দেওয়ানজি বলিলেন, “আমার মুনিব স্ত্রীলোক, আবার অল্পবয়স্কা। এজন্য তিনি নিয়ম করিয়াছেন যে, কোন অপরিচিত লোকে পত্র আনিলে আমরা তাহা না পড়িয়া তাঁহার কাছে পাঠাইব না |”
আগন্তুক বলিল, “আপনি পড়ুন |”
দেওয়ানজি পত্র পড়িলেন–
“প্রিয় ভগিনি!
এ ব্যক্তি পুরুষ হইলেও ইঁহার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিও–ভয় করিও না। যেমত যেমত ঘটে, আমাকে লিখিও।
শ্রীমতী বসন্তকুমারী |”
কামাখ্যা বাবুর কন্যার স্বাক্ষর দেখিয়া, কেহ আর কিছু বলিল না। পত্র অন্ত:পুরে গেল।
অন্ত:পুর হইতে পরিচারিকা, পত্রবাহক বাবুকে লইতে আসিল। আর কেহ সঙ্গে যাইতে পারিল না–হুকুম নাই।
পরিচারিকা বাবুকে লইয়া এক সুসজ্জিত গৃহে বসাইলেন। রাধারাণীর অন্ত:পুরে সেই প্রথম পুরুষ মানুষ প্রবেশ করিল। দেখিয়া একজন পরিচারিকা রাধারাণীকে ডাকিতে গেল, আর একজন অন্তরালে থাকিয়া আগন্তুককে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। দেখিল যে, তাঁহার বর্ণটুকু গৌর, স্ফুটিত মল্লিকারাশির মত গৌর; তাঁহার শরীর দীর্ঘ, ঈষৎ স্থূল, কপাল দীর্ঘ, অতি সূক্ষ্ম পরিষ্কার ঘনকৃষ্ণ সুরঞ্জিত কেশজালে মণ্ডিত; চক্ষু বৃহৎ, কটাক্ষ স্থির, ভ্রূযুগ সূক্ষ্ম, ঘন দূরায়ত এবং নিবিড় কৃষ্ণ; নাসিকা দীর্ঘ এবং উন্নত; ওষ্ঠাধর রক্তবর্ণ, ক্ষুদ্র এবং কোমল; গ্রীবা দীর্ঘ, অথচ মাংসল; অন্যান্য অঙ্গ বস্ত্রে আচ্ছাদিত; কেবল অঙ্গুলিগুলি দেখা যাইতেছে, সেগুলি শুভ্র, সুগঠিত, এবং একটি বৃহদাকার হীরকে রঞ্জিত।
রাধারাণী সেই স্থানে আসিয়া পরিচারিকাকে বিদায় করিয়া দিলেন। রাধারাণী আসিবামাত্র দর্শকের বোধ হইল যে, সেই কক্ষমধ্যে এক অভিনব সূর্যোদয় হইল–রূপের আলোকে তাঁহার মস্তকের কেশ পর্যন্ত যেন প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।
আগন্তুকের উচিত, প্রথম কথা কহা–কেন না, তিনি পুরুষ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ–কিন্তু তিনি সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হইয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রাধারাণী একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “আপনি এরূপ গোপনে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিলাষ করিয়াছেন কেন? আমি স্ত্রীলোক, কেবল বসন্তের অনুরোধেই আমি ইহা স্বীকার করিয়াছি |”
আগন্তুক বলিল, “আমি আপনার সহিত এরূপ সাক্ষাতের অভিলাষী হইয়াছি, ঠিক তা নহে |”
রাধারাণী অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “তা নয় বটে। তবে বসন্ত কি জন্য এরূপ অনুরোধ করিয়াছেন, তাহা কিছু লেখেন নাই। বোধ হয়, আপনি জানেন |”
আগন্তুক একখানি অতি পুরাতন সংবাদপত্র বাহির করিয়া তাহা রাধারাণীকে দেখাইলেন। রাধারাণী পড়িলেন; কামাখ্যা বাবুর স্বাক্ষরিত রুক্মিণীকুমার সম্বন্ধে সেই বিজ্ঞাপন। রাধারাণী দাঁড়াইয়াছিলেন–দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া নারিকেলপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন। আগন্তুকের দেবতুল্য গঠন দেখিয়া, মনে ভাবিলেন, ইনিই আমার সেই রুক্মিণীকুমার। আর থাকিতে পারিলেন না–জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন, “আপনার নাম কি রুক্মিণীকুমার বাবু?”
আগন্তুক বলিলেন, “না |” “না” শব্দ শুনিয়াই রাধারাণী ধীরে ধীরে আসন গ্রহণ করিলেন। আর দাঁড়াইতে পারিলেন না–তাঁহার বুক যেন ভাঙ্গিয়া গেল। আগন্তুক বলিলেন, “না। আমি যদি রুক্মিণীকুমার হইতাম, তাহা হইলে, কামাখ্যা বাবু এ বিজ্ঞাপন দিতেন না। কেন না, তাঁহার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কিন্তু যখন এই বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তখনি আমি ইহা দেখিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিলাম |”
রাধারাণী বলিল, “যদি আপনার সঙ্গে এই বিজ্ঞাপনের কোন সম্বন্ধ নাই তবে আপনি ইহা তুলিয়া রাখিয়াছিলেন কেন?”
উত্তরকারী বলিলেন, “একটি কৌতুকের জন্য। আজি আট দশ বৎসর হইল, আমি যেখানে সেখানে বেড়াইতাম –কিন্তু লোকলজ্জাভয়ে আপনার নামটা গোপন করিয়া কাল্পনিক নাম ব্যবহার করিতাম। কাল্পনিক নাম রুক্মিণীকুমার। আপনি অত বিমনা হইতেছেন কেন?”
রাধারাণী একটু স্থির হইলেন-আগন্তুক বলিতে লাগিলেন-“যথার্থ রুক্মিণীকুমার নাম ধরে, এমন কাহাকেও চিনি না। যদি কেহ আমারই তল্লাস করিয়া থাকে-তাহা সম্ভব নহে-তথাপি কি জানি-সাত পাঁচ ভাবিয়া বিজ্ঞাপনটি তুলিয়া রাখিলাম-কিন্তু কামাখ্যা বাবুর কাছে আসিতে সাহস হইল না।”
“পরে?”
“পরে কামাখ্যা বাবুর শ্রাদ্ধে তাঁহার পুত্রগণ আমাকে নিমন্ত্রণ করিল, কিন্তু আমি কার্যগতিকে আসিতে পারি নাই। সম্প্রতি সেই ত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য তাঁহার পুত্রদিগের নিকট আসিলাম। কৌতুকবশত: বিজ্ঞাপন সঙ্গে আনিয়াছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে উহার কথা উত্থাপন করিয়া কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠপুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, এ বিজ্ঞাপন কেন দেওয়া হইয়াছিল? কামাখ্যা বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বলিলেন, যে রাধারাণীর অনুরোধে। আমিও এক রাধারাণীকে চিনিতাম–এক বালিকা–আমি একদিন দেখিয়া তাহাকে আর ভুলিতে পারিলাম না। সে মাতার পথ্যের জন্য, আপনি অনাহারে থাকিয়া বনফুলের মালা গাঁথিয়া–সেই অন্ধকার বৃষ্টিতে___” বক্তা আর কথা কহিতে পারিলেন না–তাঁহার চক্ষু: জলে পূরিয়া গেল। রাধারাণীরও চক্ষু: জলে ভাসিতে লাগিল। চক্ষু: মুছিয়া রাধারাণী বলিল, “ইতর লোকের কথায় এখন প্রয়োজন কি? আপনার কথা বলুন |”
আগন্তুক উত্তর করিলেন, “রাধারাণী ইতর লোক নহে। যদি সংসারে কেহ দেবকন্যা থাকে, তবে সেই রাধারাণী। যদি কাহাকে পবিত্র, সরলচিত্ত, এ সংসারে আমি দেখিয়া থাকি, তবে সেই রাধারাণী–যদি কাহারও কথায় অমৃত থাকে, তবে সেই রাধারাণী–যথার্থ অমৃত! বর্ণে বর্ণে অপ্সরার বীণা বাজে, যেন কথা কহিতে বাধ বাধ করে অথচ সকল কথা পরিষ্কার, সুমধুর,-অতি সরল! আমি এমন কণ্ঠ কখন শুনি নাই–এমন কথা কখনও শুনি নাই!”