তাহারা বলিল, “সে কথা আর মনে করিও না। আমরা সে কথা সারিয়া লইব। তুমি এখন অনাথা বালিকা–তোমার সঙ্গে আর আমাদের কোন বিবাদ নাই।”
প্রফুল্ল সম্মত হইল। দুই জন হরবল্লভকে নিমন্ত্রণ করিতে গেল। হরবল্লভ বলিলেন, “কি ঠাকুর! তোমরাই বিহাইনকে জাতিভ্রষ্টা বলিয়া তাকে একঘরে করেছিলে–আবার তোমাদেরই মুখে এই কথা?”
ব্রাহ্মণেরা বলিল, “সে কি জানেন– অমন পাড়াপড়শীতে গোলযোগ হয–সেটা কোন কাজের কথা নয়।”
হরবল্লভ বিষয়ী লোক–ভাবিলেন, “এ সব জুয়াচুরি। এ বেটারা বাগদী বেটীর কাছে টাকা খাইয়াছে। ভাল, বাগদী বেটী টাকা পাইল কোথা?” অতএব হরবল্লভ নিমন্ত্রণের কথায় কর্ণপাতও করিলেন না। তাঁহার মন প্রফুল্লের প্রতি বরং আরও নিষ্ঠুর ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল।
ব্রজেশ্বর এ সকল শুনিল। মনে করিল, “এক দিন রাত্রে লুকাইয়া গিয়া প্রফুল্লকে দেখিয়া আসিব। সেই রাত্রেই ফিরিব।”
প্রতিবাসীরা নিষ্ফল হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। প্রফুল্ল যথারীতি মাতৃশ্রাদ্ধ করিয়া প্রতিবাসীদিগের সাহায্যে ব্রাহ্মণ-ভোজন সম্পন্ন করিল। ব্রজেশ্বর যাইবার সময় খুঁজিতে লাগিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ফুলমণি নাপিতানীর বাস প্রফুল্লের বাসের নিকট। মাতৃহীন হইয়া অবধি প্রফুল্ল একা গৃহে বাস করে। প্রফুল্ল সুন্দরী, যুবতী, রাত্রে একা বাস করে, তাহাতে ভয়ও আছে, কলঙ্ক আছে। কাছে শুইবার জন্য রাত্রে একজন স্ত্রীলোক চাই। ফুলমণিকে এ জন্য প্রফুল্ল অনুরোধ করিয়াছিল। ফুলমণি বিধবা; তার এক বিধবা ভগিনী ভিন্ন কেহ নাই। আর তারা দুই বোনেই প্রফুল্লের মার অনুগত ছিল। এই জন্য প্রফুল্ল ফুলমণিকে অনুরোধ করে, আর ফুলমণিও সহজে স্বীকার করে। অতএব যে দিন প্রফুল্লের মা মরিয়াছিল, সেই দিন অবধি প্রফুল্লের বাড়ীতে ফুলমণি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আসিয়া শোয়।
তবে ফুলমণি কি চরিত্রের লোক, তাহা ছেলেমানুষ প্রফুল্ল সবিশেষ জানিত না। ফুলমণি প্রফুল্লের অপেক্ষা বয়স দশ বছরের বড়। দেখিতে শুনিতে মন্দ নয়, বেশ-ভূষায় একটু পারিপাট্য রাখিত। একে ইতর জাতির মেয়ে, তাতে বালবিধবা; চরিত্রটা বড় খাঁটি রাখিতে পারে নাই। গ্রামের জমিদার পরাণ চৌধুরী। তাঁহার একজন গোমস্তা দুর্লভ চক্রবর্তী ঐ গ্রামে আসিয়া মধ্যে মধ্যে কাছারি করিত। লোকে বলিত, ফুলমণি দুর্লভের বিশেষ অনুগৃহীতা–অথবা দুর্লভ তাহার অনুগৃহীত। এ সকল কথা প্রফুল্ল একেবারে যে কখনও শুনে নাই–তা নয়, কিন্তু কি করে–আর কেহ আপনার ঘর দ্বার ফেলিয়া প্রফুল্লের কাছে শুইতে চাহে না। বিশেষ প্রফুল্ল মনে করিল, “সে মন্দ হোক, আমি না মন্দ হইলে আমায় কে মন্দ করিবে?”
অতএব ফুলমণি দুই চারি দিন আসিয়া প্রফুল্লের ঘরে শুইল। শ্রাদ্ধের পরদিন ফুলমণি একটু দেরি করিয়া আসিতেছিল। পথে একটা আমগাছের তলায়, একটা বন আছে, আসিবার সময় ফুলমণি সেই বনে প্রবেশ করিল। সে বনের ভিতর একজন পুরুষ দাঁড়াইয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, সে সেই দুর্লভচন্দ্র।
চক্রবর্তী মহাশয় কৃতাভিসারা, তাম্বুলরাগরক্তাধরা, রাঙ্গাপেড়ে, সাড়ীপরা, হাসিতে মুখভরা ফুলমণিকে দেখিয়া বলিলেন, “কেমন, আজ?”
ফুলমণি বলিলেন, “হাঁ, আজই বেশ। তুমি রাত্রি দুপুরের সময় পাল্কী নিয়ে এসো–দুয়ারে টোকা মেরো। আমি দুয়ার খুলিয়া দিব। কিন্তু দেখো, গোল না হয়।”
দু। তার ভয় নাই। কিন্তু সে ত গোল করবে না?
ফু। তার একটা ব্যবস্থা করবে হবে। আমি আস্তে আস্তে দোরটি খুলবে তুমি আস্তে, আস্তে, সে ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে তার মুখটি কাপড় দিয়া চাপিয়া বাঁধিয়া ফেলিবে। তার পর চেঁচায় কার বাপের সাধ্য!
দু। তা, এমন জোর করে নিয়ে গেলে কয় দিন থাকিবে?
ফু। একবার নিয়ে যেতে পারলেই হলো। যার তিন কুলে কেউ নাই, যে অন্নের কাঙ্গাল, সে খেতে পাবে, কাপড় পাবে, গয়না পাবে, টাকা পাবে, সোহাগ পাবে–সে আবার থাকবেত না? সে ভার আমার–আমি যেন গয়না টাকার ভাগ পাই।
এইরূপ কথাবার্তা সমাপ্ত হইলে, দুর্লভ স্বস্থানে গেল–ফুলমণি প্রফুল্লের কাছে গেল। প্রফুল্ল এ সর্বনাশের কথা কিছুই জানিতে পারে নাই। সে মার কথা ভাবিতে ভাবিতে শয়ন করিল। মার জন্য যেমন কাঁদে, তেমন কাঁদিল; কাঁদিয়া যেমন রোজ ঘুমায়, তেমনি ঘুমাইল। দুই প্রহরে দুর্লভ আসিয়া দ্বারে টোকা মারিল। ফুলমণি দ্বার খুলিল। দুর্লভ প্রফুল্লের মুখ বাঁধিয়া ধরাধরি করিয়া পাল্কীতে তুলিল। বাহকেরা নিঃশব্দে তাহাকে পরাণবাবু জমিদারের বিহার-মন্দিরে লইয়া চলিল। বলা বাহুল্য, ফুলমণি সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
ইহার অর্দ্ধ দণ্ড পরে ব্রজেশ্বর সেই শূন্য গৃহে প্রফুল্লের সন্ধানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ব্রজেশ্বর সকলকে লুকাইয়া রাত্রে পলাইয়া আসিয়াছে। কোথাও কেহ নাই।
প্রফুল্লকে লইয়া বাহকেরা নিঃশব্দে চলিল বলিয়াছি; কেহ মনে না করেন–এটা ভ্রম-প্রমাদ! বাহকের প্রকৃতি শব্দ করা। কিন্তু এবার শব্দ করার পক্ষে তাহাদের প্রতি নিষেধ ছিল। শব্দ করিলে গোলযোগ হইবে; তা ছাড়া আর একটা কথা ছিল। ব্রহ্মঠাকুরাণীর মুখে শুনা গিয়াছে, বড় ডাকাতের ভয়। বাস্তবিক এরূপ ভয়ানক দস্যুভীতি কখনও কোন দেশে হইয়াছিল কি না সন্দেহ। তখন দেশ অরাজক। মুসলমানের রাজ্য গিয়াছে; ইংরেজের রাজ্য ভাল করিয়া পত্তন হয় নাই–হইতেছে মাত্র। তাতে আবার বছর কত হইল, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেশ ছারখার করিয়া গিয়াছে। তার পর আবার দেবী সিংহের ইজারা। পৃথিবীর ও পারে ওয়েষ্ট্ মিনষ্টর হলে দাঁড়াইয়া এদ্ম ন্দ্ বর্ক সেই দেবী সিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্বতোদ্গীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বর্ক দেবী সিংহের দুর্বিষহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাঁহার নিজমুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল–আজিও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর লোমাঞ্চিত এবং হৃদয় উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্র-ভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল। অনেকেই কেবল খাইতে পায় না নয়, গৃহে পর্যন্ত বাস করিতে পায় না। যাহাদের খাইবার নাই, তাহারা পরের কাড়িয়া খায়। কাজেই এখন গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর ডাকাত। কাহার সাধ্য শাসন করে? গুড্ল্যা ড সাহেব রঙ্গপুরের প্রথম কালেক্টর। ফৌজদারী তাঁহারই জিম্মা। তিনি দলে দলে সিপাহী ডাকাত ধরিতে পাঠাইতে লাগিলেন। সিপাহীরা কিছুই করিতে পারিল না।