কিন্তু নৌকা ডুবিল না–কাত হইয়া আবার সোজা হইয়া বাতাসে পিছন করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ছুটিল। যাহারা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার খাড়া হইয়া দাঁড়াইল–সাহেব আবার ঘুঁষি তুলিলেন। কিন্তু সাহেবের ফৌজ, যাহারা জলে দাঁড়াইয়াছিল, বজরা তাহাদের ঘাড়ের উপর দিয়া চলিয়া গেল। অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণরক্ষা করিল; কেহ দূর হইতে বজরা ঘুরিতেছে দেখিতে পাইয়া পলাইয়া বাঁচিল; কেহ বা আহত হইল; কেহ মরিল না। ছিপগুলি বজরার নীচে পড়িয়া ডুবিয়া গেল–জল সেখানে এমন বেশী নহে–স্রোত বড় নাই–সুতরাং সকলেই বাঁচিল। কিন্তু বজরা আর কেহ দেখিতে পাইল না। নক্ষত্রবেগে উড়িয়া বজরা কোথায় ঝড়ের সঙ্গে মিশিয়া চলিল, কেহ আর দেখিতে পাইল না। সিপাহী সেনা ছিন্নভিন্ন হইল। দেবী তাহাদের পরাস্ত করিয়া পাল উড়াইয়া চলিল, লেফটেনান্ট সাহেব ও হরবল্লভ দেবীর নিকট বন্দী হইল। নিমেষমধ্যে যুদ্ধ জয় হইল। দেবী তাই আকাশ দেখাইয়া বলিয়াছিল, “আমার রক্ষার উপায় ভগবান করিতেছেন।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বজরা জলের রাশি ভাঙ্গিয়া, দুলিতে দুলিতে নক্ষত্র-বেগে ছুটিল। শব্দ ভয়ানক। বজরার মুখে কৃষ্ণ তরঙ্গরাশির গর্জন ভয়ানক–ঝড়ের শব্দ ভয়ানক। কিন্তু নৌকার গঠন অনুপম, নাবিকদিগের দক্ষতা ও শিক্ষা প্রসিদ্ধ। নৌকা এই ঝড়ের মুখে চারিখানা পাল দিয়া নির্বিঘ্নে চলিল। আরোহিবর্গ যাঁহারা প্রথমে কুষ্মাণ্ডাকারে গড়াগড়ি দিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলে স্বপদস্থ হইলেন। হরবল্লভ রায় মহাশয়, অঙ্গুষ্ঠে যজ্ঞোপবীত জড়িত করিয়া দুর্গানাম জপিতে আরম্ভ করিলেন, আবার না ডুবি। লেফটেনান্ট সাহেব সেই মুলতবী ঘুঁষিটা আবার পুনর্জীবিত করিবার চেষ্টায় হস্তোত্তোলন করিলেন, অমনি ব্রজেশ্বর তাঁর হাতখানা ধরিয়া ফেলিল। হরবল্লভ ছেলেকে ভর্ৎসনা করিলেন। বলিলেন, “ও কি কর, ইংরেজের গায়ে হাত তোল?”
ব্রজেশ্বর বলিল, “আমি ইংরেজের গায়ে হাত তুলেছি, না ইংরেজ আমার গায়ে হাত তুলিতেছে?”
হরবল্লভ সাহেবকে বলিলেন, “হুজুর! ও ছেলেমানুষ, আজও বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, আপনি ওর অপরাধ লইবেন না। মাফ করুন।”
সাহেব বলিলেন, “ও বড় বদমাস। তবে যদি আমার কাছে ও জোড়হাত করিয়া মাফ চায়, তবে আমি মাফ করিতে পারি।”
হ। ব্রজ তাই কর। জোড়হাত করিয়া সাহেবকে বল, “আমাকে মাফ করুন।”
ব্র। সাহেব, আমরা হিন্দু, পিতার আজ্ঞা আমরা কখনও লঙ্ঘন করি না। আমি আপনার কাছে জোড়হাত করিয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমাকে মাফ করুন।
সাহেব ব্রজেশ্বরের পিতৃভক্তি দেখিয়া প্রসন্ন হইয়া ব্রজেশ্বরকে ক্ষমা করিলেন, আর ব্রজেশ্বরের হাত লইয়া আচ্ছা করিয়া নাড়া দিলেন। ব্রজেশ্বরের চতুর্দশ পুরুষের মধ্যে কখন জানে না, সেকহ্যাকণ্ড কাকে বলে–সুতরাং ব্রজেশ্বর একটু ভেকা হইয়া রহিল। মনে করিল, “কি জানি, যদি আবার বাঁধে।” এই ভাবিয়া ব্রজেশ্বর বাহিরে গিয়া বসিল। কেবল ঝড়, –বৃষ্টি নাই, –ভিজিতে হইল না।
রঙ্গরাজ বাহিরে আসিয়া, কামরার দ্বার বন্ধ করিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া বসিল–দুই দিকের পাহারায় বিশেষ, এ সময়ে বাহিরে একটু সতর্ক থাকা ভাল, বজরা বড় তীব্রবেগে যাইতেছে, হঠাৎ বিপদ ঘটাও বিচিত্র নহে।
দিবা উঠিয়া দেবীর কাছে গেল–পুরুষ-মহলে এখন আর প্রয়োজন নাই। নিশি উঠিল না–তার কিছু মতলব ছিল। সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত–সুতরাং অগাধ সাহস।
সাহেব জাঁকিয়া আবার রূপার চৌকিতে বসিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “ডাকাইতের হাত হইতে কিরূপে মুক্ত হইব? যাহাকে ধরিতে আসিয়াছিলাম, তাহারই কাছে ধরা পড়িলাম–স্ত্রীলোকের কাছে পরাজিত হইলাম, ইংরেজ মহলে আর কি বলিয়া মুখ দেখাইব? আমার না ফিরিয়া যাওয়াই ভাল।”
হরবল্লভ আর বসিবার স্থান না পাইয়া নিশি সুন্দরীর মসনদের কাছে বসিলেন। দেখিয়া নিশি বলিল, “আপনি একটু নিদ্রা যাবেন?”
হ। আজ কি আর নিদ্রা হয়?
নি। আজ না হইল ত আর হইল না।
হ। সে কি?
নি। আবার ঘুমাইবার দিন কবে পাইবেন?
হ। কেন?
নি। আপনি দেবী চৌধুরাণীকে ধরাইয়া দিতে আসিয়াছিলেন?
হ। তা–তা–কি জান–
নি। ধরা পড়িলে দেবীর কি হইত, জান?
হ। আ–এমন কি–
নি। এমন কিছু নয়, ফাঁসি!
হ। তা–না–এই–তা কি জান–
নি। দেবী তোমার কোন অনিষ্ট করে নাই, বরং ভারী উপকার করিয়াছিল–যখন তোমার জাতি যায়, প্রাণ যায়, তখন তোমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়া, তোমায় রক্ষা করিয়াছিল। তার প্রত্যুপকারে তুমি তাহাকে ফাঁসি দিবার চেষ্টায় ছিলে। তোমার যোগ্য কি দণ্ড বল দেখি?
হরবল্লভ চুপ করিয়া রহিল।
নিশি বলিতে লাগিল, “তাই বলিতেছিলাম, এই বেলা ঘুমাইয়া লও–আর রাত্রের মুখ দেখিবে না। নৌকা কোথায় যাইতেছে বল দেখি?”
হরবল্লভের কথা কহিবার শক্তি নাই।
নিশি বলিতে লাগিল, “ডাকিনীর শ্মশান বলিয়া প্রকাণ্ড শ্মশান আছে। আমরা যাদের প্রাণে মারি, তাদের সেইখানে লইয়া গিয়া মারি। বজরা এখন সেইখানে যাইতেছে। সেইখানে পৌঁছিলে সাহেব ফাঁসি যাইবে, রাণীজির হুকুম হইয়া গিয়াছে। আর তোমায় কি হুকুম করিয়াছে, জান?”
হরবল্লভ কাঁদিতে লাগিল–জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমায় রক্ষা কর।”
নিশি বলিল, “তোমায় রক্ষা করিবে, এমন পাষণ্ড পামর কে আছে? তোমায় শূলে দিবার হুকুম হইয়াছে।”
হরবল্লভ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ঝড়ের শব্দ বড় প্রবল; সে কান্নার শব্দ ব্রজেশ্বর শুনিতে পাইল না–দেবীও না। সাহেব শুনিল। সাহেব কথাগুলা শুনিতে পায় নাই–কান্না শুনিতে পাইল। সাহেব ধমকাইল, “রোও মৎ-উল্লুক মর্নাি এক রোজ আল্বৎ হ্যায়।”