জ্যোতিষী গণনা করিয়া দেখিলা
হিরণ্ময়ী তুল্য সোণার পুত্তলি।
বাহ হইলে ভয়ানক বিপদ।
সর মুখ পরস্পরে।
হইতে পারে।
হিরণ্ময়ী কোন অজ্ঞাত বিপদ আশঙ্কা করিয়া অত্যন্ত ভীতা হইলেন। কাহাকে কিছু না বলিয়া পত্রখণ্ড তুলিয়া রাখিলেন।
যুগলাঙ্গুরীয় – ০৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
দুই বৎসরের পর আরও এক বৎসর গেল। তথাপি পুরন্দরের সিংহল হইতে আসার কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। কিন্তু হিরণ্ময়ীর হৃদয়ে তাঁহার মূর্ত্তি পূর্ব্ববৎ উজ্জ্বল ছিল। তিনি মনে মনে বুঝিলেন যে, পুরন্দরও তাঁহাকে ভুলিতে পারেন নাই–নচেৎ এতদিন ফিরিতেন।
এইরূপে দুই আর একে তিন বৎসর গেলে, অকস্মাৎ এক দিন ধনদাস বলিলেন যে, “চল, সপরিবারে কাশী যাইব। গুরুদেবের নিকট হইতে তাঁহার শিষ্য আসিয়াছেন। গুরুদেব সেইখানে যাইতে অনুমতি করিয়াছেন। তথায় হিরণ্ময়ীর বিবাহ হইবে। সেইখানে তিনি পাত্র স্থির করিয়াছেন |”
ধনদাস, পত্নী ও কন্যাকে লইয়া কাশী যাত্রা করিলেন। উপযুক্ত কালে কাশীতে উপনীত হইলে পর, ধনদাসের গুরু আনন্দস্বামী আসিয়া সাক্ষাৎ করিলেন। এবং বিবাহের দিন স্থির করিয়া যথাশাস্ত্র উদ্যোগ করিতে বলিয়া গেলেন।
বিবাহের দিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল–এক প্রহর রাত্রে লগ্ন, তথাপি গৃহে যাহারা সচরাচর থাকে, তাহারা ভিন্ন আর কেহ নাই। প্রতিবাসীরাও কেহ উপস্থিত নাই। এ পর্য্যন্ত ধনদাস ভিন্ন গৃহস্থ কেহও জানে না যে, কে পাত্র–কোথাকার পাত্র। তবে সকলেই জানিত যে, যেখানে আনন্দস্বামী বিবাহের সম্বন্ধ করিয়াছেন, সেখানে কখন অপাত্র স্থির করেন নাই। তিনি যে কেন পাত্রের পরিচয় ব্যক্ত করিলেন না, তাহা তিনিই জানেন–তাঁহার মনের কথা বুঝিবে কে? একটি গৃহে পুরোহিত সম্প্রদানের উদ্যোগাদি করিয়া একাকী বসিয়া আছেন। বাহিরে ধনদাস একাকী বরের প্রতীক্ষা করিতেছেন। অন্ত:পুরে কন্যাসজ্জা করিয়া হিরণ্ময়ী বসিয়া আছেন–আর কোথাও কেহ নাই। হিরণ্ময়ী মনে মনে ভাবিতেছেন -“এ কি রহস্য! কিন্তু পুরন্দরের সঙ্গে যদি বিবাহ না হইল-তবে যে হয় তাহার সঙ্গে বিবাহ হউক-সে আমার স্বামী হইবে না |”
এমন সময়ে ধনদাস কন্যাকে ডাকিতে আসিলেন। কিন্তু তাঁহাকে সম্প্রদানের স্থানে লইয়া যাইবার পূর্ব্বে, বস্ত্রের দ্বারা তাঁহার দুই চক্ষু: দৃঢ়তর বাঁধিলেন। হিরণ্ময়ী কহিলেন, “এ কি পিতা?” ধনদাস কহিলেন, “গুরুদেবের আজ্ঞা। তুমিও আমার আজ্ঞামত কার্য্য কর। মন্ত্রগুলি মনে মনে বলিও |” শুনিয়া হিরণ্ময়ী কোন কথা কহিলেন না। ধনদাস দৃষ্টিহীনা কন্যার হস্ত ধরিয়া সম্প্রদানের স্থানে লইয়া গেলেন।
হিরণ্ময়ী তথায় উপনীত হইয়া যদি কিছু দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে দেখিতেন যে, পাত্রও তাঁহার ন্যায় আবৃতনয়ন। এইরূপে বিবাহ হইল। সেই স্থানে গুরু পুরোহিত এবং কন্যাকর্ত্তা ভিন্ন আর কেহ ছিল না। বর-কন্যা কেহ কাহাকে দেখিলেন না। শুভদৃষ্টি হইল না।
সম্প্রদানাস্তে আনন্দস্বামী বর-কন্যাকে কহিলেন যে, “তোমাদিগের বিবাহ হইল, কিন্তু তোমরা পরস্পরকে দেখিলে না। কন্যার কুমারী নাম ঘুচানই এই বিবাহের উদ্দেশ্য ; ইহজন্মে কখন তোমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হইবে কি না, বলিতে পারি না। যদি হয়, তবে কেহ কাহাকে চিনিতে পারিবে না। চিনিবার আমি একটি উপায় করিয়া দিতেছি। আমার হাতের দুইটি অঙ্গুরীয় আছে। দুইটি ঠিক এক প্রকার। অঙ্গুরীয় যে প্রস্তরে নির্ম্মিত, তাহা প্রায় পাওয়া যায় না। এবং অঙ্গুরীয়ের ভিতরের পৃষ্ঠে একটি ময়ূর অঙ্কিত আছে। ইহার একটি বরকে, একটি কন্যাকে দিলাম। এরূপ অঙ্গুরীয় অন্য কেহ পাইবে না-বিশেষ এই ময়ূরের চিত্র অননুকরণীয়। ইহা আমার স্বহস্তখোদিত। যদি কন্যা কোন পুরুষের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, সেই পুরুষ তাঁহার স্বামী। যদি বর কখন কোন স্ত্রীলোকের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, তিনিই তাঁহার পত্নী। তোমরা কেহ এ অঙ্গুরীয় হারাইও না, বা কাহাকে দিও না, অন্নাভাব হইলেও বিক্রয় করিও না। কিন্তু ইহাও আজ্ঞা করিতেছি যে, অদ্য হইতে পঞ্চ বৎসর মধ্যে কদাচ এই অঙ্গুরীয় পরিও না। অদ্য আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমী, রাত্রি একাদশ দণ্ড হইয়াছে, ইহার পর পঞ্চম আষাঢ়ের শুক্লা পঞ্চমীর একাদশ দণ্ড রাত্রি পর্য্যন্ত অঙ্গুরীয় ব্যবহার নিষেধ করিলাম। আমার নিষেধ অবহেলা করিলে গুরুতর অমঙ্গল হইবে |”
এই বলিয়া আনন্দস্বামী বিদায় হইলেন। ধনদাস কন্যার চক্ষুর বন্ধন মোচন করিলেন। হিরণ্ময়ী চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন, গৃহমধ্যে কেবল পিতা ও পুরোহিত আছেন-তাঁহার স্বামী নাই। তাঁহার বিবাহরাত্রি একাই যাপন করিলেন।
যুগলাঙ্গুরীয় – ০৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বিবাহান্তে ধনদাস স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেন। আরও চারি বৎসর অতিবাহিত হইল। পুরন্দর ফিরিয়া আসিলেন না—হিরণ্ময়ীর পক্ষে এখন ফিরিলেই কি, না ফিরিলেই কি?
পুরন্দর যে এই সাত বৎসরে ফিরিল না, ইহা ভাবিয়া হিরণ্ময়ী দু:খিতা হইলেন। মনে ভাবিলেন, “তিনি যে আজিও আমায় ভুলিতে পারেন নাই বলিয়া আসিলেন না, এমত কদাচ সম্ভবে না। তিনি জীবিত আছেন কি না সংশয়। তাঁহার দেখার আমি কামনা করি না, এখন আমি অন্যের স্ত্রী ; কিন্তু আমার বাল্যকালের সুহৃৎ বাঁচিয়া থাকুন, এ কামনা কেন না করিব?”
ধনদাসেরও কোন কারণে না কোন কারণে চিন্তিত ভাব প্রকাশ হইতে লাগিল, ক্রমে চিন্তা গুরুতর হইয়া শেষে দারুণ রোগে পরিণত হইল। তাহাতে তাঁহার মৃত্যু হইল। ধনদাসের পত্নী অনুমৃতা হইলেন। হিরণ্ময়ীর আর কেহ ছিল না, এজন্য হিরণ্ময়ী মাতার চরণ ধারণ করিয়া অনেক রোদন করিয়া কহিলেন যে, তুমি মরিও না। কিন্তু শ্রেষ্ঠিপত্নী শুনিলেন না। তখন হিরণ্ময়ী পৃথিবীতে একাকিনী হইলেন।
মৃত্যুকালে হিরণ্ময়ীর মাতা তাঁহাকে বুঝাইয়াছিলেন যে, “বাছা, তোমার কিসের ভাবনা? তোমার একজন স্বামী অবশ্য আছেন। নিয়মিত কাল অতীত হইলে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেও হইতে পারে। না হয়, তুমিও নিতান্ত বালিকা নহে। বিশেষ পৃথিবীতে যে সহায় প্রধান—ধন–তাহা তোমার অতুল পরিমাণে রহিল |”
কিন্তু সে আশা বিফল হইল–ধনদাসের মৃত্যুর পর দেখা গেল যে, তিনি কিছুই রাখিয়া যান নাই। অলঙ্কার অট্টালিকা এবং গার্হস্থ্য মমমম ভিন্ন আর কিছুই নাই। অনুসন্ধানে হিরণ্ময়ী জানিলেন যে, ধনদাস কয়েক বৎসর হইতে বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া আসিতেছিলেন। তিনি তাহা কাহাকেও না বলিয়া শোধনের চেষ্টায় ছিলেন। ইহাই তাঁহার চিন্তার কারণ। শেষে শোধনও অসাধ্য হইল। ধনদাস মনের ক্লেশে পীড়িত হইয়া পরলোকপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
এই সকল সংবাদ শুনিয়া অপরাপর শ্রেষ্ঠীরা আসিয়া হিরণ্ময়ীকে কহিল যে, তোমার পিতা আমাদের ঋণগ্রস্ত হইয়া মরিয়াছেন। আমাদিগের ঋণ পরিশোধ কর। শ্রেষ্ঠিকন্যা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, তাহাদের কথা যথার্থ। তখন হিরণ্ময়ী সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া তাহাদের ঋণ পরিশোধ করিলেন। বাসগৃহ পর্য্যন্ত বিক্রয় করিলেন।
এখন হিরণ্ময়ী অন্নবস্ত্রের দু:খে দু:খিনী হইয়া নগরপ্রান্তে এক কুটীরমধ্যে একা বাস করিতে লাগিলেন। কেবল মাত্র এক সহায় পরম হিতৈষী আনন্দস্বামী, কিন্তু তিনি তখন দূরদেশে ছিলেন। হিরণ্ময়ীর এমন একটি লোক ছিল না যে, আনন্দস্বামীর নিকট প্রেরণ করেন।
যুগলাঙ্গুরীয় – ০৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ