তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কি করিলাম! এ কি প্রফুল্ল? সে যে দশ বৎসর মরিয়াছে! ব্রজেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিয়া একেবার ছিপে গিয়ে উঠিল। সাগরকে সঙ্গে লইয়াও গেল না। সাগর “ধর! ধর! আসামী পলায়!” বলিয়া, পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া ছিপে উঠিল। ছিপ খুলিয়া ব্রজেশ্বরকে ও ব্রজেশ্বরের দুই রত্নাধার–একটি সাগর আর একটি কলসী–ব্রজেশ্বরের নৌকায় পৌঁছাইয়া দিল।
এদিকে নিশি আসিয়া দেবীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দেবী নৌকার তক্তার উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতেছে। নিশি তাহাকে উঠাইয়া বসাইল–চোখের জল মুছাইয়া দিল– সুস্থির করিল। তখন নিশি বলিল, “এই কি মা, তোমার নিষ্কাম ধর্ম? এই কি সন্ন্যাস? ভগবদ্বাক্য কোথায় মা, এখন?”
দেবী চুপ করিয়া রহিল। নিশি বলিল, “ও সকল ব্রত মেয়েমানুষের নহে। যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মত হইতে হইবে। আমাকে কাঁদাইবার জন্য ব্রজেশ্বর নাই। আমার ব্রজেশ্বর বৈকুণ্ঠেশ্বর একই।”
দেবী চক্ষু মুছিয়া বলিল, “তুমি যমের বাড়ী যাও।”
নি। আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমার উপর যমের অধিকার নাই। তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।
দেবী। সে পথ খোলা থাকিলে আমি এ পথে আসিতাম না। এখন বজরা খুলিয়া দিতে। চার পাল উঠাও।
তখন সেই জাহাজের মত বজরা চারিখান তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল।
নবম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর আপনার নৌকায় আসিয়া গম্ভীর হইয়া বসিল। সাগরের সঙ্গে কথা কহে না। দেখিল, দেবীর বজরা পাল তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল। তখন ব্রজেশ্বর সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বজরা কোথায় গেল?”
সাগর বলিল, “তা দেবী ভিন্ন আর কেহ জানে না। সে সকল কথা দেবী আর কাহাকেও বলে না।”
ব্র। দেবী কে?
সা। দেবী দেবী।
ব্র। তোমার কে হয়?
সা। ভগিনী।
ব্র। কি রকম ভগিনী?
সা। জ্ঞাতি।
ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। মাঝিদিগকে ডাকিয়া বলিল, “তোমরা বড় বজরার সঙ্গে যাইতে পার?” মাঝিরা বলিল, “সাধ্য কি! ও নক্ষত্রের মত ছুটিয়াছে।” ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। সাগর ঘুমাইয়া পড়িল।
প্রভাত হইল, ব্রজেশ্বর বজরা খুলিয়া চলিল।
সূর্যোদয় হইলে সাগর আসিয়া ব্রজেশ্বরের কাছে বসিল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী কি ডাকাতি করে?”
সা। তোমার কি বোধ হয়?
ব্র। ডাকাতির সমান ত সব দেখিলাম–ডাকাতি করিলে করিতে পারে, তাও দেখিলাম। তবু বিশ্বাস হয় না যে, ডাকাতি করে।
সা। তবু কেন বিশ্বাস হয় না?
ব্র। কে জানে। ডাকাতি না করিলেই বা এত ধন কোথায় পাইল?
সা। কেহ বলে, দেবী দেবতার বরে এত ধন পাইয়াছে; কেহ বলে, মাটির ভিতর পোঁতা টাকা পাইয়াছে; কেহ বলে, দেবী সোণা করিতে জানে।
ব্র। দেবী কি বলে?
সা। দেবী বলে, এক কড়াও আমার নয়, সব পরের।
ব্র। পরের ধন এত পাইল কোথায়?
সা। তা কি জানি।
ব্র। পরের ধন হলে অত আমিরি করে? পরে কিছু বলে না?
সা। দেবী কিছু আমিরি করে না। খুদ খায়, মাটিতে শোয়, গড়া পরে। কাল যা দেখলে, সে সকল তোমার আমার জন্য মাত্র, –কেবল দোকানদারি। তোমার হাতে ও কি?
সাগর ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে নূতন আঙ্গটি দেখিল।
ব্রজেশ্বর বলিল, “কাল দেবীর নৌকায় জলযোগ করিয়াছিলাম বলিয়া দেবী আমাকে এই আঙ্গটি মর্যাদা দিয়াছে।”
সা। দেখি।
ব্রজেশ্বর আঙ্গটি খুলিয়া দেখিতে দিল। সাগর হাতে লইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিল। বলিল, “ইহাতে দেবী চৌধুরাণীর নাম লেখা আছে।”
ব্র। কই?
সা। ভিতরে–ফারসীতে।
ব্র। (পড়িয়া) এ কি এ? এ যে আমার নাম–আমার আঙ্গটি? সাগর! তোমাকে আমার দিব্য, যদি তুমি আমার কাছে সত্য কথা কও না কও। আমায় বল, দেবী কে?
সা। তুমি চিনিতে পার নাই, সে কি আমার দোষ? আমি ত এক দণ্ডে চিনিয়াছিলাম।
ব্র। কে! কে! দেবী কে?
সা। প্রফুল্ল।
আর ব্রজেশ্বর কথা কহিল না। সাগর দেখিল, প্রথমে ব্রজেশ্বরের শরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল, তার পর একটা অনির্বচনীয় আহ্লাদের চিহ্ন–উচ্ছলিত সুখের তরঙ্গ শরীরে দেখা দিল। মুখ প্রভাময়, নয়ন উজ্জ্বল অথচ জলপ্লাবিত, দেহ উন্নত, কান্তি স্ফূর্তিময়ী। তার পরই আবার সাগর দেখিল, সব যেন নিবিয়া গেল; বড় ঘোরতর বিষাদ আসিয়া যেন সেই প্রভাময় কান্তি অধিকার করিল। ব্রজেশ্বর বাক্যশূন্য, স্পন্দনহীন, নিমেষশূন্য। ক্রমে সাগরের মুখপানে চাহিয়া চাহিয়া ব্রজেশ্বর চক্ষু মুদিল। দেহ অবসন্ন হইল; ব্রজেশ্বর সাগরের কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল। সাগর কাতর হইয়া অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। কিছুই উত্তর পাইল না; একবার ব্রজেশ্বর বলিল, “প্রফুল্ল ডাকাত! ছি!”
দশম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর ও সাগরকে বিদায় দিয়া দেবী চৌধুরাণী–হায়! কোথায় গেল দেবী? কই সে বেশভূষা, ঢাকাই সাড়ি, সোণাদানা, হীরা মুক্তা পান্না–সব কোথায় গেল? দেবী সব ছাড়িয়াছে–সব একেবারে অন্তর্ধান করিয়াছে। দেবী কেবল একখানা গড়া পরিয়াছে–হাতে কেবল এক গাছা কড়। দেবী নৌকার এক পাশে বজরার শুধু তক্তার উপর একখানা চট পাতিয়া শয়ন করিল। ঘুমাইল কি না, জানি না।
প্রভাতে বজরা বাঞ্ছিত স্থানে আসিয়া লাগিয়াছে দেখিয়া, দেবী নদীর জলে নামিয়া স্নান করিল। স্নান করিয়া ভিজা কাপড়েই রহিল–সেই চটের মত মোটা সাড়ি। কপাল ও বুক গঙ্গামৃত্তিকায় চর্চিত করিল–রুক্ষ, ভিজা চুল এলাইয়া দিল–তখন দেবীর যে সৌন্দর্য বাহির হইল, গত রাত্রির বেশভূষা, জাঁকজমক, হীরা মতি চাঁদনি বা রাণীগিরিতে তাহা দেখা যায় নাই। কাল দেবীকে রত্নাভরণে রাজরাণীর মত দেখাইয়াছিল–আজ গঙ্গামৃত্তিকার সজ্জায় দেবতার মত দেখাইতেছে। যে সুন্দর, সে মাটি ছাড়িয়া হীরা পরে কেন?