অষ্টম পরিচ্ছেদ : বিমলার মন্ত্রণা
বিমলা অভিরাম স্বামীর কুটীরমধ্যে দণ্ডায়মান আছেন। অভিরাম স্বামী ভূমির উপর যোগাসনে বসিয়াছেন। জগৎসিংহের সহিত যে প্রকারে বিমলা ও তিলোত্তমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, বিমলা তাহা আদ্যোপান্ত অভিরাম স্বামীর নিকট বর্ণন করিতেছিলেন; বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কহিলেন, “আজ চতুর্দশ দিবস; কাল পক্ষ পূর্ণ হইবেক।” অভিরাম স্বামী কহিলেন, “এক্ষণে কি স্থির করিয়াছ?”
বিমলা উত্তর করিলেন, “উচিত পরামর্শ জন্যই আপনার কাছে আসিয়াছি।”
স্বামী কহিলেন, “উত্তম, আমার পরামর্শ এই যে, এ বিষয় আর মনে স্থান দিও না।”
বিমলা অতি বিষণ্ণ বদনে নীরব হইয়া রহিলেন। অভিরাম স্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিষণ্ণ হইলে কেন?”
বিমলা কহিলেন, “তিলোত্তমার কি উপায় হইবে?”
অভিরাম স্বামী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন? তিলোত্তমার মনে কি অনুরাগ সঞ্চার হইয়াছে?”
বিমলা কিয়ৎকাল নীরবে থাকিয়া কহিলেন, “আপনাকে কত কহিব! আমি আজ চৌদ্দ দিন অহোরাত্র তিলোত্তমার ভাবগতিক বিলক্ষণ দেখিতেছি, আমার মনে এমন বোধ হইয়াছে যে, তিলোত্তমার মনোমধ্যে অতি প্রগাঢ় অনুরাগের সঞ্চার হইয়াছে।”
পরমহংস ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, “তোমরা স্ত্রীলোক; মনোমধ্যে অনুরাগের লক্ষণ দেখিলেই গাঢ় অনুরাগ বিবেচনা কর। বিমলে, তিলোত্তমার মনের সুখের জন্য চিন্তিত হইও না; বালিকা–স্বভাববশত:ই প্রথম দর্শনে মনশ্চাঞ্চল্য হইয়াছে; এ বিষয়ে কোন কথাবার্তা উত্থাপন না হইলেই শীঘ্র জগৎসিংহকে বিস্মৃত হইবে।”
বিমলা কহিল, “না, না, প্রভু, সে লক্ষণ নয়। পক্ষমধ্যে তিলোত্তমার স্বভাব পরিবর্তন হইয়াছে! তিলোত্তমা আমার সঙ্গে কি বয়স্যাদিগের সঙ্গে সেরূপ দিবারাত্রি হাসিয়া কথা কহে না; তিলোত্তমা আর প্রায় কথা কয় না; তিলোত্তমার পুস্তকসকল পালঙ্কের নীচে পড়িয়া পচিতেছে; তিলোত্তমার ফুলগাছসকল জলাভাবে শুষ্ক হইল; তিলোত্তমার পাখীগুলিতে আর সে যত্ন নাই; তিলোত্তমা নিজে আহার করে না; রাত্রে নিদ্রা যায় না; তিলোত্তমা বেশভূষা করে না; তিলোত্তমা কখন চিন্তা করে না, এক্ষণে দিবানিশি অন্যমনে থাকে। তিলোত্তমার মুখে কালিমা পড়িয়াছে।”
অভিরাম স্বামী শুনিয়া নিস্তব্ধ রহিলেন। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “আমার বোধ ছিল যে, দর্শনমাত্র গাঢ় অনুরাগ জন্মিতে পারে না; তবে স্ত্রীচরিত্র, বিশেষত: বালিকাচরিত্র, ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু কি করিবে? বীরেন্দ্র এ সম্বন্ধে সম্মত হইবে না|”
বিমলা কহিল, “আমি সেই আশঙ্কায় এ পর্যন্ত ইহার কোন উল্লেখ করি নাই, মন্দিরমধ্যেও জগৎসিংহকে পরিচয় দিই নাই। কিন্তু এক্ষণে যদি সিংহ মহাশয়”,–এই কথা বলিতে বিমলার মুখের কিঞ্চিৎ ভাবান্তর হইল–“এক্ষণে যদি সিংহ মহাশয় মানসিংহের সহিত মিত্রতা করিলেন, তবে জগৎসিংহকে জামাতা করিতে হানি কি?”
অ। মানসিংহই বা সম্মত হইবে কেন?
বি। না হয়, যুবরাজ স্বাধীন।
অ। জগৎসিংহই বা বীরেন্দ্রসিংহের কন্যাকে বিবাহ করিবে কেন?
বি। জাতিকুলের দোষ কোন পক্ষেই নাই, জয়ধরসিংহের পূর্বপুরুষেরাও যদুবংশীয়।
অ। যদুবংশীয় কন্যা মুসলমানের শ্যালকপুত্রের বধূ হইবে?
বিমলা উদাসীনের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া কহিল, “না হইবেই বা কেন, যদুবংশের কোন্ কুল ঘৃণ্য?”
এই কথা কহিবামাত্র ক্রোধে পরমহংসের চক্ষু হইতে অগ্নি স্ফুরিত হইতে লাগিল; কঠোর স্বরে কহিলেন, “পাপীয়সি! নিজ হতভাগ্য বিস্মৃত হও নাই? দূর হও!”
নবম পরিচ্ছেদ : কুলতিলক
জগৎসিংহ পিতৃচরণ হইতে সসৈন্য বিদায় হইয়া যে যে কার্য করিলেন, তাহাতে পাঠান সৈন্যমধ্যে মহাভীতি প্রচার হইল। কুমার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া তিনি কতলু খাঁর পঞ্চাশৎ সহস্রকে সুবর্ণরেখা পার করিয়া দিবেন, যদিও এ পর্যন্ত তত দূর কৃতকার্য হইবার সম্ভাবনা দেখাইতে পারেন নাই, তথাপি তিনি শিবির হইতে আসিয়া দুই সপ্তাহে যে পর্যন্ত যোদ্ধৃপতিত্ব গুণের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া মানসিংহ কহিয়াছিলেন, “বুঝি আমার কুমার হইতে রাজপুত নামের পূর্বগৌরব পুনরুদ্দীপ্ত হইবে।”
জগৎসিংহ উত্তমরূপে জানিতেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া পঞ্চাশৎ সহস্রকে সম্মুখসংগ্রামে বিমুখ করা কোন রূপেই সম্ভব নহে, বরং পরাজয় বা মৃত্যুই নিশ্চয়। অতএব সম্মুখসংগ্রামের চেষ্টায় না থাকিয়া, যাহাতে সম্মুখসংগ্রাম না হয়, এমন প্রকার রণপ্রণালী অবলম্বন করিলেন। তিনি নিজ সামান্যসংখ্যক সেনা সর্বদা অতি গোপনে লুক্কায়িত রাখিতেন, নিবিড় বনমধ্যে বা ঐ প্রদেশে সমুদ্র-তরঙ্গবৎ কোথাও নিম্ন, কোথাও উচ্চ যে সকল ভূমি আছে, তন্মধ্যে এমন স্থানে শিবির করিতেন যে, পার্শ্ববর্তী উচ্চ ভূমিখণ্ড সকলের অন্তরালে, অতি নিকট হইতেও কেহ তাঁহার সেনা দেখিতে পাইত না। এইরূপ গোপনভাবে থাকিয়া, যখন কোথাও স্বল্পসংখ্যক পাঠান সেনার সন্ধান পাইতেন, তরঙ্গপ্রপাতবৎ বেগে তদুপরি সসৈন্য পতিত হইয়া তাহা একেবারে নি:শেষ করিতেন। তাঁহার বহুসংখ্যক চর ছিল; তাহারা ফলমূলমৎস্যাদিবিক্রেতা বা ভিক্ষুক উদাসীন ব্রাহ্মণ বৈদ্যাদির বেশে নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া, পাঠান-সেনার গতিবিধির সন্ধান আনিয়া দিত। জগৎসিংহ সংবাদ পাইবামাত্র অতি সাবধানে অথচ দ্রুতগতি এমন স্থানে গিয়া সৈন্য সংস্থাপন করিতেন যে, যেন আগন্তুক পাঠান-সেনার উপরে সুকৌশলে এবং অপূর্বদৃষ্ট হইয়া আক্রমণ করিতে পারেন। যদি পাঠান-সেনা অধিকসংখ্যক হইত, তবে জগৎসিংহ তাহাদিগকে আক্রমণ করার কোন স্পষ্ট উদ্যম করিতেন না; কেন না, তিনি জানিতেন. তাঁহার বর্তমান অবস্থায় এক যুদ্ধে পরাজয় হইলে সকল নষ্ট হইবে। তখন কেবল পাঠান-সেনা চলিয়া গেলে সাবধানে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া তাহাদিগের আহারীয় দ্রব্য, অশ্ব, কামান ইত্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া আসিতেন। আর যদি পাঠান-সেনা প্রবল না হইয়া স্বল্পসংখ্যক হইত; তবে যতক্ষণে সেনা নিজ মনোমত স্থান পর্যন্ত না আসিত, সে পর্যন্ত স্থির হইয়া গোপনীয় স্থানে থাকিতেন; পরে সময় বুঝিয়া, ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় চীৎকার শব্দে ধাবমান হইয়া হতভাগ্য পাঠানদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেন। সে অবস্থায় পাঠানেরা শত্রুর নিকটস্থিতি অবগত থাকিত না; সুতরাং রণ জন্য প্রস্তুত থাকিত না। অকস্মাৎ শত্রুপ্রবাহমুখে পতিত হইয়া প্রায় বিনা যুদ্ধে প্রাণ হারাইত।
এইরূপে বহুতর পাঠান-সৈন্য নিপাত হইল। পাঠানেরা অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হইল, এবং সম্মুখসংগ্রামে জগৎসিংহের সৈন্য বিনষ্ট করিবার জন্য বিশেষ সযত্ন হইল। কিন্তু জগৎসিংহের সৈন্য কোথায় থাকে, কোন সন্ধান পাওয়া যায় না; কেবল যমদূতের ন্যায় পাঠান-সেনার মৃত্যুকালে একবার দেখা দিয়া মৃত্যুকার্য সম্পাদন করিয়া অন্তর্ধান করে। জগৎসিংহ কৌশলময়; তিনি পঞ্চ সহস্র সেনা সর্বদা একত্র রাখিতেন না, কোথায় সহস্র, কোথায় পঞ্চ শত, কোথায় দ্বিশত, কোথায় দ্বিসহস্র এইরূপে ভাগে ভাগে, যখন যথায় যেরূপ শত্রু সন্ধান পাইতেন, তখন সেইরূপ পাঠাইতেন; কার্য সম্পাদন হইলে আর তথায় রাখিতেন না। কখন কোন্খানে রাজপুত আছে, কোন্খানে নাই, পাঠানেরা কিছুই স্থির করিতে পারিত না। কতলু খাঁর নিকট প্রত্যহই সেনানাশের সংবাদ আসিত। প্রাতে, মধ্যাহ্নে, সায়াহ্নে, সকল সময়েই অমঙ্গল সংবাদ আসিত। ফলে যে কার্যেই হউক না, পাঠান-সেনার অল্প সংখ্যায় দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়া দু:সাধ্য হইল। লুঠপাট একেবারে বন্ধ হইল; সেনাসকল দুর্গমধ্যে আশ্রয় লইল; অধিকন্তু আহার আহরণ করা সুকঠিন হইয়া উঠিল। শত্রুপীড়িত প্রদেশ এইরূপ সুশাসিত হওয়ার সংবাদ পাইয়া মহারাজ মানসিংহ পুত্রকে এই পত্র লিখিলেন,-
“কুলতিলক! তোমা হইতে রাজ্যাধিকার পাঠানশূন্য হইবে জানিলাম; অতএব তোমার সাহায্যার্থ আর দশ সহস্র সেনা পাঠাইলাম।”
যুবরাজ প্রত্যুত্তর লিখিলেন,-
“মহারাজের যেরূপ অভিপ্রায়; আর সেনা আইসে ভাল; নচেৎ ও শ্রীচরণাশীর্বাদে এ দাস পঞ্চ সহস্রে ক্ষত্রকুলোচিত প্রতিজ্ঞাপালন করিবেক।”
কুমার বীরমদে মত্ত হইয়া অবাধে রণজয় করিতে লাগিলেন। শৈলেশ্বর! তোমার মন্দিরমধ্যে যে সুন্দরীর সরল দৃষ্টিতে এই যোদ্ধা পরাভূত হইয়াছিলেন, সে সুন্দরীকে সেনা-কোলাহল মধ্যে কি তাঁহার একবারও মনে পড়ে নাই? যদি না পড়িয়া থাকে, তবে জগৎসিংহ তোমারই ন্যায় পাষাণ।