তপতী বলিল—এখনও বিচ্ছেদটা কোর্ট থেকে পাকা হয়নি। তুমি তো বোকা মেয়ে, বোঝে কচু। দুলাখ টাকায় ওর পেট ভরেনি, আরো অত্যন্ত লাখ-খানেক চায়—তাই মুক্তিপত্রটা এখনও হাতে রেখে দিয়েছে।
মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন,—যাকগে খুকী—যেতে দে।
টাকাটাই ওর লক্ষ্য ছিল, মা। আমি যে ওকে নেবো না, সেকথা ওকে প্রথম দিনই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ঘর থেকে বার করে দিয়ে। লোকটা এতবেশী চালাক যে, সাত মাস ধরে অভিনয় করে তোমাদের ঠকিয়ে গেল। মাসোহারার টাকাটা তোমার কাছে জমা রেখে ও বোঝালে, কারও দান ও নেয় না,আর বোকা তোমরা দুলাখ টাকা দিয়ে দিলে—একটা হিসাব পর্যন্ত চাইলে না।
—কিন্তু অফিসের কেরানীটাকে রক্ত দেওয়া?
তপতীর একটা খটকা লাগিল। পরমুহূর্তেই তাহার তীক্ষ্মবুদ্ধি তাহাকে সাহায্য করিল, কহিল,—ও একটা মস্ত চাল! অফিসের টাকায় তাকে হাসপাতালে রেখেছে—শিখিয়ে দিয়েছে ঐ কথা বলতে, কিংবা দিয়েছে একটু রক্ত, তাতেই কি! শরীরটায় তো রক্তের তার অভাব নেই–যা খাওয়া তুমি খাওয়াতে ওকে!—তপতী আপনার কথায় আপনি হাসিয়া উঠিল।
মারও মনে হইতেছে, হয়তো ইহাই সত্য হইবে। তথাপি তিনি বললেন–না চলে গেলেও পারতো?
–না, ধরা ও পড়াতেই; তাই জেলে যাবার ভয়ে পালিয়েছে দেশ ছেড়ে বিস্তর বাংলা বই ও পড়েছে, বুঝলে মা? বাংলা কথা কইলে ওকে কিছুতেই ধরা যায় না।
মা সত্যই আজ বিভ্রান্ত হইয়া উঠিলেন। তপন কি তাঁহাদের এমনি ভাবে সত্যই ঠকাইয়াছে।
তপতী আহার সাবিয়া শয়নকক্ষে গেল। শয়নের বেশ পরিধান করিতে গিয়া সে আপনাকে বারবার নিরীক্ষণ করিল দর্পণে। নিটোল কপোল আবার রক্তাভ হইয়া উঠিতেছে। কটাক্ষের বিদ্যুত আবার ফিরিয়া আসিয়াছে পূর্বের মতো! মসৃণ বাহুতে তরঙ্গারিত হইতেছে দেহের দ্যুতি। রক্তরাঙা ঠোটা উল্টাইয়া তপতী আপন মনে বলিল-এই ওষ্ঠে যে প্রথম প্রেমচুম্বন আঁকিবে সে তপন নয় ..
ওঃ কি দারুণ ভুল সে করিতে বসিয়াছিল! শরীরটা তাহার ভাঙিয়া গিয়াছিল আর কি! প্রথম জীবনের প্রণয়োচ্ছাস! বোকামী আর কাহাকে বলে? সেই ভণ্ডটার জন্য জন্য প্রাণ দিতে বসিয়াছিল তপতী। গান গাহিতে গাহিতে তপতী শুইয়া পড়িল-হোয়েন দাই বিলাভেড় কামস…
অভিনয়ের দিন আর-একবার মিঃ রায় অনুরোধ করিলেন শেষ দৃশ্যটা জুড়িয়া দেবার জন্য। কিন্তু তপতী দৃঢ়স্বরে কহিল,না। তাহলে আমি অভিনয় করবো না—বিয়ের বন্ধন আমি সইতে পারিনে।
সকলেই আশ্চৰ্য্যন্বিত হইয়া কহিলেন,—অর্থাৎ! বিয়ে আপনি করবেন না নাকি?
কলহাস্যে সকলকে চমকাইয়া দিয়া তপতী কহিল,—বিয়ের চেয়ে বড় কিছু আমি করতে চাই।
মিঃ রায় কহিলেন,—আইডিয়াটা চমৎকার, কিন্তু কী সেটা?
—যিনি আমার বিয়ে করবেন, তিনিই সেটা আমায় বলবেন… মিঃ রায় ব্যাকুল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, তা কি হইতে পারে? বিবাহের চেয়ে বড় তো প্রেম! কহিলেন,—প্রেম!
—আমি পাদরী নই যে যিশুকে প্রেম নিবেদন করব।
সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিঃ রায় আরো খানিক ভাবিয়া বলিলেন,–বুঝেছি। আপনার ইচ্ছে কম্প্যানিয়েট ম্যারেজ।
হো হো করিয়া হাসিয়া তপতী কহিল,—আপনার বুদ্ধিতে কুলোবে না, মিঃ রায়, চুপ করুন।
চারদিক অন্ধকার দেখিয়া মিঃ রায় থামিয়া গেলেন।
তপতী কহিল, আমিই বলে দিচ্ছি, শুনুন। বিবাহের চেয়ে বড় হচ্ছে অবিবাহিত ছেলেদের মাথাগুলো চিবিয়ে খাওয়া!
হাসিয়া কল্যাণী কহিল,–ওটা বুঝি এখন আস্বাদন করছিস?
-চুপ কর, লক্ষ্মীছাড়ি! ওর মাথায় গোবরের গন্ধ!
সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিঃ রায়ও হাসিলেন। কিন্তু তপতীকে তাহার অত্যন্ত দুর্বোধ বোধ হইতেছে। উহার মনের ইচ্ছাটা কী?
অভিনয় হইয়া গেলে তিনি খানিকটা পথ তপতীর সহিত আসিতে আসিতে কহিলেন,—বিয়ে কি আপনি সত্য করবেন না মিস্ চ্যাটার্জী?
—আমার বাবার ঠিক করা আছে একটি ছেলে। তাকে যদি বিয়ে না করি তোল, আপনার কথাটা তখন ভেবে দেখব।
মিঃ রায় কথা শুনিয়া দমিয়া গেলেন। আরো কিছুটা আসিয়া তিনি বিদায় লইলেন।
তপতী হাসিয়া উঠিল আপন মনে। এক ঢিলে দুই পাখী সে মারিয়াছে। কৌশলে সে মিঃ রায়কে জানাইয়া দিলো, বিবাহিতা না হইলেও, স্বামী তাহার ঠিক করা আছে—তপনে কথাটা প্রকাশ পাইলেও আর বেশী ভয়ের কারণ থাকিবেনা; দ্বিতীয়ত, মিঃ রায়ের অন্তরে তপতী আরো গভীর ভাবে আসন গড়িবে কিংবা মিঃ রায় তাহাকে ভুলিতে চাহিবেন।তপতী পরীক্ষা করিয়া লইতে চায়। আর সে ঠকিবেনা। অবশ্য মিঃ রায়কে বিবাহ করিতে তপতীর কিছুমাত্র আপত্তি হইতে পারে না; তথাপি মিঃ রায়ের দিকটাও সে ভালো করিয়া জানিয়া লইতে চায়! কারণ এ বিবাহ অন্তরের নয় বাহিরের।
পরদিন সকালে আসিল একখানি চিঠি—মার নামে–
বিজয়ার সংখ্যাতীত প্রণামান্তে, নিবেদন, মা, আপনাদের অপরিশোধ্য স্নেহঋণের বিনিময়ে কিছুই আমি দিতে পারিনি। অভাগা ছেলেকে মার্জনা করিবেন।
ইতি–প্রণতঃ তপন
মা চিঠিখানার দিকে চাহিয়াই রহিলেন। কলকাতার একটা ঠিকানা রহিয়াছে! ঐখানে হয়তো আছে সে। উঠিয়া তিনি স্বামীকে গিয়া কহিলেন—আসতে টেলিগ্রাম করে দাও, খুকীর সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া হয়ে যাক। আর, মুক্তিনামাও তো লিখিয়ে নেওয়া চাই একটা?
মিঃ চ্যাটার্জী খানিক ভাবিয়া বলিলেন—খুকীকে জিজ্ঞাসা করেছো? কী বলে সে?
–না, ওকে জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। টেলি করে দাও এক্ষুনি প্রি-পেড।
তৎক্ষণাৎ টেলিগ্রাম করা হইল। উত্তরে তপন জানাইল যে সে ত্রয়োদশীর দিন শিলং আসিবে, কিন্তু উঠিবে হোটেলে।