দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কালের শীতল প্রলেপে সেই হৃদয়ক্ষত ক্রমে পূরিয়া উঠিতে লাগিল।
কাশীধামে গোবিন্দকান্ত দত্ত নামে কোন সচ্চরিত্র, অতি প্রাচীন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে আমার আলাপ হইল। ইনি বহুকাল হইতে কাশীবাস করিয়া আছেন।
একদা তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনকালে পুলিসের অত্যাচারের কথা প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হইল। অনেকে পুলিসের অত্যাচারঘটিত অনেকগুলিন গল্প বলিলেন-দুই একটা বা সত্য, দুই একটা বক্তাদিগের কপোলকল্পিত! গোবিন্দকান্ত বাবু একটি গল্প বলিলেন, তাহার সারমর্ম এই।
“হরেকৃষ্ণ দাস নামে আমাদিগের গ্রামে একঘর দরিদ্র কায়স্থ ছিল। তাহার একটি কন্যা ভিন্ন অন্য সন্তান ছিল না। তাহার গৃহিণীর মৃত্যু হইয়াছিল, এবং সে নিজেও রুগ্ন। এজন্য সে কন্যাটি আপন শ্যালীপতিকে প্রতিপালন করিতে দিয়াছিল। তাহার কন্যাটি কতকগুলিন স্বর্ণালঙ্কার ছিল। লোভবশত: তাহা সে শ্যালীপতিকে দেয় নাই। কিন্তু যখন মৃত্যু উপস্থিত দেখিল, তখন সেই অলঙ্কারগুলি সে আমাকে ডাকিয়া আমার কাছে রাখিল-বলিল যে, ‘আমার কন্যার জ্ঞান হইলে তাহাকে দিবেন-এখন দিলে রাজচন্দ্র ইহা আত্মসাৎ করিবে |’ আমি স্বীকৃত হইলাম। পরে হরেকৃষ্ণের মৃত্যু হইলে সে লাওয়ারেশ মরিয়াছে বলিয়া, নন্দী-ভৃঙ্গী সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেব দারোগা মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হরেকৃষ্ণের ঘটী বাটী পাতর টুকনি লাওয়ারেশ মাল বলিয়া হস্তগত করিলেন। কেহ কেহ বলিল যে, হরেকৃষ্ণ লাওয়ারেশ নহে–কলিকাতায় তাহার কন্যা আছে। দারোগা মহাশয় তাহাকে কটু বলিয়া, আজ্ঞা করিলেন, ‘ওয়ারেশ থাকে, হুজুরে হাজির হইবে |’ তখন আমার দুই একজন শত্রু সুযোগ মনে করিয়া বলিয়া দিল যে, গোবিন্দ দত্তের কাছে ইহার স্বর্ণালঙ্কার আছে। আমাকে তলব হইল। আমি তখন দেবাদিদেবের কাছে আসিয়া যুক্তকরে দাঁড়াইলাম। কিছু গালি খাইলাম। আসামীর শ্রেণীতে চালান হইবার গতিক দেখিলাম। বলিব কি? ঘুষাঘুষির উদ্যোগ দেখিয়া অলঙ্কারগুলি সকল দারোগা মহাশয়ের পাদপদ্মে ঢালিয়া দিলাম, তাহার উপর পঞ্চাশটাকা নগদ দিয়া নিষ্কৃতি পাইলাম।
“বলা বাহুল্য যে, দারোগা মহাশয় অলঙ্কারগুলি আপন কন্যার ব্যবহারার্থ নিজালয়ে প্রেরণ করিলেন। সাহেবের কাছে তিনি রিপোর্ট করিলেন যে, ‘হরেকৃষ্ণ দাসের এক লোটা আর এক দেরকো ভিন্ন অন্য কোন সম্পত্তিই নাই ; এবং সে লাওয়ারেশা ফেতি করিয়াছে, তাহার কেহ নাই’|”
হরেকৃষ্ণ দাসের নাম শুনিয়াছিলাম। আমি গোবিন্দ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “ঐ হরেকৃষ্ণ দাসের এক ভাইয়ের নাম মনোহর দাস না?”
গোবিন্দকান্ত বাবু বলিলেন, “হাঁ। আপনি কি প্রকারে জানিলেন?”
আমি বিশেষ কিছু বলিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরেকৃষ্ণের শ্যালীপতির নাম কি?”
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “রাজচন্দ্র দাস |”
আমি। তাহার বাড়ী কোথায়?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “কলিকাতায়। কিন্তু কোন্ স্থানে, তাহা আমি ভুলিয়া গিয়াছি |”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কন্যাটির নাম কি জানেন?”
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “হরেকৃষ্ণ তাহার নাম রজনী রাখিয়াছিলেন |”
ইহার অল্প দিন পরেই আমি কাশী পরিত্যাগ করিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
প্রথমে আমাকে বুঝিতে হইতেছে, আমি কি খুঁজি। চিত্ত আমার দু:খময়, এ সংসার আমার পক্ষে অন্ধকার। আজি আমার মৃত্যু হইলে, আমি কাল চাহি না। যদি দু:খ নিবারণ করিতে না পারিলাম, তবে পুরুষত্ব কি? কিন্তু ব্যাধির শান্তি করিতে গেলে আগে ব্যাধির নির্ণয় চাহি। দু:খ নিবারণের আগে আমার দু:খ কি, তাহা নিরুপণের আবশ্যক।
দু:খ কি? অভাব। সকল দু:খই অভাব। রোগ দু:খ ; কারণ, রোগ স্বাস্থ্যের অভাব। অভাবমাত্রই দু:খ নহে, তাহা জানি। রোগের অভাব দু:খ নহে। অভাববিশেষই দু:খ।
আমার কিসের অভাব? আমি চাই কি? মনুষ্যই চায় কি? ধন? আমার যথেষ্ট আছে।
যশ? পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যাহার যশ নাই। যে পাকা জুয়াচোর, তাহারও বুদ্ধি সম্বন্ধে যশ আছে। আমি একজন কশাইয়েরও যশ শুনিয়াছি-মাংস সম্বন্ধে সে কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিত না। সে কখন মেষমাংস বলিয়া কাহাকেও কুক্কুরমংস দেয় নাই। যশ সকলেরই আছে। আবার কাহারও যশ সম্পূর্ণ নহে। বেকনের ঘুষখোর অপবাদ-সক্রেতিস অপযশহেতু বধদণ্ডার্হ হইয়াছিলেন। যুধিষ্ঠির দ্রোণবধে মিথ্যাবাদী-অর্জুন বভ্রুবাহন কর্তৃক পরাভূত। কাইসরকে যে বিথীনিয়ার রাণী বলিত, সে কথা অদ্যাপি প্রচলিত;-সেক্সপিয়রকে বল্টের ভাঁড় বলিয়াছেন। যশ চাহি না।
যশ সাধারণ লোকের মুখে। সাধারণ লোক কোন বিষয়েরই বিচারক নহে-কেন না, সাধারণ লোক মূর্খ এবং স্থূলবুদ্ধি। মূর্খ স্থূলবুদ্ধির কাছে যশস্বী হইয়া আমার কি সুখ হইবে? আমি যশ চাহি না।
মান? সংসারে এমন লোক কে আছে যে, সে মানিলে সুখী হই? যে দুই চারি জন আছে, তাহাদিগের কাছে আমার মান আছে। অন্যের কাছে মান-অপমান মাত্র। রাজদরবারে মান-সে কেবল দাসত্বের প্রাধান্যচিহ্ন বলিয়া অগ্রাহ্য করি। আমি মান চাহি না। মান চাহি কেবল আপনার কাছে।
রূপ? কতটুকু চাই? কিছু চাই। লোকে দেখিয়া, না নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে। আমাকে দেখিয়া কেহ নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে না। রূপ যাহা আছে তাহাই আমার যথেষ্ট।
স্বাস্থ্য? আমার স্বাস্থ্য অদ্যাপি অনন্ত।
বল? লইয়া কি করিব? প্রহারের জন্য বল আবশ্যক। আমি কাহাকেও প্রহার করিতে চাহি না।
বুদ্ধি? এ সংসারে কেহ কখন বুদ্ধির অভাব আছে মনে করে নাই-আমিও করি না। সকলেই আপনাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলিয়া জানে, আমিও জানি।
বিদ্যা? ইহার অভাব স্বীকার করি, কিন্তু কেহ কখন বিদ্যার অভাবে আপনাকে অসুখী মনে করে নাই। আমিও করি না।
ধর্ম? লোকে বলে, ধর্মের অভাব পরকালের দু:খের কারণ ইহকালের নহে। লোকের চরিত্রে দেখিতে পাই, অধর্মের অভাবই দু:খ। জানি আমি সে মিথ্যা। কিন্তু জানিয়াও ধর্মকামনা করি না। আমার সে দু:খ নহে।
প্রণয়? স্নেহ? ভালবাসা? আমি জানি, ইহার অভাবই সুখ-ভালবাসাই দু:খ। সাক্ষী লবঙ্গলতা।
তবে আমার দু:খ কিসের? আমার অভাব কিসের? আমার কিসের কামনা যে, তাহা লাভে সফল হইয়া দু:খ নিবারণ করিব? আমার কাম্য বস্তু কি?
বুঝিয়াছি। আমার কাম্য বস্তুর অভাবই আমার দু:খ। আমি বুঝিয়াছি যে, সকলই অসার। তাই আমার কেবল দু:খ সার।