তৃতীয় পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা
আমি মনে করিয়াছিলাম, রজনীর এই বিস্ময়কর কথা শুনিয়া, অমরনাথ আগুনে সেঁকা কলাপাতের মত শুকাইয়া উঠিবে। কই, তাহা ত কিছুই দেখিলাম না। তাহার মুখ না শুকাইয়া বরং প্রফুল্ল হইল। বিস্মিত হতবুদ্ধি, যা হইবার, তাহা আমিই হইলাম।
আমি প্রথমে তামাসা মনে করিলাম, কিন্তু রজনীর কাতরতা, অশ্রুপাত এবং দার্ঢ্য দেখিয়া আমার নিশ্চয় প্রতীতি জন্মিল যে, রজনী আন্তরিক বলিতেছে। আমি বলিলাম, “রজনী! কায়েতের কুলে তুমিই ধন্য! তোমার মত কেহ নাই। কিন্তু আমি তোমার দান গ্রহণ করিব না |”
রজনী বলিল, “না গ্রহণ করেন, আমি ইহা বিলাইয়া দিব |”
আমি। অমরনাথ বাবুকে?
র। আপনি উঁহাকে সবিশেষ চিনেন না; আমি দিলেও উনি লইবেন না। লইবার অন্য লোক আছে।
আমি। অমরনাথ বাবু কি বল?
আমি। আমার সঙ্গে কোন কথা হইতেছে না, আমি কি বলিব?
আমি বড় ফাঁপরে পড়িলাম; রজনী যে বিষয় ছাড়িয়া দিতেছে, তাহাতে বিস্মিত; আবার অমরনাথ যে বিষয় উদ্ধারের জন্য এত করিয়াছিল, যাহার লোভে রজনীকে বিবাহ করিবার জন্য উদ্যোগ করিতেছে, সে বিষয় হাতছাড়া হইতেছে, দেখিয়াও সে প্রফুল্ল। কাণ্ডখানা কি?
আমি অমরনাথকে বলিলাম, যদি স্থানান্তরে যাও, তবে আমি রজনীর সঙ্গে সকল কথা মুখ ফুটিয়া কই। অমরনাথ অমনি সরিয়া গেল। আমি তখন রজনীকে বলিলাম, “সত্যসত্যই কি তুমি বিষয় বিলাইয়া দিবে?”
“সত্যসত্যই। আমি গঙ্গাজল নিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি |”
আমি। আমি তোমার দান লই, তুমি যদি আমার কিছু দান লও।
র। অনেক লইয়াছি।
আমি। আরও কিছু লইতে হইবে।
র। একখানি প্রসাদি কাপড় দিবেন।
আমি। তা না। আমি যা দিই, তাই নিতে হইবে।
র। কি দিবেন?
আমি। শচীন্দ্র বলিয়া আমার একটি পুত্র আছে। আমি তোমাকে শচীন্দ্র দান করিব। স্বামিস্বরূপ তুমি তাহাকে গ্রহণ করিবে। তুমি যদি তাহাকে গ্রহণ কর, তবেই আমি তোমার বিষয় গ্রহণ করিব।
রজনী দাঁড়াইয়াছিল, ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া, অন্ধ নয়ন মুদিল। তার পর তাহার মুদিত নয়ন হইতে অবিরল জলধারা পড়িতে লাগিল-চক্ষের জল আর ফুরায় না। আমি বিষম বিপদে পড়িলাম। রজনী কথা কহে না-কেবল কাঁদে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রজনী! অত কাঁদ কেন?”
রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “সে দিন গঙ্গার জলে আমি ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিলাম-ডুবিয়াছিলাম, লোকে ধরিয়া তুলিল। সে শচীন্দ্রের জন্য। তুমি যদি বলিতে, তুমি অন্ধ, তোমার চক্ষু ফুটাইব দিব-আমি তাহা চাহিতাম না-আমি শচীন্দ্র চাহিতাম। শচীন্দ্রের অপেক্ষা এ জগতে আর কিছুই নাই-আমার প্রাণ তাঁহার কাছে, দেবতার কাছে ফুলের কলিমাত্র-শ্রীচরণে স্থান পাইলেই সার্থক। অন্ধের দু:খের কথা শুনিবে কি?”
আমি রজনীর কাতরতা দেখিয়া কাতর হইয়া বলিলাম, “শুনিব |”
তখন রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে হৃদয় খুলিয়া, আমার কাছে সকল কথা বলিল। শচীন্দ্রের কণ্ঠ, শচীন্দ্রের স্পর্শ, অন্ধের রূপোন্মাদ! তাহার পলায়ন, নিমজ্জন, উদ্ধার, সকল বলিল। বলিয়া বলিল, “ঠাকুরাণি, তোমাদের চক্ষু আছে-চক্ষু থাকিলে এত ভালবাসা বাসিতে পারে কি?”
মনে মনে বলিলাম, “কাণি! তুই ভালাবাসার কি জানিস! তুমি লবঙ্গলতার অপেক্ষা সহস্রগুণে সুখী |” প্রকাশ্যে বলিলাম, “না রজনী, আমার বুড়া স্বামী-আমি অত শত জানি না। তুমি শচীন্দ্রকে তবে বিবাহ করিবে, ইহা স্থির?”
রজনী বলিল, “না |”
আমি। সে কি? তবে এত কথা কি বলিতেছিলে-এত কাঁদিলে কেন?
র। আমার সে সুখ কপালে নাই বলিয়াই এত কাঁদিলাম।
আমি। সে কি? আমি বিবাহ দিব।
র। দিতে পারিবেন না। অমরনাথ হইতে আমার সর্বস্ব। অমরনাথ আমার বিষয় উদ্ধারের জন্য যাহা করিয়াছেন, পরের জন্য পরে কি তত করে? তাও ধরি না, তিনি আপনার প্রাণ দিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছেন।
রজনী সে বৃত্তান্ত বলিল। পরে কহিল, “যাঁহার কাছে আমি এত ঋণী, তিনি আমার যাহা করিবেন, তাহাই হইবে। তিনি যখন অনুগ্রহ করিয়া আমাকে দাসী করিতে চাহিয়াছেন, তখন আমি তাঁহারই দাসী হইব, আর কাহারও নহে |”
হরি! হরি! কেন বাছাকে সন্ন্যাসী দিয়া ঔষধ করিলাম! বিবাহ ব্যতীতও বিষয় থাকে-রজনী ত এখনই বিষয় দিতে চাহিতেছে। কিন্তু ছি! রজনীর দান লইব? ভিক্ষা মাগিয়া খাইব-সেও ভাল। আমি বলিয়াছি-আমি যদি এই বিবাহ না দিই ত আমি কায়েতের মেয়ে নই। আমি বিবাহ দিবই দিব। আমি রজনীকে বলিলাম, “তবে আমি তোমার দান লইব না। তুমি যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে দান করিও |” আমি উঠিলাম।
রজনী বলিল, “আর একবার বসুন। আমি অমরনাথ বাবুর দ্বারা একবার অনুরোধ করাইব। তাঁহাকে ডাকিতেছি |”
অমরনাথের সঙ্গে আর একবার সাক্ষাৎ আমারও ইচ্ছা। আমি আবার বসিলাম। রজনী অমরনাথকে ডাকিল।
অমরনাথ আসিলে, আমি রজনীকে বলিলাম, “অমরনাথ বাবু এ বিষয়ে যদি অনুরোধ করিতে চাহেন, তবে সকল কথা কি তোমার সাক্ষাতে খুলিয়া বলিতে পারিবেন? আপনার প্রশংসা আপনি দাঁড়াইয়া শুনিও না |”
রজনী সরিয়া গেল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা
আমি অমরনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি রজনীকে বিবাহ করিবে?”
অ। করিব-স্থির।
আমি। এখনও স্থির? রজনীর বিষয় ত রজনী আমাকে দিতেছে।
অ। আমি রজনীকে বিবাহ করিব-বিষয় বিবাহ করিব না।
আমি। বিষয়ের জন্যই ত রজনীকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলে?
অ। স্ত্রীলোকের মন এমনই কদর্য।
আমি। আমাদের উপর এত অভক্তি কতদিন?
অ। অভক্তি নাই-তাহা হইলে বিবাহ করিতে চাহিতাম না।
আমি। কিন্তু বাছিয়া বাছিয়া অন্ধ কন্যাতে এত অনুরাগ কেন? তাই বিষয়ের কথা বলিতেছিলাম।
অ। তুমি বৃদ্ধতে এত অনুরক্ত কেন? বিষয়ের জন্য কি?
আমি। কাহারও সাক্ষাতে তাহার স্বামীকে বুড়া বলিতে নাই। আমার সঙ্গে রাগারাগি কেন? তুমি কি মুখরা স্ত্রীলোকের মুখকে ভয় কর না?
(কিন্তু রাগারাগি আমার আন্তরিক বাসনা।)
অমরনাথ বলিল, “ভয় করি বই কি? রাগের কথা কিছু বলি নাই। তুমি মিত্রজাকে ভালবাস, আমিও রজনীকে তেমনি ভালবাসি !”
আমি। কটাক্ষের গুণ নাকি?
অ। না। কটাক্ষ নাই বলিয়া। তুমিও কাণা হইলে আরও সুন্দর হইতে।
আমি। সে কথা মিত্রজাকে জিজ্ঞাসা করিব, তোমাকে নহে। সম্প্রতি তুমিও যেমন রজনীকে ভালবাস, আমিও রজনীকে তেমনি ভালবাসি।
অ। তুমিও রজনীকে বিবাহ করিতে চাও নাকি?
আমি। প্রায়। আমি নিজে তাহাকে বিবাহ না করি, তাহার ভাল বিবাহ দিতে চাই। তোমার সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতে দিব না।
অ। আমি সুপাত্র। রজনীর এরূপ আর জুটিতেছে না।
আমি। তুমি কুপাত্র। আমি সুপাত্র জুটাইয়া দিব।
অম। আমি কুপাত্র কিসে?
আমি। কামিজটা খুলিয়া পিঠ বাহির কর দেখি?
অমরনাথের মুখ শুকাইয়া কালো হইয়া গেল। অতি দু:খিতভাবে বলিল, “ছি! লবঙ্গ!”
আমার দু:খ হইল, কিন্তু দু:খ দেখিয়া ভুলিলাম না। বলিলাম, “একটি গল্প বলিব শুনিবে?”
আমি কথা চাপা দিতেছি মনে করিয়া অমরনাথ বলিল, “শুনিব |”
আমি তখন বলিতে লাগিলাম, “প্রথম যৌবনকালে লোকে আমাকে রূপবতী বলিত___”
অ। এটা যদি গল্প, তবে সত্য কোন্ কথা?
আমি। পরে শোন। সেই রূপ দেখিয়া এক চোর মুগ্ধ হইয়া, আমার পিত্রালয়ে, যে ঘরে আমি এক পরিচারিকা সঙ্গে শয়ন করিয়াছিলাম, সেই ঘরে সিঁধ দিল।
এই কথা বলিতে আরম্ভ করায়, অমরনাথ গলদ্ঘর্ম হইয়া উঠিল। বলিল, “ক্ষমা কর |”
আমি বলিতে লাগিলাম, “সেই চোর সিঁধপথে আমার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। ঘরে আলো জ্বলিতেছিল-আমি চোরকে চিনিলাম। ভীতা হইয়া পরিচারিকাকে উঠাইলাম। সে চোরকে চিনিত না। আমি তখন অগত্যা, চোরকে আদর করিয়া আশ্বস্ত করিয়া পালঙ্কে বসাইলাম |”
অ। ক্ষমা কর, সে ত সকলই জানি।
আমি। তবু একবার স্মরণ করিয়া দেওয়া ভাল। ক্ষণেক পরে, চোরের অলক্ষ্যে আমার সঙ্কেতানুসারে পরিচারিকা বাহিরে গিয়া দ্বারবানকে ডাকিয়া লইয়া সিঁধমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। আমিও সময় বুঝিয়া, বাহিরে প্রয়োজন ছলনা করিয়া নির্গত হইয়া, বাহির হইতে একমাত্র দ্বারের শৃঙ্খল বদ্ধ করিলাম। মন্দ করিয়াছিলাম?
অমরনাথ বলিল, “এ সকল কথা কেন?”
আমি। পরে চোর নির্গত হইল কি প্রকারে বল দেখি? ডাকিয়া পাড়ার লোক জমা করিলাম। বড় বড় বলবান আসিয়া চোরকে ধরিল। চোর লজ্জায় মুখে কাপড় দিয়া রহিল। আমি দয়া করিয়া তাহার মুখের কাপড় খুলাইলাম না, কিন্তু স্বহস্তে লোহার শলা তপ্ত করিয়া তাহার পিঠে লিখিয়াছিলাম,
“চোর!”
অমরবাবু, অতি গ্রীষ্মেও কি আপনি গায়ের জামা খুলিয়া শয়ন করেন না?
অ। না।
আমি। লবঙ্গলতার হস্তাক্ষর মুছিবার নহে। আমি রজনীকে ডাকিয়া গল্প শুনাইয়া যাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শুনাইব না। তুমি রজনীর যোগ্য নহ, রজনীকে বিবাহ করিতে চেষ্টা পাইও না। যদি ক্ষান্ত না হও, তবে সুতরাং শুনাইতে বাধ্য হইব।
অমরনাথ কিছুক্ষণ ভাবিল। পরে দু:খিতভাবে বলিল, “শুনাইতে হয় শুনাইও। তুমি শুনাও বা না শুনাও, আমি স্বয়ং আজি তাহাকে সকল শুনাইব। আমার দোষ-গুণ সকল শুনিয়া রজনী আমাকে গ্রহণ করিতে হয়, গ্রহণ করিবে ; না করিতে হয়, না করিবে। আমি তাহাকে প্রবঞ্চনা করিব না |”
আমি হারিয়া, মনে মনে অমরনাথকে শত শত ধন্যবাদ করিতে করিতে, হর্ষবিষাদে ঘরে ফিরিয়া আসিলাম।