সপ্তম পরিচ্ছেদ
হীরালাল, জগন্নাথের ঘাটে গিয়া নৌকা ধরিল। রাত্রিকালে দক্ষিণা বাতাসে পাল দিল। সে বলিল, তাহাদের পিত্রালয় হুগলী। আমি তাহা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম।
পথে হীরালাল বলিল, “গোপালের সঙ্গে বিবাহ ত হইবে না-আমায় বিবাহ কর |” আমি বলিলাম, “না |” হীরালাল বিচার আরম্ভ করিল। তাহার যত্ন যে, বিচারের দ্বারা প্রতিপন্ন করে যে, তাহার ন্যায় সৎপাত্র পৃথিবীতে দুর্লভ ; আমার ন্যায় কুপাত্রীও পৃথিবীতে দুর্লভ। আমি উভয়ই স্বীকার করিলাম-তথাপি বলিলাম যে, “না, তোমাকে বিবাহ করিব না |”
তখন হীরালাল বড় ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, “কাণাকে কে বিবাহ করিতে চাহে?” এই বলিয়া নীরব হইল। উভয়ে নীরবে রহিলাম-এইরূপে রাত্রি কাটিতে লাগিল।
তাহার পরে, শেষ রাত্রে, হীরালাল অকস্মাৎ মাঝিদিগকে বলিল, “এইখানে ভিড় |” মাঝিরা নৌকা লাগাইল-নৌকাতলে ভূমি স্পর্শের শব্দ শুনিলাম। হীরালাল আমাকে বলিল, “নাম-আসিয়াছি |”-সে আমার হাত ধরিয়া নামাইল। আমি কূলে দাঁড়াইলাম।
তাহার পর শব্দ শুনিলাম, যেন হীরালাল আবার নৌকায় উঠিল। মাঝিদিগকে বলিল, “দে, নৌকা খুলিয়া দে |” আমি বলিলাম, “সে কি? আমাকে নামাইয়া দিয়া নৌকা খুলিয়া দাও কেন?”
হীরালাল বলিল, “আপনার পথ আপনি দেখ |” মাঝিরা নৌকা খুলিতে লাগিল-দাঁড়ের শব্দ শুনিলাম। আমি তখন কাতর হইয়া বলিলাম, “তোমার পায়ে পড়ি! আমি অন্ধ-যদি একান্তই ফেলিয়া যাইবে, তবে কাহারও বাড়ী পর্যন্ত আমাকে রাখিয়া দিয়া যাও। আমি ত এখানে কখনও আসি নাই-এখানকার পথ চিনিব কি প্রকারে?”
হীরালাল বলিল, “আমাকে বিবাহ করিতে সম্মত আছ?”
আমার কান্না আসিল। ক্ষণেক রোদন করিলাম; রাগে হীরালালকে বলিলাম, “তুমি যাও। তোমার কাছে কোন উপকারও পাইতে নাই-রাত্রি প্রভাত হইলে তোমার অপেক্ষা দয়ালু শত শত লোকের সাক্ষাৎ পাইব। তাহারা অন্ধের প্রতি তোমার অপেক্ষা দয়া করিবে |”
হী। দেখা পেলে তো? এ যে চড়া! চারিদিকে জল। আমাকে বিবাহ করিবে?
হীরালালের নৌকা তখন কিছু বাহিরে গিয়াছিল। শ্রবণশক্তি আমার জীবনাবলম্বন-শ্রবণই আমার চক্ষের কাজ করে। কেহ কথা কহিলে-কত দূরে, কোন্ দিকে কথা কহিতেছে, তাহা অনুভব করিতে পারি। হীরালাল কোন্ দিকে, কত দূরে থাকিয়া কথা কহিল, তাহা মনে মনে অনুভব করিয়া, জলে নামিয়া সেই দিকে ছুটিলাম-ইচ্ছা, নৌকা ধরিব। গলাজল অবধি নামিলাম। নৌকা পাইলাম না। নৌকা আরও বেশী জলে। নৌকা ধরিতে গেলে ডুবিয়া মরিব।
তালের লাঠি তখনও হাতে ছিল। আবার ঠিক করিয়া শব্দানুভব করিয়া বুঝিলাম, হীরালাল এই দিকে, এত দূর হইতে কথা কহিতেছে। পিছু হটিয়া, কোমর জলে উঠিয়া, শব্দের স্থানানুভব করিয়া, সবলে সেই তালের লাঠি নিক্ষেপ করিলাম।
চীৎকার করিয়া হীরালাল নৌকার উপর পড়িয়া গেল। “খুন হইয়াছে, খুন হইয়াছে!” বলিয়া মাঝিরা নৌকা খুলিয়া দিল। বাস্তবিক-সেই পাপিষ্ঠ খুন হয় নাই। তখনই তাহার মধুর কণ্ঠ শুনিতে পাইলাম-নৌকা বাহিয়া চলিল-সে উচ্চৈ:স্বরে আমাকে গালি দিতে দিতে চলিল-অতি কদর্য অশ্রাব্য ভাষায় পবিত্রা গঙ্গা কলুষিত করিতে করিতে চলিল। আমি স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম যে, সে শাসাইতে লাগিল যে, আবার খবরের কাগজ করিয়া আমার নামে আর্টিকেল লিখিবে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সেই জনহীনা রাত্রিতে আমি অন্ধ যুবতী, একা সেই দ্বীপে দাঁড়াইয়া গঙ্গার কল কল জলকল্লোল শুনিতে লাগিলাম।
হায়, মানুষের জীবন! কি অসার তুই! কেন আসিস-কেন থাকিস-কেন যাস? এ দু:খময় জীবন কেন? ভাবিলে জ্ঞান থাকে না। শচীন্দ্র বাবু একদিন তাঁহার মাতাকে বুঝাইতেছিলেন, সকলই নিয়মাধীন। মানুষের এই জীবন কি কেবল নিয়মের ফল? যে নিয়মে ফুল ফুটে, মেঘ ছুটে, চাঁদ উঠে,-যে নিয়মে জলবুদবুদ ভাসে, হাসে, মিলায়, যে নিয়মে ধূলা উড়ে, তৃণ পুড়ে, পাতা খসে, সেই নিয়মেই কি এই সুখদু:খময় মনুষ্যজীবন আবদ্ধ, সম্পূর্ণ বিলীন হয়? যে নিয়মের অধীন হইয়া ঐ নদীগর্ভস্থ কুম্ভীর শিকারের সন্ধান করিতেছে-যে নিয়মের অধীন হইয়া এই চরে ক্ষুদ্র কীটসকল অন্য কীটের সন্ধান করিয়া বেড়াইতেছে, সেই নিয়মের অধীন হইয়া আমি শচীন্দ্রের জন্য প্রাণত্যাগ করিতে বসিয়াছি? ধিক্ প্রাণত্যাগে! ধিক্ প্রণয়ে! ধিক্ মনুষ্যজীবনে! কেন এই গঙ্গাজলে ইহা পরিত্যাগ করি না?
জীবন অসার-সুখ নাই বলিয়া অসার, তাহা নহে। শিমুলগাছে শিমুলফুলই ফুটিবে ; তাহা বলিয়া তাহাকে অসার বলিব না। দু:খময় জীবনে দু:খ আছে বলিয়া তাহাকে অসার বলিব না। কিন্তু অসার বলি এই জন্য যে, দু:খই দু:খের পরিণাম-তাহার পর আর কিছু নাই। আমার মর্ম্মের দু:খ, আমি একা ভোগ করিলাম, আর কেহ জানিল না-আর কেহ বুঝিল না-দু:খ প্রকাশের ভাষা নাই বলিয়া তাহা বলিতে পারিলাম না; শ্রোতা নাই বলিয়া তাহা শুনাইতে পারিলাম না-সহৃদয় বোদ্ধা নাই বলিয়া তাহা বুঝাইতে পারিলাম না। একটি শিমুলবৃক্ষ হইতে সহস্র শিমুলবৃক্ষ হইতে পারিবে, কিন্তু তোমার দু:খে আর কয়জনের দু:খ হইবে। পরের অন্ত:করণমধ্যে পরে প্রবেশ করিতে পারে, এমন কয়জন পর পৃথিবীতে জন্মিয়াছে? পৃথিবীতে কে এমন জন্মিয়াছে যে, অন্ধ পুষ্পনারীর দু:খ বুঝিবে? কে এমন জন্মিয়াছে যে, এ ক্ষুদ্র হৃদয়ে, প্রতি কথায়, প্রতি শব্দে, প্রতি বর্ণে, কত সুখদু:খের তরঙ্গ উঠে, তাহা বুঝিতে পারে? সুখ দু:খ? হাঁ, সুখও আছে। যখন চৈত্র মাসে, ফুলের বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছি ছুটিয়া আমাদের গৃহমধ্যে প্রবেশ করিত, তখন সে শব্দের সঙ্গে আমার কত সুখ উছলিত, কে বুঝিত? যখন গীতিব্যবসায়িনীর অট্টালিকা হইতে বাদ্যনিক্কণ, সান্ধ্য সমীরণে কর্ণে আসিত, তখন আমার সুখ কে বুঝিয়াছে? যখন বামাচরণের আধ আধ কথা ফুটিয়াছিল-জল বলতে “ত” বলিত, কাপড় বলিতে “খাব” বলিত, রজনী বলিতে “জুঞ্জি” বলিত তখন আমার মনে কত সুখ উছলিত, তাহা কে বুঝিয়াছিল? আমার দু:খই বা কে বুঝিবে? অন্ধের রূপোন্মাদ কে বুঝিবে? না দেখায় যে দু:খ, তাহা কে বুঝিবে? বুঝিলেও বুঝিতে পারে, কিন্তু দু:খ যে কখন প্রকাশ করিতে পারিলাম না, এ দু:খ কে বুঝিবে? পৃথিবীতে যে দু:খের ভাষা নাই, এ দু:খ কে বুঝিবে? ছোট মুখে বড় কথা তোমরা ভালবাস না, ছোট ভাষায় বড় দু:খ কি প্রকাশ করা যায়? এমনই দু:খ যে, আমার যে কি দু:খ, তাহাতে হৃদয় ধ্বংস হইলেও, সকলটা আপনি মনে ভাবিয়া আনিতে পারি না।
মনুষ্যভাষাতে তেমন কথা নাই-মনুষ্যের তেমন চিন্তাশক্তি নাই। দু:খ ভোগ করি-কিন্তু দু:খটা বুঝিয়া উঠিতে পারি না। আমার কি দু:খ? কি তাহা জানি না, কিন্তু হৃদয় ফাটিয়া যাইতেছে। সর্বদা দেখিতে পাইবে যে, তোমার দেহ শীর্ণ হইতেছে, বল অপহৃত হইতেছে, কিন্তু তোমার শারীরিক রোগ কি, তাহা জানিতে পারিতেছ না। তেমনি অনেক সময় দেখিবে যে, দু:খে তোমার বক্ষ: বিদীর্ণ হইতেছে, প্রাণ বাহির করিয়া দিয়া, শূন্যমার্গে পাঠাইতে ইচ্ছা করিতেছে-কিন্তু কি দু:খ, তাহা আপনি বুঝিতে পারিতেছ না। আপনি বুঝিতে পারিতেছ না-পরে বুঝিবে কি? ইহা কি সামান্য দু:খ? সাধ করিয়া বলি, জীবন অসার!
যে জীবন এমন দু:খময়, তাহার রক্ষার জন্য এত ভয় পাইতেছিলাম কেন? আমি কেন ইহা ত্যাগ করি না? এই ত কলনাদিনী গঙ্গার তরঙ্গমধ্যে দাঁড়াইয়া আছি-আর দুই পা অগ্রসর হইলেই মরিতে পারি। না মরি কেন? এ জীবন রাখিয়া কি হইবে? মরিব!
আমি কেন জন্মিলাম? কেন অন্ধ হইলাম? জন্মিলাম ত শচীন্দ্রের যোগ্য হইয়া জন্মিলাম না কেন? শচীন্দ্রের যোগ্য না হইলাম, তবে শচীন্দ্রকে ভালবাসিলাম কেন? ভালবাসিলাম, তবে তাঁহার কাছে রহিতে পারিলাম না কেন? কিসের জন্য শচীন্দ্রকে ভাবিয়া, গৃহত্যাগ করিতে হইল? নি:সহায় অন্ধ, গঙ্গার চরে মরিতে আসিলাম কেন? কেন বানের মুখে কুটার মত, সংসারস্রোতে, অজ্ঞাত পথে ভাসিয়া চলিলাম? এ সংসারে অনেক দু:খী আছে, আমি সর্বাপেক্ষা দু:খী কেন? এ সকল কাহার খেলা? দেবতার? জীবের এত কষ্টে দেবতার কি সুখ? কষ্ট দিবার জন্য সৃষ্টি করিয়া কি সুখ? মূর্তিমতী নির্দয়তাকে কেন দেবতা বলিব? কেন নিষ্ঠুরতার পূজা করিব? মানুষের এত ভয়ানক দু:খ কখন দেবকৃত নহে-তাহা হইলে দেবতা রাক্ষসের অপেক্ষা সহস্রগুণে নিকৃষ্ট। তবে কি আমার কর্মফল? কোন্ পাপে আমি জন্মান্ধ?
দুই এক পা করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম-মরিব! গঙ্গার তরঙ্গরব কাণে বাজিতে লাগিল-বুঝি মরা হইল না-আমি মিষ্ট শব্দ বড় ভালবাসি! না, মরিব। চিবুক ডুবিল! অধর ডুবিল! আর একটু মাত্র। নাসিকা ডুবিল! চক্ষু: ডুবিল! আমি ডুবিলাম!
ডুবিলাম, কিন্তু মরিলাম না। কিন্তু এ যন্ত্রণাময় জীবনচরিত আর বলিতে সাধ করে না। আর একজন বলিবে।
আমি সেই প্রভাতবায়ুতাড়িত গঙ্গাজলপ্রবাহমধ্যে নিমগ্ন হইয়া ভাসিতে ভাসিতে চলিলাম। ক্রমে শ্বাস নিশ্চেষ্ট, চেতনা বিনষ্ট হইয়া আসিল।
রজনী – ২
দ্বিতীয় খণ্ড
অমরনাথের কথা