দূর হইতে লড়াই হইলে সিপাহীর কাছে লাঠিয়ালেরা অধিকক্ষণ টিকিত না–কেন না, দূরে লাঠি চলে না। কিন্তু ছিপের উপর থাকিতে হওয়ায় সিপাহীদের বড় অসুবিধা হইল। যাহারা তীরে উঠিয়া যুদ্ধ করিতেছিল, সে সিপাহীরা লাঠিয়ালদিগকে সঙ্গীনের মুখে হটাইতে লাগিল, কিন্তু যাহারা জল লড়াই করিতেছিল, তাহারা বরকন্দাজদিগের লাঠি-সড়কিতে হাত পা বা মাথা ভাঙ্গিয়া কাবু হইতে লাগিল।
প্রফুল্ল নীচে আসিবার অল্পমাত্র পরেই এই ব্যাপার আরম্ভ হইল। প্রফুল্ল মনে করিল, “হয় ভবানী ঠাকুরের কাছে আমার কথা পৌঁছে নাই–নয় তিনি আমার কথা রাখিলেন না; মনে করিয়াছেন, আমি মরিতে পারিব না। ভাল, আমার কাজটাই তিনি দেখুন।”
দেবীর রাণীগিরিতে গুটিকতক চমৎকার গুণ জন্মিয়াছিল। তার একটি এই যে, যে সামগ্রীর কোন প্রকার প্রয়োজন হইতে পারে, তাহা আগে গুছাইয়া হাতের কাছে রাখিতেন। এ গুণের পরিচয় অনেক পাওয়া গিয়াছে। দেবী এখন হাতের কাছেই পাইলেন–একটা সাদা নিশান। সাদা নিশানটি বাহিরে লইয়া গিয়া স্বহস্তে উঁচু করিয়া ধরিলেন।
সেই নিশান দেখিবামাত্র লড়াই একেবারে বন্ধ হইল। যে যেখানে ছিল, সে সেইখানেই হাতিয়ার ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ঝড় তুফান যেন হঠাৎ থামিয়া গেল, প্রমত্ত সাগর যেন অকস্মাৎ প্রশান্ত হ্রদে পরিণত হইল।
দেবী দেখিল, পাশে ব্রজেশ্বর। এই যুদ্ধের সময়ে দেবীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া, ব্রজেশ্বরও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। দেবী তাঁহাকে বলিল, “তুমি এই নিশান এইরূপ ধরিয়া থাক। আমি ভিতরে গিয়া নিশি ও দিবার সঙ্গে একটা পরামর্শ আঁটিব। রঙ্গরাজ যদি এখানে আসে, তাহাকে বলিও, সে দরওয়াজা হইতে আমার হুকুম লয়।”
এই বলিয়া দেবী ব্রজেশ্বরের হাতে নিশান দিয়া চলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর নিশান তুলিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইতিমধ্যে সেখানে রঙ্গরাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। রঙ্গরাজ ব্রজেশ্বরের হাতে সাদা নিশান দেখিয়া, চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “তুমি কার হুকুমে সাদা নিশান দেখাইলে?”
ব্র। রাণীজির হুকুম।
র। রাণীজির হুকুম? তুমি কে?
ব্র। চিনিতে পার না?
রঙ্গরাজ একটু নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “চিনিয়াছি। তুমি ব্রজেশ্বরবাবু? এখানে কি মনে করে? বাপ-বেটায় এক কাজে না কি? কেহ একে বাঁধ।”
রঙ্গরাজের ধারণা হইল যে, হরবল্লভের ন্যায় দেবীকে ধরাইয়া দিবার জন্যই ব্রজেশ্বর কোন ছলে বজরায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার আজ্ঞা পাইয়া দুই জন ব্রজেশ্বরকে বাঁধিতে আসিল। ব্রজেশ্বর কোন আপত্তি করিলেন না, বলিলেন, “আমায় বাঁধ, তাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু একটা কথা বুঝাইয়া দাও। সাদা নিশান দেখিয়াই দুই দলে যুদ্ধ বন্ধ করিল কেন?”
রঙ্গরাজ বলিল, “কচি খোকা আর কি? জান না, সাদা নিশান দেখাইলে ইংরেজের আর যুদ্ধ করিতে নাই?”
ব্র। তা আমি জানিতাম না। তা আমি জানিয়াই করি, আর না জানিয়াই করি, রাণীজির হুকুম মত সাদা নিশান দেখাইয়াছি কি না, তুমি না হয় জিজ্ঞাসা করিয়া আইস। আর তোমায়ও আজ্ঞা আছে যে, তুমি দরওয়াজা হইতে রাণীজির হুকুম লইবে।
রঙ্গরাজ বরাবর কামরার দরজায় গেল। কামরার দরজা বন্ধ আছে দেখিয়া বাহির হইতে ডাকিল, “রাণী মা!”
ভিতর হইতে উত্তর, “কে, রঙ্গরাজ?”
র। আজ্ঞা হাঁ–একটা সাদা নিশান আমাদের বজরা হইতে দেখান হইয়াছে–লড়াই সেই জন্য বন্ধ আছে।
ভিতর হইতে–“সে আমার হুকুম মত হইয়াছে। এখন তুমি ঐ সাদা নিশান লইয়া লেফটেনান্ট সাহেবের কাছে যাও। গিয়া বল যে, লড়াইয়ে প্রয়োজন নাই, আমি ধরা দিব।”
র। আমার শরীর থাকিতে তাহা কিছুতেই হইবে না।
দেবী। শরীরপাত করিয়াও আমায় রক্ষা করিতে পারিবে না।
র। তথাপি শরীরপাত করিব।
দেবী। শোন, মূর্খের মত গোল করিও না। তোমরা প্রাণ দিয়া আমায় বাঁচাইতে পারিবে না–এ সিপাহীর বন্দুকের কাছে লাঠি সোঁটা কি করিবে?
র। কি না করিবে?
দেবী। যাই করুক–আর এক বিন্দু রক্তপাত হইবার আগে আমি প্রাণ দিব,-বাহিরে গিয়া গুলির মুখে দাঁড়াইব–রাখিতে পারিবে না। বরং এখন আমি ধরা দিলে, পলাইবার ভরসা রহিল। বরং এক্ষণে আপন আপন প্রাণ রাখিয়া সুবিধা মত যাহাতে আমি বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারি, সে চেষ্টা করিও। আমার অনেক টাকা আছে। কোম্পানির লোক সকল অর্থের বশ–আমার পলাইবার ভাবনা কি?
দেবী মুহূর্ত জন্যও মনে করেন নাই যে, ঘুষ দিয়া তিনি পলাইবেন। সে রকম পলাইবার ইচ্ছাও ছিল না। এ কেবল রঙ্গরাজকে ভুলাইতেছিলেন। তাঁর মনের ভিতর যে গভীর কৌশল উদ্ভাবিত হইয়াছিল, রঙ্গরাজের বুঝিবার সাধ্য ছিল না–সুতরাং রঙ্গরাজকে তাহা বুঝাইলেন না। সরলভাবে ইংরেজকে ধরা দিবেন, ইহা স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাও বুঝিয়াছিলেন যে, ইংরেজ আপনার বুদ্ধিতে সব খোয়াইবে। ইহাও স্থির করিয়াছিলেন যে, শত্রুর অনিষ্ট করিবেন না, বরং শত্রুকে সতর্ক করিয়া দিবেন। তবে স্বামী, শ্বশুর, সখীদিগের উদ্ধারের জন্য যাহা অবশ্য কর্তব্য, তাহাও করিবেন; যাহা যাহা হইবে, দেবী যেন দর্পণের ভিতর সকল দেখিতে পাইতেছিলেন।
রঙ্গরাজ বলিল, “যাহা দিয়া কোম্পানীর লোক বশ করিবেন, তাহা ত বজরাতেই আছে। আপনি ধরা দিলে, ইংরেজ বজরাও লইবে।”
দেবী। সেইটি নিষেধ করিও। বলিও যে, আমি ধরা দিব, কিন্তু বজরা দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহার কিছুই দিব না; বজরায় যাহা আছে, তাহাদের কাহাকেও তিনি ধরিতে পারিবেন না। এই নিয়মে আমি ধরা দিতে রাজি।