প্র। আমার শ্বশুর কি বলিবেন?
ব্র। আমার বাপের সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করিব।
প্র। হায়! এ কথা কাল শুনি নাই কেন?
ব্র। কাল শুনিলে কি হইত?
প্র। তাহা হইলে কার সাধ্য আজ আমায় ধরে?
ব্র। এখন?
প্র। এখন আর উপায় নাই। তোমার পান্সি ডাক–নিশি ও দিবাকে লইয়া শীঘ্র যাও।
ব্রজেশ্বর আপনার পান্সি ডাকিল। পান্সিওয়ালা নিকটে আসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “তোরা শীঘ্র পলা, ঐ কোম্পানির সিপাহীর ছিপ আসিতেছে; তোদের দেখিলে উহারা বেগার ধরিবে। শীঘ্র পলা, আমি যাইব না, এইখানে থাকিব।”
পান্সির মাঝি মহাশয়, আর দ্বিরুক্তি না করিয়া, তৎক্ষণাৎ পান্সি খুলিয়া প্রস্থান করিলেন। ব্রজেশ্বর চেনা লোক, টাকার ভাবনা নাই।
পান্সি চলিয়া গেল দেখিয়া প্রফুল্ল বলিল, “তুমি গেলে না?”
ব্র। কেন, তুমি মরিতে জান, আমি জানি না? তুমি আমার স্ত্রী–আমি তোমায় শত বার ত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু আমি তোমার স্বামী–বিপদে আমিই ধর্মতঃ তোমার রক্ষাকর্তা। আমি রক্ষা করিতে পারি না–তাই বলিয়া কি বিপদ্কা লে তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব?
“তবে কাজেই আমি স্বীকার করিলাম, প্রাণরক্ষার যদি কোন উপায় হয়, তা আমি করিব।” এই বলিতে বলিতে প্রফুল্ল আকাশপ্রান্তে দৃষ্টিপাত করিল। যাহা দেখিল, তাহাতে যেন কিছু ভরসা হইল। আবার তখনই নির্ভরসা হইয়া বলিল, “কিন্তু আমার প্রাণ-রক্ষায় আর এক অমঙ্গল আছে।”
ব্র। কি?
প্র। এ কথা তোমায় বলিব না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন আর না বলিলে নয়। এই সিপাহীদের সঙ্গে আমার শ্বশুর আছেন। আমি ধরা না পড়িলে তাঁর বিপদ ঘটিলেও ঘটিতে পারে।
ব্রজেশ্বর শিহরিল–মাথায় করাঘাত করিল। বলিল, “তিনিই কি গোইন্দা?”
প্রফুল্ল চুপ করিয়া রহিল। ব্রজেশ্বরের বুঝিতে কিছু বাকি রহিল না। এখানে আজিকার রাত্রে যে দেবী চৌধুরাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে, এ কথা হরবল্লভ ব্রজেশ্বরের কাছে শুনিয়াছিলেন। ব্রজেশ্বর আর কাহারও কাছে এ কথা বলেন নাই; দেবীরও যে গূঢ় মন্ত্রণা, আর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা নাই। বিশেষ দেবী এ ঘাটে আসিবার আগেই কোম্পানীর সিপাহী রঙ্গপুর হইতে যাত্রা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই; নহিলে ইহারই মধ্যে পৌঁছিত না। আর ইতিপূর্বেই হরবল্লভ কোথায় যাইতেছেন, কাহারও কাছে প্রকাশ না করিয়া দূরযাত্রা করিয়াছেন, আজও ফেরেন নাই। কথাটা বুঝিতে দেরী হইল না। তাই হরবল্লভ টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ করেন নাই। তথাপি ব্রজেশ্বর ভুলিলেন না যে,
“পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতার প্রীতিমাপন্নে পীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”
ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে বলিলেন, “আমি মরি কোন ক্ষতি নাই। তুমি মরিলে, আমার মরার অধিক হইবে, কিন্তু আমি দেখিতে আসিব না। তোমার আত্মরক্ষার আগে, আমার ছার প্রাণ রাখিবার আগে, আমার পিতাকে রক্ষা করিতে হইবে।”
প্র। সে জন্য চিন্তা নাই। আমার রক্ষা হইবে না, অতএব তাঁর কোন ভয় নাই। তিনি তোমায় রক্ষা করিলে করিতে পারিবেন। তবে ইহাও তোমার মনস্তুষ্টির জন্য আমি স্বীকার করিতেছি যে, তাঁর অমঙ্গল সম্ভাবনা থাকিতে, আমি আত্মরক্ষার কোন উপায় করিব না। তুমি বলিলেও করিতাম না, না বলিলেও করিতাম না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকিও।
এই কথা দেবী আন্তরিক বলিয়াছিল। হরবল্লভ প্রফুল্লের সর্বনাশ করিয়াছিল, হরবল্লভ এখন দেবীর সর্বনাশ করিতে নিযুক্ত। তবু দেবী তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী। কেন না, প্রফুল্ল নিষ্কাম। যার ধর্ম নিষ্কাম, সে কার মঙ্গল খুঁজিলাম, তত্ত্ব রাখে না। মঙ্গল হইলেই হইল।
কিন্তু এ সময়ে তীরবর্তী অরণ্যমধ্য হইতে গভীর তূর্যধ্বনি হইল। দুই জনেই চমকিয়া উঠিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
দেবী ডাকিল, “নিশি!”
নিশি ছাদের উপর আসিল।
দেবী। কার ভেরী ঐ?
নি। যেন দাড়ি বাবাজীর বলিয়া বোধ হয়।
দেবী। রঙ্গরাজের?
নি। সেই রকম।
দেবী। সে কি? আমি রঙ্গরাজকে প্রাতে দেবীগড় পাঠাইয়াছি।
নি। বোধ হয়, পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে।
দেবী। রঙ্গরাজকে ডাক।
ব্রজেশ্বর বলিল, “ভেরীর আওয়াজ অনেক দূর হইতে হইয়াছে। এখান হইতে ডাকিলে ডাক শুনিতে পাইবে না। আমি নামিয়া ভেরীওয়ালাকে খুঁজিয়া আনিতেছি।”
দেবী বলিল, “কিছু করিতে হইবে না। তুমি একটু নীচে গিয়া নিশির কৌশল দেখ।”
নিশি ও ব্রজ নীচে আসিল। নিশি নীচে গিয়া এ বাঁশী বাহির করিল। নিশি গীত বাদ্যে বড় পটু, সে শিক্ষা রাজবাড়ীতে হইয়াছিল। নিশিই দেবীর বীণার ওস্তাদ। নিশি বাঁশীতে ফুঁ দিয়া মল্লারে তান মারিল। অনতিবিলম্বে রঙ্গরাজ বজরায় আসিয়া উঠিয়া দেবীকে আশীর্বাদ করিল।
এই সময়ে ব্রজেশ্বর নিশিকে বলিল, “তুমি ছাদে যাও। তোমার কাছে কেহ বোধ হয়, কথা লুকাইবে না। কি কথা হয়, শুনিয়া আসিয়া আমাকে সব বলিও।”
নিশি স্বীকৃত হইয়া কামরার বাহির হইল–বাহির হইয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “আপনি একটু বাহিরে আসিয়া দেখুন।”
ব্রজেশ্বর মুখ বাড়াইয়া দেখিল। দেখিতে পাইল, জঙ্গলের ভিতর হইতে অগণিত মনুষ্য বাহির হইতেছে। নিশিকে জিজ্ঞাসা করিল, “উহারা কারা? সিপাই?”
নিশি বলিল, “বোধ হয় উহারা বরকউন্দাজ। রঙ্গরাজ আনিয়া থাকিবে।”
দেবীও সেই মনুষ্যশ্রেণী দেখিতেছিল, এমন সময়ে রঙ্গরাজ আসিয়া আশীর্বাদ করিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখানে কেন রঙ্গরাজ?”
রঙ্গরাজ প্রথমে কোন উত্তর করিল না। দেবী পুনরপি বলিল, “আমি সকালে তোমাকে দেবীগড় পাঠাইয়াছিলাম। সেখানে যাও নাই কেন? আমার কথা অমান্য করিয়াছ কেন?”