বিবাহের পর পঞ্চমাষাঢ়ের শুক্লা পঞ্চমী আসিয়া উপস্থিত হইল। হিরণ্ময়ী এ কথা স্মরণ করিয়া সন্ধ্যাকালে বিমনা হইয়া বসিয়াছিলেন। ভাবিতেছিলেন, “গুরুদেবের আজ্ঞানুসারে আমি কালি হইতে অঙ্গুরীয়টি পরিতে পারি। কিন্তু পরিব কি? পরিয়া আমার কি লাভ? হয়ত স্বামী পাইব, কিন্তু স্বামী পাইবার আমার বাসনা নাই। অথবা চিরকালের জন্য কেনই বা পরের মূর্ত্তি মনে আঁকিয়া রাখি? এ দুরন্ত হৃদয়কে শাসিত করাই উচিত। নহিলে ধর্ম্মে পতিত হইতেছি |”
এমন সময়ে অমলা বিস্ময়বিহ্বলা হইয়া আসিয়া কহিল, “কি সর্ব্বনাশ! আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। না জানি কি হইবে!”
হি। কি হইয়াছে?
অ। রাজপুরী হইতে তোমার জন্য শিবিকা লইয়া দাস-দাসী আসিয়াছে। তোমাকে লইয়া যাইবে।
হি। তুমি পাগল হইয়াছ। আমকে রাজবাড়ী হইতে লইতে আসিবে কেন?
এমন সময়ে রাজদূতী আসিয়া প্রণাম করিল এবং কহিল যে, “রাজাধিরাজ পরম ভট্টারক শ্রীমদনদেবের আজ্ঞা যে, হিরণ্ময়ী এই মুহূর্ত্তেই শিবিকারোহণে রাজাবরোধ যাইবেন|”
হিরণ্ময়ী বিস্মিতা হইলেন। কিন্তু অস্বীকার করিতে পারিলেন না। রাজাজ্ঞা অলঙ্ঘ্য। বিশেষ রাজা মদনদেবের অবরোধে যাইতে কোন শঙ্কা নাই। রাজা পরম ধার্ম্মিক এবং জিতেন্দ্রিয় বলিয়া খ্যাত। তাঁহার প্রতাপে কোন রাজপুরুষও কোন স্ত্রীলোকের উপর কোন অত্যাচার করিতে পারে না।
হিরণ্ময়ী অমলাকে বলিলেন, “অমলে, আমি রাজদর্শনে যাইতে সম্মতা। তুমি সঙ্গে চল |”
অমলা স্বীকৃতা হইল।
তৎসমভিব্যাহারে শিবিকারোহণে হিরণ্ময়ী রাজাবরোধমধ্যে প্রবিষ্টা হইলেন। প্রতিহারী রাজাকে নিবেদন করিল যে, শ্রেষ্ঠিকন্যা আসিয়াছে। রাজাজ্ঞা পাইয়া প্রতিহারী একা হিরণ্ময়ীকে রাজসমক্ষে লইয়া আসিল। অমলা বাহিরে রহিল।
» যুগলাঙ্গুরীয় – ০৮
অষ্টম পরিচ্ছেদ
হিরণ্ময়ী রাজাকে দেখিয়া বিস্মিতা হইলেন। রাজা দীর্ঘাকৃতি পুরুষ, কবাটকক্ষ; দীর্ঘহস্ত ; অতি সুগঠিত আকৃতি ; ললাট প্রশস্ত ; বিস্ফারিত, আয়ত চক্ষু ; শান্ত মূর্ত্তি—এরূপ সুন্দর পুরুষ কদাচিৎ স্ত্রীলোকের নয়নপথে পড়ে। রাজাও শ্রেষ্ঠিকন্যাকে দেখিয়া জানিলেন যে, রাজাবরোধেও এরূপ সুন্দরী দুর্লভ।
রাজা কহিলেন, “তুমি হিরণ্ময়ী?”
হিরণ্ময়ী বলিলেন, “আমি আপনার দাসী |”
রাজা কহিলেন, “কেন তোমাকে ডাকাইয়াছি, তাহা শুন। তোমার বিবাহের কথা মনে পড়ে?”
হি। পড়ে।
রাজা। সেই রাত্রে আনন্দস্বামী তোমাকে যে অঙ্গুরীয় দিয়াছিলেন, তাহা তোমার কাছে আছে?
হি। মহারাজ! সে অঙ্গুরীয় আছে। কিন্তু সে সকল অতি গুহ্য বৃত্তান্ত, কি প্রকারে আপনি তাহা অবগত হইলেন?
রাজা তাহার কোন উত্তর না দিয়া কহিলেন, “সে অঙ্গুরীয় কোথায় আছে? আমাকে দেখাও |”
হিরণ্ময়ী বলিলেন, “উহা আমি গৃহে রাখিয়া আসিয়াছি। পঞ্চ বৎসর পরিপূর্ণ হইতে আরও কয়েক দণ্ড বিলম্ব আছে—অতএব তাহা পরিতে আনন্দস্বামীর যে নিষেধ ছিল—তাহা এখনও
আছে |”
রাজা। ভালই—কিন্তু সেই অঙ্গুরীয়ের অনুরূপ দ্বিতীয় যে অঙ্গুরীয় তোমার স্বামীকে আনন্দস্বামী দিয়াছিলেন, তাহা দেখিলে চিনিতে পারিবে?
হি। উভয় অঙ্গুরীয় একই রূপ ; সুতরাং দেখিলে চিনিতে পারিব।
তখন প্রতিহারী রাজাজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া এক সুবর্ণের কৌটা আনিল। রাজা তাহার মধ্য হইতে একটি অঙ্গুরীয় লইয়া বলিলেন, “দেখ, এই অঙ্গুরীয় কাহার?”
হিরণ্ময়ী অঙ্গুরীয় প্রদীপালোকে বিলক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “দেব! এই আমার স্বামীর অঙ্গুরীয় বটে, কিন্তু আপনি ইহা কোথায় পাইলেন?” পরে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “দেব! ইহাতে জানিলাম যে, আমি বিধবা হইয়াছি। স্বজনহীন মৃতের ধন আপনার হস্তগত হইয়াছে। নহিলে তিনি জীবিতাবস্থায় ইহা ত্যাগ করিবার সম্ভাবনা ছিল না |”
রাজা হাসিয়া বলিলেন, “আমার কথায় বিশ্বাস কর, তুমি বিধবা নহ |”
হি। তবে আমার স্বামী আমার অপেক্ষাও দরিদ্র। ধনলোভে ইহা বিক্রয় করিয়াছেন।
রা। তোমার স্বামী ধনী ব্যক্তি।
হি। তবে আপনি বলে ছলে কৌশলে তাঁহার নিকট ইহা অপহরণ করিয়াছেন।
রাজা এই দু:সাহসিক কথা শুনিয়া বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “তোমার বড় সাহস! রাজা মদনদেব চোর, ইহা আর কেহ বলে না |”
হি। নচেৎ আপনি এ অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলেন?
রা। আনন্দস্বামী তোমার বিবাহের রাত্রে ইহা আমার অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিয়াছেন।
হিরণ্ময়ী তখন লজ্জায় অধোমুখী হইয়া কহিলেন, আর্য্যপুত্র! আমার অপরাধ ক্ষমা করুন—আমি চপলা, না জানিয়া কটু কথা বলিয়াছি।
যুগলাঙ্গুরীয় – ০৯
নবম পরিচ্ছেদ
হিরণ্ময়ী রাজমহিষী, ইহা শুনিয়া হিরণ্ময়ী অত্যন্ত বিস্মিতা হইলেন। কিন্তু কিছুমাত্র আহ্লাদিত হইলেন না। বরং বিষণ্ণা হইলেন। ভাবিতে লাগিলেন যে, “আমি এত দিন পুরন্দরকে পাই নাই বটে, কিন্তু পরপত্নীত্বের যন্ত্রণাভোগ করি নাই। এক্ষণ হইতে আমার সে যন্ত্রণা আরম্ভ হইল। আর আমি হৃদয়মধ্যে পুরন্দরের পত্নী—কি প্রকারে অন্যানুরাগিণী হইয়া এই মহাত্মার গৃহ কলঙ্কিত করিব?” হিরণ্ময়ী এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমত সময়ে রাজা বলিলেন, “হিরণ্ময়ি! তুমি আমার মহিষী বটে, কিন্তু তোমাকে গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে আমার কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা আছে। তুমি বিনা মূল্যে পুরন্দরের গৃহে বাস কর কেন?”
হিরণ্ময়ী অধোবদন হইলেন। রাজা পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার দাসী অমলা সর্ব্বদা পুরন্দরের গৃহে যাতায়াত করে কেন?”
হিরণ্ময়ী আরও লজ্জাবনতমুখী হইয়া রহিলেন; ভাবিতেছিলেন, “রাজা মদনদেব কি সর্ব্বজ্ঞ?”
তখন রাজা কহিলেন, “আর একটা গুরুতর কথা আছে। তুমি পরনারী হইয়া পুরন্দরপ্রদত্ত হীরকহার গ্রহণ করিয়াছিলে কেন?”
এবার হিরণ্ময়ী কথা কহিলেন। বলিলেন, “আর্য্যপুত্র, জানিলাম আপনি সর্ব্বজ্ঞ নহেন। হীরকহার আমি ফিরাইয়া দিয়াছি |”
রাজা। তুমি সেই হার আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছ। এই দেখ সেই হার।
এই বলিয়া রাজা কৌটার মধ্য হইতে হার বাহির করিয়া দেখাইলেন। হিরণ্ময়ী হীরকহার চিনিতে পারিয়া বিস্মিতা হইলেন। কহিলেন, “আর্য্যপুত্র, এ হার কি আমি স্বয়ং আসিয়া আপনার কাছে বিক্রয় করিয়াছি?”
রাজা। না, তোমার দাসী বা দূতী অমলা আসিয়া বিক্রয় করিয়াছে। তাহাকে ডাকাইব?
হিরণ্ময়ীর অমর্ষান্বিত বদনমণ্ডলে একটু হাসি দেখা দিল। বলিলেন, “আর্য্যপুত্র! অপরাধ ক্ষমা করুন। অমলাকে ডাকাইতে হইবে না—আমি এ বিক্রয় স্বীকার করিতেছি |”
এবার রাজা বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “স্ত্রীলোকের চরিত্র অভাবনীয় তুমি পরের পত্নী হইয়া পুরন্দরের নিকট কেন এ হার গ্রহণ করিলে?”
হি। প্রণয়োপহার বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি।
রাজা আরও বিস্মিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি? কি প্রকারে প্রণয়োপহার?”
হি। আমি কুলটা। মহারাজ! আমি আপনার গ্রহণের যোগ্যা নহি। আমি প্রণাম করিতেছি, আমাকে বিদায় দিন। আমার সঙ্গে বিবাহ বিস্মৃত হউন।
হিরণ্ময়ী রাজাকে প্রণাম করিয়া গমনোদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে রাজার বিস্ময়বিকাশক মুখকান্তি অকস্মাৎ প্রফুল্ল হইল। তিনি উচ্চৈর্হাস্য করিয়া উঠিলেন। হিরণ্ময়ী ফিরিল।
রাজা কহিলেন, “হিরণ্ময়ি! তুমিই জিতিলে,—আমি হারিলাম। তুমি কুলটা নহ, আম তোমার স্বামী নহি। যাইও না |”
হি। মহারাজ! তবে এ কাণ্ডটা কি, আমাকে বুঝাইয়া বলুন। আমি অতি সামান্যা স্ত্রী- আমার সঙ্গে আপনার তুল্য গম্ভীরপ্রকৃতি রাজাধিরাজের রহস্য সম্ভবে না।
রাজা হাস্যত্যাগ না করিয়া বলিলেন, “আমার ন্যায় রাজারই এরূপ রহস্য সম্ভবে। ছয় বৎসর হইল, তুমি একখানি পত্রার্দ্ধ অলঙ্কারমধ্যে পাইয়াছিলে? তাহা কি আছে?”
হি। মহারাজ! আপনি সর্ব্বজ্ঞই বটে। পত্রার্দ্ধ আমার গৃহে আছে।
রা। তুমি শিবিকারোহণে পুনশ্চ গৃহে গিয়া সেই পত্রার্দ্ধ লইয়া আইস। তুমি আসিলে আমি সকল কথা বলিব।
যুগলাঙ্গুরীয় – ১০
দশম পরিচ্ছেদ