প্র। তার পর কি?
ভ। নরকের পথ সাফ। লালসা আছে, কিন্তু লালসাপরিতৃপ্তির উপায় নাই–সেই নরকের পরিষ্কার পথ। পুণ্য সঞ্চয় করিবে?
প্র। বাবা! আমি গৃহস্থের মেয়ে, কখনও পাপ জানি না। আমি কেন পাপের পথে যাইব? আমি বড় কাঙ্গাল–আমার অন্নবস্ত্র জুটিলেই ঢের, আমি ধন চাই না–দিনপাত হইলেই হইল। এ ধন তুমি সব নাও–আমি নিষ্পাপে যাতে এক মুটো অন্ন পাই তাই ব্যবস্থা করিয়া দাও।
ভবানী মনে মনে প্রফুল্লকে ধন্যবাদ করিল। প্রকাশ্যে বলিল, “ধন তোমার। আমি লইব না।”
প্রফুল্ল বিস্মিত হইল। মনের ভাব বুঝিয়া ভবানী বলিল, “তুমি ভাবিতেছ, ডাকাইতি করে, পরের ধন কাড়িয়া খায়, আবার এ রকম ভাণ করে কেন? সে কথা তোমায় এখন বলিবার প্রয়োজন নাই। তবে তুমি যদি পাপাচরণে প্রবৃত্ত হও, তবে তোমার এ ধন লুঠ করিয়া লইলেও লইতে পারি। এখন এ ধন লইব না। তোমার আবার জিজ্ঞাসা করিতেছি–এ ধন লইয়া তুমি কি করিবে?”
প্র। আপনি দেখিতেছি জ্ঞানী, আপনি আমায় শিখাইয়া দিন, ধন লইয়া কি করিব।
ভ। শিখাইতে পাঁচ সাত বৎসর লাগিবে। যদি শেখ, আমি শিখাইতে পারি। এই পাঁচ সাত বৎসর তুমি ধন স্পর্শ করিবে না। তোমার ভরণপোষণের কোন কষ্ট হইবে না। তোমার খাইবার পরিবার জন্য যাহা যাহা আবশ্যক, তাহা আমি পাঠাইয়া দিব। কিন্তু আমি যাহা বলিব, তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া মানিতে হইবে। কেমন, স্বীকৃত আছ?
প্র। বাস করিব কোথায়?
ভ। এইখানে। ভাঙ্গাচোরা একটু একটু মেরামত করিয়া দিব।
প্র। এইখানে একা বাস করিব?
ভ। না, আমি দুই জন স্ত্রীলোক পাঠাইয়া দিব। তাহারা তোমার কাছে থাকিবে। কোন ভয় করিও না। এ বনে আমি কর্তা। আমি থাকিতে তোমার কোন অনিষ্ট ঘটিবে না। প্র। আপনি কিরূপে শিখাইবেন?
ভ। তুমি লিখিতে-পড়িতে জান?
প্র। না।
ভ। তবে প্রথমে লেখাপড়া শিখাইব।
প্রফুল্ল স্বীকৃত হইল। এ অরণ্যমধ্যে একজন সহায় পাইয়া সে আহ্লাদিত হইল। ভবানী ঠাকুর বিদায় হইয়া সেই ভগ্ন অট্টালিকার বাহিরে আসিয়া দেখিলেন এক ব্যক্তি তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহার বলিষ্ঠ গঠন, চৌগোঁপ্পা ও ছাঁটা গালপাট্টা আছে। ভবানী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঙ্গরাজ! এখানে কেন?”
রঙ্গরাজ বলিল, “আপনার সন্ধানে। আপনি এখানে কেন?”
ভ। যা এত দিন সন্ধান করিতেছিলাম, তাহা পাইয়াছি।
র। রাজা?
ভ। রাণী।
র। রাজা রাণী আর খুঁজিতে হইবে না। ইংরেজ রাজা হইতেছে। কলিকাতায় না কি হষ্টিন* বলিয়া একজন ইংরেজ ভাল রাজ্য ফাঁদিয়াছে।
ভ। আমি সেরকম রাজা খুঁজি না। আমি খুঁজি যা, তা ত তুমি জান।
র। এখন পাইয়াছেন কি?
ভ। সে সামগ্রী পাইবার নয়, তৈয়ার করিয়া লইতে হইবে। জগদীশ্বর লোহা সৃষ্টি করেন, মানুষে কাটারি গড়িয়া লয়। ইস্পাত ভাল পাইয়াছি; এখন পাঁচ সাত বৎসর ধরিয়া গড়িতে শাণিতে হইবে। দেখিও, এই বাড়ীতে আমি ভিন্ন আর কোন পুরুষমানুষ না প্রবেশ করিতে পায়। মেয়েটি যুবতী এবং সুন্দরী।
র। যে আজ্ঞা। সম্প্রতি ইজারাদারের লোক রঞ্জনপুর লুঠিয়াছে। তাই আপনাকে খুঁজিতেছি।
ভ। চল, তবে আমরা ইজারাদারের কাছারি লুঠিয়া, গ্রামের লোকের ধন গ্রামের লোককে দিয়া আসি। গ্রামের লোক আনুকূল্য করিবে?
র। বোধ হয় করিতে পারে।
—————–
*Warren Hastings
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ভবানী ঠাকুর অঙ্গীকার মত দুই জন স্ত্রীলোক পাঠাইয়া দিলেন। একজন হাটে ঘাটে যাইবে, আর একজন প্রফুল্লের কাছে অনুক্ষণ থাকিবে। দুই জন দুই রকমের। যে হাটে ঘাটে যাইবে, তাহার নাম গোবরার মা, বয়স তিয়াত্তর বছর, কালো আর কালা। যদি একেবারে কাণে না শুনিত, ক্ষতি ছিল না, কোন মতে ইসারা ইঙ্গিতে চলিত; কিন্তু এ তা নয়। কোন কোন কথা কখন কখন শুনিতে পায়, কখন কোন কথা শুনিতে পায় না। এ রকম হইলে বড় গণ্ডগোল বাধে।
যে কাছে থাকিবার জন্য আসিয়াছিল, সে সম্পূর্ণরূপে ভিন্নপ্রকৃতির স্ত্রীলোক। বয়সে প্রফুল্লের অপেক্ষা পাঁচ সাত বৎসরের বড় হইবে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ–বর্ষাকালে কচি পাতার মত রঙ। রূপ উছলিয়া পড়িতেছে।
দুই জনে একত্র আসিল–যেন পূর্ণিমা অমাবস্যার হাত ধরিয়াছে। গোবরার মা প্রফুল্লকে প্রণাম করিল। প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কি গা?”
গোবরার মা শুনিতে পাইল না; অপরা বলিল, “ও একটু কালা–ওকে সবাই গোবরার মা বলে।”
প্র। গোবরার মা! তোমার কয়টি ছেলে গা?
গোবরার মা। আমি ছিলেম কোথায়? বাড়ীতে ছিলেম।
প্র। তুমি কি জেতের মেয়ে?
গোবরার মা। যেতে আসতো খুব পারব। যেখানে বলিবে, সেইখানেই যাব।
প্র। বলি, তুমি কি লোক?
গো-মা। আর তোমার লোকে কাজ কি মা! আমি একাই তোমার সব কাজ করে দেব। কেবল দুই একটা কাজ পারব না।
প্র। পারব না, কি?
গোবরার মার কাণ ফুটিল। বলিব, “পারব না, কি? এই জল তুলতেখ পারব না। আমার কাঁকালে জোর নাই। আর কাপড়-চোপড় কাচা–তা না হয় মা, তুমিই করো।”
প্র। আর সব পারব ত?
গো-মা। বাসনটাসনগুলো মাজা–তাও না হয় তুমি আপনিই করলে।
প্র। তাও পারব না; তবে পারব কি?
গো-মা। আর এমন কিছু না–এই ঘর ঝেঁটোন, ঘর নিকোন, এটাও বড় পারি নে।
প্র। পারব কি?
গো-মা। আর যা বল। সলতেব পাকাব, জল গড়িয়ে দেব, আমার এঁটো পাতা ফেলবোব,- আর আসল কাজ যা যা, তা করব–হাট করব।
প্র। বেসাতির হিসাবটা দিতে পারবে?
গো-মা। তা মা, আমি বুড়ো মানুষ, হালা কালা, আমি কি অত পারি! তবে কড়িপাতি যা দেবে, তা সব খরচ করে আসব–তুমি বলতেষ পাবে না যে, আমার এই খরচটা হলো না।