- বইয়ের নামঃ চৌধুরাণী
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
দেবী চৌধুরাণী – ১ম খণ্ড – ০১-০৫
প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ
“ও পি–ও পিপি–ও প্রফুল্ল–ও পোড়ারমুখী ।”
“যাই মা ।”
মা ডাকিল–মেয়ে কাছে আসিল। বলিল, “কেন মা?”
মা বলিল, “যা না–ঘোষেদের বাড়ী থেকে একটা বেগুন চেয়ে নিয়ে আয় না ।”
প্রফুল্লমুখী বলিল, “আমি পারিব না। আমার চাইতে লজ্জা করে ।”
মা। তবে খাবি কি? আজ ঘরে যে কিছু নেই।
প্র। তা শুধু ভাত খাব। রোজ রোজ চেয়ে খাব কেন গা?
মা। যেমন অদৃষ্ট করে এসেছিলি। কাঙ্গাল গরিবের চাইতে লজ্জা কি?
প্রফুল্ল কথা কহিল না। মা বলিল, “তুই তবে ভাত চড়াইয়া দে, আমি কিছু তরকারির চেষ্টায় যাই ।”
প্রফুল্ল বলিল, “আমার মাথা খাও, আর চাইতে যাইও না। ঘরে চাল আছে, নুন আছে, গাছে কাঁচা লঙ্কা আছে–মেয়ে মানুষের তাই ঢের ।”
অগত্যা প্রফুল্লের মাতা সম্মত হইল। ভাতের জল চড়াইয়াছিল, মা চাল ধুইতে গেল। চাল ধুইবার জন্য ধুচুনি হাতে করিয়া মাতা গালে হাত দিল। বলিল, “চাল কই?” প্রফুল্লকে দেখাইল, আধ মুটা চাউল আছে মাত্র–তাহা একজনের আধপেটা হইবে না।
মা ধুচুনি হাতে করিয়া বাহির হইল। প্রফুল্ল বলিল, “কোথা যাও?”
মা। চাল ধার করিয়া আনি–নইলে শুধু ভাতই কপালে জোটে কই?
প্র। আমরা লোকের কত চাল ধারি–শোধ দিতে পারি না–তুমি আর চাল ধার করিও না।
প্র। আবাগীর মেয়ে, খাবি কি? ঘরে যে একটি পয়সা নাই।
প্র। উপস করিব।
মা। উপস করিয়া কয় দিন বাঁচিবি?
প্র। না হয় মরিব।
মা। আমি মরিলে যা হয় করিস; তুই উপস করিয়া মরিবি, আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না। যেমন করিয়া পারি, ভিক্ষা করিয়া তোকে খাওয়াইব।
প্র। ভিক্ষাই বা কেন করিতে হইবে? এক দিনের উপবাসে মানুষ মরে না। এসো না, মায়ে ঝিয়ে আজ পৈতে তুলি। কাল বেচিয়া কড়ি করিব।
মা। সূতা কই?
প্র। কেন, চরকা আছে।
মা। পাঁজ কই?
তখন প্রফুল্লমুখী অধোবদনে রোদন করিতে লাগিল। মা ধুচুনি হাতে আবার চাউল ধার করিয়া আনিতে চলিল, তখন প্রফুল্ল মার হাত হইতে ধুচুনি কাড়িয়া লইয়া তফাতে রাখিল। বলিল, “মা, আমি কেন চেয়ে ধার করে খাব–আমার ত সব আছে?”
মা চক্ষের জল মুছাইয়া বলিল, “সবই ত আছে মা –কপালে ঘটিল কৈ?”
প্র। কেন ঘটে না মা–আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে, শ্বশুরের অন্ন থাকিতে আমি খাইতে পাইব না?
মা। এই অভাগীর পেটে হয়েছিলি, এই অপরাধ–আর তোমার কপাল। নহিলে তোমার অন্ন খায় কে?
প্র। শোন মা, আমি আজ মন ঠিক করিয়াছি–শ্বশুরের অন্ন কপালে জোটে, তবে খাইব–নইলে আর খাইব না। তুমি চেয়ে চিন্তে যে প্রকারে পার, আনিয়া খাও। খাইয়া আমাকে সঙ্গে করিয়া শ্বশুরবাড়ী রাখিয়া আইস।
মা। সে কি মা! তাও কি হয়?
প্র। কেন হয় না মা?
মা। না নিতে এলে কি শ্বশুরবাড়ী যেতে আছে?
প্র। পরের বাড়ী চেয়ে খেতে আছে, আর না নিতে এলে আপনার শ্বশুরবাড়ী যেতে নেই?
মা। তারা যে কখনও তোমার নাম করে না।
প্র। না করুক–তাতে আমার অপমান নাই। যাহাদের উপর আমার ভরণপোষণের ভার, তাহাদের কাছে অন্নের ভিক্ষা করিতে আমার অপমান নাই। আপনার ধন আপনি চাহিয়া খাইব–তাহাতে আমার লজ্জা কি?
মা চুপ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। প্রফুল্ল বলিল, “তোমাকে একা রাখিয়া আমি যাইতে চাহিতাম না–আমার দুঃখ ঘুচিলে তোমারও দুঃখ কমিবে, এই ভরসায় যাইতে চাহিতেছি ।”
মাতে মেয়েতে অনেক কথাবার্তা হইল। মা বুঝিল যে, মেয়ের পরামর্শই ঠিক। তখন মা, যে কয়টি চাউল ছিল, তাহা রাঁধিল। কিন্তু প্রফুল্ল কিছুতেই খাইল না। কাজেই তাহার মাতাও খাইল না। তখন বলিল, “তবে আর বেলা কাটাইয়া কি হইবে? অনেক পথ ।”
তাহার মাতা বলিল, “আয় তোর চুলটা বাঁধিয়া দিই ।”
প্রফুল্ল বলিল, “না থাক ।”
মা ভাবিল, “থাক। আমার মেয়েকে সাজাইতে হয় না ।”
মেয়ে ভাবিল, “থাক। সেজে গুজে কি ভুলাইতে যাইব? ছি!”
তখন দুই জনে মলিন বেশে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বরেন্দ্রভূমে ভূতনাথ নামে গ্রাম; সেইখানে প্রফুল্লমুখীর শ্বশুরালয়। প্রফুল্লের দশা যেমন হউক, তাহার শ্বশুর হরবল্লভবাবু খুব বড়মানুষ লোক। তাঁহার অনেক জমিদারী আছে, দোতালা বৈঠকখানা, ঠাকুরবাড়ী, নাটমন্দির, দপ্তরখানা, খিড়কিতে বাগান, পুকুর প্রাচীরে বেড়া। সে স্থান প্রফুল্লমুখীর পিত্রালয় হইতে ছয় ক্রোশ। ছয় ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মাতা ও কন্যা অনশনে বেলা তৃতীয় প্রহরের সময়ে সে ধনীর গৃহে প্রবেশ করিলেন।
প্রবেশকালে প্রফুল্লের মার পা উঠে না। প্রফুল্ল কাঙ্গালের মেয়ে বলিয়া যে হরবল্লভবাবু তাঁহাকে ঘৃণা করিতেন, তাহা নহে। বিবাহের পরে একটা গোল হইয়াছিল। হরবল্লভ কাঙ্গাল দেখিয়াও ছেলের বিবাহ দিয়াছিলেন। মেয়েটি পরমসুন্দরী, তেমন মেয়ে আর কোথাও পাইলেন না, তাই সেখানে বিবাহ দিয়াছিলেন। এদিকে প্রফুল্লের মা, কন্যা বড়মানুষের ঘরে পড়িল, এই উৎসাহে সর্বস্ব ব্যয় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন। সেই বিবাহতেই–তাঁর যাহা কিছু ছিল, ভস্ম হইয়া গেল। সেই অবধি এই অন্নের কাঙ্গাল। কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে সাধের বিবাহে বিপরীত ফল ফলিল। সর্বস্ব ব্যয় করিয়াও–সর্বস্বই তার কত টাকা?–সর্বস্ব ব্যয় করিয়াও সে বিধবা স্ত্রীলোক সকল দিক কুলান করিতে পারিল না। বরযাত্রদিগের লুচি মণ্ডায়, দেশ কাল পাত্র বিবেচনায়, উত্তম ফলাহার করাইল। কিন্তু কন্যাযাত্রগণের কেবল চিড়া দই। ইহাতে প্রতিবাসী কন্যাযাত্রেরা অপমান বোধ করিলেন। তাঁহারা খাইলেন না–উঠিয়া গেলেন। ইহাতে প্রফুল্লের মার সঙ্গে তাঁহাদের কোন্দল বাঁধিল; প্রফুল্লের মা বড় গালি দিল। প্রতিবাসীরা একটা বড় রকম শোধ লইল।