প্র। বাছা, তোমার মত গুণের লোক পাওয়া ভার।
গো-মা। তা মা, যা বল, তোমার আপনার গুণে বল।
প্রফুল্ল অপরাকে তখন বলিল, “তোমার নাম কি গা?”
নবাগতা সুন্দরী বলিল, “তা ভাই, জানি না।”
প্রফুল্ল হাসিয়া বলিল, “সে কি বাপ-মায় কি নাম রাখে নাই?”
সুন্দরী বলিল, “রাখাই সম্ভব। কিন্তু আমি সবিশেষ অবগত নহি।”
প্র। সে কি গো?
সুন্দরী। জ্ঞান হইবার আগে হইতে আমি বাপ-মার কাছছাড়া। ছেলেবেলায় আমায় ছেলেধরায় চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছিল।
প্র। বটে। তা তারাও ত একটা নাম রেখেছিল?
সুন্দরী। নানা রকম।
প্র। কি কি?
সুন্দরী। পোড়ারমুখী, লক্ষ্মীছাড়ী, হতভাগী, চুলোমুখী।
এতক্ষণ গোবরার মা আবার কাণ হারাইয়াছিল। এই কয়টা সদাশ্রুত গুণবাচক শব্দে শ্রুতি জাগরিত হইল। সে বলিল, “যে আমায় পোড়ারমুখী বলে, সেই পোড়ারমুখী, যে আমায় চুলোমুখী বলে, সেই চুলোমুখী, যে আমায় আঁটকুড়ী বলে, সেই আঁটকুড়ী _”
সুন্দরী। (হাসিয়া) আঁটকুড়ী বলি নাই, বাছা!
গো-মা। তুই আঁটকুড়ী বলিলেও বলেছিস, না বলিলেও বলেছিস–কেন বলবিম লা?
প্রফুল্ল হাসিয়া বলিল, “তোমাকে বলচে, না গো–ও আমাকে বলচে।”
তখন নিশ্বাস ফেলিয়া গোব্করার মা বলিল, “ও কপাল! আমাকে না? তা বলুক মা, বলুক, তুমি রাগ করো না। ও বামনীর মুখটা বড় কদুয্যি। তা বাছা! রাগ কর্তেব নেই।” গোব্,রার মার মুখে এইরূপ আত্মপক্ষে বীররস ও পক্ষান্তরে শান্তিরসের অবতারণা শুনিয়া যুবতীদ্বয় প্রীতা হইলেন। প্রফুল্ল অপরাকে জিজ্ঞাসা করিলে, “বামনী? তা আমাকে এতক্ষণ বল নাই? আমার প্রণাম করা হয় নাই।” প্রফুল্ল প্রণাম করিল।
বয়স্যা আশীর্বাদ করিয়া বলিল, “আমি বামনের মেয়ে বটে–এইরূপ শুনিয়াছি–কিন্তু বামনী নই।”
প্র। সে কি?
বয়স্যা। বামন জোটে নাই।
প্র। বিবাহ হয় নাই? সে কি?
বয়স্যা। ছেলেধরায় কি বিয়ে দেয়?
প্র। চিরকাল তুমি ছেলেধরার ঘরে?
বয়স্যা। না, ছেলেধরায় এক রাজার বাড়ী বেচে এয়েছিল।
প্র। রাজারা বিয়ে দিল না?
বয়স্যা। রাজপুত্র ইচ্ছুক ছিলেন–কিন্তু বিবাহটা গান্ধর্বমত।
প্র। নিজে পাত্র বুঝি?
বয়স্কা। তাও কয় দিনের জন্য বলিতে পারি না।
প্র। তার পর?
বয়স্যা। রকম দেখিয়া পলায়ন করিলাম।
প্র। তার পর?
বয়স্যা। রাজমহিষী কিছু গহনা দিয়াছিলেন, গহনা সমেত পলাইয়াছিলাম। সুতরাং ডাকাইতের হাতে পড়িলাম। সে ডাকাইতের দলপতি ভবানী ঠাকুর, তিনি আমার কাহিনী শুনিয়া আমার গহনা লইলেন না, বরং আরও কিছু দিলেন। আপনার গৃহে আমায় আশ্রয় দিলেন। আমি তাঁহার কন্যা, তিনি আমার পিতা। তিনিও আমাকে এক প্রকার সম্প্রদান করিয়াছেন।
প্র। এক প্রকার কি?
বয়স্যা। সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণে।
প্র। সে কি রকম?
বয়স্যা। রূপ, যৌবন, প্রাণ।
প্র। তিনিই তোমার স্বামী?
বয়স্যা। হাঁ–কেন না, যিনি সম্পূর্ণরূপে আমার অধিকারী, তিনিই আমার স্বামী।
প্রফুল্ল দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “বলিতে পারি না। কখন স্বামী দেখ নাই, তাই বলিতেছ–স্বামী দেখিলে কখন শ্রীকৃষ্ণে মন উঠিত না।”
মূর্খ ব্রজেশ্বর এত জানিত না।
বয়স্যা বলিল, “শ্রীকৃষ্ণে সকল মেয়েরই মন উঠিতে পারে; কেন না, তাঁর রূপ অনন্ত, যৌবন অনন্ত, ঐশ্বর্য অনন্ত, গুণ অনন্ত।”
এ যুবতী ভবানী ঠাকুরের চেলা, কিন্তু প্রফুল্ল নিরক্ষর–এ কথার উত্তর দিতে পারিল না। হিন্দুধর্মপ্রণেতারা উত্তর জানিতেন। ঈশ্বর অনন্ত জানি। কিন্তু অনন্তকে হৃদয়পিঞ্জরে পুরিতে পারি না। সান্তকে পারি। তাই অনন্ত জগদীশ্বর, হিন্দুর হৃৎপিঞ্জরে সান্ত শ্রীকৃষ্ণ! স্বামী আরও পরিষ্কাররূপে সান্ত। এই জন্য প্রেম পবিত্র হইলে, স্বামী ঈশ্বরে আরোহণের প্রথম সোপান। তাই হিন্দুর মেয়ের পতিই দেবতা। অন্য সব সমাজ, হিন্দুসমাজের কাছে এ অংশে নিকৃষ্ট।
প্রফুল্ল মূর্খ মেয়ে, কিছু বুঝিতে পারিল না। বলিল, “আমি অত কথা ভাই, বুঝিতে পারি না। তোমার নামটি কি, এখনও ত বলিলে না?”
বয়স্যা বলিল, “ভবানী ঠাকুর নাম রাখিয়াছেন নিশি, আমি দিবার বহিন নিশি। দিবাকে এক দিন আলাপ করিতে লইয়া আসিব। কিন্তু যা বলিতেছিলাম, শোন। ঈশ্বরই পরমস্বামী। স্ত্রীলোকের পতিই দেবতা, শ্রীকৃষ্ণ সকলের দেবতা। দুটো দেবতা কেন, ভাই? দুই ঈশ্বর? এ ক্ষুদ্র প্রাণের ক্ষুদ্র ভক্তিটুকুকে দুই ভাগ করিলে কতটুকু থাকে?”
প্র। দূর! মেয়েমানুষের ভক্তির কি শেষ আছে?
নিশি। মেয়েমানুষের ভালবাসার শেষ নাই। ভক্তি এক, ভালবাসা আর।
প্র। আমি তা আজও জানিতে পারি নাই। আমার দুই নূতন।
প্রফুল্লের চক্ষু দিয়া ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। নিশি বলিল, “বুঝিয়াছি বোন্–তুমি অনেক দুঃখ পাইয়াছ।” তখন নিশি প্রফুল্লের গলা জড়াইয়া ধরিয়া তার চক্ষের জল মুছাইল। বলিল, “এত জানিতাম না।” নিশি তখন বুঝিল, ঈশ্বর-ভক্তির প্রথম সোপান পতি-ভক্তি।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
যে রাত্রে দুর্লভ চক্রবর্ত্তী প্রফুল্লকে তাহার মাতার বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া যায়, দৈবগতিকে ব্রজেশ্বর সেই রাত্রেই প্রফুল্লর বাসস্থানে দুর্গাপুরে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ব্রজেশ্বরের একটি ঘোড়া ছিল, ঘোড়ায় চড়িতে ব্রজেশ্বর খুব মজ্বুাত। যখন বাড়ীর সকলে ঘুমাইল, ব্রজেশ্বর গোপনে সেই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া অন্ধকারে দুর্গাপুরে প্রস্থান করিলেন। যখন তিনি প্রফুল্লের কুটীরে উপস্থিত হইলেন, তখন সে ভবন জনশূন্য, অন্ধকারময়। প্রফুল্লকে দস্যুতে লইয়া গিয়াছে। সেই রাত্রে ব্রজেশ্বর পাড়াপড়শী কাহাকেও পাইলেন না যে, জিজ্ঞাসা করেন।