“নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী বটবৃক্ষেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী দত্তগৃহেষু হীরারূপেণ সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ।
যা দেবী পুকুরঘাটেষু চুপড়িহস্তেন সংস্থিতা ||
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ||
যা দেবী ঘরদ্বারেষু ঝাঁটাহস্তেন সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম: ||”
তার পর–মালিনী মাসি!–কি মনে করে?”
হীরা ইতিপূর্বেই বৈষ্ণবীর সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া দিনমানে জানিয়া গিয়াছিল যে, হরিদাসী বৈষ্ণবী ও দেবেন্দ্র বাবু একই ব্যক্তি। কিন্তু কেন দেবেন্দ্র বৈষ্ণবী-বেশে দত্তগৃহে যাতায়াত করিতেছে? এ কথা জানা সহজ নহে। হীরা মনে মনে অত্যন্ত দু:সাহসিক সঙ্কল্প করিয়া, এই সময়ে স্বয়ং দেবেন্দ্রের গৃহে আসিল। সে গোপনে উদ্যানমধ্যে প্রবেশ করিয়া জানেলার কাছে দাঁড়াইয়া দেবেন্দ্রের কথাবার্তা শুনিয়াছিল। সুরেন্দ্রের সঙ্গে দেবেন্দ্রের কথোপকথন অন্তরাল হইতে শুনিয়া হীরা সিদ্ধমনস্কাম হইয়া ফিরিয়া যাইতেছিল, যাইবার সময় অসাবধানে খড়খড়ি ফেলিয়া দিয়াছিল–ইহাতেই গোল বাধিল।
এখন হীরা পলাইবার জন্য ব্যস্ত। দেবেন্দ্র তাহার হাতে আবার মদের গেলাস দিল। হীরা বলিল, “আপনি খান |” বলিবামাত্র দেবেন্দ্র তাহা গলাধ:করণ করিলেন। সেই গেলাস দেবেন্দ্রের পূর্ণ মাত্রা হইল–দুই একবার ঢুলিয়া–দেবেন্দ্র শুইয়া পড়িলেন। হীরা তখন উঠিয়া পলাইল। দেবেন্দ্র তখন ঝিমকিনি মারিয়া গাইতে লাগিল;-
“বয়স তাহার বছর ষোল,
দেখতে শুনতে কালো কোলো,
পিলে অগ্রমাসে মোলো,
আমি তখন খানায় পোড়ে |”
সে রাত্রে হীরা আর দত্তবাড়ীতে গেল না, আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিয়া রহিল। পরদিন প্রাতে গিয়া সূর্যমুখীর নিকট দেবেন্দ্রের সংবাদ বলিল। দেবেন্দ্র কুন্দের জন্য বৈষ্ণবী সাজিয়া যাতায়াত করে। কুন্দ যে নির্দোষী, তাহা হীরাও বলিল না, সূর্যমুখীও বুঝিলেন না। হীরা কেন সে কথা লুকাইল–পাঠক তাহা ক্রমে বুঝিতে পারিবেন। সূর্যমুখী দেখিয়াছিলেন, কুন্দ বৈষ্ণবীর সঙ্গে চুপি চুপি কথা কহিতেছেন–সুতরাং সূর্যমুখী তাহাকে দোষী মনে করিলেন। হীরার কথা শুনিয়া সূর্যমুখীর নীলোৎপললোচন রাঙ্গা হইয়া উঠিল। তাঁহার কপালে শিরা স্থূলতা প্রাপ্ত হইয়া প্রকটিত হইল। কমলও সকল শুনিলেন। কুন্দকে সূর্যমুখী ডাকাইলেন। সে আসিলে পরে বলিলেন, “কুন্দ! হরিদাসী বৈষ্ণবী কে, আমরা চিনিয়াছি। আমরা জানিয়াছি যে, সে তোর কে। তুই যা তা জানিলাম! আমরা এমন স্ত্রীলোককে বাড়ীতে স্থান দিই না। তুই বাড়ী হইতে এখনই দূর হ। নহিলে হীরা তোকে ঝাঁটা মারিয়া তাড়াইবে |”
কুন্দের গা কাঁপিতে লাগিল। কমল দেখিলেন যে, সে পড়িয়া যায়। কমল তাহাকে ধরিয়া শয়নগৃহে লইয়া গেলেন। শযনগৃহে থাকিয়া আদর করিয়া সান্ত্বনা করিলেন এবং বলিলেন, “ও মাগী যাহা বলে বলুক; আমি উহার একটি কথাও বিশ্বাস করি না |”
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : অনাথিনী
গভীর রাত্রে গৃহস্থ সকলে নিদ্রিত হইলে কুন্দনন্দিনী শয়নাগারের দ্বার খুলিয়া বাহির হইল। এক বসনে সূর্যমুখীর গৃহ ত্যাগ করিয়া গেল। সেই গভীর রাত্রে এক বসনে সপ্তদশবর্ষীয়া, অনাথিনী সংসারসমুদ্রে একাকিনী ঝাঁপ দিল।
রাত্রি অত্যন্ত অন্ধকার। অল্প অল্প মেঘ করিয়াছে, কোথায় পথ?
কে বলিয়া দিবে, কোথায় পথ? কুন্দনন্দিনী কখন দত্তদিগের বাটীর বাহির হয় নাই। কোন্ দিকে কোথায যাইবার পথ, তাহা জানে না। আর কোথাই বা যাইবে?
অট্টালিকার বৃহৎ অন্ধকারময় কায়া, আকাশের গায়ে লাগিয়া রহিয়াছে– সেই অন্ধকার বেষ্টন করিয়া কুন্দনন্দিনী বেড়াইতে লাগিল। মানস, একবার নগেন্দ্রনাথের শয়নকক্ষের বাতায়নপথে আলো দেখিয়া যায়। একবার সেই আলো দেখিয়া চক্ষু জুড়াইয়া যাইবে।
তাঁহার শয়নাগার চিনিত–ফিরিতে ফিরিতে তাহা দেখিতে পাইল–বাতায়নপথে আলো দেখা যাইতেছে। কবাট খোলা–শার্সি বন্ধ–অন্ধকারমধ্যে তিনটি জানেলা জ্বলিতেছে। তাহার উপর পতঙ্গজাতি উড়িয়া উড়িয়া পড়িতেছে। আলো দেখিয়া উড়িয়া পড়িতেছে, কিন্তু রুদ্ধপথে প্রবেশ করিতে না পারিয়া কাচে ঠেকিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। কুন্দনন্দিনী এই ক্ষুদ্র পতঙ্গদিগের জন্য হৃদয়মধ্যে পীড়িতা হইল।
কুন্দনন্দিনী মুগ্ধলোচনে সেই গবাক্ষপথ-প্রেরিত আলোক দেখিতে লাগিল–সে আলো ছাড়িয়া যাইতে পারিল না। শয়নাগারের সম্মুখে কতকগুলি ঝাউগাছ ছিল–কুন্দনন্দিনী তাহার তলায় গবাক্ষ প্রতি সম্মুখ করিয়া বসিল। রাত্রি অন্ধকার, চারি দিক অন্ধকার, গাছে গাছে খদ্যোতের চাকচিক্য সহস্রে সহস্রে ফুটিতেছে, মুদিতেছে; মুদিতেছে, ফুটিতেছে। আকাশে কালো মেঘের পশ্চাতে কালো মেঘ ছুটিতেছে–তাহার পশ্চাতে আরও কালো মেঘ ছুটিতেছে–তৎপশ্চাতে আরও কালো। আকাশে দুই একটি নক্ষত্র মাত্র, কখনও মেঘে ডুবিতেছে, কখনও ভাসিতেছে। বাড়ীর চারি দিকে ঝাউগাছের শ্রেণী, সেই মেঘময় আকাশে মাথা তুলিয়া নিশাচর পিশাচের মত দাঁড়াইয়া আছে। বায়ুর স্পর্শে সেই করালবদনা নিশীথিনী-অঙ্কে থাকিয়া, তাহারা আপন আপন পৈশাচী ভাষায় কুন্দনন্দিনীর মাথার উপর কথা কহিতেছে। পিশাচেরাও করাল রাত্রির ভয়ে, অল্প শব্দে কথা কহিতেছে। কদাচিৎ বায়ুর সঞ্চালনে গবাক্ষের মুক্ত কবাট প্রাচীরে বারেক মাত্র আঘাত করিয়া শব্দ করিতেছে। কালপেঁচা সৌধোপরি বসিয়া ডাকিতেছে। কদাচিৎ একটা কুক্কুর অন্য পশু দেখিয়া সম্মুখ দিয়া অতি দ্রুতবেগে ছুটিতেছে। কদাচিৎ ঝাউয়ের পল্লব অথবা ফল খসিয়া পড়িতেছে। দূরে নারিকেল বৃক্ষের অন্ধকার শিরোভাগ অন্ধকারে মন্দ মন্দ হেলিতেছে; দূর হইতে তালবৃক্ষের পত্রের তর তর মর্মর শব্দ কর্ণে আসিতেছে; সর্বোপরি সেই বাতায়নশ্রেণীর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছে–আর পতঙ্গদল ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। কুন্দনন্দিনী সেই দিকে চাহিয়া রহিল।
ধীরে ধীরে একটি গবাক্ষের শার্সি খুলিল। এক মনুষ্যমূর্তি আলোকপটে চিত্রিত হইল। হরি! হরি! সে নগেন্দ্রের মূর্তি। নগেন্দ্র–নগেন্দ্র! যদি ঐ ঝাউতলার অন্ধকারের মধ্যে ক্ষুদ্র কুন্দ কুসুমটি দেখিতে পাইতে! যদি তোমাকে গবাক্ষপথে দেখিয়া তাহার হৃদয়ঘাতের শব্দ–দুপ! দুপ! শব্দ–যদি সে শব্দ শুনিতে পাইতে! যদি জানিতে পারিতে যে, তুমি আবার এখনই সরিয়া অদৃশ্য হইবে, এই ভয়ে তাহার দেখার সুখ হইতেছে না! নগেন্দ্র! দীপের দিকে পশ্চাৎ করিয়া দাঁড়াইয়াছ–একবার দীপ সম্মুখে করিয়া দাঁড়াও! তুমি দাঁড়াও, সরিও না–কুন্দ বড় দু:খিনী। দাঁড়াও–তাহা হইলে, সেই পুষ্করিণীর স্বচ্ছ শীতল বারি–তাহার তলে নক্ষত্রচ্ছায়া–তাহার আর মনে পড়িবে না।
ঐ শুন! কালপেঁচা ডাকিল! তুমি সরিয়া যাইবে, আর কুন্দনন্দিনীর ভয় করিবে! দেখিলে বিদ্যুৎ! তুমি সরিও না–কুন্দনন্দিনীর ভয় করিবে! ঐ দেখ, আবার কালো মেঘ পবনে চাপিয়া যে যুদ্ধে ছুটিতেছে। ঝড় বৃষ্টি হইবে। কুন্দকে কে আশ্রয় দিবে?
দেখ, তুমি গবাক্ষ মুক্ত করিয়াছ, ঝাঁকে ঝাঁকে পতঙ্গ আসিয়া তোমার শয্যাগৃহে প্রবেশ করিতেছে। কুন্দ মনে করিতেছে, কি পুণ্য করিলে পতঙ্গজন্ম হয়। কুন্দ! পতঙ্গ যে পুড়িয়া মরে! কুন্দ তাই চায়। মনে করিতেছে, “আমি পুড়িলাম–মরিলাম না কেন?”
নগেন্দ্র শার্সি বন্ধ করিয়া সরিয়া গেলেন। নির্দয়! ইহাতে কি ক্ষতি! না, তোমার রাত্রি জাগিয়া কাজ নাই–নিদ্রা যাও–শরীর অসুস্থ হইবে। কুন্দনন্দিনী মরে, মরুক। তোমার মাথা না ধরে, কুন্দনন্দিনীর কামনা এই।
এখন আলোকময় গবাক্ষ যেন অন্ধকার হইল। চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়া, চক্ষের জল মুছিয়া, কুন্দনন্দিনী উঠিল। সম্মুখে যে পথ পাইল–সেই পথে চলিল। কোথায় চলিল? নিশাচর পিশাচ ঝাউগাছেরা সর্ সর্ শব্দ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাও?” তালগাছেরা তর্ তর্ করিয়া শব্দ করিয়া বলিল, “কোথায় যাও?” পেচক গম্ভীর নাদে বলিল, “কোথায় যাও?” উজ্জ্বল গবাক্ষশ্রেণী বলিতে লাগিল, “যায় যাউক–আমরা আর নগেন্দ্র দেখাইব না |” তবু কুন্দনন্দিনী–নির্বোধ কুন্দনন্দিনী ফিরিয়া ফিরিয়া সেই দিকে চাহিতে লাগিল।
কুন্দ চলিল, চলিল–কেবল চলিল। আকাশে আরও মেঘ ছুটিতে লাগিল–মেঘ সকল একত্র হইয়া আকাশেও রাত্রি করিল–বিদ্যুৎ হাসিল–আবার হাসিল–আবার! বায়ু গর্জিল, মেঘ গর্জিল–বায়ুতে মেঘেতে একত্র হইয়া গর্জিল। আকাশ আর রাত্রি একত্র হইয়া গর্জিল। কুন্দ! কোথায় যাইবে?
ঝড় উঠিল। প্রথমে শব্দ, পরে ধূলি উঠিল, পরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া লইয়া বায়ু স্বয়ং আসিল! শেষে পিট্! পিট!–পট্ পট্!–হু হু! বৃষ্টি আসিল। কুন্দ! কোথায় যাইবে?
বিদ্যুতের আলোকে পথিপার্শ্বে কুন্দ একটা সামান্য গৃহ দেখিল। গৃহের চতুষ্পার্শ্বে মৃৎপ্রাচীর; মৃৎপ্রাচীরের ছোট চাল। কুন্দনন্দিনী আসিয়া তাহার আশ্রয়ে, দ্বারের নিকটে বসিল। দ্বারে পিঠ রাখিয়া বসিল। দ্বার পিঠের স্পর্শে শব্দিত হইল। গৃহস্থ সজাগ, দ্বারের শব্দ তাহার কাণে গেল। গৃহস্থ মনে করিল, ঝড় ; কিন্তু তাহার দ্বারে একটা কুক্কুর শয়ন করিয়া থাকে–সেটা উঠিয়া ডাকিতে লাগিল। গৃহস্থ তখন ভয় পাইল। আশঙ্কায় দ্বার খুলিয়া দেখিতে আইল। দেখিল, আশ্রয়হীনা স্ত্রীলোকমাত্র। জিজ্ঞাসা করিল, “কে গা তুমি?”
কুন্দ কথা কহিল না।
“কে রে মাগি?”
কুন্দ বলিল, “বৃষ্টির জন্য দাঁড়াইয়াছি |”
গৃহস্থ ব্যগ্রভাবে বলিল, “কি? কি? কি? আবার বল ত?”
কুন্দ বলিল, “বৃষ্টির জন্য দাঁড়াইয়াছি |”
গৃহস্থ বলিল, “ও গলা যে চিনি। বটে? ঘরের ভিতর এস ত?”
গৃহস্থ কুন্দকে ঘরের ভিতর লইয়া গেল। আগুন করিয়া আলো জ্বালিল। কুন্দ তখন দেখিল–হীরা।
হীরা বলিল, “বুঝিয়াছি, তিরস্কারে পলাইয়াছ। ভয় নাই। আমি কাহারও সাক্ষাতে বলিব না। আমার এইখানে দুই দিন থাক |”