয়াছি।
গ। কেন?
স্ত্রী। সেই কথাই আপনার আগে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আপনি একটা দু:সাহসিক কাজ করিতে পারিবেন?
গ। কি?
স্ত্রী। আমি আপনাকে যেখানে লইয়া যাইব, সেইখানে এখনই যাইতে পারিবেন?
গ। কোথায় যাইতে হইবে?
স্ত্রী। তাহা আমি আপনাকে বলিব না। আপনি তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না। সাহস হয় কি?
গ। আচ্ছা, তা না বল, আর দুই একটা কথা বল। তোমার নাম কি? তুমি কে? কি কর? আমাকেই বা কি করিতে হইবে?
স্ত্রী। আমার নাম মুরলা, ইহা ছাড়া আর কিছুই বলিব না। আপনি আসিতে সাহস না করেন, আসিবেন না। কিন্তু যদি এই সাহস না থাকে, তবে মুসলমানের হাত হইতে নগর রক্ষা করিবেন কি প্রকারে? আমি স্ত্রীলোক যেখানে যাইতে পারি, আপনি নগররক্ষক হইয়া সেখানে এত কথা নহিলে যাইতে পারিবেন না?
কাজেই গঙ্গারামকে মুরলার সঙ্গে যাইতে হইল। মুরলা আগে আগে চলিল, গঙ্গারাম পাছু পাছু। কিছু দূর গিয়া গঙ্গারাম দেখিলেন, সম্মুখে উচ্চ অট্টালিকা। চিনিয়া বলিলেন, “এ যে রাজবাড়ী যাইতেছ?”
মু। তাতে দোষ কি?
গ। সিং-দরজা দিয়া গেলে দোষ ছিল না। এ যে খিড়কি। অন্তঃপুরে যাইতে হইবে না কি?
মু। সাহস হয় না?
গ। না-আমার যে সাহস হয় না, এ আমার প্রভুর অন্তঃপুর! বিনা হুকুমে যাইতে পারি না।
মু। কার হুকুম চাই?
গ। রাজার হুকুম।
মু। তিনি ত দেশে নাই। রাণীর হুকুম হইলে চলিবে?
গঙ্গা। চলিবে।
মুরলা। আসুন, আমি রাণীর হুকুম আপনাকে শুনাইব।
গঙ্গা। কিন্তু পাহারাওয়ালা তোমাকে যাইতে দিবে?
মুরলা। দিবে।
গঙ্গা। কিন্তু আমাকে না চিনিলে ছাড়িয়া দিবে না। এ অবস্থায় পরিচয় দিবার আমার ইচ্ছা নাই।
মুরলা। পরিচয় দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি আপনাকে লইয়া যাইতেছি।
দ্বারে প্রহরী দণ্ডায়মান। মুরলা তাহার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন পাঁড়ে ঠাকুর, দ্বার খোলা রাখিয়াছ ত?”
পাঁড়ে ঠাকুর বলিলেন, “হাঁ রাখিয়েসে। এ কোন্?”
প্রহরী গঙ্গারামের প্রতি দৃষ্টি করিয়া এই কথা বলিল। মুরলা বলিল, “এ আমার ভাই |”
পাঁড়ে। মরদ যাতে পার্রবে না। হুকুম নেহি।
মুরলা তর্জন গর্জন করিয়া বলিল, “ই:, কার হুকুম রে? তোর আবার কার হুকুম চাই? আমার হুকুম ছাড়া কার হুকুম খুঁজিস? খ্যাংরা মেরে দাড়ি মুড়িয়ে দেব জানিস না?”
প্রহরী জড়সড় হইল, আর কিছু বলিল না। মুরলা গঙ্গারামকে লইয়া নির্বিঘ্নে অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দোতালায় উঠিল। সে একটি কুঠারি দেখাইয়া দিয়া বলিল, “ইহার ভিতর প্রবেশ করুন। আমি নিকটেই রহিলাম, কিন্তু ভিতরে যাইব না |”
গঙ্গারাম কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া কুঠারির ভিতর প্রবেশ করিলেন। মহামূল্য দ্রব্যাদিতে সুসজিত গৃহ, রজতপালঙ্কে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক- উজ্জ্বল দীপাবলীর স্নিগ্ধ রশ্মি তাহার মুখের উপর পড়িয়াছে, সে অধোবদনে চিন্তা করিতেছে। আর কেহ নাই। গঙ্গারাম মনে করিলেন, এমন সুন্দরী পৃথিবীতে আর জন্মে নাই। সে রমা।