ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ : কাহার আপত্তি
কমলমণি পত্র পড়িয়া বলিলেন, “কোন্ কারণে নিন্দনীয়? জগদীশ্বর জানেন। কিন্তু কি ভ্রম! পুরুষে বুঝি কিছুই বুঝে না। যা হৌক, মন্ত্রিবর আপনি সজ্জা করুন। আমাদিগের গোবিন্দপুরে যাইতে হইবে |”
শ্রী। তুমি কি বিবাহ বন্ধ করিতে পারিবে?
ক। না পারি, দাদার সম্মুখে মরিব।
শ্রী। তা পারিবে না। তবে নূতন ভাইজের নাক কাটিয়া আনিতে পারিবে। চল, সেই উদ্দেশ্যে যাই।
তখন উভয়ে গোবিন্দপুর যাত্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। পরদিন প্রাতে তাঁহারা নৌকারোহণে গোবিন্দপুর যাত্রা করিলেন। যথাকালে তথায় উপস্থিত হইলেন।
বাটীতে প্রবেশ করিবার পূর্বেই দাসীদিগের এবং পল্লীস্থ স্ত্রীলোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইল, অনেকেই কমলমণিকে নৌকা হইতে লইতে আসিল। বিবাহ হইয়া গিয়াছে কি না, জানিবার জন্য তাঁহার ও স্বামীর নিতান্ত ব্যগ্রতা জন্মিয়াছিল, কিন্তু দুই জনের কেহই এ কথা কাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না–এ লজ্জার কথা কি প্রকারে অপর লোককে মুখ ফুটিয়া জিজ্ঞাসা করেন?
অতি ব্যস্তে কমলমণি অন্ত:পুরে প্রবেশ করিলেন। এবার সতীশ যে পশ্চাতে পড়িয়া রহিল, তাহা ভুলিয়া গেলেন। বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, স্পষ্ট স্বরে, সাহসশূন্য হইয়া দাসীদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, “সূর্যমুখী কোথায়?” মনে ভয়, পাছে কেহ বলিয়া ফেলে যে, বিবাহ হইয়া গিয়াছে–পাছে কেহ বলিয়া ফেলে সূর্যমুখী মরিয়াছে।
দাসীরা বলিয়া দিল, সূর্যমুখী শয়নগৃহে আছেন। কমলমণি ছুটিয়া শয়নগৃহে গেলেন।
প্রবেশ করিয়া প্রথমে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। মুহূর্তকাল ইতস্তত: নিরীক্ষণ করিলেন। শেষে দেখিতে পাইলেন, ঘরের কোণে, এক রুদ্ধ গবাক্ষসন্নিধানে, অধোবদনে একটি স্ত্রীলোক বসিয়া আছে। কমলমণি তাহার মুখ দেখিতে পাইলেন না; কিন্তু চিনিলেন যে সূর্যমুখী। পরে সূর্যমুখী তাহার পদধ্বনি পাইয়া উঠিয়া কাছে আসিলেন। সূর্যমুখীকে দেখিয়া কমলমণি, বিবাহ হইয়াছে কি না, ইহা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না–সূর্যমুখীর কাঁধের হাড় উঠিয়া পড়িয়াছে–নবদেবদারুতুল্য সূর্যমুখীর দেহতরু ধনুকের মত ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, সূর্যমুখীর প্রফুল্ল পদ্মপলাশ চক্ষু কোটরে পড়িয়াছে–সূর্যমুখীর পদ্মমুখ দীর্ঘাকৃত হইয়াছে। কমলমণি বুঝিলেন যে, বিবাহ হইয়া গিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কবে হলো?” সূর্যমুখী সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিলেন, “কাল |”
তখন দুই জনে সেইখানে বসিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিলেন–কেহ কিছু বলিলেন না। সূর্যমুখী কমলের কোলে মাথা লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন–কমলমণির চক্ষের জল তাঁহার বক্ষে ও কেশের উপর পড়িতে লাগিল।
তখন নগেন্দ্র বৈঠকখানায় বসিয়া কি ভাবিতেছিলেন? ভাবিতেছিলেন, “কুন্দনন্দিনী! কুন্দ আমার! কুন্দ আমার স্ত্রী! কুন্দ! কুন্দ! কুন্দ! সে আমার!” কাছে শ্রীশচন্দ্র আসিয়া বসিয়াছিলেন–ভাল করিয়া তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে পারিতেছিলেন না। এক একবার মনে পড়িতেছিল, “সূর্যমুখী উদ্যোগী হইয়া বিবাহ দিয়াছে–তবে আমার এ সুখে আর কাহার আপত্তি!”
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : সূর্যমুখী ও কমলমণি
যখন প্রদোষে, উভয়ে উভয়ের নিকট স্পষ্ট করিয়া কথা কহিতে সমর্থ হইলেন, তখন সূর্যমুখী কমলমণির কাছে নগেন্দ্র ও কুন্দনন্দিনীর বিবাহবৃত্তান্তের আমূল পরিচয় দিলেন। শুনিয়া কমলমণি বিস্মিতা হইয়া বলিলেন, “এ বিবাহ তোমার যত্নেই হইয়াছে–কেন তুমি আপনার মৃত্যুর উদ্যোগ আপনি করিলে?”
সূর্যমুখী হাসিয়া বলিলেন, “আমি কে?”–মৃদু ক্ষীণ হাসিয়া হাসিয়া উত্তর করিলেন,- বৃষ্টির পর আকাশপ্রান্ত ছিন্ন মেঘে যেমন বিদ্যুৎ হয়, সেইরূপ হাসি হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমি কে? একবার তোমার ভাইকে দেখিয়া আইস–সে মুখভরা আহ্লাদ দেখিয়া আইস;-তখন জানিবে, তিনি আজ কত সুখে সুখী। তাঁহার এত সুখ আমি চক্ষে দেখিলাম, তবে কি আমার জীবন সার্থক হইল না? কোন্ সুখের আশায় তাঁকে অসুখী রাখিব? যাঁহার এক দণ্ডের অসুখ দেখিলে মরিতে ইচ্ছা করে, দেখিলাম, দিবারাত্র তাঁর মর্মান্তিক অসুখ–তিনি সকল সুখ বিসর্জন দিয়া দেশত্যাগী হইবার উদ্যোগ করিলেন–তবে আমার সুখ কি রহিল? বলিলাম, “প্রভু! তোমার সুখই আমার সুখ–তুমি কুন্দকে বিবাহ কর–আমি সুখী হইব’,-তাই বিবাহ করিয়াছেন |”
ক। আর, তুমি সুখী হইয়াছ?
সূ। আবার আমার কথা কেন জিজ্ঞাসা কর, আমি কে? যদি কখনও স্বামীর পায়ে কাঁকর ফুটিয়াছে দেখিয়াছি, তখনই মনে হইয়াছে যে, আমি ঐখানে বুক পাতিয়া দিই নাই কেন, স্বামী আমার বুকের উপর পা রাখিয়া যাইতেন।
বলিয়া সূর্যমুখী ক্ষণকাল নীরবে রহিলেন–তাঁহার চক্ষের জলে বসন ভিজিয়া গেল–পরে সহসা মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কমল, কোন্ দেশে মেয়ে হলে মেরে ফেলে?”
কমল মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “মেয়ে হলেই কি হয়? যার যেমন কপাল, তার তেমনি ঘটে |”
সূ। আমার কপালের চেয়ে কার কপাল ভাল? কে এমন ভাগ্যবতী? কে এমন স্বামী পেয়েছে? রূপ, ঐশ্বর্য, সম্পদ–সে সকলও তুচ্ছ কথা–এত গুণ কার স্বামীর? আমার কপাল, জোর কপাল–তবে কেন এমন হইল?
ক। এও কপাল।
সূ। তবে এ জ্বালায় মন পোড়ে কেন?
ক। তুমি স্বামীর আজিকার আহ্লাদপূর্ণ মুখ দেখিয়া সুখী–তথাপি বলিতেছ, এ জ্বালায় মন পোড়ে কেন? দুই কথাই কি সত্য?
সূ। দুই কথাই সত্য। আমি তাঁর সুখে সুখী–কিন্তু আমায় যে তিনি পায়ে ঠেলিলেন, আমার পায়ে ঠেলিয়াছেন বলিয়াই তাঁর এত আহ্লাদ!–
সূর্যমুখী আর বলিতে পারিলেন না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইল–চক্ষু ভাসিয়া গেল, কিন্তু সূর্যমুখীর অসমাপ্ত কথার মর্ম কমলমণি সম্পূর্ণ বুঝিয়াছিলেন। বলিলেন, “তোমায় পায়ে ঠেলেছেন বলে তোমার অন্তর্দাহ হতেছে। তবে কেন বল আমি কে? তোমার অন্ত:করণের আধখানা আজও আমিতে ভরা; নহিলে আত্মবিসর্জন করিয়াও অনুতাপ করিবে কেন?”
সূ। অনুতাপ করি না। ভালই করিয়াছি, ইহাতে আমার কোন কোন সংশয় নাই। কিন্তু মরণে ত যন্ত্রণা আছেই। আমার মরণই ভাল বলিয়া, আপনার হাতে আপনি মরিলাম। কিন্তু তাই বলিয়া মরণের সময়ে কি তোমার কাছে কাঁদিব না?
সূর্যমুখী কাঁদিলেন। কমল তাঁহার মাথা আপন হৃদয়ে আনিয়া হাত দিয়া ধরিয়া রাখিলেন। কথায় সকল কথা ব্যক্ত হইতেছিল না–কিন্তু অন্তরে অন্তরে কথোপকথন হইতেছিল। অন্তরে অন্তরে কমলমণি বুঝিতেছিলেন যে, সূর্যমুখী কত দু:খী। অন্তরে অন্তরে সূর্যমুখী বুঝিয়াছিলেন যে, কমলমণি তাঁহার দু:খ বুঝিতেছেন।
উভয়ে রোদন সম্বরণ করিয়া চক্ষু মুছিলেন। সূর্যমুখী তখন আপনার কথা ত্যাগ করিয়া, অন্যান্য কথা পাড়িলেন। সতীশচন্দ্রকে আনাইয়া আদর করিলেন, এবং তাহার সঙ্গে কথোপকথন করিলেন। কমলের সঙ্গে, অনেকক্ষণ পর্যন্ত সতীশ শ্রীশচন্দ্রের কথা কহিলেন। সতীশচন্দ্রের বিদ্যাশিক্ষা, বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক সুখের কথার আলোচনা হইল। এইরূপ গভীর রাত্রি পর্যন্ত উভয়ে কথোপকথন করিয়া সূর্যমুখী কমলকে স্নেহভরে আলিঙ্গন করিলেন এবং সতীশচন্দ্রকে ক্রোড়ে লইয়া মুখচুম্বন করিলেন। উভয়কে বিদায় দিবার কালে সূর্যমুখীর চক্ষের জল আবার অসম্বরণীয় হইল। রোদন করিতে করিতে তিনি সতীশকে আশীর্বাদ করিলেন, “বাবা! আশীর্বাদ করি, যেন তোমার মামার মত অক্ষয় গুণে গুণবান হও। ইহার বাড়া আশীর্বাদ আমি আর জানি না |”
সূর্যমুখী স্বাভাবিক মৃদুস্বরে কথা কহিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার কণ্ঠস্বরের ভঙ্গীতে কমলমণি চমকিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বউ! তোমার মনে কি হইতেছে–কি? বল না?”
সূ। কিছু না।
ক। আমার কাছে লুকাইও না।
সূ। তোমার কাছে লুকাইবার আমার কোন কথাই নাই।
কমল তখন স্বচ্ছন্দচিত্তে শয়নমন্দিরে গেলেন। কিন্তু সূর্যমুখীর একটি লুকাইবার কথা ছিল। তাহা কমল প্রাতে জানিতে পারিলেন। প্রাতে সূর্যমুখীর সন্ধানে তাঁহার শয্যাগৃহে গিয়া দেখিলেন, সূর্যমুখী তথায় নাই। কিন্তু অভুক্ত শয্যার উপরে একখানি পত্র পড়িয়া আছে। পত্র দেখিয়াই কমলমণির মাথা ঘুরিয়া গেল–পত্র পড়িতে হইল না–না পড়িয়াই সকল বুঝিলেন। বুঝিলেন, সূর্যমুখী পলায়ন করিয়াছেন। পত্র খুলিয়া পড়িতে ইচ্ছা হইল না–তাহা করতলে বিমর্দিত করিলেন। কপালে করাঘাত করিয়া শয্যায় বসিয়া পড়িলেন। বলিলেন, “আমি পাগল। নচেৎ কাল ঘরে যাইবার সময়ে বুঝিয়াও বুঝিলাম না কেন?” সতীশ নিকটে দাঁড়াইয়াছিল; মার কপালে করাঘাত ও রোদন দেখিয়া সেও কাঁদিতে লাগিল।