আজ কুমার আর তার এক বন্ধু আসবেন বাড়িতে থেকে বেরিও না। তিনি একটা কাজ জোগাড় করে দিবেন বলছেন, বুঝলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে মহেন্দ্র কিযে ভাবছে। মেজদা চলে গেল।
মহেন্দ্র ভাবছে তো ভাবছেই। কি যে ভাবছে ঠিক নেই। ওদিকে এক এক করে কয়েকখানা গাড়ি ঢুকলো টেনিস লনে, কুমার ইত্যাদি বলেন, বেতের চেয়ারে। একটা চাকর এসে মহেন্দ্রকে আসতে বললো ওখানে। কাদা মাখা জামাটা খুলে রেখেছে মহেন্দ্র, অন্য একটা পরেছে, এগিয়ে নমস্কার জানালো সকলকে। কুমার ওর পানে দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করলো টাইপ শেখা হলো তোমার? আজ্ঞে হ্যাঁ এখন চোখ বুজে টাইপ করতে পারি তবে স্পিড কম–আরো দিনকতক অভ্যাস করলে ঠিক হয়ে যাবে।
এবার কাজের মাথায় অভ্যাস করবে–পরশু সোমবার আমার ওখানে যাবে দশটার সময়, সাদার্ণ পার্কে কেমন।
যে আজ্ঞে। বললো মহেন্দ। আনন্দই হচ্ছে ওর একটা কাজ এতদিন পর হোল। কিন্তু এখানেই মাধুরী চা পরিবেশন করছে অতিথিদের হঠাৎ কুমারকে সে প্রশ্ন করলো–
কাপটা কি? টাইপ না কি বাজার সরকারী।
দরকার হলে সবই করতে হবে বললো কুমার গম্ভীর স্বরে।
না ও যাবে না। আপনার জুতো বুরুশ করার মতো শিল্প জ্ঞান নেই ওর। –সে কি। মাধুরী। বুরুশ করবার কথা কি?
–এই তো বললেন সবই করতে হবে তার মধ্যে জুতো বুরুশও পড়ে।
–না না, আমি বলছি, বাড়ির ছেলের মত থাকবে যখন যা দরকার–
–আজ্ঞে না। এ ক্ষেত্র মুখুয্যেরই বাড়ির ছেলে আর কারো বাড়ির ছেলে হয়ে কাজ নেই। মহীনদা তুমি বলে দাও, আমি তোমাকে যেতে দেব না বলেই মাধুরী বাকি চারজনকে চা পরিবেশন করলো, ধীরে ধীরে, তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।
ব্যাপারটা এমন দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়ালো যে কুমার আর বললো না। মেজদা যেন গম্ভীর আর মেজবৌদির চোখে জ্বলন্ত একটা অগ্নি যেন ধিকধিক করছে কিন্তু মহেন্দ্রর অবস্থা আরো শোচনীয়। সে নিরুপায়ভাবে একখানা চেয়ারে বসে।
চল, আরম্ভ করা যাক। কুমারই বললো কথাটা। খেলোয়াড়দের এখন খেলার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে ওরা গুমোট ভাবটা কাটাতে চায়, কিন্তু খেলার একজন সঙ্গী কম হচ্ছে। অতিথি যিনি আসার কথা তিনি এখনো আসেননি।
এসো। মহীন ততক্ষণ তোমাকে নিয়েই আরম্ভ করা যাক বলে কুমার অকস্মাৎ মহীনকে হাতে ধরে টেনে দাঁড় করে দিল। মহীন এর আগে দু’একদিন খেলেছে মাধুরীর সঙ্গে কিন্তু শুধু খেলা শিখবার জন্য ওর মোটে অভ্যাস নেই। আমি। আমিতো ভাল খেলতে পারি না।
–খুব পারবে এসো। বলে তাকে টেনে নিয়ে এল, হাতে গুঁজে দিল টেনিস র্যাকেটটা। নিরুপায় মহেন্দ্র দাঁড়ালো খেলতে।
পড়ে গিয়ে ওর কোমরে ব্যথা হয়েছে, তারপর খেলার তেমন অভ্যাস নাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মহেন্দ্র কাবু হয়ে পড়লো, অবস্থাটা এমন যে অন্যান্য খেলোয়াড়রা হাসছে। কিন্তু কুমার পরম অভিজাত ব্যক্তি মহেন্দ্রর মত নগন্য ব্যক্তিকে কেন খেলার সাথী করলো। কেউ ভেবে দেখলো না।
অকস্মাৎ মাধুরীর আবির্ভাব ঘটলো, এক মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলো অবস্থাটা তারপর মহেন্দ্রের হাত থেকে র্যাকেটখানা কেড়ে নিয়ে বললো–আসুন কে কত পারেন দেখা যাক বলেই মহেন্দ্রকে বললো, যাও তুমি আমার গানের আসরটা ঠিক করগে।
অতঃপর মাধুরী খেলতে আরম্ভ করলো যেন, দশভূজা। এত ভালোখেলা ও হয়তো জীবনে খেলেনি কী এক আশ্চর্য উত্তেজনা ওকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। র্যাকেটখানায় যাদু লেগেছে যেন। মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওকে।
খেলাটা শেষ করে র্যাকেটখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আঁচলে মুখ মুছলো, বললো, দুর্বলকে জয় করতে যাওয়ার কোনো মহিমা নেই সপ্তরথী ঘিরে অভিমুন্যকে হত্যার কলঙ্ক শুধু মহা ভারতের কলঙ্ক নয় আপনাদেরও।
চলে গেল মাধুরী। কে কি বললো, জানবার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। ইতিমধ্যে সেই আহুত খোলোয়াড়টি এসে পড়েছে। তিনিও দেখছিলেন খেলা মাধুরী তাকে নমস্কার পর্যন্ত করলে না, ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু, খেলোয়াড়টি সত্যি স্পোর্টম্যান হেসে বললেন–
: চমৎকার খেলেন। উনি তো খুব ভাল খেলোয়াড় হবেন।
: ও কিছু হবে না একটা জলন্ত তল্লা, আগুন জলতে জলতে ও নিজেই পুড়ে যাবে কথাটা বললো যতীন তারপর এসে করমর্দন করলো অতিথির সঙ্গে।
: কেন একথা বলছেন? মেয়েটি কে আপনার? শুধালেন ভদ্রলোক?
আমার বোন, অনেক দুঃখেই কথাটা বলছি, মিঃ আদিলিঙ্গম। ও আমাদের ঘরের প্রদীপ। লেখায়, সঙ্গীতে, শিল্পে ওর বিচিত্র প্রতিভা বিস্ময় জাগায়। কিন্তু ঐ হোমকুণ্ডে আহুতি দেবার মত স্মৃত্বিক আমরা খুঁজে পাচ্ছিনে হয়তো ও ব্যর্থ হয়ে যাবে।
ছিঃ ছিঃ ! এরকম কথা কেন ভাবছেন নিতান্ত ছেলে মানুষ এখনো। বলে মিঃ আদিলিঙ্গম সস্নেহ দৃষ্টি একবার তাকালেন বাড়িটার পানে। যেন মাধুরীকে আর একবার দেখতে চাইছেন। মেজবৌ ব্যাপারটা বুঝে চাকরকে বললো ডাকতো ছোটদিকে।
কিন্তু ডাকতে হলো না, মাধুরী নিজেই এলো এবং সুষ্ঠু ভঙ্গীতে নমস্কার করে বললো শুরুতেই মার্জনা চাইছি; আপনার কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম।
–না না, কিছু না ওতে আর কি হয়েছে? আপনার খেলা দেখে খুশী হয়েছে আমি। আপনি ভালো খেলোয়াড় হতে পারবেন।
আপনার আশীর্বাদ মাথা পেতে নিলাম কিন্তু খেলোয়াড় হবার ইচ্ছে নেই।
কেন? মিঃ আদিলিঙ্গম সস্নেহে প্রশ্ন করলেন।
কারণ, খেলার আগ্রহ খেয়াল থেকে জন্মায় বাস্তবের রূঢ়তা ও সইতে পারে না।