- বইয়ের নামঃ রজনী
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
রজনী – ১
রজনী
প্রথম খণ্ড
রজনীর কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ
তোমাদের সুখদু:খে আমার সুখদু:খ পরিমিত হইতে পারে না। তোমরা আর আমি ভিন্নপ্রকৃতি। আমার সুখে তোমরা সুখী হইতে পারিবে না-আমার দু:খ তোমরা বুঝিবে না-আমি একটি ক্ষুদ্র যূথিকার গন্ধে সুখী হইব; আর ষোলকলা শশী আমার লোচনাগ্রে সহস্র নক্ষত্রমণ্ডলমধ্যস্থ হইয়া বিকসিত হইলেও আমি সুখী হইব না-আমার উপাখ্যান কি তোমরা মন দিয়া শুনিবে? আমি জন্মান্ধ।
কি প্রকারে বুঝিবে? তোমাদের জীবন দৃষ্টিময়-আমার জীবন অন্ধকার-দু:খ এই, আমি ইহা অন্ধকার বলিয়া জানি না। আমার এ রুদ্ধ নয়নে, তাই আলো! না জানি তোমাদের আলো কেমন!
তাই বলিয়া কি আমার সুখ নাই? তাহা নহে। সুখ দু:খ তোমার আমার প্রায় সমান। তুমি রূপ দেখিয়া সুখী, আমি শব্দ শুনিয়াই সুখী। দেখ, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যূথিকাসকলের বৃন্তগুলি কত সূক্ষ্ম, আর আমার এই করস্থ সূচিকাগ্রভাগ আরও কত সূক্ষ্ম! আমি এই সূচিকাগ্রে সেই ক্ষুদ্র পুষ্পবৃন্তসকল বিদ্ধ করিয়া মালা গাঁথি-আশৈশব মালাই গাঁথিয়াছি-কেহ কখন আমার গাঁথা মালা পরিয়া বলে নাই যে, কাণায় মালা গাঁথিয়াছে।
আমি মালাই গাঁথিলাম। বালিগঞ্জের প্রান্তভাগে আমার পিতার একখানি পুষ্পোদ্যান জমা ছিল-তাহাই তাঁহার উপজীবিকা ছিল। ফাল্গুন মাস হইতে যত দিন ফুল ফুটিত, তত দিন পর্যন্ত পিতা প্রত্যহ তথা হইতে পুষ্পচয়ন করিয়া আনিয়া দিতেন, আমি মালা গাঁথিয়া দিতাম। পিতা তাহা লইয়া মহানগরীর পথে পথে বিক্রয় করিতেন। মাতা গৃহকর্ম করিতেন। অবকাশমতে পিতামাতা উভয়েই আমার মালা গাঁথার সহায়তা করিতেন।
ফুলের স্পর্শ বড় সুন্দর-পরিতে বুঝি বড় সুন্দর হইবে-ঘ্রাণে পরম সুন্দর বটে। কিন্তু ফুল গাঁথিয়া দিন চলে না। অন্নের বৃক্ষের ফুল নাই। সুতরাং পিতা নিতান্ত দরিদ্র ছিলেন। মৃজাপুরে একখানি সামান্য খাপরেলের ঘরে বাস করিতেন। তাহারই এক প্রান্তে, ফুল বিছাইয়া, ফুল স্তূপাকৃত করিয়া, ফুল ছড়াইয়া, আমি ফুল গাঁথিতাম। পিতা বাহির হইয়া গেলে গান গাইতাম-
আমার এত সাধের প্রভাতে সই, ফুটলো নাকো কলি-
ও হরি-এখনও আমার বলা হয় নাই, আমি পুরুষ, কি মেয়ে! তবে, এতক্ষণে যিনি না বুঝিয়াছেন, তাঁহাকে না বলাই ভাল। আমি এখন বলিব না।
পুরুষই হই, মেয়েই হই, অন্ধের বিবাহের বড় গোল। কাণা বলিয়া আমার বিবাহ হইল না। সেটা দুর্ভাগ্য, কি সৌভাগ্য, যে চোখের মাথা না খাইয়াছে, সেই বুঝিবে। অনেক অপাঙ্গরঙ্গরঙ্গিণী, আমার চিরকৌমার্যের কথা শুনিয়া বলিয়া গিয়াছে, “আহা আমিও যদি কাণা হইতাম!”
বিবাহ না হউক-তাতে আমার দু:খ ছিল না। আমি স্বয়ম্বরা হইয়াছিলাম। একদিন পিতার কাছে কলিকাতার বর্ণনা শুনিতেছিলাম। শুনিলাম, মনুমেণ্ট বড় ভারি ব্যাপার। অতি উঁচু, অটল, ঝড়ে ভাঙ্গে না, গলায় চেন-একা একাই বাবু। মনে মনে মনুমেণ্টকে বিবাহ করিলাম। আমার স্বামীর চেয়ে বড় কে? আমি মনুমেণ্টমহিষী।
কেবল একটা বিবাহ নহে। যখন মনুমেণ্টকে বিবাহ করি, তখন আমার বয়স পনের বৎসর। সতের বৎসর বয়সে, বলিতে লজ্জা করে, সধবাবস্থাতেই-আর একটা বিবাহ ঘটিয়া গেল। আমাদের বাড়ীর কাছে, কালীচরণ বসু নামে একজন কায়স্থ ছিল। চীনাবাজারে তাহার একখানি খেলানার দোকান ছিল। সে কায়স্থ-আমরাও কায়স্থ-এজন্য একটু আত্মীয়তা হইয়াছিল। কালী বসুর একটি চারি বৎসরের শিশুপুত্র ছিল। তাহার নাম বামাচরণ। বামাচরণ সর্বদা আমাদের বাড়ীতে আসিত। একদিন একটা বর বাজনা বাজাইয়া মন্দগামী ঝড়ের মত আমাদিগের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া যায়। দেখিয়া বামাচরণ জিজ্ঞাসা করিল,- “ও কেও?”
আমি বলিলাম, “ও বর |” বামাচরণ তখন কান্না আরম্ভ করিল-“আমি বল হব |”
তাহাকে কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া বলিলাম, “কাঁদিস না-তুই আমার বর |” এই বলিয়া একটা সন্দেশ তাহার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন, তুই আমার বর হবি?” শিশু সন্দেশ হাতে পাইয়া, রোদন সম্বরণ করিয়া বলিল, “হব |”
সন্দেশ সমাপ্ত হইলে, বালক ক্ষণেককাল পরে বলিল, “হাঁ গা, বলে কি কলে গা?” বোধ হয়, তাহার ধ্রুব বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, বরে বুঝি কেবল সন্দেশই খায়। যদি তা হয়, তবে সে আর একটা আরম্ভ করিতে প্রস্তুত। ভাব বুঝিয়া আমি বলিলাম, “বরে ফুলগুলি গুছিয়ে দেয় |” বামাচরণ স্বামীর কর্তব্যাকর্তব্য বুঝিয়া লইয়া, ফুলগুলি আমার হাতে গুছাইয়া তুলিয়া দিতে লাগিল। সেই অবধি আমি তাহাকে বর বলি-সে আমাকে ফুল গুছাইয়া দেয়।
আমার এই দুই বিবাহ-এখন এ কালের জটিলা-কুটিলাদিগকে আমার জিজ্ঞাস্য-আমি সতী বলাইতে পারি কি?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বড়বাড়ীতে ফুল যোগান বড় দায়। সে কালের মালিনী মাসী রাজবাটীতে ফুল যোগাইয়া মশানে গিয়াছিল। ফুলের মধু খেলে বিদ্যাসুন্দর, কিল খেলে হীরা মালিনী-কেন না, সে বড়বাড়ীতে ফুল যোগাইত। সুন্দরের সেই রামরাজ্য হইল-কিন্তু মালিনীর কিল আর ফিরিল না।
বাবা ত “বেলফুল” হাঁকিয়া, রসিক মহলে ফুল বেচিতেন, মা দুই একটা অরসিক মহলে ফুল নিত্য যোগাইতেন। তাহার মধ্যে রামসদয় মিত্রের বাড়ীই প্রধান। রামসদয় মিত্রের সাড়ে চারিটা ঘোড়া ছিল।-(নাতিদের একটা পণি, আর আদত চারিটা) সাড়ে চারিটা ঘোড়া-আর দেড়খানা গৃহিণী। একজন আদত-একজন চিররুগ্না এবং প্রাচীনা। তাঁহার নাম ভুবনেশ্বরী-কিন্তু তাঁর গলার সাঁই সাঁই শব্দ শুনিয়া রামমণি ভিন্ন অন্য নাম আমার মনে আসিত না।
আর যিনি পুরা একখানি গৃহিণী, তাঁহার নাম লবঙ্গলতা। লবঙ্গলতা লোকে বলিত, কিন্তু তাঁহার পিতা নাম রাখিয়াছিলেন ললিতলবঙ্গলতা, এবং রামসদয় বাবু আদর করিয়া বলিতেন-ললিত-লবঙ্গলতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে। রামসদয় বাবু প্রাচীন, বয়:ক্রম ৬৩ বৎসর। ললিতলবঙ্গলতা নবীনা, বয়স ১৯ বৎসর, দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-আদরের আদরিণী, গৌরবের গৌরবিণী, মানের মানিনী, নয়নের মণি, ষোলআনা গৃহিণী। তিনি রামসদয়ের সিন্দুকের চাবি, বিছানার চাদর, পানের চূণ, গেলাসের জল। তিনি রামসদয়ের জ্বরে কুইনাইন, কাসিতে ইপিকা, বাতে ফ্লানেল এবং আরোগ্যে সুরুয়া।
নয়ন নাই-ললিত-লবঙ্গ-লতাকে কখন দেখিতে পাইলাম না-কিন্তু শুনিয়াছি, তিনি রূপসী। রূপ যাউক, গুণ শুনিয়াছি। লবঙ্গ বাস্তবিক গুণবতী। গৃহকার্যে নিপুণা, দানে মুক্তহস্তা, হৃদয়ে সরলা, কেবল বাক্যে বিষময়ী। লবঙ্গলতার অশেষ গুণের মধ্যে, একটি এই যে, তিনি বাস্তবিক পিতামহের তুল্য সেই স্বামীকে ভালবাসিতেন-কোন নবীনা নবীন স্বামীকে সেরূপ ভালবাসেন কি না সন্দেহ। ভালবাসিতেন বলিয়া, তাঁহাকে নবীন সাজাইতেন-সে সজ্জার রস কাহাকে বলি? আপন হস্তে নিত্য শুভ্র কেশে কলপ মাখাইয়া কেশগুলি রঞ্জিত করিতেন। যদি রামসদয় লজ্জার অনুরোধে কোন দিন মলমলের ধুতি পরিত, স্বহস্তে তাহা ত্যাগ করাইয়া কোকিলপেড়ে, ফিতেপেড়ে, কল্কাপেড়ে পরাইয়া দিতেন-মলমলের ধুতিখানি তৎক্ষণাৎ বিধবা দরিদ্রগণকে বিতরণ করিতেন। রামসদয় প্রাচীন বয়সে, আতরের শিশি দেখিলে ভয়ে পলাইত-লবঙ্গলতা, তাহার নিদ্রিতাবস্থায় সর্বাঙ্গে আতর মাখাইয়া দিতেন। রামসদয়ের চশমাগুলি লবঙ্গ প্রায় চুরি করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিত, সোণাটুকু লইয়া, যাহার কন্যার বিবাহের সম্ভাবনা, তাহাকে দিত। রামসদয়ের নাক ডাকিলে, লবঙ্গ ছয়গাছা মল বাহির করিয়া, পরিয়া ঘরময় ঝমঝম করিয়া, রামসদয়ের নিদ্রা ভাঙ্গিয়া দিত।
লবঙ্গলতা আমাদের ফুল কিনিত-চারি আনার ফুল লইয়া দুই টাকা মূল্য দিত। তাহার কারণ, আমি কাণা। মালা পাইলে, লবঙ্গ গালি দিত, বলিত, এমন কদর্য মালা আমাকে দিস কেন? কিন্তু মূল্য দিবার সময় ডবল পয়সার সঙ্গে ভুল করিয়া টাকা দিত। ফিরাইয়া দিতে গেলে বলিত-ও আমার টাকা নয়-দুই বার বলিতে গেলে গালি দিয়া তাড়াইয়া দিত। তাহার দানের কথা মুখে আনিলে মারিতে আসিত। বাস্তবিক, রামসদয় বাবুর ঘর না থাকিলে, আমাদিগের দিনপাত হইত না; তবে যাহা রয় সয়, তাই ভাল বলিয়া, মাতা, লবঙ্গের কাছে অধিক লইতেন না। দিনপাত হইলেই আমরা সন্তুষ্ট থাকিতাম। লবঙ্গলতা আমাদিগের নিকট রাশি রাশি ফুল কিনিয়া রামসদয়কে সাজাইত। সাজাইয়া বলিত-দেখ, রতিপতি। রামসদয় বলিত-দেখ, সাক্ষাৎ-অঞ্জনানন্দন। সেই প্রাচীনে নবীনে মনের মিল ছিল-দর্পণের মত দুইজনে দুইজনের মন দেখিতে পাইত। তাহাদের প্রেমের পদ্ধতিটা এইরূপ-
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রামসদয় বলিত, “ললিতলবঙ্গলতাপরিশী-?”
ল। আজ্ঞে ঠাকুরদাদামহাশয়, দাসী হাজির।
রা। আমি যদি মরি?
ল। আমি তোমার বিষয় খাইব | লবঙ্গ মনে মনে বলিত,“আমি বিষ খাইব |” রামসদয় তাহা মনে মনে জানিত।
লবঙ্গ এত টাকা দিত, তবে বড়বাড়ীতে ফুল যোগান দু:খ কেন? শুন।
একদিন মার জ্বর। অন্ত:পুরে বাবা যাইতে পারিবেন না-তবে আমি বৈ আর কে লবঙ্গলতাকে ফুল দিতে যাইবে? আমি লবঙ্গের জন্য ফুল লইয়া চলিলাম। অন্ধ হই, যাই হই-কলিকাতার রাস্তা সকল আমার নখদর্পণে ছিল। বেত্রহস্তে সর্বত্র যাইতে পারিতাম, তখন গাড়ি ঘোড়ার সম্মুখে পড়ি নাই। অনেক বার পদচারীর ঘাড়ে পড়িয়াছি বটে-তাহার কারণ, কেহ কেহ অন্ধ যুবতী দেখিয়া সাড়া দেয় না, বরং বলে, “আ মলো! দেখতে পাসনে? কাণা না কি?” আমি ভাবিতাম, “উভয়ত:|”
ফুল লইয়া গিয়া লবঙ্গের কাছে গেলাম। দেখিয়া লবঙ্গ বলিলেন, “কি লো কাণি-আবার ফুল লইয়া মরতে এয়েছিস কেন?” কাণী বলিলে আমার হাড় জ্বলিয়া যাইত-আমি কি কদর্য উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, এমত সময়ে সেখানে হঠাৎ কাহার পদধ্বনি শুনিলাম-কে আসিল। যে আসিল-বলিল, “এ কে ছোট মা?”
ছোট মা! তবে রামসদয়ের পুত্র। রামসদয়ের কোন্ পুত্র! বড় পুত্রের কণ্ঠ একদিন শুনিয়াছিলাম-সে এমন অমৃতময় নহে-এমন করিয়া কর্ণবিবর ভরিয়া, সুখ ঢালিয়া দেয় নাই। বুঝিলাম, এ ছোট বাবু।
ছোট মা বলিলেন, এবার বড় মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “ও কাণা ফুলওয়ালী |”
“ফুলওয়ালী! আমি বলি বা কোন ভদ্রলোকের মেয়ে।”
লবঙ্গ বলিলেন, “কেন গা, ফুলওয়ালী হইলে কি ভদ্রলোকের মেয়ে হয় না?”
ছোট বাবু অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “হবে না কেন? এটি ত ভদ্রলোকের মেয়ের মতই বোধ হইতেছে। তা ওটি কাণা হইল কিসে?”
ল। ও জন্মান্ধ।
ছোট বাবু। দেখি?
ছোট বাবুর বিদ্যার গৌরব ছিল। তিনি অন্যান্য বিদ্যাও যেরূপ যত্নের সহিত শিক্ষা করিয়াছিলেন, অর্থের প্রত্যাশী না হইয়া চিকিৎসাশাস্ত্রেও সেইরূপ যত্ন করিয়াছিলেন। লোকে রাষ্ট্র করিত যে, শচীন্দ্র বাবু (ছোট বাবু) কেবল দরিদ্রগণের বিনামূল্যে চিকিৎসা করিবার জন্য চিকিৎসা শিখিতেছিলেন। “দেখি” বলিয়া আমাকে বলিলেন, “একবার দাঁড়াও ত গা!”
আমি জড়সড় হইয়া দাঁড়াইলাম।
ছোট বাবু বলিলেন, “আমার দিকে চাও |”
চাব কি ছাই!
“আমার দিকে চোখ ফিরাও!”
কাণা চোখে শব্দভেদী বাণ মারিলাম। ছোট বাবুর মনের মত হইল না। তিনি আমার দাড়ি ধরিয়া, মুখ ফিরাইলেন।
ডাক্তারির কপালে আগুন জ্বেলে দিই। সেই চিবুকস্পর্শে আমি মরিলাম!
সেই স্পর্শ পুষ্পময়। সেই স্পর্শে যূথী, জাতি, মল্লিকা, শেফালিকা, কামিনী, গোলাপ, সেঁউতি-সব ফুলের ঘ্রাণ পাইলাম। বোধ হইল, আমার আশেপাশে ফুল, আমায় মাথায় ফুল, পায়ে ফুল, আমার পরনে ফুল, আমার বুকের ভিতর ফুলের রাশি। আ মরি মরি! কোন্ বিধাতা এ কুসুমময় স্পর্শ গড়িয়াছিল! বলিয়াছি ত কাণার সুখদু:খ তোমরা বুঝিবে না। আ মরি মরি-সে নবনীত-সুকুমার-পুষ্পগন্ধময় বীণাধ্বনিবৎ স্পর্শ! বীণাধ্বনিবৎ স্পর্শ, যার চোখ আছে, সে বুঝিবে কি প্রকারে? আমার সুখদু:খ আমাতেই থাকুক। যখন সেই স্পর্শ মনে পড়িত, তখন কত বীণাধ্বনি কর্ণে শুনিতাম, তাহা তুমি, বিলোলকটাক্ষকুশলিনি! কি বুঝিবে?
ছোট বাবু বলিলেন, “না, এ কাণা সারিবার নয় |”
আমার ত সেইজন্য ঘুম হইতেছিল না।
লবঙ্গ বলিল, “তা না সারুক, টাকা খরচ করিলে কাণার কি বিয়ে হয় না?”
ছোট বাবু। কেন, এর কি বিবাহ হয় নাই?
ল। না। টাকা খরচ করিলে হয়?
ছোট বাবু। আপনি কি ইহার বিবাহ জন্য টাকা দিবেন?
লবঙ্গ রাগিল। বলিল, “এমন ছেলেও দেখি নাই! আমার কি টাকা রাখিবার জায়গা নাই? বিয়ে কি হয়, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি। মেয়ে মানুষ, সকল কথা ত জানি না। বিবাহ কি হয়?”
ছোট বাবু ছোট মাকে চিনিতেন। হাসিয়া বলিলেন, “তা মা, তুমি টাকা রেখ, আমি সম্বন্ধ করিব |”
মনে মনে ললিতলবঙ্গলতার মুণ্ডপাত করিতে করিতে আমি সে স্থান হইতে পলাইলাম।
তাই বলিতেছিলাম, বড় মানুষের বাড়ী ফুল যোগান বড় দায়।
বহুমূর্তিময়ি বসুন্ধরে! তুমি দেখিতে কেমন? তুমি যে অসংখ্য, অচিন্তনীয় শক্তি ধর, অনন্ত বৈচিত্র্যবিশিষ্ট জড় পদার্থসকল হৃদয়ে ধারণ কর, সে সব দেখিতে কেমন? যাকে যাকে লোকে সুন্দর বলে, সে সব দেখিতে কেমন? তোমার হৃদয়ে যে অসংখ্য, বহুপ্রকৃতিবিশিষ্ট জন্তুগণ বিচরণ করে, তারা সব দেখিতে কেমন? বল মা, তোমার হৃদয়ের সারভূত, পুরুষজাতি দেখিতে কেমন? দেখাও মা, তাহার মধ্যে, যাহার করস্পর্শে এত সুখ, সে দেখিতে কেমন? দেখা মা, দেখিতে কেমন দেখায়? দেখা কি? দেখা কেমন? দেখিলে কিরূপ সুখ হয়? এক মুহূর্তজন্য এই সুখময় স্পর্শ দেখিতে পাই না? দেখা মা! বাহিরের চক্ষু নিমীলিত থাকে থাকুক মা! আমার হৃদয়ের মধ্যে চক্ষু ফুটাইয়া দে, আমি একবার অন্তরের ভিতর থাকে থাকুক মা! আামর হৃদয়ের মধ্যে চক্ষু ফুটাইয়া দে, আমি একবার অন্তরের ভিতর অন্তর লুকাইয়া, মনের সাধে রূপ দেখে, নারীজন্ম সার্থক করি। সবাই দেখে-আমি দেখিব না কেন? বুঝি কীট-পতঙ্গ অবধি দেখে-আমি কি অপরাধে দেখিতে পাই না? শুধু দেখা-কারও কষ্ট নাই, কারও পাপ নাই, সবাই অবহেলে দেখে-কি দোষে আমি কখনও দেখিব না?
না! না! অদৃষ্টে নাই। হৃদয়মধ্যে খুঁজিলাম। শুধু শব্দ স্পর্শ গন্ধ। আর কিছু পাইলাম না।
আমার অন্তর বিদীর্ণ করিয়া ধ্বনি উঠিতে লাগিল, কে দেখাবি দেখা গো-আমায় রূপ দেখা! বুঝিল না! কেহই অন্ধের দু:খ বুঝিল না।